You dont have javascript enabled! Please enable it!

মুক্তিযুদ্ধে চন্দনাইশ উপজেলা (চট্টগ্রাম)

চন্দনাইশ উপজেলা (চট্টগ্রাম) মুক্তিযুদ্ধের সময় পটিয়া থানার অধীনে ছিল। ১৯৭০ সালের এপ্রিল মাসের শেষ সপ্তাহে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান – নির্বাচনী প্রচারে এখানে আসেন। তখন চন্দনাইশের সর্বজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি আব্দুল মজিদ চৌধুরীর সভাপতিত্বে গাছবাড়িয়া উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে এক জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় দেয়া বঙ্গবন্ধুর ভাষণ পাকিস্তানি শাসন-শোষণ ও শৃঙ্খল থেকে মুক্তির লক্ষ্যে এলাকার জনগণকে দারুণভাবে উদ্বুদ্ধ করে। তারা নির্বাচনে একযোগে আওয়ামী লীগকে ভোট দেয়। ফলে পটিয়া (বর্তমান পটিয়া, কর্ণফুলী ও চন্দনাইশ) থেকে আওয়ামী লীগ প্রার্থী অধ্যাপক নুরুল ইসলাম চৌধুরী এমএনএ এবং পটিয়ার একাংশ (বর্তমান চন্দনাইশ) ও সাতকানিয়ার একাংশ থেকে ডা. বি এম ফয়জুর রহমান এমপিএ নির্বাচিত হন। সারা দেশে আওয়ামী লীগ বিপুল ভোটে জয়লাভ করে। কিন্তু পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী নির্বাচনের রায় বানচাল করে বাঙালিদের দমন ও চিরকালের জন্য পদানত করে রাখার ষড়যন্ত্র শুরু করে। এর বিরুদ্ধে ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে বঙ্গবন্ধু আহূত দেশব্যাপী অসহযোগ আন্দোলন-এ চন্দনাইশের জনগণও ঝাঁপিয়ে পড়ে।
৭ই মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে প্রদত্ত বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের পর চট্টগ্রাম দক্ষিণ মহকুমা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এ কে এম আবদুল মান্নানের নেতৃত্বে গাছবাড়িয়া উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে দক্ষিণ পটিয়া (বর্তমান চন্দনাইশ) আঞ্চলিক সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। পরিষদের সভাপতি ছিলেন আওয়ামী লীগ নেতা এডভোকেট মুস্তাফিজুর রহমান চৌধুরী (বৈলতলী), সহ-সভাপতি চৌধুরী সিরাজুল ইসলাম খালেদ (ফতেনগর), রাখাল চন্দ্র সরকার (জোয়ারা), মোখলেসুর রহমান চৌধুরী (বৈলতলী) ও ওবাইদুল হাকিম (সাতবাড়িয়া), সাধারণ সম্পাদক হারুন আল জাফর চৌধুরী (উত্তর হাশিমপুর), যুগ্ম সম্পাদক ডা. মোহাম্মদ সিরাজ (বরমা) ও খায়ের আহমদ সওদাগর (পশ্চিম এলাহাবাদ) এবং কোষাধ্যক্ষ নুরুল আনোয়ার চৌধুরী (হাশিমপুর)। সদস্য ছিলেন— মীর আহমেদ চৌধুরী, (পূর্ব চন্দনাইশ), মোজাফফর আহমদ (পূর্বজোয়ারা), মোহাম্মদ ইউছুফ চৌধুরী (পাঠানদণ্ডি), ফয়েজ আহামদ (পশ্চিম কেশুয়া), আলতাপর রহমান (বরমা), মুন্সেফ আলী মাস্টার (কাঞ্চননগর), ধীরেন্দ্রলাল দাশ (কাঞ্চননগর), আবুল বশর (উত্তর হাশিমপুর), আবদুল মোবিন ওরফে বাচা (চন্দনাইশ), এডভোকেট হিমাংশু বিমল ঘোষ (দক্ষিণ হাশিমপুর), মোহাম্মদ ইছহাক মিয়া ফকির (দোহাজারী), সামশুল ইসলাম (চাগাচর), আবুল কালাম আজাদ চৌধুরী (দক্ষিণ হাশিমপুর), আবদুল মোতালেব (মোহাম্মদপুর), তুষিত বড়ুয়া (সাতবাড়িয়া), হাজি আবদুল গফফার (বরকল), ওকপাই কেয়াং (ধোপাছড়ি), মং চিং থা (ধোপাছড়ি), আবদুল গফফার চৌধুরী (গাছবাড়িয়া), ছালেহ আহমদ কন্ট্রাক্টর (গাছবাড়িয়া) মোহাম্মদ ইউছুপ (গাছবাড়িয়া), আবদুল মজিদ (বৈলতলী), নুরুল ইসলাম চৌধুরী (গাছবাড়িয়া), ফোরক আহমদ মুন্সি (মধ্যম চন্দনাইশ), ডা. সমসুদ্দিন আহমদ (রৌশনহাট), সিরাজুল ইসলাম রহমানী (হারলা), ডা. আহমদ কবির চৌধুরী (পূর্ব চন্দনাইশ), প্রফুল্ল রঞ্জন বড়ুয়া (জামিজুরী) প্রমুখ। ইউনিয়ন পর্যায়েও সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। হারলা ইউনিয়ন (বর্তমান চন্দনাইশ পৌরসভার অন্তর্গত) সংগ্রাম পরিষদে সিরাজুল ইসলাম রহমানী, আহমদ হোসেন, মীর আহমদ চৌধুরী, আকবর আলী (হাজিপাড়া) ও ফোরক আহমদ চৌধুরী এবং দোহাজারী ইউনিয়ন সংগ্রাম পরিষদে বজলুর রহমান, ইছহাক মিয়া ফকির, সিরাজ মিয়া ড্রাইভার, বাদল মল্লিক ও প্রফুল্ল রঞ্জন বড়ুয়া নেতৃত্বে ছিলেন। দোহাজারীর ছাত্রলীগ নেতা আবু তাহের খান খসরুর নেতৃত্বে ৭ই মার্চের পূর্বে দোহাজারী গণমুক্তি বাহিনী এবং পরে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। গণমুক্তি বাহিনীর সদস্যরা আনসার কমান্ডার শামসুল আলম মাস্টারের নিকট তখন থেকে মায়ারাম দিঘির পাড়ে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিতে থাকে।
২৩শে মার্চ পাকিস্তান দিবসে চন্দনাইশের সর্বত্র স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করা হয়। গাছবাড়িয়ার খানহাটে সংগ্রাম পরিষদ অফিসে আওয়ামী লীগ নেতা এডভোকেট মুস্তাফিজুর রহমান চৌধুরী ও হারুন আল জাফর চৌধুরী স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করেন। ২৬শে মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার পর চন্দনাইশের ছাত্র-যুবকরা সংগ্রাম পরিষদের নির্দেশে চাকরি থেকে পালিয়ে আসা ও অবসরপ্রাপ্ত ইবিআর, ইপিআর, পুলিশ ও আনসার বাহিনীর সদস্যদের নেতৃত্বে গাছবাড়িয়া উচ্চ বিদ্যালয় মাঠ, হারলা নয়াহাট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠ ও বরকল এস জেড উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ শুরু করে। প্রশিক্ষণ দেন অবসরপ্রাপ্ত ইবিআর হাবিলদার ওমর মিয়া (হাশিমপুর), অবসরপ্রাপ্ত নায়েক আবদুল গনী (গাছবাড়িয়া), হাবিলদার আবদুল মালেক, ইবিআর হাবিলদার আমির হামজা, সেনাসদস্য বেদার বকসু প্রমুখ। এসব ইবিআর, ইপিআর ও পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের কাছে যেসব অস্ত্র ছিল, সেগুলো প্রশিক্ষণের কাজে ব্যবহৃত হয়। এর পাশাপাশি সংগ্রাম পরিষদ, স্থানীয় আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, ন্যাপ-, কমিউনিস্ট পার্টি—, ছাত্র ইউনিয়ন – ও কৃষক সমিতির নেতৃবৃন্দও অস্ত্র সংগ্রহ করেন।
চন্দনাইশ উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকের দায়িত্ব পালন করেন শাহজাহান ইসলামাবাদী, আওয়ামী লীগ নেতা ডা. বি এম ফয়জুর রহমান এমপিএ, মুরিদুল আলম, ফরিদুল আলম, এডভোকেট মুস্তাফিজুর রহমান চৌধুরী, মোখলেসুর রহমান চৌধুরী, সিরাজুল ইসলাম রহমানী, মুন্সেফ আলী মাস্টার, এ কে এম আবদুল মন্নান, কাঞ্চননগরের ইঞ্জিনিয়ার আফসার উদ্দিন আহমদ, সাতবাড়িয়ার ওয়াহেদ মাস্টার, জালাল উদ্দিন, বৈলতলীর এডভোকেট ফয়েজুর রহমান, হারলার আহমদ হোসেন, ফোরক আহমদ চৌধুরী, মোহাম্মদ ইউছুপ, আবদুল মোবিন, আকবর আলী, গাছবাড়িয়ার ছালেহ আহমদ কন্ট্রাক্টর, জালাল আহমদ, দক্ষিণ হাশিমপুরের এডভোকেট আবুল কালাম আজাদ, উত্তর হাশিমপুরের হারুন আল জাফর চৌধুরী, দোহাজারীর বজলুর রহমান, ইছহাক মিয়া ফকির, সিরাজ মিয়া ড্রাইভার, প্রফুল্ল রঞ্জন বড়ুয়া, বাদল মল্লিক, আলী আহম সওদাগর, আবদুল করিম লেদু, মিয়া হোসেন, নসরত আলী, চুন্নু মিয়া খান, হাবিবুর রহমান খান, ছৈয়দ মেম্বার, আনসার আলী, জেবর মুলুক, জামালুর রহমান খান, ছাত্রলীগ নেতা জোয়ারার মোহাম্মদ কাসেম, চৌধুরী সিরাজুল ইসলাম খালেদ, দোহাজারীর আবু তাহের খান খসরু, রফিক আহমদ, আবদুল খালেক জগলু, গাছবাড়িয়ার আবদুল গফুর চৌধুরী, পূর্ব চন্দনাইশের মোজাহেরুল হক চৌধুরী, ধোপাছড়ির আবদুর রশিদ, ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টির মীর আহমদ চৌধুরী (পূর্ব চন্দনাইশ), উত্তর হাশিমপুরের কৃষকনেতা মনির আহমদ, দক্ষিণ হাশিমপুরের কমরেড মোহাম্মদ মুসা, আবদুল মান্নান আনসারি, আবদুল নবী, ছাত্র ইউনিয়ন নেতা উত্তর হাশিমপুরের আবদুল হামিদ, দোহাজারীর এডভোকেট সুব্রত চৌধুরী, মনোজ সিংহ হাজারী, দীপক পাল, রশিদ আহমদ, মাহফুজুর রহমান প্রমুখ।
কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন হাবিলদার আবু মো. ইসলাম (এফএফ – ৫ এ গ্রুপ), শাহজাহান ইসলামাবাদী (শাহজাহান ইসলামাবাদী গ্রুপ), আবদুস সবুর খান (আবদুস সবুর খান গ্রুপ), এম এ মজিদ (এম এ মজিদ গ্রুপ), নুরুল ইসলাম (নুরুল ইসলাম গ্রুপ, বরকল), মাহবুবুর রহমান (এফএফ ১৫৫ গ্রুপ), জাকের আহমদ চৌধুরী (এফএফ ১৪৭ গ্রুপ), হাবিলদার সুজায়েত আলী (ইপিআর ৩০১৩) (হাবিলদার সুজায়েত আলী গ্রুপ), হাবিলদার আসহাব মিয়া (ইপিআর ৩৭৫৪) (হাবিলদার আসহাব মিয়া গ্রুপ)। মীর আহমদ চৌধুরী (এফএফ ৫ বি গ্রুপ), সামশুল আলম (এফএফ ১১২), এম এ গফুর (এফএফ ১১৭ গ্রুপ), আবদুল জলিল বকসু (এফএফ ১৫৩ গ্রুপ, দোহাজারী ব্রিজ সংলগ্ন কাটগড়), আবু তাহের খান খসরু (এফএফ ১৫৪ গ্রুপ) ও রশিদ আহমদ (রশিদ আহমদ গ্রুপ) এবং ডেপুটি কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন আবুল বশর (উত্তর হাশিমপুর), ল্যান্স নায়েক আবুল কালাম আজাদ, শ্যামাচরণ নাথ ও আবুল হোসেন। বাহিনী প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করে ফ্লাইট সার্জেন্ট মহিউল আলম ও সুলতান আহমদ কুসুমপুরী এমপিএ।
পাকবাহিনীকে প্রতিরোধ করার জন্য ২৬শে মার্চ সকালে চন্দনাইশের শতশত লোক লোহার রড, লাঠি, বল্লম প্রভৃতি দেশীয় অস্ত্র নিয়ে আরাকান সড়কে জমায়েত হয়। দোহাজারীতে বিওসি মোড় ও গাছবাড়িয়ার খানহাটে ব্যারিকেড দেয়া হয়। কালুরঘাটে বাঙালি সৈন্যরা অবস্থান নেন। এর নেতৃত্বদানকারীদের একজন ছিলেন অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ক্যাপ্টেন (পরে কর্নেল) অলি আহমদ (চন্দনাইশ)। সৈন্যদের মধ্যে মোস্তফা কামাল (চন্দনাইশ), আবুল বশর (উত্তর হাশিমপুর) ২২ বোরের একটি রিভলবার ও একটি থ্রি-নট-থ্রি রাইফেলসহ ২৬শে মার্চ চট্টগ্রাম শহর থেকে এসে যোগ দেন। ৩রা এপ্রিলের পরে আসেন সিরাজুল ইসলাম (চন্দনাইশ) ও মাহমুদুল হক (গাছবাড়িয়া)। এঁদের জন্য দক্ষিণ পটিয়া (বর্তমান চন্দনাইশ) আঞ্চলিক সংগাম পরিষদ ও ইউনিয়ন সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে আবুল বশর (উত্তর হাশিমপুর), আবদুল গফুর (দক্ষিণ কাঞ্চননগর), আবদুর রউফ (উত্তর হাশিমপুর), টুনু মিয়া (দক্ষিণ গাছবাড়িয়া), বজলুর রহমান (দোহাজারী), সিরাজুল ইসলাম রহমানী (হারলা), গণমুক্তি বাহিনীর পক্ষ থেকে আবু তাহের খান খসরু (দোহাজারী) প্রমুখ খাদ্য ও রসদ পৌঁছানোর কাজে সম্পৃক্ত ছিলেন।
এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে আবু সালেহ এমএনএ (সাতকানিয়া), আক্তারুজ্জামান চৌধুরী বাবু এমপিএ (আনোয়ারা), এম ইদ্রিছ বিকম, বিশ্বেশ্বর গুপ্ত, ছালেহ আহমদ চেয়ারম্যান, মাস্টার আবুল হাশেম, ইপিআর সদস্য আবদুল নবী (বারখাইন)সহ অনেক আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ নেতা-কর্মী চন্দনাইশের ধোপাছড়ি থেকে পার্বত্য পথে ভারতের দেমাগ্রির উদ্দেশ্যে রওনা দেন। পথিমধ্যে পাকবাহিনীর সহযোগী <মিজোবাহিনীর সঙ্গে তাঁদের সংঘর্ষ হয় এবং তাতে ইপিআর সদস্য আবদুল নবী শহীদ হন। ১১ই এপ্রিল কালুরঘাট পতনের দিন পাকসেনাদের ছোড়া গোলায় কোম্পানি কমান্ডার ক্যাপ্টেন হারুন আহমদ চৌধুরী কালুরঘাটের পশ্চিম তীরে গুরুতর আহত হন।
পাকবাহিনী চন্দনাইশে প্রথম প্রবেশ করে ১৭ই এপ্রিল। তারপর ২২শে এপ্রিল তারা দোহাজারী সিএন্ডবি অফিসে ক্যাম্প স্থাপন করে।
চন্দনাইশে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিদের মধ্যে দক্ষিণ চট্টগ্রামের কনভেনশন মুসলিম লীগ-এর আহ্বায়ক এডভোকেট আহমেদুর রহমান চৌধুরী (পিতা অছিয়র রহমান চৌধুরী, হাজিপাড়া), এ দলের অন্যতম নেতা আমজাদ হোসেন (সাতবাড়িয়া), পিডিপির দক্ষিণ চট্টগ্রামের সভাপতি খায়ের আহমদ চৌধুরী (পিতা রহমত আলী, পূর্ব চৌধুরীপাড়া; চন্দনাইশ তথা পটিয়া থানা শান্তি কমিটির আহ্বায়ক), প্রফেসর খায়েরুল বশর (বরকল; চট্টগ্রাম শান্তি কমিটির সদস্য), হামিদুল কবির চৌধুরী ওরফে খোকা (পিতা ফউজুল কবির চৌধুরী, সওদাগর বাড়ি; চট্টগ্রাম আলশামস বাহিনীর প্রধান), জাফরুল্লা (হাজিপাড়া), হাজি নুরুল ইসলাম (হাজিপাড়া), মোস্তাফিজুর রহমান ওরফে মুন্সিয়া (হাজিপাড়া), খলিলুর রহমান (হাজিপাড়া), আবদুস শুক্কুর ওরফে শুক্কুইয্যা (বুচিক্কা) (চন্দনাইশ), আবদুল আলিম (জোয়ারা, মোহাম্মদপুর), জলু মিয়া (জোয়ারা, মোহাম্মদপুর), আজিজুর রহমান (বৈলতলী), আহমদ সৈয়দ (বৈলতলী), বাদশা (বৈলতলী), নুরুল হক (বৈলতলী), আহমদুর রহমান (দোহাজারী), আমিন শরীফ (পূর্ব দোহাজারী), জামালউদ্দিন মেম্বার (ধোপাছড়ি), নজু মিয়া (ধোপাছড়ি), মোনাফ কোম্পানি (দোহাজারী ব্রিজ সংলগ্ন কাটগড়), এডভোকেট সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী (গাছবাড়িয়া), তাজর মুলুক ওরফে মেজর তাজু (দোহাজারী), আমানত খাঁ (পূর্ব হাছনদণ্ডি), মাওলানা ইছহাক (হারলা, নয়াহাট), আহমদ হোসেন ওরফে ছিয়া হোসেন (হাজিপাড়া), উমর আলী (নগরপাড়া), ফউজুল কবির চৌধুরী (পূর্বজোয়ারা), মাহফুজুল কবির চৌধুরী কাঞ্চন (পূর্বজোয়ারা), মাহবুবুল কবির চৌধুরী (পূর্বজোয়ারা), মোখতার আহমদ চৌধুরী, শাহ আলম মোক্তার, নুর মোহাম্মদ (পূর্ব চন্দনাইশ চৌধুরীপাড়া), মোজাফ্ফর আহমদ (সাতবাড়িয়া), আবু ছাহাত চৌধুরী (কাঞ্চননগর), মমতাজ (হাজিপাড়া), আহমদ শফি ওরফে চেইঙ্গা ফইর (দোহাজারী), আমজু মলই (দোহাজারী-চাগাচর), এ এস এরশাদ হোসেন (চট্টগ্রাম সদর দক্ষিণ মহকুমার আলবদর কমান্ডার), বাচা মলই (দোহাজারী), হাবিবুর রহমান (হাজিপাড়া), নবী আহমেদ (হাজিপাড়া), সাবের আহমদ (হাজিপাড়া), দানু মিয়া (হাজিপাড়া), নজরুল ইসলাম ওরফে নজু মিয়া (হাজিপাড়া), আবদুল আজিজ চৌকিদার (হাজিপাড়া), আবু তাহের চৌধুরী ওরফে দুদু মিয়া (পূর্ব জোয়ারা), আইয়ুব আলী (পূর্ব জোয়ারা), মোহাম্মদ জকরিয়া দুলু (পূর্ব জোয়ারা) প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য।
চন্দনাইশে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী রাজনৈতিক দল মুসলিম লীগ, নেজামে ইসলামী ও জামায়াতে ইসলামী সক্রিয় ছিল। এসব দলের নেতৃত্বে শান্তি কমিটি, রাজাকার, আলবদর, আলশামস ও মুজাহিদ বাহিনী গঠিত হয়। পূর্ব চন্দনাইশ চৌধুরীপাড়ার খায়ের আহমদ চৌধুরী (পিতা রহমত আলী)-কে আহ্বায়ক করে গঠিত হয় পটিয়া থানা শান্তি কমিটি। চন্দনাইশ থেকে এর সদস্য ছিল- হাজিপাড়ার হাজি নুরুল ইসলাম, আবদুস সালাম, মোস্তাফিজুর রহমান ওরফে মুন্সিয়া, আবদুল করিম (ভেট্টা সওদাগর), চন্দনাইশ সদরের নাসির উদ্দিন, মোহাম্মদ সিদ্দিক, মাওলানা আবদুস সবুর, মধ্যম চন্দনাইশের মাওলানা শফিউর রহমান, মাওলানা আলাউদ্দিন, মাওলানা বোরহান উদ্দিন, আবুল খায়ের চৌধুরী, নুরুল ইসলাম, পূর্ব চন্দনাইশের সালেহ আহমদ ভেন্ডার, পূর্বজোয়ারার ফউজুল কবির চৌধুরী, মাহফুজুল কবির চৌধুরী কাঞ্চন, ফউজুল আজিম ওরফে বোচইন্যা, হারলার মাওলানা ইছহাক, মোহাম্মদপুরের আবদুল আলিম, জলু মিয়া, কাঞ্চননগরের আবু ছাহাত চৌধুরী, বৈলতলীর আজিজুর রহমান, সাতবাড়িয়ার আমজাদ হোসেন, আবদুশ শুক্কুর, হাশিমপুরের ইদ্রিস চৌকিদার, আনু চৌকিদার, দোহাজারীর আহমদুর রহমান, ধোপাছড়ির নজু মিয়া, জামাল মেম্বার, মীর আবুল বশর মাস্টার, বরকলের এডভোকেট রশিদ আহমদ, হারলার ডা. নুর আহমদ, পূর্ব চন্দনাইশের ইসলাম মিয়া চৌধুরী, হাজি বশরত আলী, সিদ্দিক আহমদ চৌধুরী প্রমুখ। প্রত্যেক ইউনিয়নে এর শাখা কমিটি গঠিত হয়। শান্তি কমিটির তত্ত্বাবধানে বৈলতলী ইউনিয়নের নুরুল হক (পিতা আজিজুর রহমান)-কে কমান্ডার করে রাজাকার বাহিনী গঠন করা হয়। থানা হেডকোয়ার্টার্সে দুই শতাধিক এবং প্রত্যেক ইউনিয়নে শান্তি কমিটির আহ্বায়কের অধীনে ১০ জন করে রাজাকার নিযুক্ত হয়। রাজাকার বাহিনী সাব-মার্শাল ল এডমিনিস্ট্রেটর (চিটাগাং সেক্টর)-এর অধীনে কাজ করত। নুরুল হক রাজাকার বাহিনীর কমান্ডার হলেও তার পক্ষ থেকে সবচেয়ে বেশি অপরাধ-কর্মে লিপ্ত ছিল তার দুই ভাই আহমদ সৈয়দ ও বাদশা। এছাড়া চন্দনাইশের কতিপয় রাজাকাররা হলেন— আবদুল মজিদ (দোহাজারী) আবুল কাশেম (দোহাজারী), আবদুল সালাম (দাহাজারী), ওমর আলী (দাহাজারী), মোহাম্মদ মুসা (মোহাম্মদপুর), নুরুল আলম (হারলা), আবদুল মান্নান (জাফরাবাদ), আবদুল খালেক (বশরত নগর), আলী আহাম্মেদ (চাগাচর), জাহিদ হোসেন (বশরত নগর), আহাম্মেদ শফি (দোহাজারী), হোসেন মোহাম্মদ (বশরত নগর), সাহেলী মিয়া (চাগাচর), রাজু মিয়া (জাফরাবাদ), আবদুল মালেক (জাফরাবাদ), ইসকান্দার (বশরত নগর), ফয়েজ আহাম্মদ (চাগাচর), মো. খুইল্যা মিয়া (চন্দনাইশ), আবদুস সাত্তার (মোহাম্মদপুর), মোখলেসুর রহমান (উত্তর জোয়ারা), খায়ের আহাম্মেদ (বশরত নগর), রশিদ আহাম্মেদ (মোহাম্মদপুর), মতিয়ার রহমান (বশরত নগর), সামছুল ইসলাম (বশরত নগর), মোহাম্মদ হোসেন (চাগাচর), আবুল বাশার (বৈলতলী), গোরা মিয়া (দোহাজারী), নুরুল আলম (বশরত নগর), শামসুল আলম (চাগাচর), মোহাম্মদ আইয়ুব (মুরাদাবাদ), ইয়াকুব আলী (দোহাজারী), সালিলিউর আহাম্মেদ (মুরাদাবাদ), শফিকুর রহমান (জামিজুরী), কবির আহাম্মেদ (দোহাজারী), আবদুস সফুর (দোহাজারী), মো. আহাম্মেদ (মুরাদাবাদ), ওমর আলী (উত্তর জোয়ারা), সিরাজুল মোস্তফা (মোহাম্মদপুর), ইসলাম খান (দোহাজারী)।
জামায়াতে ইসলামীর ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘ-এর মাধ্যমে আলবদর ও আলশামস বাহিনী গঠিত হয়। আবুল কালাম (মনসা, পটিয়া) আলবদর এবং মোজাফ্ফর আহমদ (সাতবাড়িয়া, চন্দনাইশ) আলশামস বাহিনীর থানা কমান্ডার নিযুক্ত হয়। মুজাহিদ বাহিনীর থানা কমান্ডার ছিল নুর মোহাম্মদ (পূর্ব চন্দনাইশ)। এসব সংগঠনের সদস্যরা মুক্তিবাহিনীর খবরাখবর সংগ্রহ করে পাকবাহিনীকে দিত এবং গণহত্যা ও নারীনির্যাতনে পাকবাহিনীকে সহায়তা করত। লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ ও হিন্দুদের ধর্মান্তরকরণেও এসব সংগঠন লিপ্ত ছিল।
২৬শে মার্চের পর থেকে ১২ই এপ্রিল পর্যন্ত পূর্বজোয়ারা, হাজিপাড়া (চন্দনাইশ) ও মধ্য চন্দনাইশের রাজাকাররা হাজি নুরুল ইসলামের নেতৃত্বে দফায় দফায় জোয়ারার হিন্দু বাড়িগুলোতে লুটপাট চালায়। ১২ই এপ্রিল মন্দির, প্রাচীন প্রতিষ্ঠান দামোদর ঔষধালয়, কমলা ঔষধালয় ও পাগলা গারদ লুট করে। এছাড়া অনেক বাড়িতে অগ্নিসংযোগ ও নারীধর্ষণ করা হয়। ২৪শে এপ্রিল দোহাজারীর যুগিপাড়ায় অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। এতে প্রায় দেড়শ ঘরবাড়ি পুড়ে যায়। এর আগে বাড়িগুলো লুট করা হয়। অনেক নারীকে ধর্ষণ করা হয় এবং পুকুরে জাল ফেলে মাছ ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। সেদিনের ঘটনায় জড়িত দালালদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য আহমদ শফি ওরফে চেইয়া কইর (দোহাজারী), তাজর মুলুক ওরফে মেজর তাজু (দোহাজারী), আমানত খাঁ (সাতবাড়িয়াস্থ পূর্ব হাছনদণ্ডি), জানু মিয়া (পূর্ব হাছনদণ্ডি), আহমেদ শফি (পূর্ব হাছনদণ্ডি), নুর মোহাম্মদ (দেওয়ান হাট), সিরাজ মিয়া (পূর্ব হাছনদণ্ডি), ছুরুত আলী (পূর্ব হাছনদণ্ডি), সরু মিয়া (পূর্ব হাছনদণ্ডি) প্রমুখ। সেদিন দোহাজারীর কয়েকটি স্থানে ৪ জন নিরীহ লোককে হত্যাও করা হয়। পরবর্তীতে এপ্রিলের ২৮ তারিখ দোহাজারী সদরে আওয়ামী লীগ নেতা বজলুর রহমানের বাড়িটিও পুড়িয়ে দেয়া হয়। একই দিন দোহাজারীর জামিজুরীতে পাকবাহিনী ১৩ জন নিরীহ মানুষকে গুলি করে হত্যা করে, যা জামিজুরী গণহত্যা নামে পরিচিত। এদিন পাকবাহিনীর দোসররা এখানকার ৪৫০টি ঘর লুট করে এবং ৪৪৯টিতে আগুন দেয়। পাকবাহিনী কর্তৃক নারীধর্ষণের ঘটনাও ঘটে। ৩০শে এপ্রিল দক্ষিণ গাছবাড়িয়ার পালপাড়ায় পাকবাহিনী ১৫ জনকে গুলি করে হত্যা করে, যা পালপাড়া গণহত্যা- নামে পরিচিত। রাজাকাররা এখানে ৮৬টি ঘর লুট করার পর পুড়িয়ে দেয়। এখানেও পাকবাহিনী কর্তৃক নারীধর্ষণের ঘটনা ঘটে। পাকবাহিনী আলো রাণী পালকে ধর্ষণ করতে অগ্রসর হলে তিনি কোলে থাকা ৩ মাসের শিশুপুত্রকে শাশুড়ির দিকে ছুড়ে দিয়ে আগুনে ঝাঁপিয়ে পড়ে আত্মাহুতি দেন। এ সময় দোহাজারীর শফিকুর রহমানের বাড়ি ও পদ্মপুকুরপাড়ায় অগ্নিসংযোগ করা হয়।
মে মাসের প্রথম সপ্তাহে হাজিপাড়া (চন্দনাইশ) ও মধ্য চন্দনাইশের ২০-২৫ জন রাজাকার পাকবাহিনীকে নিয়ে পশ্চিম হারলার হিন্দুবাড়িগুলোতে লুটপাট চালায় এবং আগুন দেয়। হারলায় যাওয়ার পথে মধ্য চন্দনাইশে রাজাকারদের হাতে বন্দি পূর্ণেন্দু চৌধুরীকে পাকবাহিনী গুলি করে হত্যা করে। পশ্চিম হারলা থেকে উত্তর জোয়ারায় যাওয়ার পথে চানমাঝিপাড়ায় রাজাকাররা ডাক্তার প্রাণহরি শীলকে হত্যা করে। একই সময় হারলার যোগিপাড়া ও শীলপাড়া এবং সাতবাড়িয়ার পূর্ব হাছনদণ্ডির নিরঞ্জন মহাজনের বাড়িতে লুটপাট চালায় এবং অগ্নিসংযোগ করে। সেদিন খানহাটের পশ্চিম পাশের শীলবাড়িটিও লুট করে পুড়িয়ে দেয়। জুলাই মাসে রাজাকার তাজর মুল্লুক ওরফে মেজর তাজুর দল উত্তর হাশিমপুরের বারৈপাড়ার জগদ্বন্ধু দে নামে এক হিন্দুকে হত্যা করে। দোহাজারীর চাগাচরস্থ নাথপাড়ায় বাড়িঘর লুট ও নারীদের ধর্ষণ করার পর গান পাউডার ছিটিয়ে অগ্নিসংযোগ করা হয়। এ ঘটনায় জড়িত দালালদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য লাল মিয়া (চাগাচর), মোহাম্মদ হোসেন (চাগাচর), অলি আহমদ (চাগাচর), ছালেহ আহমদ (চাগাচর), ছালেহ আহমদ (চাগাচর), শামসুল আলম (চাগাচর), আলী আহমেদ (চাগাচর), ফয়েজ আহমদ (চাগাচর), আবদুস সালাম (চাগাচর), জাহেদুল ইসলাম (চাগাচর), সাহেলী মিয়া (চাগাচর) প্রমুখ। মে মাসের ৬ তারিখ আমজু মলই (মৌলবি)-সহ এই দালালরা উক্ত নাথপাড়ার হরিশচন্দ্র নাথকে ধরে দোহাজারী ব্রিজের পূর্বদিকে শঙ্খ নদীর উত্তর পাড়সংলগ্ন পটিয়া ন্যাশনাল সল্ট মিল (বর্তমান সৈকত মিল)-এর সামনের মাঠের পানি নিষ্কাশন নালায় এনে হত্যা করে। সেদিন তার সঙ্গে সাতকানিয়ার মির্জারখাল গ্রামের একজনকেও হত্যা করা হয়। দুদিন পর নালাসংলগ্ন উত্তরপাড়ে আরো একজনকে হত্যা করে শঙ্খ নদীর পানিতে ফেলে দেওয়া হয়।
আগস্টের প্রথম সপ্তাহে রাজাকাররা সুচিয়ার জানকী কবিরাজের বাড়িতে প্রভাত আলোক রায়চৌধুরীকে হত্যা করে। ২১শে আগস্ট তারা পূর্ব চন্দনাইশের চৌধুরীপাড়া থেকে ২ জন, গাছবাড়িয়ার টাকখাইয়ের পাড়া থেকে ২ জন ও দক্ষিণ গাছবাড়িয়ার বাইন্যাপাড়া থেকে ১৪ জন মোট ১৮ জন নিরীহ লোককে ধরে পটিয়ার পিটিআই-তে নিয়ে যায়। শারীরিক নির্যাতনের পর ২ জনকে মুক্তি দিয়ে ১৫ জনকে সেখানে এবং ১ জনকে দোহাজারী ব্রিজে হত্যা করা হয়। বাইন্যাপাড়া ও চৌধুরীপাড়ার কয়েকটি বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে।
১৭ই মে ও নভেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে সংঘটিত হয় শুচিয়া গণহত্যা-। এতে ৮ জন নিরীহ লোক শহীদ হন। ১১ই নভেম্বর সংঘটিত হয় ধোপাছড়ি গণহত্যা। এতে তিনজন মুক্তিযোদ্ধা এবং ৫ জন সাধারণ লোক শহীদ হন। নভেম্বরের চতুর্থ সপ্তাহে বৈলতলীর প্রফুল্ল সাধুর বাড়ি এবং ২৯শে নভেম্বর রাতে এডভোকেট মুস্তাফিজুর রহমান চৌধুরীর বাড়িতে লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। ৩০শে নভেম্বর পূর্ব হাছনদণ্ডির বড়ুয়াবাড়ি ও বৈলতলীর নাথপাড়ায় রাজাকার ও পাকবাহিনী কর্তৃক লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ ও ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। একই দিন বৈলতলীর নাথপাড়ায় পাকসেনারা এক নারীর ওপর নৃশংস পাশবিক নির্যাতন করে, যার ফলে তিনি পঙ্গু হয়ে যান। ১৬ই ডিসেম্বরের পরে এই বীরাঙ্গনা নারী মৃত্যুবরণ করেন।
দোহাজারী সিএন্ডবি অফিস, দোহাজারী আহমদুর রহমান উচ্চ বিদ্যালয়, দেওয়ানহাট কৃষি কর্পোরেশন, বৈলতলী বশরত নগর কওমি মাদ্রাসা, বৈলতলী শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান আজিজুর রহমানের বাসভবন ও হাশিমপুর ইউনিয়ন কাউন্সিল অফিস ছিল পাকবাহিনীর নির্যাতনকেন্দ্র ও বন্দিশিবির। এসব স্থানে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের নিরীহ লোকদের ধরে এনে নির্যাতন করা হতো।
চন্দনাইশ উপজেলায় ৬টি বধ্যভূমি ও একটি গণকবর রয়েছে। সেগুলো হলো— তুলাতলী বধ্যভূমি ও গণকবর-, শঙ্খনদী ব্রিজ বধ্যভূমি, দোহাজারী সিএন্ডবি অফিস বধ্যভূমি দোহাজারী ব্রিজ বধ্যভূমি – দোহাজারী রেলসেতু বধ্যভূমি এবং শঙ্খনদীর চর বধ্যভূমি।
মুক্তিযুদ্ধের সময় চন্দনাইশে মহিউল আলম বাহিনী, ইসলাম কোম্পানি, ১৫৪ নং আবু তাহের খান খসরু গ্রুপ ও ১৪৭ নং জাকের আহমদ চৌধুরী গ্রুপ নামে চারটি স্থানীয় মুক্তিবাহিনী ছিল। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে বরিশালের অধিবাসী ফ্লাইট সার্জেন্ট মহিউল আলম বরমা ইউনিয়নের শাহ্য়াহান ইসলামাবাদীর দেউরি ঘরে ঘাঁটি স্থাপন করেন এবং চন্দনাইশ, পটিয়া, আনোয়ারা ও বাঁশখালীর অবসরপ্রাপ্ত সেনাসদস্য, পালিয়ে আসা বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও ইপিআর-এর হাবিলদার, সুবেদার, নায়েক, ল্যান্স নায়েকদের নিয়ে এ বাহিনী গঠন করেন। অক্টোবর মাসে হাবিলদার আবু মো. ইসলাম তাঁর গ্রুপ নিয়ে ধোপাছড়িতে এলে সুলতান আহমদ কুসুমপুরী এমপিএ, নায়েক সুজায়েত আলী ও সেনাসদস্য আসহাব মিয়ার গ্রুপের সঙ্গে মিলে ইসলাম কোম্পানি গঠিত হয়। ১২৫ সদস্যের এ কোম্পানির প্রধান হন আবু মো. ইসলাম। এ দুটি বাহিনী এলাকায় অনেক সফল অপারেশন পরিচালনা করে। ১৫৪ নং আবু তাহের খান খসরু গ্রুপের কমান্ডার ছিলেন আবু তাহের খান খসরু এবং ১৪৭ নং জাকের আহমদ চৌধুরী গ্রুপের কমান্ডার ছিলেন ১৪৭ নং জাকের আহমদ চৌধুরী।
চন্দনাইশে পাকবাহিনী ও তাদের দোসরদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকগুলো যুদ্ধ হয়। সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- ধোপাছড়ির যুদ্ধ, কাঞ্চননগররেলওয়ে ওয়ার্কশপ অপারেশন, পাঠানিপুল ব্রিজ অপারেশন, উত্তর হাশিমপুর বাইন্যাপুকুর যুদ্ধ, বাদামতল রাজাকার অপারেশন, বশরতনগর রশিদিয়া মাদ্রাসা অপারেশন- সাতবাড়িয়া ইউনিয়ন কাউন্সিল অপারেশন বৈলতলী তহশিল অফিস অপারেশন, গাছবাড়িয়া খানহাট পুল অপারেশন, উত্তর জোয়ারা নগরপাড়া পুল অপারেশন, দোহাজারী যুদ্ধ, অঁ-তলা অপারেশন, জোয়ারা মহাজনঘাটা সংলগ্ন বড়ুয়াপাড়া অপারেশন মাইগাতার যুদ্ধ, পটিয়া শান্তি কমিটির হেডকোয়ার্টার অপারেশন, বাদল মাস্টার পাড়া যুদ্ধ, দোহাজারী রেলসেতু অপারেশন চানখালি নদীতে রাজাকার অপারেশন এবং দেওয়ানজীর খিল যুদ্ধ। ১৩ই ডিসেম্বর চন্দনাইশ উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়।
উপজেলার খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা হলেন— কর্নেল অলি আহমদ, বীর বিক্রম (পিতা আমানত ছফা) ও আব্দুল করিম, বীর বিক্রম (পিতা আরজু মিয়া, বধুরপাড়া, গাছবাড়িয়া)। চন্দনাইশ উপজেলার শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- মুরিদুল আলম (পিতা আহমদুর রহমান চৌধুরী, কেশুয়া), ফরিদুল আলম (পিতা কবির উদ্দিন আহমদ, কেশুয়া), হাবিলদার রুস্তম আলী (পিতা আবদুর রাজ্জাক, দোহাজারী), শামসুল ইসলাম (পিতা সাহেব মিয়া, সাতবাড়িয়া, হাছনদণ্ডি), জাহাঙ্গীর আলম (পিতা বদিউল আলম, বরমা, বাইনজুরী), মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম কাজেমী (পিতা আবদুল ওয়াছেক কাজেমী, বরকল), আবদুস সবুর খান (পিতা আলী হোসেন খান, বরমা, মাইগাতা), মাহফুজুল আলম (পিতা ছিদ্দিকুল আলম, বাইনজুরী), বজলুর রহমান (পিতা বশরত আলী, দোহাজারী), আবুল খায়ের (পিতা হাজি মো. ইব্রাহিম, চর বরমা), নজরুল ইসলাম (ফটিকছড়ি; উত্তর হাশিমপুর বাইন্যাপুকুরপাড় যুদ্ধে শহীদ), নায়েক ফয়েজ আহমদ (পিতা মোহাম্মদ ইসমাইল, সাতকানিয়া; কাঞ্চনা নোয়াপতং-এ পাকবাহিনীর আক্রমণে শহীদ), রনজিত (লোহাগাড়া- আমিরাবাদ), বিমল কান্তি চৌধুরী (পিতা সুধাংশু বিমল চৌধুরী, সাতকানিয়া, নলুয়া; চন্দনাইশের দেওয়ানজীর খিলে পাকবাহিনীর আক্রমণে শহীদ), সুভাষ মজুমদার (পিতা ক্ষিতীশ মজুমদার, লোহাগাড়া, উত্তর আমিরাবাদ; চন্দনাইশের দেওয়ানজীর খিলে পাকবাহিনীর আক্রমণে শহীদ), মো. ইউছুফ (পিতা ফজল করিম, লোহগাড়া, কলাউজান; ধোপাছড়ির যুদ্ধে শহীদ), আবদুস ছবুর (পিতা আশরাফ আলম, দোহাজারী ব্রিজ সংলগ্ন কাটগড়), আবদুস সত্তার (পিতা জব্বার আলী, ঐ), মোহাম্মদ ইউনুচ (পিতা আবদুস ছামাদ, ঐ) এবং সুবেদার সিরাজুল ইসলাম (বোয়ালখালী-আহ্লা)।
চন্দনাইশ উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। সেগুলোর মধ্যে রয়েছে- জামিজুরী ও পালপাড়া গণহত্যায় শহীদদের উদ্দেশে নির্মিত দুটি স্মৃতিস্তম্ভ। উপজেলার বরকল ইউনিয়নে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মিত হয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধের পরপর দোহাজারী স্টেশন রোড লালুটিয়া সড়ক এবং দোহাজারী খানবাড়ি বালিকা বিদ্যালয় বড়ুয়াপাড়া সড়কের নতুন নামকরণ করা হয় যথাক্রমে শহীদ মুক্তিযোদ্ধা বজলুর রহমান সড়ক ও মুক্তিযোদ্ধা আবু তাহের খান খসরু সড়ক। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্টের পর এ নাম পরিবর্তন করা হয়। দোহাজারী সাঙ্গুভেলী ঈদপুকুরিয়া সড়কের নাম বীর মুক্তিযোদ্ধা মতিয়ুর রহমান সড়ক এবং গাছবাড়িয়া-বরকল সড়কের নাম শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা মুরিদুল আলম সড়ক রাখা হয়েছে। এছাড়া দেওয়ানজীর খিলে মুক্তিযোদ্ধা সুভাষ মজুমদার ও বিমল চৌধুরী যেখানে গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন, সেখানে একটি স্মৃতিচিহ্ন নির্মিত হয়েছিল। [শামসুল আরেফীন]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৩য় খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!