মুক্তিযুদ্ধে চকরিয়া উপজেলা (কক্সবাজার)
চকরিয়া উপজেলা (কক্সবাজার) বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ-এর পর চকরিয়ায় ১০ই মার্চ আলহাজ এস কে শামসুল হুদা ও ডা. শামসুদ্দিন চৌধুরীকে যথাক্রমে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক করে ৩১ সদস্য বিশিষ্ট সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। এ পরিষদের অন্য সদস্যরা ছিলেন আলহাজ্ব আনোয়ার হোসেন কন্ট্রাক্টর, হাজী আবু তাহের, মফজল আহমদ সওদাগর, মাস্টার আবদুল মালেক, জমির উদ্দিন আল মোজাহিদ, তাহের আহমদ, মোহাম্মদ আলী (হারবাং) এনামুল হক চৌধুরী (কাকারা), আবুল হাশেম বিএসসি (বিএমচর), নুরুল ইসলাম চৌধুরী (টৈটং), নুরুল আবছার হেলালী (খুটাখালী), মাস্টার নুরুল ইসলাম (বিনামারা), মৌলানা নুরুল হোছাইন (ভরামুহুরী), নজির আহমদ (দিগরপানখালী), কে এম এ জলিল চৌধুরী (কৈয়ারবিল), জুবাইর আহমদ বিএসসি (বদরখালী), এডভোকেট কামাল হোসেন (পেকুয়া) প্রমুখ। একই দিন ১১ সদস্যবিশিষ্ট একটি ছাত্র সংগ্রাম পরিষদও গঠন করা হয়। এ কমিটির নেতৃত্বে ছিলেন আনোয়ারুল হাকিম দুলাল ও রেজাউল করিম চৌধুরী। পরে এস এম সিরাজুল হকের নেতৃত্বে গঠিত হয় চকরিয়া থানা জয় বাংলা বাহিনী। এ বাহিনীর সদস্যরা ছিলেন খাইরুল আলম মজনু, আবু তাহের (খিলছাদক), শিব্বির আহমদ (ফাঁসিয়াখালী), গিয়াস উদ্দিন (চিরিঙ্গা), সামশুল আলম (বরইতলী), এনামুল হক (ভরামুহুরী), আবু ছৈয়দ, মুহাম্মদ ইছহাক, মোহাম্মদ উল্লাহ, নজির আহমদ, মোহাম্মদ বেলায়ত প্রমুখ। এ তিন বাহিনীর নেতৃত্বে চকরিয়া স্বাধীনতা আন্দোলন চলতে থাকে। চকরিয়া থানা সদরের চিরিঙ্গা ওয়াপদা রোডস্থ ডা. হালিমের চেম্বারে স্থাপন করা হয় কন্ট্রোল রুম।
সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের সিদ্ধান্তক্রমে ১১ই মার্চ চকরিয়া হাইস্কুল মাঠে মুক্তিযুদ্ধের প্রাথমিক প্রশিক্ষণ শুরু হয়। প্রশিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন গোলাম কাদের, আশরাফ উদ্দিন, হাবিলদার আবুল কালাম, সার্জেন্ট মিজবাহ, মঞ্জুর আলম এবং রেজাউল করিম। এখানে দু-শতাধিক মুক্তিযোদ্ধা প্রাথমিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। এর ২-৩ দিন পরে ডুলাহাজরা হাইস্কুল মাঠ, বিএমচর হাইস্কুল মাঠ, চিরিংগা সিসি মাঠ, পেকুয়া বাজার মাঠ এবং হারবাং হাইস্কুল মাঠেও প্রশিক্ষণ চলে। এসব কেন্দ্রে প্রশিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন গোলাম কাদের, আশরাফ উদ্দিন, সার্জেন্ট মিজবাহ, মঞ্জুর আলম এবং রেজাউল করিম। পরবর্তীকালে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা ভারতের মিজোরাম রাজ্যের দেমাগ্রিতে গিয়ে উচ্চতর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন।
২০শে মার্চ রাতে সংগ্রাম পরিষদের নির্দেশে চকরিয়া থানা থেকে ১২টি রাইফেল ও কিছু গোলাবারুদ সংগ্রহ করা হয়। রাইফেলগুলো রশিদুল হক থানা থেকে স্বাক্ষর দিয়ে গ্রহণ করেন। ২৩শে মার্চ সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে আয়োজিত ঐতিহাসিক চকরিয়া আমতলার সমাবেশে প্রধান অতিথি এম আর সিদ্দিকী এমএনএ জয় বাংলা বাহিনী ও স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত তিন শতাধিক সদস্যের অভিবাদন গ্রহণ করেন।
২৫শে মার্চ রাতে নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর পাকবাহিনীর সশস্ত্র আক্রমণের পর বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে দেশব্যাপী মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। চকরিয়ার মানুষও এ-যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ২৬শে মার্চ সকালে সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে থানা থেকে আরো ১৮টি রাইফেল ও গোলাবারুদ সংগ্রহ করা হয়। চকরিয়া থানা অপারেশন- থেকে সংগৃহীত রাইফেলগুলো মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ ও পরে যুদ্ধে ব্যবহৃত হয়।
২রা এপ্রিল চকরিয়া থানা, অফিস-আদালত ও চিরিংগা বাণিজ্যিক এলাকার দোকানপাটে পাকিস্তানি পতাকা নামিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। এ-সময় কতিপয় পাকিস্তানি দালাল ও পুলিশের সঙ্গে সংগ্রাম পরিষদের সংঘর্ষ হয়। অতঃপর থানার সর্বত্র স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করা হয়। এদিন থেকেই চকরিয়া থানা মিলনায়তনে (বর্তমান মোহনা) শুরু হয় মুক্তিযোদ্ধাদের সশস্ত্র প্রশিক্ষণ। এতে অংশগ্রহণ করেন রশিদুল হক, বিমান বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত সদস্য কবির আহমদ, মাস্টার আহমদ হোসেনসহ ১৫ জন।
২৬শে মার্চের পরে চট্টগ্রামের দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলে পাকবাহিনীর আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য মেজর মীর শওকত আলীর নেতৃত্বে ৮ম বেঙ্গল রেজিমেন্টের একটি দল চট্টগ্রামের কালুরঘাটে অবস্থান নেয়। চকরিয়া সংগ্রাম পরিষদের নির্দেশে হাবিলদার জোনাব আলীর নেতৃত্বে ইপিআর-এর একটি দলও তাঁদের সঙ্গে যোগ দেয়। শওকত আলীর দলটি পরে পটিয়ায় চলে যায়। কালুরঘাটে অবস্থানকারী মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য চকরিয়ার প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে খাদ্যসামগ্রী পাঠানো হয়। এজন্য নুরুল কাদের বিকম (স্বাধীনতার পরে উপজেলা আওয়ামী লীগ-এর সাবেক সভাপতি), বিনামারার মাস্টার আজিজুর রহমান প্রমুখ মাইকিং করে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে প্রচারণা চালানোর পাশাপাশি জনসাধারণের কাছ থেকে খাদ্য ও অর্থ সংগ্রহ করেন। এছাড়া যুবকরাও পাড়ায়-পাড়ায় গিয়ে চাল সংগ্রহ করে। এভাবে সংগৃহীত অর্থ ও খাদ্যসামগ্রী ২৮শে মার্চ থেকে ১৩ই এপ্রিল পর্যন্ত কালুরঘাট, পটিয়া ও অন্যান্য এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য পাঠানো হয়।
উপর্যুক্ত নেতৃবৃন্দ চকরিয়া উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকের ভূমিকা পালন করেন। আর কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন হাবিলদার আবুল কালাম, আবদুল হামিদ (গেরিলা কমান্ডার), নজির আহমদ, (গেরিলা কমান্ডার), মোহাম্মদ আলী (গেরিলা কমান্ডার), মাহাবুবুর রহমান, দিদারুল আলম (বেলাল), সৈয়দ নুর মোহাম্মদ, এ জেড এম তাহের উদ্দিন, নায়েক বদিউল আলম (স্থানীয়ভাবে গঠিত গ্রুপ কমান্ডার), আহমদ হোসেন সিকদার (স্থানীয়ভাবে গঠিত গ্রুপ কমান্ডার), বোরহান উদ্দিন রিদুয়ান (স্থানীয়ভাবে গঠিত গ্রম্প কমান্ডার), করপোরেল মোজাম্মেল হক (স্থানীয়ভাবে গঠিত গ্রুপ কমান্ডার), গোলাম কাদের, এ এইচ সালাহ উদ্দিন মাহমুদ (কক্সবাজার মহকুমা <বিএলএফ- কমান্ডার) প্রমুখ। এঁদের মধ্যে প্রথম সাতজন ছিলেন ভারত থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত।
চকরিয়ায় পাকবাহিনীকে প্রতিহত করার লক্ষ্যে ২৩শে এপ্রিল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ইউটিসি-র (বর্তমান বিএনসিসি) ক্যাপ্টেন ফরহাদ ও সুবেদার লতিফের নেতৃত্বে বানিয়ারছড়া ও ফাসিয়াখালী পাহাড়ে এম্বুশ করা হয়। এতে বেশ কয়েকজন ইপিআর সদস্য ও মুক্তিযোদ্ধা অংশ নেন। এছাড়া মাতামুহুরী ব্রিজের নিচেও প্রতিরোধ গড়ে তোলা হয়। চট্টগ্রামে যখন প্রতিরোধযুদ্ধ চরছিল তখন আরাকান সড়ক (চট্টগ্রাম-কক্সবাজার সড়ক) জুড়ে ছিল ব্যারিকেড। রাস্তায় ইট, পাথর ও তেলের ড্রাম ফেলে ব্যারিকেড দেয়া হয়। পাশাপাশি সশস্ত্র পাহারাও বাসানো হয়, যাতে পাকবহিনী অগ্রসর হতে না পারে। ফলে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা সম্পূর্ণরূপে বন্ধ হয়ে যায়। চকরিয়ার মাতামুহুরী ব্রিজের নিচেও বসানো হয় পাহারা। পাকবাহিনীর আগমনের কয়েকদিন আগ পর্যন্ত প্লাটুন কমান্ডার মোজাম্মেল হকের নেতৃত্বে এ পাহারা চলতে থাকে। ২৭শে এপ্রিল সকালে পাকসেনাদের আগমনের খবর পেয়ে কয়েকশ লোক লোঠিসোটা নিয়ে ছিকলঘাট এলাকায় জড়ো হয়। কিন্তু ভারী অস্ত্রে সজ্জিত পাকবাহিনীকে এভাবে প্রতিরোধ করা সম্ভব নয় দেখে নেতৃবৃন্দের নির্দেশে তারা সরে যায়। ফলে বিনা বাধায় পাকবাহিনী চকরিয়ায় প্রবেশ করে। তবে এখানে তারা কোনো স্থায়ী ক্যাম্প স্থাপন করেনি, মাঝে-মধ্যে কক্সবাজার থেকে এসে অপারেশন চালাত।
চকরিয়া উপজেলায় পিডিপি- নেতা আলহাজ্ব আজিজুর রহমান (পরবর্তীতে মুসলিম লীগ নেতা আলহাজ্ব আব্বাস আহমদ)-কে সভাপতি এবং চিরিংগা ইউপি চেয়ারম্যান রুহুল কাদের চৌধুরীকে সম্পাদক করে শান্তি কমিটি গঠন করা হয়। এরা চকরিয়ায় মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি, থানায় অপারেশন, মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং, কালুরঘাট প্রতিরোধযুদ্ধে অংশগ্রহণ, থানা অফিসসহ সর্বত্র স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন ইত্যাদি অভিযোগে চকরিয়ায় পাকবাহিনীকে প্রতিরোধকারী মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের ৩০২ জনকে আসামি করে একটি মামলা রুজু করে।। আসামিদের তালিকায় নাম ছিল এমন ৫২ জনের মধ্যে 5 কয়েকজন হলেন এডভোকেট জহিরুল ইসলাম এমপিএ, আলহাজ এস কে শামসুল হুদা, নুরুল হক, তাহের আহমদ মাজু, ডা. শামসুদ্দিন চৌধুরী, করপোরেল মোজাম্মেল হক, মাস্টার শামসুল হুদা বিএসসি, অধ্যক্ষ আকবর আহমদ, অধ্যাপক মমতাজ উদ্দিন আহমদ চৌধুরী, রেজাউল করিম চৌধুরী (রাজা মিয়া), মাস্টার নুরুল কবির, অধীর চন্দ্র শীল, ইছহাক আহমদ কন্ট্রাক্টর, আনোয়ারুল হাকিম দুলাল, হাবিলদার আবুল কালাম প্রমুখ।
পাকসেনারা ২৭শে এপ্রিল চকরিয়ায় প্রবেশ করেই স্থানীয় 1 দোসরদের সহায়তায় ধ্বংসযজ্ঞে মেতে ওঠে। তারা চিরিংগা-লক্ষ্যারচর এলাকায় হিন্দু সম্প্রদায় এবং আওয়ামী – লীগ নেতা-কর্মীদের বাড়িতে আগুন দেয়। চিরিংগা। হিন্দুপাড়ায় প্রায় সত্তরটি বাড়িতে লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগ করে। আবুল হোসেন (মুদি দোকানদার ও মুক্তিযোদ্ধার 5 ভাই), পরিতোষ দাশ (দশম শ্রেণির ছাত্র), রমণী নাথ দে, T সুরেন্দ্র নাথ দে ও মণীন্দ্র লাল দে সহ কয়েকজনকে গুলি 1 করে হত্যা করে। এটি চিরিঙ্গা হিন্দুপাড়া গণহত্যা- নামে 1 পরিচিত। গণহত্যাকালে পলায়নরত মহিলাদের বিবস্ত্র করে न তাদের স্বর্ণালঙ্কার ও নগদ অর্থ ছিনিয়ে নেওয়া হয়। ২৯শে – এপ্রিল করপোরেল মোজাম্মেল হক ও অধ্যাপক রশিদ = আহমদের বাড়ি জ্বালিয়ে দেয়। পরবর্তীকালে চকরিয়া, নাথপাড়া, ভরামুহুরী, বাটাখালী, বরইতলী, হারবাং, ডুলাহাজরা, দিগরপানখালী, আজিজনগর ম্যাচ ফ্যাক্টরি, পূর্ব বড়ভেওলা প্রভৃতি এলাকায়ও গণহত্যা, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট চালায়। ১২ই মে দিগরপানখালী হিন্দুপাড়া হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়। এতে ৩ জন মানুষ শহীদ ও বেশ কয়েকজন হানাদারবাহিনীর নির্যাতনের শিকার হন। নভেম্বর মাসে আজিজনগর ম্যাচ ফ্যাক্টরিতে পাকিস্তানি হানাদাররা অপর এক গণহত্যা সংঘটিত করে, যা আজিজনগর ম্যাচ ফ্যাক্টরি গণহত্যা নামে পরিচিত। সব মিলিয়ে এ উপজেলায় প্রায় তিন শতাধিক ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেয়, আট শতাধিক ঘরবাড়িতে লুটপাট চালায় এবং ৪-৫ জন নারীকে ধর্ষণ করে। সাবের (সাংবাদিক), পিয়ারী মহাজন (ধনাঢ্য ব্যক্তি), যতীন্দ্র নাথ দে (রৌপ্য ব্যবসায়ী), অনিল কান্তি দাশ (রৌপ্য ব্যবসায়ী), কিরণ চন্দ্র দাশ, দীনবন্ধু চৌধুরী ও ফজলুল হক (ফজু খলিফা, কাপড় ব্যবসায়ী) নামে আরো সাতজনকে হত্যা করে।
চকরিয়া উপজেলায় ওয়াপদা অফিস ছিল পাকবাহিনীর নির্যাতনকেন্দ্র ও বন্দিশিবির। এছাড়া কক্সবাজারের রেস্ট হাউজ ও টেকনাফের সমুদ্রচরকে হানাদার বাহিনী এতদঞ্চলের নির্যাতনকেন্দ্র ও বন্দিশিবির হিসেবে ব্যবহার করত। এসব স্থানে চকরিয়াসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে নিরীহ লোকজনদের ধরে এনে নির্যাতন করা হতো।
চকরিয়ায় স্থানীয় বাহিনীসমূহের মধ্যে আবদুল হামিদ বাহিনী, সুলতানুল কবির বাহিনী, ক্যাপ্টেন আবদুস সোবহান বাহিনী, রবিউল আলম বাহিনী, ইদ্রিস বাহিনী, মাহবুবুর রহমান বাহিনী ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। মুক্তিযুদ্ধের সময় এসব বাহিনী বিশেষ অবদান রাখে। আবদুল হামিদ বাহিনীর নেতৃত্বে ছিলেন চকরিয়ার সন্তান চট্টগ্রাম কমার্স কলেজের ছাত্র ও ছাত্রলীগ নেতা আবদুল হামিদ। তাঁর চ বাহিনী লামা, আলীকদম, চকরিয়ায় অনেকগুলো সফল অপারেশন পরিচালনা করে। এছাড়া সাব-কমান্ডার ক্যাপ্টেন আবদুস সোবহানের নেতৃত্বে ২রা নভেম্বর মুক্তিযোদ্ধারা B চকরিয়ার ডুলহাজারা ব্রিজে পাকিস্তানি হানাদারদের দোসর 1. পুলিশ ও রাজাকারদের বিরুদ্ধে একটি সফল অপারেশন পরিচালনা করেন, যা ডুলহাজারা লাল ব্রিজ অপারেশন- নামে পরিচিত। এতে একজন রাজাকার নিহত, কয়েকজন রাজাকার ও পুলিশ আহত এবং বেশ কিছু অস্ত্র। মুক্তিযোদ্ধাদের হস্তগত হয়। পাকবাহিনীর পরাজয় লক্ষ্য করে তাদের স্থানীয় দোসররা ডিসেম্বরের শুরুতে আত্মগোপনে যেতে থাকে এবং ১১ই ডিসেম্বর চকরিয়া উপজেলা মুক্তাঞ্চল হিসেবে ঘোষিত হয়।
দেশের বিভিন্ন স্থানে যুদ্ধে শাহাদত বরণকারী চকরিয়া উপজেলার মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- হাবিলদার আবুল কালাম (বাটাখালী; অবসরপ্রাপ্ত সেনাসদস্য, ভারতের দেমাগ্রিতে প্রশিক্ষণ নিয়ে ফেরার পথে সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ), মো. এনামুল হক (পিতা আলহাজ মৌলভী আবুল ফজল, কৈয়ারবিল; ৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সিপাহি, ভারতের দেমাগ্রিতে প্রশিক্ষণ নিয়ে ফেরার পথে সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ), সুবেদার গোলাম সাত্তার (পিতা আবদুল অদুদ, হারবাংকালা সিকদারপাড়া; ২৪শে মার্চ চট্টগ্রাম বন্দরে অস্ত্র খালাসের প্রতিবাদ করায় পাকসেনাদের হাতে শহীদ), আকতার হোসেন (পিতা হেদায়ত আলী, কৈয়ারবিল; ২৪শে মার্চ চট্টগ্রাম বন্দরে অস্ত্র খালাসের প্রতিবাদ করায় পাকসেনাদের হাতে শহীদ), গোলাম কাদের (পিতা আমজাদ আলী, পালাকাটা; পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং কোরের সদস্য, ২৭শে মার্চ কুমিল্লা ময়নামতি ক্যান্টমেন্টে পাকসেনাদের হাতে শহীদ), আকবর আহমদ (পূর্ব বড়ভেওলা) এবং আবদুল হামিদ- (পিতা আবদুল ফাত্তাহ, বমু বিলছড়ি; গেরিলা কমান্ডার; বন্দী অবস্থায় পাকিস্তানি হানাদারদের হাতে নিশংসভাবে শহীদ।
চকরিয়ায় মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতিরক্ষায় বেশকিছু উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। চকরিয়ার কাকারাস্থ শাহ উমর (র:)-এর মাজারের পার্শ্বস্থ কবরস্থানে শহীদ মুক্তিযোদ্ধা আবদুল হামিদের কবরে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়েছে, যাতে লেখা রয়েছে ‘যাঁদের রক্তে মুক্ত এদেশ’। তাঁর নামে চট্টগ্রাম কমার্স কলেজ ও চকরিয়া কলেজের দুটি ছাত্রাবাসের নামকরণ করা হয়েছে। কক্সবাজার পাবলিক লাইব্রেরি কর্তৃপক্ষ তাঁদের পাঠাগারের নামকরণ করেছেন ‘শহীদ আবদুল হামিদ পাঠাগার’। চকরিয়া পৌরসভা কর্তৃপক্ষ নবনির্মিত বাসটার্মিনালের নামকরণ করেছেন তাঁর নামে। এছাড়া বিএমচরে নায়েক বদিউল আলমের নামে, কাকারায় আলহাজ আনোয়ার হোসেনের নামে, সুরাজপুরে নজির আহমদের নামে, লক্ষ্যারচরে আনোয়ার হোসেন বাঙ্গালীর নামে, ডুলাহাজরায় এস এম কামাল উদ্দিন ও হাজী মফজল আহমদের নামে এবং পূর্ব বড়ভেওলায় আকবর আহমদের নামে একটি করে সড়কের নামকরণ করা হয়েছে। [এ কে এম গিয়াসউদ্দিন]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৩য় খণ্ড