You dont have javascript enabled! Please enable it!

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় যুদ্ধ (হাটহাজারী, চট্টগ্রাম)

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় যুদ্ধ (হাটহাজারী, চট্টগ্রাম) সংঘটিত হয় ২৮শে মার্চ। এতে ৪ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। ২৮ তারিখের পরে আশেপাশে আরো কয়েকটি খণ্ডযুদ্ধ হয়। তাতে ২৫ জন প্রতিরোধযোদ্ধা হতাহতের শিকার হন। হানাদারদের পক্ষেও বেশকিছু হতাহত হয় এবং তারা পশ্চাদপসরণ করতে বাধ্য হয়৷
২৫শে মার্চের গণহত্যার পর ইপিআর-এর ১৭নং উইং-এর ‘এ’ কোম্পানির সুবেদার আবদুল গনি চট্টগ্রাম সেক্টর থেকে ক্যাপ্টেন রফিকুল ইসলামের বিদ্রোহের সংবাদ পেয়ে কোম্পানির সকল অবাঙালিকে বন্দি করে রাঙ্গামাটির জেলা প্রশাসক এইচ টি ইমামের নিকট হস্তান্তর করেন এবং বাঙালি সৈনিকদের নিয়ে ২৬শে মার্চ রাত ১০টার দিকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় পৌঁছান। চট্টগ্রাম ও উত্তর চট্টগ্রাম থেকে আরো প্রায় ২৫০ জন ইপিআর সৈনিক এসে তাঁদের সঙ্গে যোগ দেন। সুবেদার আবদুল গনি নিকটস্থ সেনানিবাস থেকে পাকিস্তানি সৈন্যদের অগ্রাভিযানকে প্রতিরোধ করার জন্য সেনানিবাসের উত্তর-পূর্ব পাশে অবস্থান নেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপচার্য ড. এর আর মল্লিক এবং বাংলা বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ আলী আহসান ও ড. আনিসুজ্জামান ইপিআর বাহিনীর সাহায্যে এগিয়ে আসেন। তাঁরা সৈনিকদের আহার এবং অন্যান্য জিনিসপত্র সরবরাহের ব্যবস্থা করেন। এমন সময় আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুল ওয়াহাব মিয়া এমপিএ, রাঙ্গামাটির জেলা প্রশাসক এইচ টি ইমাম, মহকুমা প্রশাসক, এসপি প্রমুখও মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্যে এগিয়ে আসেন। সেনাদের প্রয়োজনীয় জিনিসের সরবরাহ ব্যবস্থা যাতে অব্যাহত থাকে সেজন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়। স্থানীয় জনগণও এ-কাজে সহায়তা করে। সুবেদার আবদুল গনি নামে একজন ইপিআর জেসিও পাকবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ করার আনুষ্ঠানিক শপথ গ্রহণ করেন। সবদিক বিবেচনা করে ক্যান্টনমেন্টের উত্তরে ট্রেঞ্চ খনন করে ইপিআর জওয়ানদের পোস্ট করা হয়। প্রতিদিন তাঁদের প্যাকেট খাবার পাঠানো হতো। সন্ধ্যায় এক গ্রুপের বদলে আরেক গ্রুপকে পাঠানো হতো। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা গবেষণাগারে হাতবোমা, গ্রেনেড ইত্যাদি তৈরি করে তা পাকিস্তানি হানাদারদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হয়। এভাবে ২৫শে মার্চের পর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে পরিণত হয়।
২৭শে মার্চ ভোর ৪টার দিকে ইপিআর জওয়ানদের ক্যান্টনমেন্টের উত্তর ও উত্তর-পূর্ব কোণে নিয়োগ করা হয়। এর কয়েক ঘণ্টার মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় ঘাঁটিতে এসে যোগ দেন আরো দুই দল ইপিআর। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের কিছু সৈন্যও এসে তাঁদের সঙ্গে যোগ দেন। ফলে তাঁদের সংখ্যাক্যান্টনমেন্টের পূর্বদিকে আরো কয়েকটি ট্রেঞ্চ খনন করে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পূর্বদিকে মাইল খানেক দূরে হাটহাজারীর এক গ্রামে অয়ারলেস যোগাযোগ কেন্দ্র স্থাপন করা হয়। সেনানিবাসের দুপাশ ঘিরে ইপিআর মোতায়েন করা হয়। উপাচার্যের কার্যালয় কার্যত এক ধরনের সমর দপ্তরে পরিণত হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ছাত্র এবং স্থানীয় জনতা নেতৃবৃন্দের আহ্বানে অসহযোগ আন্দোলন- ও মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে সশস্ত্র ট্রেনিং-এর পাশাপাশি বিস্ফোরক দ্রব্য সংগ্রহ করে বিশ্ববিদ্যালয় দাঁড়ায় ৩৬০ জনে। ইতোমধ্যে ইউনিভার্সিটি অফিসার্স ট্রেনিং কোরের ক্যাডেটদের নিয়ে একটি প্রতিরক্ষা ঘাঁটি স্থাপন করা হয়। সমবেত যোদ্ধাদের নিয়ে অবিরাম পাকিস্তানি হানাদারদের প্রতিরোধে নেতৃত্ব দেন উপাচার্য এ আর মল্লিক।
২৮শে মার্চ দুপুর একটার দিকে ক্যান্টনমেন্টের উত্তর-পূর্ব পাশে ইপিআর সুবেদার গনির অবস্থানের ওপর পাকিস্তান সেনাবাহিনী আর্টিলারি, ট্যাংক, মর্টার এবং বিমান নিয়ে ব্যাপক আক্রমণ চালায়। প্রতিরোধযোদ্ধারাও পাল্টা জবাব দেন। তিন ঘণ্টার তুমুল যুদ্ধে শত্রুসেনারা পিছু হটতে বাধ্য হয়। তবে ইপিআর প্লাটুন কমান্ডার নায়েব সুবেদার নাজির আহমদ ও অপর ৩ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ এবং ইপিআর বাহিনীর বেশকিছু সৈন্য গুরুতররূপে আহত হন।
২৮শে মার্চ সম্মুখ যুদ্ধের পর প্রতিরোধযোদ্ধা ও পাকিস্তানি হানাদারদের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের উত্তর ও পূর্ব পার্শ্বে বেশ কয়টি সম্মুখ যুদ্ধ হয়। তাতে প্রায় ২৫ জন প্রতিরোধযোদ্ধা হতাহতের শিকার হন। হানাদারদের পক্ষে বেশকিছু হতাহত হওয়া ছাড়াও তাদের বেশ কয়েকটি যানবাহন প্রতিরোধযোদ্ধারা জ্বালিয়ে দেন। এ পরিস্থিতিতে উপাচার্য এ আর মল্লিক তাঁর ৪৪ জন সহকর্মীকে নিয়ে ২৯শে মার্চ রাউজানের নূতন চন্দ্র সিংহ- প্রতিষ্ঠিত কুণ্ডেশ্বরী ভবনে গিয়ে আশ্রয় নেন। সেখান থেকে ৭ই এপ্রিল তাঁরা ভারতের উদ্দেশে রওনা হন।
এদিকে ইপিআর যোদ্ধাদের সঙ্গে পাকিস্তানি হানাদারদের যুদ্ধের তীব্রতা এতই ভয়াবহ রূপ নেয় যে, ৩০ও ৩১শে মার্চ বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পরিবারগুলোকে পার্শ্ববর্তী গ্রামে সরিয়ে নেয়া হয়। আর শিক্ষকদের নিরাপদে সরিয়ে দিয়ে ইপিআর সৈনিকরা বিশ্ববিদ্যালয় ঘাঁটি থেকে পাকিস্তানি হানাদারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যান। ক্যাপ্টেন রফিকুল ইসলাম অস্ত্রশস্ত্র ও গোলা-বারুদ সংগ্রহের জন্য ২রা এপ্রিল রামগড় সীমান্ত দিয়ে ভারতে যান এবং অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ৪ঠা এপ্রিল বাংলাদেশে প্রবেশ করেন। ৫ই এপ্রিল তিনি ফটিকছড়ি থানার উদালিয়া চা-বাগানে অবস্থান নেন এবং লে. এজাজকে সেখানে রেখে কালুরঘাটের দিকে অগ্রসর হন। হানাদাররা চট্টগ্রাম শহর দখল করে নিলেও বাঙালি সৈনিকরা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ও ক্যান্টনমেন্টের উত্তরে এমন সব প্রতিরক্ষাব্যূহ গঠন করেন, যার ফলে পাকিস্তানিদের আক্রমণ বাধাগ্রস্থ হয় এবং বিশ্ববিদ্যালয় ঘাঁটি ১২ই এপ্রিল পর্যন্ত অটুট থাকে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় যুদ্ধের শুরু থেকে সবকিছুর নেতৃত্বে ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এ আর মল্লিক। তাঁর সহায়তায় এগিয়ে আসেন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক প্রফেসর অনুপম সেন, বিশ্ববিদ্যালয় সংগ্রাম পরিষদের যুগ্ম-আহ্বায়ক অধ্যাপক ফজলী হোসেন ও অধ্যাপক মাহবুব তালুকদার। সংগ্রাম পরিষদের সদস্য ড. এখলাস উদ্দিন আহমদ, ড. আনিসুজ্জামান, অধ্যাপক হুজ্জাতুল ইসলাম লতিফি, অধ্যাপক সৈয়দ আলী আহসান, অধ্যাপক খলিলুর রহমান, অধ্যাপক রশিদ চৌধুরী, ড. বদরুদ্দোজা, ড. রফিকুল ইসলাম চৌধুরী, অধ্যাপক সুধীর রঞ্জন সেন, অধ্যাপক রফিক উদ্দিন আহমদ প্রমুখ শিক্ষক চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও হাটহাজারী এলাকায় স্বাধীনতার পক্ষে অনন্য ভূমিকা রাখেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রবেশদ্বার ও মূল ক্যাম্পাসে একাধিক স্মৃতিস্তম্ভ ও ম্যুরাল নির্মাণ করা হয়েছে। [জামাল উদ্দিন]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৩য় খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!