চন্দ্রগঞ্জ বাজার যুদ্ধ (বেগমগঞ্জ, নোয়াখালী)
চন্দ্রগঞ্জ বাজার যুদ্ধ (বেগমগঞ্জ, নোয়াখালী) সংঘটিত হয় ৫ই সেপ্টেম্বর। এতে ২৩ জন পাকসেনা নিহত হয়। চন্দ্রগঞ্জ বাজারটি নোয়াখালী জেলার বেগমগঞ্জ উপজেলা সদর থেকে ১৫ কিমি পশ্চিমে বেগমগঞ্জ-লক্ষ্মীপুর প্রধান সড়কের পাশে অবস্থিত। বাজারটি দুটি অংশে বিভক্ত। এর মাঝখান দিয়ে নোয়াখালী খাল প্রবাহিত। খালের ওপর নির্মিত ব্রিজের পূর্ব অংশ নোয়াখালী এবং পশ্চিম অংশ লক্ষ্মীপুর জেলার অর্ন্তভুক্ত।
এ দেশীয় দোসরদের ইঙ্গিতে আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর এক বিশাল দল ৫ই সেপ্টেম্বর ফেনী থেকে চন্দ্রগঞ্জ অভিমুখে রওনা দেয়। এখানে পৌঁছামাত্র তারা মুক্তিযোদ্ধাদের তীব্র প্রতিরোধের মুখে পড়ে।
হানাদার বাহিনী ঘুণাক্ষরেও কল্পনা করতে পারেনি যে, বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে এতদঞ্চলে বিশেষ করে লাকসাম, সোনাইমুড়ী, আমিশাপাড়া, চাটখিল, লক্ষ্মীপুর, রায়পুর, রামগঞ্জ ও মাইজদী এলাকায় এমন একজন অসীম সাহসী মুক্তিযোদ্ধা আছেন, যিনি বিনা বাধায় শত্রুবাহিনীকে কখনো যেতে দেননি। তিনি হলেন বেঙ্গল রেজিমেন্টের সুবেদার লুৎফর রহমান। তিনি ঐ এলাকায় অবসরপ্রাপ্ত ও ছুটিতে আসা সশস্ত্র বাহিনীর বাঙালি সৈনিকদের শতাধিক সদস্য নিয়ে একটি শক্তিশালী মুক্তিবাহিনী গড়ে তোলেন। এ বাহিনী সর্বদা হানাদার বাহিনীকে মোকাবেলার জন্য প্রস্তুত থাকত। ৫ই সেপ্টেম্বর তাঁর কাছে খবর আসে যে, ফেনী থেকে একদল পাকিস্তানি সৈন্য চন্দ্রগঞ্জ অভিমুখে আসছে। লুৎফর রহমান এ খবর পাওয়া মাত্র হানাদার বাহিনীকে প্রতিরোধের জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েন। তাৎক্ষণিকভাবে তিনি ৭ থেকে ১০ জন মুক্তিযোদ্ধা সংগ্রহ এবং ৭টি এসএলআর-সহ কিছু হালকা অস্ত্র যোগাড় করেন। এত সামান্য অস্ত্র ও শক্তি দিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করাটা ছিল দুঃসাহসিক কাজ। তবুও মনের অসীম জোরে তিনি শত্রুকে মোকাবেলার জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হন। চন্দ্ৰগঞ্জ বাজারের প্রবেশমুখে ছিল প্রশস্ত এক রাস্তা। রাস্তার ধারে বড় রকমের ইটের স্তূপ জমা ছিল। সেই ইটের স্তূপের পাশ দিয়েই শত্রুসৈন্যদের যেতে হবে। সুবেদার লুৎফর রহমান তাঁর যোদ্ধাদের নিয়ে ইটের স্তূপের আড়ালে এম্বুশ নেন এবং এখান থেকেই শত্রুর ওপর হামলা চালানোর প্রস্তুতি নেন।
অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ ছিল সে অপারেশন। যে-কোনো সময় বিপদ আসতে পারত। সাত মুক্তিযোদ্ধার হাতে সাতটি এসএলআর এবং অন্যান্য অস্ত্র প্রস্তুত। এরই মধ্যে হানাদার বাহিনীর সামরিক যানগুলো এসে চন্দ্রগঞ্জ বাজারের রাস্তার মোড়ে থামে। মুক্তিযোদ্ধাদের রক্তে তখন বিদ্রোহের আগুন জ্বলছে। আর অপেক্ষা নয়, শুরু হয়ে যায় এসএলআর-এর গুলির গর্জন। প্রচণ্ড আওয়াজে পাকিস্তানি সামরিক যানের টায়ারগুলো মুহূর্তের মধ্যে ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। সেই সঙ্গে লুটিয়ে পড়ে হানাদার বাহিনীর বেশকিছু সৈন্য। হানাদাররা হতচকিত, দিশেহারা ও ভয়ে আতঙ্কিত হয়ে পড়ে এবং দ্রুত গাড়ি থেকে নেমে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান চিহ্নিত করার চেষ্টা করে। অনবরত বৃষ্টির মতো ঝাঁকে-ঝাঁকে গুলি এসে পড়ছিল হানাদার বাহিনীর ওপর। ফলে তারা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। চারপাশে ছিল ঝোপ-জঙ্গল। এক পর্যায়ে অনেকক্ষণ ধরে আর কোনো গুলির শব্দ নেই। পাকসেনারা ভেবেছে মুক্তিযোদ্ধারা সরে পড়েছে। তারা তাদের আহত ও নিহত সৈন্যদের ভ্যানে তুলছিল। ঠিক তখনই আবার গুলিবর্ষণ। অনবরত গুলি চলছিল। পাকিস্তানি সৈন্যদের কিছু অংশ গাড়িতে, কিছু অংশ রাস্তায়। ভীত-সন্ত্রস্ত পাকসেনাদের দলে তখন শুধু চিৎকার। চোরাগোপ্তা আক্রমণের উৎসস্থল চিহ্নিত করতে ব্যর্থ হয়ে তারা এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়তে থাকে। এমনই এক মুহূর্তে হানাদার বাহিনীর সঙ্গে আসা এদেশীয় ঘৃণ্য এক দালাল মুক্তিযোদ্ধাদের শনাক্ত করে পাকসেনাদের দেখিয়ে দেয়। হানাদার বাহিনীর সদস্যরা মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান লক্ষ করে গুলি ছুড়তে থাকে। কিন্তু এর আগেই মুক্তিযোদ্ধারা নিরাপদ স্থানে চলে যেতে সক্ষম হন।
চন্দ্রগঞ্জ বাজার যুদ্ধে হানাদার বাহিনীর ২৩ জন সৈন্য নিহত এবং তাদের বহু সামরিক যান ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অপরদিকে মুক্তিযোদ্ধাদের কোনোরকম ক্ষতির শিকার হতে হয়নি। [মো. ফখরুল ইসলাম]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৩য় খণ্ড