চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউজ পেট্রোল পাম্প অপারেশন (চট্টগ্রাম মহানগর)
চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউজ পেট্রোল পাম্প অপারেশন (চট্টগ্রাম মহানগর) পরিচালিত হয় ১৭ই নভেম্বর। পাম্পটির সামনের দিকে ছিল কাস্টমস হাউজ ও বন্দর ভবন, উত্তর পাশে বর্তমান বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের খালি জায়গা, পেছনে ৪ নম্বর জেটি, দক্ষিণে কন্টেইনার ডিপো এবং সামনে প্রধান রাস্তা। পূর্বে একটি রাস্তা চলে গেছে জেটির ভেতরে। পাকিস্তান সরকারের জাতীয় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে এই পেট্রোল পাম্প গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করত। পেট্রোল পাম্পের নিকটেই ছিল পাকিস্তানি সেনা ও নৌসেনাদের চেকপোস্ট। দিনরাত ২৪ ঘণ্টা শতশত ট্রাক, লরি এবং পাকিস্তানি সেনাদের যানবাহন এই পাম্প থেকে পেট্রোল নিত। কাস্টমস, বন্দর ও জেটির সংযোগস্থলে ছিল একটি গোল চত্বর। প্রতিটি স্থাপনার সামনে ছিল কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা। এই তিন প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারী ছাড়া আর কেউ সেখানে প্রবেশ করতে পারত না। এই তিন প্রতিষ্ঠান থেকে পাকিস্তান সরকার প্রচুর রাজস্ব পেত এবং সেই অর্থ তারা পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যেত। এই ব্যবস্থা বন্ধ করার উদ্দেশ্যে মুক্তিযোদ্ধারা পেট্রোল পাম্প অপারেশনের সিদ্ধান্ত নেন। তাছাড়া বাঙালি ব্যবসায়ীরা কাস্টমস হাউজে মাল খালাসের জন্য এসে প্রতিনিয়ত হয়রানির শিকার হতেন, কারণ বিহারিরা জোর করে তাঁদের কাছ থেকে অর্থ আদায় করত। এই অপারেশনের মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধারা আরো যেসব লক্ষ্য অর্জন করতে চেয়েছিলেন, সেগুলো হলো— বন্দরের নিয়ন্ত্রণ থেকে অবাঙালি কর্মকর্তা- কর্মচারীদের সরিয়ে দেয়া, শতশত ট্রাকে করে পাকিস্তানি সরবরাহ কেন্দ্রগুলোতে যে খাদ্য ও অন্যান্য পণ্য-সামগ্রী পৌঁছে দেয়া হতো তা বন্ধ করা এবং বন্দর কলোনি ও বন্দর এলাকায় বিহারিরা বাঙালি কর্মকর্তা, কর্মচারী ও শ্রমিকদের জিম্মি করে যে মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন চালাত তা বন্ধ করা। এছাড়া অপারেশনটি সম্পন্ন হলে পতেঙ্গা পর্যন্ত পাকবাহিনী বড় ধরনের চাপের মধ্যে পড়বে, এটি ছিল অপারেশনের আরেকটি উদ্দেশ্য। দুদিন পরিস্থিতি পর্যালোচনার পর মুক্তিযোদ্ধারা ১৭ই নভেম্বর রাতে পাম্প অপারেশনের সিদ্ধান্ত নেন।
অনেক পর্যালোচনার পর সিদ্ধান্ত হয় যে, মুক্তিযোদ্ধারা ট্রাক শ্রমিকদের ছদ্মবেশে অপারেশন সম্পন্ন করবেন। অপারেশনের সময়টা হবে শেষ রাত, কারণ তখন পাকসেনারা স্বাভাবিকভাবেই কিছুটা অপ্রস্তুত অবস্থায় থাকে এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থাও অনেকটা শিথিল থাকে। পরিকল্পনা অনুযায়ী মুক্তিযোদ্ধারা একজন ট্রাক ড্রাইভারকে তাঁদের সঙ্গে নিযুক্ত করেন। মুহুরিপাড়া থেকে একটি ট্রাক সংগ্রহ করে তার নম্বরপ্লেট ও সামনের দিকের রং বদলে ফেলা হয়। ড্রাইভারের আসনে বসেন মুক্তিযোদ্ধা ফিরোজ আহমদ। তিনি শ্রমিক লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এবং একসময় ইপিআর-এর গাড়ি চালাতেন। তাঁর সহকারী হিসেবে ট্রাকে ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা এনামুল হক দানু ও ইমাম শরীফ। এছাড়া ট্রাকের ওপরে পাটাতনের নিচে কেসি-১ (কর্ণফুলী কনটিজেন্স) ও এফএফ গ্রুপের আরো দুজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। ট্রাকটি পেট্রোল পাম্পের বামদিক দিয়ে 5 ঘুরে ডানদিকে এসে পাম্পের সামনে দাঁড়ায়। পাম্পে তখন কোনো গাড়ি ছিল না। সামনের রাস্তা ফাঁকা। নিরাপত্তা রক্ষীরা তেমন তৎপর ছিল না। একজন বিহারি কর্মচারী এগিয়ে এলে ফিরোজ আহমদ খাঁটি উর্দুতে বলেন ট্রাকে পেট্রোল ভরতে। পেট্রোল ভরা শেষ হলে রশিদ আনার জন্য লোকটি অফিসের ভেতরে যায়। ঠিক তখনই ফিরোজ আহমদ গাড়ি থেকে নেমে ম্যাচের কাঠি জ্বালিয়ে পেট্রোল পাম্পে ফেলে দেন। একই সঙ্গে অনেকগুলো গ্রেনেডও চার্জ করা হয়। পাম্পের কিছুটা সামনেই ছিল পাকিস্তানিদের সেনা ছাউনি। সেখানেও দুটি গ্রেনেড চার্জ করা হয়। এরপর পাকসেনারা কিছু বুঝে ওঠার আগেই ফিরোজ আহমদ মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ট্রাক চালিয়ে বন্দর কলোনিতে ঢুকে পড়েন এবং সরু রাস্তা ধরে চলে যান বড়পুলের কাছে। সেখানে ট্রাকটি ফেলে তাঁরা চলে যান আনন্দবাজার।
এ অপারেশনে হানাদারদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। পেট্রোল পাম্পের সব কর্মী নিহত হয়। সেনা ছাউনির ঘুমন্ত সৈনিকদের অনেকেই নিহত এবং বাকিরা আহত হয়। পুরো এলাকা ছিল যেহেতু বিহারিদের নিয়ন্ত্রণে, তাই পাকিস্তানি সেনারা সেখানে কোনো একশন চালাতে পারেনি। শুধুমাত্র একজন জটাধারী ভিক্ষুককে গোয়েন্দা ভেবে গ্রেপ্তার করে। কিন্তু তাকে অনেক নির্যাতন করেও মুক্তিযোদ্ধাদের সম্পর্কে কোনো তথ্য আদায় করতে পারেনি।
কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে এমন একটি দুঃসাহসিক অপারেশনের ফলে বন্দর ও কাস্টমস হাউজ উভয় প্রতিষ্ঠানে কাজকর্ম ও মানুষের যাতায়াত কমে যায়। বন্দর জেটিতে কাজকর্ম একেবারেই বন্ধ হয়ে যায়। সকাল থেকে সামরিক ও নৌসেনাদের আনাগোনা বেড়ে যায়। কাস্টমস ও বন্দর কর্তৃপক্ষের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে সেনা ও নৌকর্মকর্তাদের কয়েকবার বৈঠক হয়। কাজে অবহেলার জন্য পাকিস্তানি নৌসেনারা আলশামস গ্রুপের সদস্যদের বেদম প্রহার করে। এ অপারেশনের ফলে পাকিস্তানি সৈন্যরা আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। বিশেষ করে নৌ- নিরাপত্তা নিয়ে তাদের শঙ্কা বেড়ে যায়। স্থানীয় আলবদর, রাজাকার ও আলশামস বাহিনীর প্রতি তাদের আস্থা হারিয়ে ফেলে। অপরদিকে, বিহারিরা বন্দর কলোনির বাইরে আসা বন্ধ করে দেয়। তাদের মধ্যে পাকিস্তানে চলে যাওয়ার হিড়িক পড়ে এবং ডিসেম্বরের প্রথম দিকে বেশির ভাগ বিহারি জাহাজে করে পাকিস্তান চলে যায়। এলাকার লোকজন তাদের অত্যাচার থেকে অনেকটা রক্ষা পায়। মুক্তিযোদ্ধাদের সাহস ও মনোবলও বৃদ্ধি পায়। [সাখাওয়াত হোসেন মজনু]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৩য় খণ্ড