You dont have javascript enabled! Please enable it! চট্টগ্রাম শহরে গেরিলা যুদ্ধের প্রস্তুতি-পর্ব (চট্টগ্রাম মহানগর) - সংগ্রামের নোটবুক

চট্টগ্রাম শহরে গেরিলা যুদ্ধের প্রস্তুতি-পর্ব (চট্টগ্রাম মহানগর)

চট্টগ্রাম শহরে গেরিলা যুদ্ধের প্রস্তুতি-পর্ব (চট্টগ্রাম মহানগর)-এ মূল উদ্যোক্তা ও সংগঠক ছিলেন মৌলভী সৈয়দ আহম্মদ ওরফে মৌলভী সৈয়দ (১৯৩৮-১৯৭৭)। মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে তিনি জয়বাংলা স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর প্রধান ছিলেন।
বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’- এ ঘোষণার মধ্য দিয়ে দেশের অগণিত মানুষের মতো মৌলভী সৈয়দও বাঙালির স্বাধীনতা অর্জনে আসন্ন মুক্তিযুদ্ধের অনিবার্যতা উপলব্ধি করতে পারেন। ফলে পাহাড়তলী-ঢাকা ট্রাঙ্ক রোডের পার্শ্বে অবস্থিত তাঁর নিজের সাইকেল পার্টস-এর দোকানটিকে কেন্দ্র করে গড়ে তোলেন স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র দেশপ্রেমিক যুবকদের এক গোপন স্কোয়াড৷ কিন্তু অচিরেই তাঁর এ তৎপরতা পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর নজরে আসে এবং স্থানটি চিহ্নিত হয়। স্থানীয় দালাল ও স্বাধীনতাবিরোধীদের মাধ্যমে তিনি পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে ধরা পড়েন। তবে সেনাবাহিনীর ট্রাক থেকে লাফিয়ে রাস্তার পার্শ্ববর্তী একটি পুকুরে পড়ে তিনি নিজ জীবন রক্ষা করতে সমর্থ হন।
২৫শে মার্চ মধ্যরাত থেকেই হালিশহরস্থ ইপিআর (বর্তমান বিজিবি) সেক্টর হেডকোয়ার্টার্সের এডজুট্যান্ট ক্যাপ্টেন রফিকুল ইসলামের নেতৃত্বে পাকিস্তানি হানাদারদের বিরুদ্ধে চট্টগ্রাম শহরে প্রতিরোধযুদ্ধ শুরু হয়। ২৮শে মার্চ পাকিস্তানি দখলদার বাহিনী চট্টগ্রাম শহরের টাইগার পাস নেভাল বেইজ দখলে নেয়। পরের দিন ২৯শে মার্চ শত্রুসেনারা বর্তমান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রোড অতিক্রম করে আগ্রাবাদ রেডিও স্টেশন কার্যালয়সহ পুরো এলাকা দখল করে নেয়। ৩০শে মার্চ হালিশহর ইপিআর হেডকোয়ার্টার্সে দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীর ব্যাপক বোমা বর্ষণের ফলে সেখানে প্রতিরোধযুদ্ধে লিপ্ত শতশত বিদ্রোহী বাঙালি সৈনিক আশপাশের অঞ্চল বা পার্শ্ববর্তী গ্রামসহ লোকালয়ে আশ্রয় গ্রহণ করেন। অনেকে তাঁদের অস্ত্রশস্ত্র স্থানীয় যুবকদের কাছে রেখে সামরিক পোশাক ছেড়ে অন্যত্র চলে যান। আবার অনেকে হানাদারদের বিরুদ্ধে কালুরঘাটে বিদ্রোহী বাঙালি সৈনিকদের প্রতিরোধযুদ্ধে শামিল হন।
তখন চট্টগ্রাম শহরের প্রধান-প্রধান রাস্তায় পাকিস্তানি দখলদার সৈন্যদের পাহারা চলছিল, ছিল অনবরত কারফিউ। শহরের জনমনে বিরাজ করছিল ভয়ঙ্কর আতঙ্ক, আর শহর হয়ে পড়ে প্রায় জনমানবশূন্য।
এমনি এক অবস্থায় শতশত ছাত্র-যুবক মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং নিতে প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতে ছুটছিলেন। একই সময় তাঁদের বয়সী অনেকে পাকিস্তানি বাহিনী পরিবেষ্টিত চট্টগ্রাম শহর থেকে বের হতে না পেরে শহরেই থেকে যেতে বাধ্য হন। অভ্যন্তরীণভাবে তাঁদের সংগঠিত, ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা ও অস্ত্র সংগ্রহ করে হানাদারদের বিরুদ্ধে গেরিলা পদ্ধতিতে অপারেশন পরিচালনার লক্ষ্যে মৌলভী সৈয়দ এগিয়ে আসেন। বেইজ ক্যাম্প স্থাপন: প্রথমেই গেরিলা যুদ্ধের উপযোগী একটি গোপন ঘাঁটি স্থাপনের স্থান নির্বাচনের সিদ্ধান্ত হয়। দখলদার পাকিস্তানি সৈনিক পরিবেষ্টিত বা নিয়ন্ত্রিত চট্টগ্রাম শহরের অভ্যন্তরে ন্যূনতম নিরাপদ একটি অঞ্চল খুঁজতে গিয়ে আধা শহর, আধা গ্রামীণ পরিবেশ আর বহু অলি-গলি, খাল-বিল, ঝোপঝাড়ের মধ্যে অবস্থিত গেরিলা যুদ্ধের জন্য উপযোগী স্থান হিসেবে বৃহত্তর আগ্রাবাদ অঞ্চলটিকে বেছে নেয়া হয়। একই সঙ্গে পানওয়ালাপাড়ার আব্দুল হাই সরদারের ‘সবুজবাগ’ বাড়িটি মুক্তিযুদ্ধের ঘাঁটি হিসেবে গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। পরবর্তীকালে হাজীপাড়ার জালাল কমিশনারের বাড়ি ও আনন্দীপুরের মোহাম্মদ হারিসের বাড়িকেও গেরিলা যোদ্ধাদের অন্যতম ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করা হয়, কেননা গেরিলা যুদ্ধের নিয়ম অনুযায়ী সব সময় বিকল্প ব্যবস্থা রাখা আবশ্যক হয়।
শপথ গ্রহণ: আনন্দীপুর নিবাসী মোহাম্মদ হারিস, রামপুর নিবাসী আবদুস মোনাফ, দামপাড়া নিবাসী আবদুর রউফ, পানওয়ালাপাড়া নিবাসী মীর সুলতান আহম্মদ, সলিমুল্লাহ, আবু সাইদ সরদার, শেখ দেলোয়ার প্রমুখ ৭ই মে বাদ জুমা রামপুরস্থ আবদুল মোনাফের ঘরে মহান সৃষ্টিকর্তার নামে পবিত্র কোরান শরীফ নিয়ে মৌলভী সৈয়দের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামে অবতীর্ণ হওয়ার শপথ গ্রহণ করেন। একই দিন দ্বিতীয় দফায় হাজীপাড়ার জালালউদ্দিন আহম্মদ ও মাঈনউদ্দিন খান বাদল প্রমুখ শপথ নেন। পর্যায়ক্রমে মূল সাংগঠনিক তৎপরতার সঙ্গে আরো জড়িত হন হাজীপাড়ার নুরুল ইসলাম, পানওয়ালাপাড়ার মো. খলিল, আলী ফজল, দোস্ত মোহাম্মদ, মনু মিয়া, দাইয়াপাড়ার মোহাম্মদ শওকত, আ. নুর, ছোটপোলের নুর মোহাম্মদ মিন্ডি, সি জি এস কলোনীর ইসমাইল কুতুবী, হাজীপাড়ার মিজানসহ আরো অনেকে।
অস্ত্র সংগ্রহ: প্রথমে বিদ্রোহী বাঙালি ইপিআর সৈনিকদের পরিত্যক্ত অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ সংগ্রহ করা হয়। এমনকি অবাঙালিদের মজুদ করা অস্ত্রশস্ত্রও দু-চার জায়গা থেকে উদ্ধার ও সংগ্রহ করা হয়।
স্বাধীনতাকামী তরুণদের এ উদ্যোগ, আয়োজন সাংগঠনিক তৎপরতা স্থানীয় অধিবাসীরা প্রথমে খুব একটা ভালো চোখে দেখেনি, কারণ তারা ভেবেছিল আধুনিক ও ভারী অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত সুসংগঠিত পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর পরিকল্পিত যুদ্ধের সঙ্গে স্থানীয় সাধারণ যুবকরা এমন কী আর প্রতিরোধ করতে পারবে।
গোপন প্রচার-প্রচারণা : নতুন-নতুন মুক্তিযোদ্ধা রিক্রুটের ব্যাপারে জনমত গঠনের লক্ষ্যে গোপন প্রচারপত্রের মাধ্যমে ব্যাপক প্রচারণা চালানোর উদ্যোগ নেয়া হয় ৷ এ সমস্ত প্রচারপত্র যেহেতু কোনো ছাপাখানা থেকে প্রকাশ্যে ছাপানো সম্ভব ছিল না, তাই পুরনো একটি সাইক্লোস্টাইল মেশিন সংগ্রহ করে নিজেরাই এসব প্রচারপত্র মুদ্রণ করে স্থানীয় রিকশাওয়ালা, ফেরিওয়ালা, দোকানদার ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সরকারি- বেসরকারি চাকরিজীবীদের মাধ্যমে তা বিলির ব্যবস্থা করা হয়। অচিরেই সাড়া পড়ে যায়। ব্যাপক গোপন প্রচারণার ফলে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের দেশের অভ্যন্তরে আটকে পড়া নেতা-কর্মীসহ স্বাধীনতার পক্ষের অনেকেই এ গোপন ঘাঁটির সঙ্গে যোগাযোগ করেন এবং অত্যন্ত উৎসাহ ও সাহসিকতার সঙ্গে সহযোগিতা দানে এগিয়ে আসেন। এক পর্যায়ে দলে-দলে আশপাশের গ্রামসহ শহরের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছাত্র, যুবক ও জনতা এ তৎপরতার সঙ্গে যুক্ত হয়। কেউ মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশ নিতে, কেউ মুক্তিযোদ্ধার ট্রেনিং নিতে, আর কেউ ভারতে গিয়ে ট্রেনিং গ্রহণের সুযোগ কামনা করেন। এভাবে অল্প সময়ের মধ্যেই মৌলভী সৈয়দের নেতৃত্বাধীন গেরিলা বাহিনীর তৎপরতা সারা শহরে ছড়িয়ে পড়ে।
পরবর্তীকালে উপরে উল্লিখিত সাইক্লোস্টাইল মেশিনটির সাহায্যে আবু সাইদ সরদার ও মাঈনউদ্দিন খান বাদলের সম্পাদনায় অনিয়মিতভাবে আগুন নামে একটি সাপ্তাহিক বুলেটিন প্রকাশ করা হতো। এতে স্থানীয় জনগণ মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়মিত তৎপরতাসহ রণাঙ্গনের অনেক খবর পেত।
অস্ত্র মজুদের ডাম্ব স্থাপন: প্রতিষ্ঠিত ঘাঁটি বা বেইজ ক্যাম্পের জন্য প্রথমেই পানওয়ালাপাড়া, মুহুরীপাড়া, হাজীপাড়া, ছোটপোল, রামপুর, আনন্দীপুর, মিস্ত্রিপাড়া প্রভৃতি স্থানের অভ্যন্তরীণ কবরস্থানগুলোতে অস্ত্র মওজুদের জন্য ডাম্ব স্থাপন করা হয়। সেসব স্থানে কবর আকৃতির মাটি খুঁড়ে কাটা ড্রাম পুঁতে তার ওপর পলিথিনের বড় টুকরো লাগিয়ে প্রয়োজনীয় অস্ত্রশস্ত্র পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে গ্রিজ ইত্যাদি দিয়ে প্রতিটি ডাম্বে অন্তত ১০ জন গেরিলা যোদ্ধা ব্যবহার করতে পারেন সে পরিমাণ অস্ত্র মওজুদ করে তা আবার কবর আকৃতি করে ঢেকে দেয়া হতো। এসব অস্ত্র মওজুদ ও সংরক্ষণের জন্য নির্দিষ্ট কিছু মুক্তিযোদ্ধার ওপর দায়িত্ব অর্পিত হয়। কোন কবরস্থানে কী কী অস্ত্র আছে তা শুধু তাঁরাই জানতেন।
নির্দিষ্ট অপারেশনের পূর্বে সংশ্লিষ্ট টিমের ২-৩ জন যোদ্ধাকে রাত্রে চোখ বেঁধে তাঁদের অপারেশনের নিকটস্থ অস্ত্র মওজুদের স্থানে নিয়ে যাওয়া হতো এবং তাঁদের প্রয়োজনীয় অস্ত্র হস্তান্তর করে আবার নির্দিষ্ট জায়গায় এনে চোখ খুলে দেওয়া হতো। অস্ত্রের লোকেশনটি কোথায় তা তাঁরা জানতেও চেষ্টা করতেন না। কারণ, যে কোনো একজন শত্রুর হাতে ধরা পরলে অকথ্য নির্যাতনে হয়তো অস্ত্রের খবর বলেও দিতে পারেন। এজন্যই সাবধানতা অবলম্বন।
আগ্রাবাদস্থ গেরিলা ঘাঁটির অধীন আশপাশের বিভিন্ন গ্রামের কবরস্থানে ন্যূনতম এরূপ ৩০টির অধিক অস্ত্র সংরক্ষণের ডাম্ব ছিল।
ট্রেনিং ক্যাম্প স্থাপন: আগ্রাবাদ গেরিলা বেইজের কার্যক্রম বর্ধিত করে আগ্রাবাদ ছোটপোলস্থ নুর মোহাম্মদ মিন্ডির বাড়ির পেছনের মাঠ (চট্টগ্রামের ভাষায় বিল)-টিকে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং প্রদানের স্থান হিসেবে নির্বাচন করা হয়। স্থানটি ছিল নির্জন বিল। চারদিকে তাকালে জঙ্গল, পুরনো ব্রিক ফিল্ড, নালা, খাল, বিল পরিবেষ্টিত এবং পায়ে হেঁটে যাওয়া ব্যতীত সে স্থানে যাওয়ার বিকল্প কোনো পথ ছিল না। গাড়ি তো দূরের কথা, সাধারণ মানুষও ঐ বিল দিয়ে দিনে-দুপুরে কোনো কারণে চলাফেরা করতে ভয় পেত। এমনি একটি স্থানে কোনো অবকাঠামো স্থাপন ব্যতীত ধু-ধু মাঠের মধ্যে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের প্রথমে সাবেক সেনাসদস্যদের দ্বারা ট্রেনিং প্রদান করা হয়। পরবর্তীতে ভারত থেকে আগত মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্য থেকে চৌকস দলনেতাদের দ্বারা স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের গেরিলা ট্রেনিং-এর ব্যবস্থা করা হয়।
রঙ্গিপাড়ায় গোয়েন্দা সেল স্থাপন: আগ্রাবাদ রঙ্গিপাড়ার পরিত্যক্ত নাপিত বাড়ির মাটির ঘরগুলোতে স্থাপন করা হয় ‘বেইজের’ গোয়েন্দা সেল। একদল চৌকস মুক্তিযোদ্ধা এ গোয়েন্দা সেলটি পরিচালনা করেন। তবে গোয়েন্দা হিসেবে বিভিন্ন শ্রেণি- পেশার সাধারণ মানুষ, যেমন রিকশাওয়ালা, ফেরিওয়ালা, মুচি, হকার, ছোট-খাট দোকানের মালিক তারাও নিয়োজিত হতেন। তারা কেউ গোয়েন্দা সেলের ঠিকানা জানতেন না। এমনকি ‘বেইজের’ অধীনের মুক্তিযোদ্ধাদেরও এই সেলের ঠিকানা জানা ছিল না।
গোয়েন্দা সেলের কাজ ছিল দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীর চলাচল ও তাদের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করা, বিভিন্ন কৌশলে বিভিন্ন লোক পাঠিয়ে হানাদার বাহিনীর কার্যকলাপের আগাম খবরাখবর সংগ্রহ করা, কোনো অপারেশনের পূর্বে রেকি করার জন্য যাদের নিয়োগ করা হয় তাদের ওপর নজরদারি করা, মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে কোনো তথ্য ফাঁস হচ্ছে কি-না তা নজরদারি করা এবং প্রয়োজনে হাই কমান্ডের নির্দেশে তার প্রতিকার করা ইত্যাদি। আগ্রাবাদ বাণিজ্যিক এলাকার মুক্তিযোদ্ধা নুরুল ইসলামের ওসমান কোর্ট অফিসটিকে মুক্তিযোদ্ধা পিঁয়াজো অফিস হিসেবে ব্যবহার করা হতো।
বেইজ কমান্ডের শেল্টারসমূহ: বেইজ কমান্ডের আওতায় স্থানীয়ভাবে ট্রেনিংপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা এবং ভারত থেকে আগত মুক্তিযোদ্ধা উভয়কে যাতে নিরাপদ আশ্রয় দেয়া যায় সেজন্য বেইজের আশপাশে অন্তত ১৫-২০টি মহল্লায় ২ শতাধিক বাড়িকে মুক্তিযোদ্ধাদের থাকার শেল্টার হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়। প্রতিটি বাড়ি বা ঘর এমনভাবে ঠিক করা হয় যাতে মুক্তিযোদ্ধাদের ঐ বাড়িতে আগমনের পথ ও প্রস্থানের পথ আলাদা-আলাদা থাকে। তবে এসব বাড়িঘরের বেশির ভাগ মালিক ছিলেন গরিব ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির। মুক্তিযুদ্ধে তারাই বেশি ঝুঁকি নিয়েছেন। এ কথা বলার প্রয়োজন পড়ে না যে, একটি আশ্রয়স্থলের একজন মুক্তিযোদ্ধাকে শত্রুবাহিনী ধরতে পারলে ঐ আশ্রয়স্থলের নারী-পুরুষ-শিশু সবাই অত্যাচার-নির্যাতনসহ মৃত্যুর ঝুঁকিতে থাকতেন।
অবজারবেশন পোস্ট: বেইজ কমান্ডের আওতাভুক্ত সমস্ত এলাকা ঘিরে শতশত অবজারবেশন পোস্ট ছিল। কোনোটি কোনো দালানের ছাদে, কোনোটি নিচতলায় কোনো দোকানের কোণায়, কোনোটি মসজিদের পাশে এমনি করে সমস্ত বেইজ এলাকায় অবজারবেশন পোস্টসমূহে তিন শিফটে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা পাহারা দিতেন। বেইজ অঞ্চলের মধ্যে শত্রুবাহিনীর কোনো গাড়ি বা সন্দেহভাজন কোনো লোকজন দেখলেই বিভিন্ন সংকেতের মাধ্যমে সমগ্র বেইজ এলাকায় সে খবর মুহূর্তের মধ্যে পৌঁছে যেত। এর ফলে বেইজ এলাকায় মুক্তিযোদ্ধারা অভ্যন্তরীণ রাস্তায় স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করতে পারতেন এবং তাঁদের আশ্রয়স্থলে নিরাপদে সুযোগমতো বিশ্রাম নিতে পারতেন। বেইজ কমান্ডের সঙ্গে যোগাযোগ: পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, আগ্রাবাদ এলাকাস্থ পানওয়ালাপাড়ার সবুজবাগে আবদুল হাই সরদারের বাড়িটি ছিল মৌলভী সৈয়দের বেইজের হেডকোয়ার্টার্স। স্থানটি ছিল খুবই সুরক্ষিত। উল্লেখ্য, গেরিলাযুদ্ধের উপযোগী স্থান পানওয়ালাপাড়া হেডকোয়ার্টার্সের সঙ্গে পূর্বে উল্লিখিত ট্রেনিং ক্যাম্পসমূহ ও গোয়েন্দা দপ্তরের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগের জন্য এমন সব অজানা-অচেনা বহুমুখী অলি-গলি ছিল, যা মুক্তিযোদ্ধাদের চলাচলের জন্য ছিল খুবই নিরাপদ।
ভারতে অবস্থানরত মুক্তিযুদ্ধের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে যোগাযোগ স্বল্প সময়ের মধ্যে বর্ণিত সকল উদ্যোগ-আয়োজন সম্পন্ন করে মে মাসের ২য় সপ্তাহে মৌলভী সৈয়দ ভারতের আগরতলায় অবস্থানরত মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। দেশের অভ্যন্তরে শত্রু পরিবেষ্টিত অবস্থায় তাঁর নেতৃত্বে ইতোমধ্যে যে সমস্ত কার্যক্রম সম্পাদন করা হয়েছে, তার বিস্তারিত উল্লেখপূর্বক প্রয়োজনীয় অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ প্রেরণের জন্য তিনি তাঁদের কাছে আবেদন জানান। সেখান থেকে নির্দেশ আসে যেন দেশের অভ্যন্তরে অবস্থানরত স্বাধীনতাকামী সাহসী যুবকদের স্থানীয়ভাবে সংগঠিত ও তাদের প্রয়োজনীয় সংক্ষিপ্ত গেরিলা ট্রেনিং দিয়ে যথেষ্ট সংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা প্রস্তুত করে রাখা হয়। এও বলা হয় যে, অস্ত্রশস্ত্রসহ ভারতে ট্রেনিংপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা চট্টগ্রাম শহরে প্রবেশের পর মৌলভী সৈয়দের বেইজের সঙ্গেই যোগাযোগ করবেন।
ভারতে ট্রেনিংপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের আগমন: ভারতে ট্রেনিংপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা প্রথমে চট্টগ্রাম শহরে প্রবেশ করেন জুন-জুলাই মাসে। তাঁদের মধ্যে সর্বপ্রথম গ্রুপ কমান্ডার সৈয়দ আবদুর রহমান মৌলভী সৈয়দ-এর বেইজের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। এরপর ভারতের ট্রেনিং ক্যাম্পে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বিএলএফ এবং এফএফ গ্রুপগুলো জুলাই- আগস্ট মাস থেকে চট্টগ্রাম শহরে প্রবেশ করতে থাকে। আগত মুক্তিযোদ্ধা দলগুলো স্থানীয় ট্রেনিংপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে মিশে মৌলভী সৈয়দ প্রতিষ্ঠিত বেইজের সমন্বয়ে প্রচণ্ড শক্তি সঞ্চয় করে সুপরিকল্পিতভাবে চট্টগ্রাম শহরে একের পর এক অপারেশন সংঘটিত করতে থাকে।
প্রকৃত অর্থে চট্টগ্রাম শহরে জুনের প্রথম সপ্তাহ থেকে ভারতে ট্রেনিংপ্রাপ্ত গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা দলগুলো প্রবেশ করতে থাকলেও ঐ সময়টিতে খুব বেশি উল্লেখযোগ্য অপারেশন চট্টগ্রাম শহরে সম্পন্ন করা সম্ভব হয়নি। শত্রু পরিবেষ্টিত চট্টগ্রাম শহরে স্থানীয় ও ভারতে ট্রেনিংপ্রাপ্ত বিপুল সংখ্যক মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে সমন্বয় সাধন ও যুদ্ধ-পরিকল্পনা পুনর্গঠন এবং যুদ্ধকে প্রকৃত গেরিলা ধারায় রূপান্তরিত করতেই গেরিলা যোদ্ধা ও সংগঠকদের বেশির ভাগ সময় মনোনিবেশ করতে হয়। অন্যদিকে, গ্রাম অঞ্চলে গেরিলা যুদ্ধ করা আর একটি শহরে উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার মধ্যে সার্বক্ষণিক শত্রু পরিবেষ্টিত অবস্থায় গেরিলা যুদ্ধ চালানোর মধ্যে অনেক পার্থক্য ছিল।
চট্টগ্রাম শহরের বেশিরভাগ গেরিলা অপারেশন মৌলভী সৈয়দের বেইজ কমান্ডের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হয়। এর মধ্যে অপারেশন চট্টগ্রাম কোর্ট বিল্ডিং, অপারেশন আইস ফ্যাক্টরি রোড, অপারেশন অভয়মিত্রঘাট ট্রান্সফরমার, অপারেশন গোসাইলডাঙ্গা পেট্রোল পাম্প, অপারেশন চট্টগ্রাম কাস্টমস্ পেট্রোল পাম্প, অপারেশন এ্যাপোলো পেট্রোল পাম্প, অপারেশন চট্টগ্রাম ফায়ার ব্রিগেড, অপারেশন কোতয়ালি থানা, অপারেশন পাকিস্তানি ইন্টেলিজেন্স অফিসার, অপারেশন আন্দরকিল্লা বন্দুকের দোকান, একরাতে শতাধিক ইলেক্ট্রিক টাওয়ার অপারেশন, অপারেশন আমেরিকান এক্সপ্রেস, অপারেশন শায়নঘাটা ট্রান্সফরমার ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।

তবে, মৌলভী সৈয়দের নেতৃত্বে চট্টগ্রাম শহরের গেরিলা যোদ্ধাদের সবচেয়ে বড় ও গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল ১৫ই আগস্ট সাবমেরিনার এ ডব্লিউ চৌধুরীর নেতৃত্বাধীনে চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দরে অপারেশন জ্যাকপট- নামে নৌ-কমান্ডো অভিযান, যাতে ৯টি পাকিস্তানি জাহাজ ও অন্যান্য নৌযান ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। [আবু সাইদ সরদার]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৩য় খণ্ড