You dont have javascript enabled! Please enable it!

চট্টগ্রাম শহরে সমন্বিত পেট্রোল পাম্প গেরিলা অপারেশন (চট্টগ্রাম মহানগর)

চট্টগ্রাম শহরে সমন্বিত পেট্রোল পাম্প গেরিলা অপারেশন (চট্টগ্রাম মহানগর) পরিচালিত হয় ১লা ডিসেম্বর। মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত পর্যায়ে চট্টগ্রাম শহরে গেরিলা তৎপরতা তীব্র আকার ধারণ করে। শহরের প্রায় সকল অংশে এবং উপকণ্ঠে প্রতিদিনই কোনো-না-কোনো অভিযান সংঘটিত হতো। এসব অভিযানের লক্ষ্যবস্তু ছিল প্রধানত টহলরত পাকিস্তানি দখলদার বাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনীর গাড়ি, তাদের প্রহরাচৌকি এবং বিক্ষিপ্তভাবে ছোট-ছোট দল বেঁধে চলাচলরত হানাদার সৈন্য ও তাদের এ-দেশীয় দালাল চক্রের সদস্যরা। গেরিলা বাহিনীর আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুর মধ্যে আরো ছিল গুরুত্বপূর্ণ সরকারি ভবন, বিদেশী ব্যাংক ও প্রতিষ্ঠানের কার্যালয়, গুরুত্বপূর্ণ সরকারি স্থাপনা এবং বিদ্যুৎ কেন্দ্র। বেশ কিছু বেসরকারি বিশেষত অবাঙালিদের ব্যবসায়িক স্থাপনা এবং কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ স্থানও গেরিলা হামলার লক্ষ্যবস্তু হিসেবে নির্ধারণ করা হয়। লক্ষ্যবস্তুগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য পায় পেট্রোল পাম্পগুলো, যদিও সেগুলোর সবই ছিল বেসরকারি মালিকানাধীন এবং অনেকগুলোর মালিক ছিলেন বাঙালি। এগুলোকে লক্ষ্যবস্তু করার কারণ ছিল জ্বালানি সরবরাহ বন্ধ করা। তাছাড়া পেট্রোল পাম্পে বিস্ফোরণ ঘটাতে পারলে জ্বালানি তেলের আগুনের শিখা আশপাশের সমগ্র এলাকায় মুক্তিকামী বাঙালিদের কাছে মুক্তিবাহিনীর উপস্থিতি সম্বন্ধে স্পষ্ট বার্তা পৌঁছে দেবে। এতে জনগণের মনোবল চাঙা হবে এবং পাকিস্তানি দখলদার ও তাদের এ-দেশীয় দালালদের মনে ভীতি-আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়বে।
১৯৭১ সালের জুন-জুলাই থেকেই চট্টগ্রাম শহরে এ ধরনের গেরিলা তৎপরতা শুরু হয় এবং নভেম্বর-ডিসেম্বর নাগাদ এসব অভিযান সমন্বিতভাবে ও অধিকতর সংগঠিতরূপে পরিচালিত হয়। এরূপ একটি সুসংগঠিত ও সমন্বিত আক্রমণ পরিকল্পনার অংশ ছিল চট্টগ্রাম শহরের সবগুলো পেট্রোল পাম্প এবং বৈদ্যুতিক ট্রান্সফরমার ও সুইচবোর্ড একই দিনে একই সময়ে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে উড়িয়ে দেয়া। এর লক্ষ্য ছিল সমগ্র নগরী একসঙ্গে কাঁপিয়ে দেয়া, শত্রুবাহিনীর মনোবল ও চেইন অব কমান্ড সম্পূর্ণ ভেঙ্গে দেয়া, তাদেরকে হতবিহ্বল করে দেয়া এবং বিশ্ববাসীকে জানিয়ে দেয়া যে, সমগ্র চট্টগ্রাম শহরের প্রতিটি প্রান্তে মুক্তিকামী গেরিলারা তাঁদের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছেন।
অপারেশন পরিচালনার জন্য চট্টগ্রাম শহরের তিনটি থানা- কোতোয়ালি, ডবলমুরিং ও পাঁচলাইশকে ৪টি ভাগে ভাগ করা হয় (ডবলমুরিং দুটি, কোতোয়ালি একটি এবং পাঁচলাইশ একটি)। চারটি ভাগের প্রত্যেকটিতে যতগুলো পেট্রোল পাম্প এবং বৈদ্যুতিক ট্রান্সফরমার ও সুইচবোর্ড ছিল, সবগুলোতেই বিস্ফোরক স্থাপন এবং সেগুলোকে উড়িয়ে দেয়ার জন্য ৩ থেকে ৫ জনের একটি করে গেরিলা দলকে দায়িত্ব দেয়া হয়। এসব গেরিলার অধিকাংশই ছিলেন স্থানীয়ভাবে রিক্রুট করা এবং প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। ভারত থেকে উচ্চতর প্রশিক্ষণ নিয়ে আসা একেকজন গেরিলা কমান্ডারের অধীনে ও নেতৃত্বে এ দলগুলো গঠন করা হয়। গেরিলাদেরকে অভিযান সম্পর্কে পৃথক-পৃথকভাবে নির্দেশনা এবং প্রয়োজনীয় বিস্ফোরক ও আত্মরক্ষার জন্য ছোট-ছোট অস্ত্র দেয়া হয়৷
চারটি অঞ্চলের চারজন অধিনায়ক ও চারজন সহ- অধিনায়কের তত্ত্বাবধানে ও নেতৃত্বে এ হামলার পরিকল্পনা করা হলেও প্রত্যেক গেরিলা দলে আবার একেকজনকে অধিনায়কের দায়িত্ব দেয়া হয়। আঞ্চলিক অধিনায়কের হাতের ঘড়ির সঙ্গে প্রত্যেক দলের অধিনায়কের ঘড়ির সময় মিলিয়ে নেয়া হয় যাতে একসঙ্গে সকল লক্ষ্যবস্তুতে বিস্ফোরণ ঘটানো যায়।
অভিযানের জন্য দিন ঠিক করা হয় ১৯৭১ সালের ১লা ডিসেম্বর। অভিযানের আগের দিন পাঁচলাইশ থানা কমান্ডার সৈয়দ মোহাম্মদ এমরান পাকিস্তানি চক্রের হাতে আটক হন। এ কারণে পাঁচলাইশ থানার লক্ষ্যবস্তুগুলোর ওপর হামলা পরিকল্পনা বাতিল করা হয়। বাকি দুটি থানার তিনটি অঞ্চলের লক্ষ্যবস্তুগুলোতে অভিযান পরিচালিত হয় পূর্ব সিদ্ধান্ত ও পরিকল্পনা অনুযায়ী।
থানাওয়ারি লক্ষ্যবস্তুগুলো হলো: কোতোয়ালি থানা- লালদীঘির পাড়ের পেট্রোল পাম্প, চন্দনপুরার ট্রান্সফরমার, হেম সেন লেনের ট্রান্সফরমার, কোতোয়ালি থানা সংলগ্ন ট্রান্সফরমার, অভয়মিত্র ঘাটের ট্রান্সফরমার, কোরবানীগঞ্জের ট্রান্সফরমার, জামালখান খাস্তগীর স্কুলের সামনে ওয়াপদার ফিল্টার, চকবাজার পেট্রোল পাম্প, আসকার দীঘির পাড়ের ট্রান্সফরমার, এপোলো পেট্রোল পাম্প, সিএন্ডবি কলোনির ট্রান্সফরমার, লালদীঘি পাড়ের ট্রান্সফরমার, মাঝিরঘাট পেট্রোল পাম্প ও স্টেডিয়ামের দক্ষিণের পেট্রোল পাম্প এবং ডবলমুরিং থানা- হোটেল আগ্রাবাদের ট্রান্সফরমার, বার্মা ইস্টার্ন পেট্রোল পাম্প, নেভাল বেইজ ট্রান্সফরমার, জাম্বুরি মাঠের পশ্চিমে ওয়াপদা সাবস্টেশন, বন্দর ভবনের পাশের পেট্রোল পাম্প, পশ্চিম মাদারবাড়ি ট্রান্সফরমার, কর্ণফুলী বাজার ট্রান্সফরমার, আগ্রাবাদ কলোনি পাওয়ার স্টেশন, ঈদগাহ বউবাজার পেট্রোল পাম্প, জোলার হাট শিউলী পেট্রোল পাম্প, বারিক বিল্ডিং পেট্রোল পাম্প, কাস্টম হাউসের সামনের পেট্রোল পাম্প, হাজী ক্যাম্পের পাশের পেট্রোল পাম্প, মনসুরাবাদ ওয়াপদা ট্রান্সফরমার, দেওয়ানহাট পেট্রোল পাম্প, পোস্ট অফিস কলোনি পেট্রোল পাম্প, আবিদের পাড়া ট্রান্সফরমার, কাট্টলী ট্রান্সফরমার ও গোল্ডেন টোব্যাকো সংলগ্ন পেট্রোল পাম্প। এসব অভিযানের প্রায় ৮০ শতাংশ কার্যকর হয় এবং তার মধ্যে ৯০ শতাংশই লক্ষ্য অর্জনে সক্ষম হয়।
এ দিনের যৌথ অভিযানের পরিকল্পনা ও অংশগ্রহণকারী গেরিলাদের মধ্যে ছিলেন মাহফুজুর রহমান, মুলকতুর রহমান, হারুন-অর-রশিদ, রইসুল হক বাহার, আবুল কাশেম, ফয়েজুর রহমান, নূর মোহাম্মদ, আহমদ শরিফ, মোহাম্মদ শরিফ, রবিউল হোসেন কচি, আবদুল আজিজ, জাহাঙ্গীর চৌধুরী, মফিজ উদ্দিন, গরিব উল্লাহ, জাহেদ আহমদ, তোহা গাজী, আলাউদ্দিন, ইমাম শরিফ, ইনামুল হক দানু, সাহাব উদ্দিন, মুসা খান, ইমতিয়াজ উদ্দিন পাশা, চৌধুরী বেলায়েত আলী, কাউসার হোসেন (নিজের পিতার মালিকানাধীন পেট্রোল পাম্প বিস্ফোরণ অভিযানে অংশ নেন), রাগীব মনজুর, শহীদুল আলম বাদল, রফিক চৌধুরী, কালাম, ফারুক, জামাল, মনজু, ফজল, লোকমান, আবদুল জব্বার, শওকত, আমান, আমির, সোলায়মান, লোকমান গণি, মোবারক, জমির, সিদ্দিক আহমদ চৌধুরী প্রমুখ। [রইসুল হক বাহার]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৩য় খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!