চট্টগ্রাম কোতোয়ালি থানা অপারেশন (চট্টগ্রাম মহানগর)
চট্টগ্রাম কোতোয়ালি থানা অপারেশন (চট্টগ্রাম মহানগর) পরিচালিত হয় নভেম্বর মাসে। এ থানার অবস্থান শহরের মূল কেন্দ্রে। এর সামনে সিডিএ ভবন, হযরত শাহসুন্দর (র.)-এর মাজার ও হযরত শাহজালাল (র.)-এর চিল্লা শরীফ; উত্তরে বাংলাদেশ ব্যাংক (তৎকালীন স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তান), কোর্ট বিল্ডিং, জেলা পরিষদ ভবন, লালদিঘি ময়দান, পুলিশ সদর দপ্তর ও ঐতিহ্যবাহী মুসলিম হাইস্কুল এবং পশ্চিমে নিউমার্কেট ও প্রধান ডাকঘর। থানার পাশে ছয় রাস্তার মিলনকেন্দ্র এবং একটি রাস্তা চলে গেছে দক্ষিণে পাথরঘাটা, আসাদগঞ্জ, ঐতিহ্যবাহী সাদুর মিষ্টির দোকান ও ফিরিঙ্গি বাজার হয়ে কর্ণফুলী নদীর পাড়ে।
এ থানাকে কেন্দ্র করে পাকবাহিনীর তৎপরতা ছিল সর্বাধিক। পুলিশের পাশাপাশি সামরিক বাহিনীরও অবস্থান ছিল এখানে। সেনাদের সঙ্গে আলশামস গ্রুপের সদস্যদের সখ্য ছিল, তাই তারা যখন-তখন এখানে আসা-যাওয়া করত। পাকসেনাদের সহায়তায় তারা পাথরঘাটা, ফিরিঙ্গি বাজার, আলকরণ প্রভৃতি এলাকা থেকে নারীদের তুলে এনে চালান করে দিত সার্কিট হাউজ, সার্সন রোডের বাংলো ও সেনানিবাসে। এছাড়া প্রতিদিনই কোনো-না-কোনো এলাকা থেকে মানুষজনদের ধরে এনে নির্যাতন করত এবং কাউকে- কাউকে হত্যা করে নদীতে ফেলে দিত। এর প্রধান শিকার ছিল নদীর দক্ষিণ পাড়ের লোকজন।
কোতোয়ালি থানাকে কেন্দ্র করে পাকসেনাদের অবস্থান ছিল ফিরিঙ্গি বাজারের মুখে, স্টেট ব্যাংক ও কোর্ট বিল্ডিং-এ, পুলিশ সদর দপ্তরে এবং প্রধান ডাকঘর এলাকায়। এসব স্থানে তারা নিয়মিত পাহারা দিত এবং পথচারীদের তল্লাসি করত। যাদের সন্দেহ হতো তাদের ধরে নেয়া হতো কোতোয়ালি থানায়। একাজে পাকসেনাদের সাহায্য করত বাঙালি- অবাঙালি কিছু দালাল। তারাই বেশি তৎপরতা চালাত। পাকসেনা ও দালালদের হাতে অনেক নারী-পুরুষ নির্যাতন ও হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়ার পর শহরের মুক্তিযোদ্ধারা এর প্রতিশোধ নেয়ার জন্য থানায় গ্রেনেড চার্জ ও থানা সংলগ্ন বিদ্যুৎ ট্রান্সফরমারটি উড়িয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। নভেম্বর মাসে এ-দুটি অপারেশন সম্পন্ন হয়।
একই সঙ্গে দুটি কঠিন ও ঝুঁকিপূর্ণ অপারেশন পরিচালনা করার জন্য সাব্বির, রফিক, এয়াকুব ও টুনু এই চারজন মুক্তিযোদ্ধার সমন্বয়ে একটি দল গঠন করা হয়। অপারেশনের পরিকল্পনা হিসেবে তাঁরা ঠিক করেন বিদ্যুৎ ট্রান্সফরমারে বিস্ফোরক বসাবেন এবং চলে যাওয়ার সময় থানায় গ্রেনেড চার্জ করবেন। এরূপ চিন্তা করে তাঁরা ঘটনাস্থলে দীর্ঘ রেকি করেন। কেমন করে ট্রান্সফরমারের কাছে যাওয়া যাবে, কেমন করে ট্রান্সফরমারের নিকট-দূরত্বে অবস্থিত গার্ডারে বিস্ফোরক বসানো যাবে, কারা পাহারায় থাকবেন, ফিউজে আগুন দিয়ে সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে কত সময় লাগবে, বিস্ফোরণ ঘটতে কত সময় লাগবে, বেড়িয়ে আসার সময় কেমন করে থানায় গ্রেনেড চার্জ করা হবে এসব বিষয় তাঁরা গভীরভাবে পর্যালোচনা করেন।
অপারেশনের দিন রাত ৮টায় পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী থানা এলাকায় বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ করে দেয়া হয়। মুক্তিযোদ্ধারা ট্রান্সফরমারের নিকট-দূরত্বে গিয়ে অন্ধকারের প্রতীক্ষায় ছিলেন। বিদ্যুৎ চলে যাওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে তাঁরা ট্রান্সফরমারের নিকট গিয়ে গার্ডারে বিস্ফোরক বসান এবং ফিউজের মাথায় আগুন লাগিয়ে পূর্বনির্ধারিত স্থানে চলে আসেন। হাতে সময় মাত্র ১০ মিনিট। এর মধ্যে থানায় গ্রেনেড চার্জ করতে হবে। তাই দ্রুত তাঁরা চলে আসেন থানার সামনে। রাস্তায় তখন মানুষজন ও যানবাহনের সংখ্যা খুবই কম। বিলম্ব না করে চার মুক্তিযোদ্ধা চারটি গ্রেনেড ছুড়ে মারেন থানার গেট বরাবর। গ্রেনেডগুলো গিয়ে পড়ে থানার ভেতরে বারান্দায়, যেখানে পাকসেনারা পাহারায় ছিল। প্রচণ্ড শব্দে ৪টি গ্রেনেড বিস্ফোরিত হয়। এর মধ্যে মুক্তিযোদ্ধারা নিরাপদ স্থানে চলে যান। তখনো পুরো এলাকা অন্ধকার। রাস্তার মানুষজন ভয়ে ছুটছে, চলন্ত গাড়িগুলো উল্টো দিকে ঘুরে যাচ্ছে। পাকসেনারা হতবিহ্বল। এমনি অবস্থায় প্রচণ্ড শব্দে বিস্ফোরিত হয় বিদ্যুৎ ট্রান্সফরমারটি। আকাশে আগুনের ফুলকি দেখা যায়। একই সঙ্গে মাত্র ৪ জন মুক্তিযোদ্ধা দুটি সফল অপারেশন সম্পন্ন করেন। এ অপারেশনে একজন ক্যাপ্টেনসহ ২০ জন পাকসেনা নিহত ও ২০ জন আহত হয়। এ অপারেশনের ফলে কোতোয়ালি থানার কার্যক্রম সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে যায়। গ্রেনেড বিস্ফোরণে থানার সব কাগজপত্র ধ্বংস হয়ে যায়, ইলেকট্রিক ওয়ারিং নষ্ট হয়ে যায় এবং আসবাবপত্র পুড়ে যায়। থানার সামনে পাকসেনাদের ক্যাম্পটিও ধ্বংস হয়ে যায়। পরে এটি আর পুনঃস্থাপিত হয়নি। থানার ভেতরে অবস্থানরত যানবাহনগুলো পুড়ে যায়।
অপারেশনের পরে থানায় অবস্থানরত বাঙালি পুলিশরা আর ফিরে আসেনি। তাই থানার কার্যক্রম চালানোর জন্য অন্যান্য থানা থেকে পুলিশ আনা হয়। আলবদর, রাজাকার, আলশামস ও পাকসেনারাও শহরের অন্যান্য ক্যাম্পে আশ্রয় নেয়। পাথরঘাটা, ফিরিঙ্গি বাজার ও আলকরণ এলাকা থেকেও ঘাতক বাহিনী চলে যায়। কর্ণফুলী নদীর ওপাড়ের লোকজন অপারেশনের পরে কিছুদিন এ এলাকায় আসা- যাওয়া বন্ধ রেখেছিল। পরে পাকিস্তানিদের তৎপরতা বন্ধ হয়েছে এ সংবাদ শুনে তারা পুনরায় আসতে থাকে। পাথরঘাটা এলাকায় অনেকগুলো খ্রিস্টান পরিবার ছিল। যুদ্ধের এক পর্যায়ে অনেকে বিভিন্ন এলাকায় চলে গিয়েছিল। এই অপারেশনের পরে অবস্থা কিছুটা স্বাভাবিক হলে তারা আবার ফিরে আসে। এই পথে যারা চাক্তাই, আসাদগঞ্জ ও খাতুনগঞ্জ যেত, তারা আবার এ-পথে চলাচল শুরু করে। নিউমার্কেট এলাকায় মানুষের চলাচল অনেকটা স্বাভাবিক হয়। এভাবে জনজীবনে গতি ফিরে আসে। [সাখাওয়াত হোসেন মজনু]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৩য় খণ্ড