চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজ নির্যাতনকেন্দ্র ও বধ্যভূমি (চট্টগ্রাম মহানগর)
চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজ নির্যাতনকেন্দ্র ও বধ্যভূমি (চট্টগ্রাম মহানগর) এ সার্কিট হাউজটি ছিল পাকিস্তানি বাহিনীর সামরিক নিয়ন্ত্রণ ও নির্যাতন কেন্দ্র। এখান থেকে তারা পুরো শহরকে নিয়ন্ত্রণ করত। এখানে একজন ব্রিগেডিয়ার পদবির সামরিক কর্মকর্তার কার্যালয় ছিল। চট্টগ্রাম শহর দখল করার পর পাকসেনাদের এক বিশাল বাহিনী এখানে অবস্থান নেয় এবং এটি সর্ব প্রকার সামরিক কর্মকাণ্ডের মূল কেন্দ্র হয়ে ওঠে। মে-জুন মাস থেকে ঘাতকের দল সার্কিট হাউজকে ৩টি ভাগে ভাগ করে, যথা— প্রশাসনিক দপ্তর, পুরুষ নির্যাতনকেন্দ্র ও নারী নির্যাতনকেন্দ্র। প্রশাসনিক দপ্তরের কাজ ছিল শহর নিয়ন্ত্রণ করা। এজন্য পুরো শহরে বিহারি যুবকদের দ্বারা গোয়েন্দা কার্যক্রম পরিচালনা করা হতো। তাদের তথ্যের ভিত্তিতে বিভিন্ন এলাকা থেকে বাঙালিদের ধরে এনে নির্যাতন করা হতো। নির্যাতনের নানারকম ভয়ঙ্কর কৌশল ছিল, যেমন- ইলেকট্রিক শক দিয়ে, ইলেকট্রিক চেয়ারে বসিয়ে, উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন বৈদ্যুতিক বাল্ব জ্বালিয়ে, কপিকলের সাহায্যে ঝুলিয়ে, পেরেকের চৌকিতে শুতে বাধ্য করে, বুকের ওপর বড় পাথর চাপা দিয়ে, হাত-পায়ের আঙ্গুল ও রগ কেটে, গলায় রশি লাগিয়ে দুদিক থেকে টেনে নির্যাতন ইত্যাদি।
২৩শে আগস্ট বিহারি যুবকরা ভিডব্লিউ মাইক্রোবাসে করে বেলায়েত হোসেন ও দত্ত চৌধুরী নামে ব্রিটিশ মালিকানাধীন লয়েডস ব্যাংকের দুজন অফিসারকে চোখ বেঁধে সার্কিট হাউজে নিয়ে আসে। দত্ত চৌধুরীর হিন্দু পরিচয় না দেয়ার জন্য সবাই তাঁকে ‘রহমান সাহেব’ বলে ডাকত। তাঁদের দুজনকে হাত বেঁধে সার্কিট হাউজের পেছনে নিয়ে লাইনে দাঁড় করানো হয়। তাঁদের সঙ্গে ছিলেন একই ব্যাংকের আরো ২৫ জন বাঙালি অফিসার। তবে শেষপর্যন্ত বাইরের হস্তক্ষেপে তাঁরা সবাই প্রাণে বেঁচে যান।
সার্কিট হাউজের নির্যাতনকেন্দ্রের দায়িত্বে ছিল পাঞ্জাবি ক্যাপ্টেন নেওয়াজ মাহমুদ নজর। তার সঙ্গে জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী ছাত্র সংঘ – ও মুসলিম লীগ-এর নেতা-কর্মীদের ঘনিষ্ঠতা ছিল। বাঙালি নির্যাতনে তাকে সহায়তা করত -আলশামস ও বিহারি নেতারা। শহরের বিহারি অধ্যুষিত এলাকার প্রতিনিধিরা প্রায় প্রতিদিনই এখানে এসে বাঙালি নিধন ও নির্যাতন বিষয়ে সভা করত। উল্লেখ্য যে, ক্যাপ্টেন নেওয়াজ মাহমুদ ঘুষ খেত। তাকে ঘুষ দিয়ে মুক্তিযোদ্ধা আবু সাঈদ সরদার, ডা. জাফরউল্লাহ ও দোস্ত মোহাম্মদসহ অনেকে মুক্তি পেয়েছিলেন।
এই নির্যাতনের বাইরে ছিল নারীনির্যাতন। বিহারিরা পাকসেনাদের সহযোগিতায় শহরের বিভিন্ন স্থান থেকে বাঙালি নারীদের ধরে এনে সার্কিট হাউজের বিশেষ-বিশেষ কক্ষে আটকে রাখত। সেনা কর্মকর্তারা মেয়েদের নিজেদের কক্ষে নিয়ে রাখত। তারা কিছুদিন ভোগ করার পর তাদেরকে সাধারণ সৈন্যদের দিত। ভোগের অনুপযোগী বা অন্তঃসত্ত্বা নারীদের ছেড়ে দিত কিংবা হত্যা করে সাগরে বা শহরের বিভিন্ন বধ্যভূমিতে ফেলে দিত। এরপর নতুন মেয়েদের ধরে এনে সেখানে রাখা হতো।
৩রা ডিসেম্বর বিহারি যুবকরা পাথরঘাটা থেকে একটি মেয়েকে ধরে এনে সার্কিট হাউজের দোতলার একটি কক্ষে রাখে। তাকে প্রথম ধর্ষণ করা নিয়ে দুজন পাকিস্তানি সেনা অফিসারের মধ্যে দ্বন্দ্ব বাঁধে। এ দ্বন্দ্ব প্রথমে ঝগড়া এবং পরে মারামারিতে রূপ নেয়। এক পর্যায়ে পরস্পরের গুলিতে উভয়ই নিহত হয়। এ-সময় হঠাৎ বিদ্যুৎ চলে যায়। মেয়েটি অন্ধকারে কৌশলে দোতলা থেকে নেমে পেছন দিক দিয়ে বাইরে এসে আলমাস সিনেমা হলে আশ্রয় নেয়। তাকে পালাতে একজন বেলুচ সৈন্য সহায়তা করে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মুক্তিযোদ্ধারা এখান থেকে অনেক মেয়ে এবং বাঙালি তরুণকে উদ্ধার করেন।
চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে অসংখ্য বাঙালিকে হত্যা করা হয়। প্রতিরাতে ট্রাকে করে তাদের লাশ ফয়’স লেক বধ্যভূমি- অথবা নদী-সাগরে ফেলে দেয়া হতো। সার্কিট হাউজ সংলগ্ন গর্তে অসংখ্য মাথার খুলি পাওয়া গেছে। [সাখাওয়াত হোসেন মজনু]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৩য় খণ্ড