You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.10.27 | ঘুইঙ্গার হাটের যুদ্ধ (দৌলতখান, ভোলা) - সংগ্রামের নোটবুক

ঘুইঙ্গার হাটের যুদ্ধ (দৌলতখান, ভোলা)

ঘুইঙ্গার হাটের যুদ্ধ (দৌলতখান, ভোলা) সংঘটিত হয় ২৭শে অক্টোবর। ভোলা সদর থেকে ছয় কিমি দক্ষিণে এবং দৌলতখান সদর থেকে ১৫ কিমি উত্তর-পশ্চিমে ভোলা সদর উপজেলা এবং দৌলতখান উপজেলার সীমান্তে ঘুইঙ্গার হাট অবস্থিত। ভোলা শহরের ওয়াপদায় অবস্থিত পাকবাহিনীর ক্যাম্প থেকে দক্ষিণের ছয়টি থানায় যেতে হলে ঘুইঙ্গার হাট হয়ে যেতে হতো। তাই এ স্থানটি মুক্তিযোদ্ধা এবং পাকবাহিনী উভয়ের জন্য ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ২৭শে অক্টোবর এখানে পাকবাহিনী ও তাদের দোসরদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের এক সম্মুখ যুদ্ধ হয়।
২৩শে অক্টোবর আনসার এডজুট্যান্ট আলী আকবর বড়ভাই, কর্পোরাল ইব্রাহিম মিয়া ও ল্যান্স নায়েক মোহাম্মদ ফারুক বাচ্চুর নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা দৌলতখান থানাযুদ্ধ-এ পাকদোসরদের পরাজিত করে কলাকোপার যোগীবাড়ি ও মুন্সীবাড়িতে ক্যাম্প স্থাপন করেন। পরের দিন ২৪শে অক্টোবর চেয়ারম্যান খোরশেদ আলম চৌধুরী অবগত হন যে, পাকবাহিনী যে-কোনো সময় দৌলতখান থানা আক্রমণ করতে পারে। এ খবর তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের অবহিত করেন। ২৫শে অক্টোবর বিকেলে মুন্সীবাড়িতে খোরশেদ আলম চৌধুরী, আলী আকবর, ইব্রাহিম মিয়া, মোহাম্মদ ফারুক প্রমুখের উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে ঘুইঙ্গার হাটে পাকবাহিনীকে প্রতিরোধ করার সিদ্ধান্ত হয়। সে অনুযায়ী ঐদিন রাতে মোহাম্মদ ফারুকের নেতৃত্বে অর্ধশতাধিক মুক্তিযোদ্ধা ঘুইঙ্গার হাটের পূর্বপাশে শরৎ ডাক্তারের বাড়িতে অবস্থান নেন। পাকবাহিনীর পরিকল্পনাসহ বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহের জন্য মোহাম্মদ ফারুক মুদি দোকানদার ও গরুর গাড়ির চালক জোবেদ আলী ফরাজীকে ২৬শে অক্টোবর ভোলা সদরে পাঠান। কিন্তু জোবেদ আলী ওয়াপদা গেটের সামনে পৌঁছলে চরপাতার ওদুদ রাজাকার তাঁকে ধরিয়ে দিলে পাকবাহিনী ক্যাম্পে নিয়ে তাঁকে হত্যা করে।
এদিকে মোহাম্মদ ফারুক যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে বিকেলবেলা সহযোদ্ধাদের নিয়ে ঘুইঙ্গার হাটে উপস্থিত হন। হাটের মধ্য দিয়ে চলে যাওয়া ভোলা-চরফ্যাশন সড়কে পাকবাহিনীকে প্রতিহত করার জন্য তিনি মুক্তিযোদ্ধা ও স্থানীয় জনগণের সহায়তায় হাটের পূর্বপাশের আকনবাড়ি, ফরাজীবাড়ি ও রমিজীবাড়ির নারকেল-সুপারি বাগানের ভেতর ২০-৩০টি বাংকার খনন করান। এছাড়া নৈমুদ্দিন বাজার সড়কের পাশে মোজাম্মেল হক কেরাণীর রাইস মিল বসানোর গর্তকেও বাংকার হিসেবে ব্যবহারের উপযোগী করা হয়। বাংকার খননের পর ১২ জন মুক্তিযোদ্ধাকে পাহারায় রেখে তিনি রাত ১১টার দিকে শরৎ ডাক্তারের বাড়িতে চলে যান।
তখন ছিল রমজান মাস। তাই ২৭শে অক্টোবর ভোর ৩:৩০টার দিকে ৩০-৩৫ জন রাজাকার, আলবদর- ও পাকসেনা জিকির তুলতে তুলতে (যাতে রোজাদার মনে করে তাদের কেউ সন্দেহ না করে) ঘুইঙ্গার হাটের দিকে অগ্রসর হয়। ঘুইঙ্গার খাল ব্রিজের গোড়ায় তখন পাহারায় ছিলেন উত্তর দিঘলদির খলিলুর রহমান। তিনি তাদের পরিচয় জানতে চান। সামনে থাকা রাজাকাররা নিজেদের বরিশালের মুক্তিযোদ্ধা কুদ্দুস মোল্লার লোক বলে পরিচয় দেয়। উল্লেখ্য যে, দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে অনেক মুক্তিযোদ্ধা ভোলায় এসে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। বরিশালের কুদ্দুস মোল্লা ছিলেন একজন বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা। তাঁর কথা ভোলার অনেকেই জানত। তাই কুদ্দুস মোল্লার লোক বলায় খলিলুর রহমান একটু দ্বিধায় পড়েন। এই সুযোগে শত্রুরা কাছে এসে খলিলুর রহমানকে বেঁধে ফেলে এবং বাজারের পশ্চিম পাশের হুডি ক্ষেতে নিয়ে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে-খুঁচিয়ে হত্যা করে। এরপর তারা বাজারের দক্ষিণ পাশের চৌরাস্তার বিভিন্ন এলাকায় অবস্থান নেয়।
মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প বাজারের কাছাকাছি হওয়ায় মুহূর্তের মধ্যে পাকবাহিনীর আসার খবর মোহাম্মদ ফারুক জেনে যান। তিনি ল্যান্স নায়েক মনির হোসেনের নেতৃত্বে ২৫-৩০ জনের একটি গ্রুপকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বাজারে প্রেরণ করেন। তখন আনুমানিক ভোর ৫টা। মনিরের গ্রুপ রাইস মিল বাংকারের পাশে আসতেই পাকবাহিনী তাঁদের আক্রমণ করে। তাঁরাও আক্রমণের জবাব দেন। কিন্তু অবস্থানগত কারণে তাঁরা পশ্চাদপসরণ করতে বাধ্য হন। এখানে ৭ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। অবশিষ্টরা ক্যাম্পে গিয়ে বিস্তারিত খবর জানান। অতঃপর পাকবাহিনী ও তাদের দোসররা বাজারের উত্তরদিকে মসজিদের ছাদ, ইউনিয়ন পরিষদ ভবন ও তৎসংলগ্ন প্রাইমারি স্কুলে অবস্থান নেয়। এ-সময় বিশ্বাস দরবেশ নামে এক মানসিক রোগী ওখানে এলে পাকবাহিনী তাকে গুলি করে হত্যা করে।
সকালে মোহাম্মদ ফারুকের নির্দেশে সকল মুক্তিযোদ্ধা আকনবাড়ির সামনে জমায়েত হন। সেখানে ফরাজীবাড়ি, রমিজীবাড়ি ও খালপার পর্যন্ত বিস্তৃত বাগানের সুবিধাজনক স্থান থেকে পাকবাহিনীকে আক্রমণের পরিকল্পনা করা হয়। সাহায্য চেয়ে বাংলাবাজারে লোক পাঠালে সেখান থেকে ২০- ২২ জন মুক্তিযোদ্ধা মর্টারসহ এসে তাঁদের সঙ্গে যোগ দেন। এরপর শুরু হয় যুদ্ধ। মুক্তিযোদ্ধারা থেমে-থেমে গুলিবর্ষণ করতে থাকেন। কিন্তু পাকবাহিনী অবিরাম গোলাবর্ষণ করে চলে। বেলা ১১টার দিকে ভোলা ক্যাম্প থেকে একটি জিপ ও একটি ট্রাকে করে অতিরিক্ত পাকসেনা ঘটনাস্থলে আসতে থাকে। তা দেখে মুক্তিযোদ্ধারা হাটের উত্তর দিকে রুস্তুম ড্রাইভারের বাড়ির সামনে পাকবাহিনীর গাড়ি আক্রমণ করেন। মুক্তিযোদ্ধাদের গুলিতে পাকবাহিনীর একটি গাড়ির চাকা ফেটে যায়। ফলে কয়েকজন পাকসেনা গাড়ি থেকে রাস্তায় পড়ে যায়। এখানে প্রায় একঘণ্টা যুদ্ধ চলে। এক পর্যায়ে পাকবাহিনীর দ্বিতীয় গাড়িটি ভোলার দিকে পালিয়ে যায়। এদিকে মুক্তিযোদ্ধাদের অপর গ্রুপ ঘুইঙ্গার হাটে অবস্থানরত পাকবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে থাকে। জোহরের নামাজের পর মুক্তিবাহিনী আকনবাড়ির সামনে থেকে পাকবাহিনীর অবস্থান লক্ষ্য করে মর্টারের গোলা ছোড়ে। প্রথম গোলাটি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়। দ্বিতীয় গোলাটি ইউনিয়ন পরিষদ ভবনের ছাদের কার্নিশে পড়লে ছাদে অবস্থানরত পাকসেনারা নিচে নেমে আসে। মুক্তিবাহিনী মসজিদ ও ইউনিয়ন পরিষদের দিকে অবিরাম গুলি চালাতে থাকে। আনুমানিক বিকেল ৪টা পর্যন্ত যুদ্ধ চলার পর পাকবাহিনীর পক্ষ থেকে গুলি আসা বন্ধ হয়ে যায়। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর মুক্তিযোদ্ধারা গুলি ছুড়তে-ছুড়তে ইউনিয়ন পরিষদ ভবন ও মসজিদে প্রবেশ করেন। সেখানে তাঁরা ৬টি লাশ দেখতে পান এবং ইউনিয়ন পরিষদের পেছন থেকে একজন আহত রাজাকারকে বন্দি করেন। এমন সময় তাঁরা খবর পান যে, পাকবাহিনী ও রাজাকার-আলবদররা বাজারের পশ্চিম পাশ দিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে। মুক্তিযোদ্ধারা তখন যুদ্ধে শহীদ ও আহতদের খুঁজতে বাজারে প্রবেশ করেন। চারদিক থেকে অনেক সাধারণ লোকও তাঁদের সঙ্গে যোগ দেয়। তাঁরা বাজারের উত্তর দিক থেকে আবদুল মন্নান চাপরাশি, বাজারের পশ্চিম পাশের হুডি ক্ষেত থেকে খলিলুর রহমান, রাইস মিল বাংকার থেকে মনির, বাংকারের নিকটস্থ স্থান থেকে আনসার সামসুদ্দিন, উত্তম সিকদার, নায়েক সুবেদার কয়ছর আহমদ, বানেশ্বর, দিলীপ ও সোলায়মানের লাশ উদ্ধার করেন। মন্নান, সামসুদ্দিন ও খলিলুর রহমানের লাশ তাঁদের আত্মীয়- স্বজনদের নিকট দিয়ে দেয়া হয়। অবশিষ্টদের লাশ রাইস মিল বাংকারের পূর্বপাশে কবর দেয়া হয়।
এদিকে রাজাকার ও আলবদরদের সহায়তায় পাকবাহিনী ইউনিয়ন পরিষদ ভবনের পেছন দিয়ে গুলি করতে-করতে চরকুমারিয়া হয়ে পশ্চিম দিকে যেতে থাকে। তাদের গুলিতে মাঠে কর্মরত চরকুমারিয়ার আবদুল গফুর নিহত হন। পলায়নরত পাকবাহিনী চরকুমারিয়ার পশ্চিম প্রান্তে উত্তর দিঘলদি ও আলীনগর ইউনিয়নের সীমানায় চৌমুহনির (রুহিতার বিল) কাদির মাস্টারের বাড়ির কাছে শাহে আলম নামে একজন গ্রামবাসীকে হত্যা করে। তখন রাত হয়ে যাওয়ায় পাকবাহিনী পথ ভুলে দুই ভাগে ভাগ হয়ে যায়। একদলের গুলি শেষ হয়ে গেলে তারা নিকটস্থ পানের বরজে আত্মগোপন করে। অন্য দলটি আলীনগর হয়ে ভোলার দিকে পালিয়ে যায়। শাহে আলম হত্যার খবরে উত্তেজিত জনতা পাকসেনাদের খুঁজতে থাকে। এক পর্যায়ে লাল মিয়া, নিরব মিয়া, বেলায়েত মিয়া, বজলুর রহমান কাহালি, নূরুল ইসলাম ও মোখলেছুর রহমানের নেতৃত্বে পানের বরজ থেকে ৫ জন পাকসেনাকে বন্দি করে শরৎ ডাক্তারের বাড়ির পাশের খালে দুজনকে এবং নৈমুদ্দিন বাজারে তিনজনকে হত্যা করা হয়। যুদ্ধে পাকসেনাদের সহযোগিতা করার অভিযোগে উত্তর দিঘলদির সেরু দফাদারকে মুক্তিযোদ্ধারা হত্যা করেন।
ঘুইঙ্গার হাটের যুদ্ধে পাকবাহিনী ও তাদের দোসরদের ১২ জন সদস্য নিহত হয় এবং ৮ জন মুক্তিযোদ্ধা ও ৪ জন গ্রামবাসী শহীদ হন। শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন— ল্যান্স নায়েক মনির হোসেন (ফরিদপুর), আনসার সামসুদ্দিন ফরাজী (চরপাতা), নায়েক সুবেদার কয়সর আহমেদ (চানপুর-মেহেন্দিগঞ্জ), দিলীপ, খলিলুর রহমান (উত্তর দিঘলদি), বানেশ্বর, উত্তম সিকদার (কুতুবা) ও সোলায়মান (গজারিয়া) এবং গ্রামবাসীরা হলেন— আবদুল গফুর (চরকুমারিয়া), শাহে আলম (চরকুমারিয়া), আবদুল মন্নান চাপরাশি (উত্তর দিঘলদি) এবং পাগলা দরবেশ (উত্তর দিঘলদি)। এছাড়া আহত হন চারজন— আবুল হাসেম, দিদার উল্লাহ, আবদুস ছত্তার (উত্তর জয়নগর) এবং ফজলুর রহমান (উত্তর জয়নগর)।
যুদ্ধে মোহাম্মদ ফারুকের সঙ্গে আরো নেতৃত্ব দেন জমশেদ খন্দকার, আবু তাহের, কাঞ্চন মিয়া, আবদুল হাদি ও কাজি নান্নু। আবদুল বারেক, কাঞ্চন, তাজুল ইসলাম, সুনীল সরকার, মোতালেব, তোফাজ্জল, সিদ্দিক মোল্লা প্রমুখ স্থানীয় জনগণ তাঁদের সর্বাত্মক সহযোগিতা করে। [মো. রফিকুল ইসলাম]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৩য় খণ্ড