মুক্তিযুদ্ধে ঘোড়াঘাট উপজেলা (দিনাজপুর)
ঘোড়াঘাট উপজেলা (দিনাজপুর) দিনাজপুর জেলার একটি ঐতিহ্যবাহী জনপদ। প্রাচীন যুগ থেকে শুরু করে তুর্কি, সুলতানি, পাঠান ও মোগল আমলে উত্তরবঙ্গের গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক ও সামরিক কেন্দ্র ছিল এটি। এখানে হিন্দু-মুসলমান ছাড়াও বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, সাঁওতাল, ওঁরাও, মুন্ডা প্রভৃতি আদিবাসী জনগোষ্ঠীর বাস। ৭১-এ তারা সম্মিলিতভাবে হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে।
১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর ভারতের উত্তর প্রদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ থেকে বহুসংখ্যক উর্দুভাষী মানুষ এখানে আসে। সরকারি উদ্যোগে ঘোড়াঘাটের বিস্তীর্ণ খাস জমিতে তাদের পুনর্বাসিত করা হয়। পুনর্বাসন এলাকাগুলো হলো- আফসারাবাদ (হায়দারনগর), খোদাদাদপুর, নূরজাহানপুর, নেসারাবাদ ও মালেকাবাদ। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার কারণে অবাঙালিরা চাকরি ও অন্যান্য ক্ষেত্রে নানারকম সুযোগ-সুবিধা ভোগ করত। কিন্তু স্থানীয়দের তারা হেয় দৃষ্টিতে দেখত ৷ তাই বাঙালিদের সঙ্গে তাদের গোড়া থেকেই সুসম্পর্ক ছিল না। আনসার, মুজাহিদ ও সেনাবাহিনীতে বাঙালি ও অবাঙালিদের মধ্যেও রেষারেষি ছিল। এজন্য অবাঙালিদের প্রতি বাঙালিদের মনে এক ধরনের ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান- ও সত্তরের নির্বাচনে ঘোড়াঘাটবাসী তাদের দীর্ঘদিনের ক্ষোভ প্রশমনের প্রয়াস পায়। কিন্তু অবাঙালিরা নির্বাচনে বিরোধী ভূমিকা পালন করে। তা সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ- এখানেসহ সারাদেশে বিপুল ভোটে জয়লাভ করে। কিন্তু আওয়ামী লীগের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর ষড়যন্ত্র বাঙালিদের ক্ষুব্ধ করে তোলে। ঘরে-বাইরে, অফিস-আদালতে সর্বত্র এ সম্বন্ধে আলোচনা চলতে থাকে। বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ-এর পর বাঙালিরা তাদের ভবিষ্যৎ করণীয় সম্বন্ধে দিকনির্দেশনা লাভ করে। অপরদিকে অবাঙালিরা পাকিস্তান রক্ষার নামে প্রকাশ্য তৎপরতা শুরু করে। এরূপ অবস্থায় ২৫শে মার্চের পর ঘোড়াঘাটবাসী দেশের অন্যান্য স্থানের মতো পাকিস্তান সরকার ও সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তোলে। দেশকে শত্রুমুক্ত করার উদ্দেশ্যে ঘোড়াঘাটের আপামর জনসাধারণ সংঘবদ্ধ হতে থাকে। বাঙালি আনসার, মুজাহিদ ও ছাত্র-জনতা এ-কাজে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে। বাঙালি মুজাহিদ বাহিনীর মেজর সৈয়দ বদরউদ্দীন আহমেদ তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন। তিনি ঘোড়াঘাট, নবাবগঞ্জ, বিরামপুর, হাকিমপুর, গোবিন্দগঞ্জ, পলাশবাড়ি ও চৌধুরানী এলাকার ৩ শতাধিক যুবককে প্রশিক্ষণ দেন। এলাকার বিশিষ্ট ব্যক্তি আব্দুল মজিদ সরকার একটি স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গড়ে তোলেন, যার প্রাথমিক সদস্য সংখ্যা ছিল ৩০-৪০ জন। তিনি নিজে তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন। এ ব্যাপারে দিনাজপুর বার কাউন্সিলের সদস্য এডভোকেট কাজেম আলী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এঁদের নেতৃত্বে একটি বিশাল মিছিল বের হয়। মিছিলের স্লোগান ছিল: “বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর’, ‘ভুট্টোর মাথায় লাথি মার, বাংলাদেশ স্বাধীন কর’ ইত্যাদি। মিছিলটি গিয়ে হোসেনপুর গ্রামের আমবাগানে পৌঁছায়। সেখানে ছিল সেনাবাহিনীর একটি অস্থায়ী ক্যাম্প। দুজন লেফটেন্যান্ট ও একজন মেজরসহ ক্যাম্পের অধিকাংশ সৈনিক ছিলেন বাঙালি। তাই তারা মিছিলটিকে বাধা দেননি। মিছিল থেকে আনসার, মুজাহিদ, পুলিশ, সেনাবাহিনী ও বিমানবাহিনীর সকল বাঙালি সদস্যকে করতোয়া নদীর পাড়ের এই আমবাগানে জমায়েত হওয়ার জন্য আহ্বান জানানো হয়। সে আহ্বানে সাড়া দিয়ে অনেকেই এসে উপস্থিত হন। এক পর্যায়ে আব্দুর সালেক নামে এক বাঙালি নায়েক সুবেদার গুল মোহাম্মদ ও শেখ মোহাম্মদ নামে দুজন অবাঙালিকে ওয়ারলেস সেট দিয়ে আঘাত করলে তারা সঙ্গে- সঙ্গে বগুড়ার সেনানিবাসকে তা জানায়। ফলে, সেখান থেকে একদল সৈন্য ঘটনাস্থলের দিকে রওনা হয়। এদিকে পাকসেনাদের আগমনের কথা জানতে পেরে বাঙালিরা ঘোড়াঘাট ছেড়ে পলাশবাড়িতে গিয়ে এম্বুশ করে। বগুড়া থেকে ট্রাকযোগে পাকসেনারা সেখানে এলে বাঙালিরা তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। এতে ১১ জন পাকিস্তানি সৈন্য নিহত হয়, অপরদিকে মো. ইসমাইল হোসেন মণ্ডল নামে একজন বাঙালি মুজাহিদ শহীদ হন।
ঘোড়াঘাট উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধের কমান্ডার ছিলেন মেজর সৈয়দ বদরউদ্দীন আহমেদ, আজহারুল ইসলাম বাবু এবং অধীর কুমার সরকার।
২৫শে মার্চের গণহত্যার পর পাকবাহিনী যাতে ঘোড়াঘাটে প্রবেশ করতে না পারে, সেজন্য ঘোড়াঘাটের প্রবেশমুখে রাস্তায় গাছ ফেলে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা হয়। ২৬শে মার্চ মেজর নিজাম, লে. মোখলেস ও লে. রফিকের নেতৃত্বে তৃতীয় বেঙ্গল রেজিমেন্টের দুটি কোম্পানি ঘোড়াঘাটে এসে বাঙালিদের সঙ্গে একতা ঘোষণা করে। অন্যদিকে নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলা রক্ষার অজুহাতে এদিন বিকেলে সৈয়দপুর সেনানিবাস থেকে ৬৪টি কনভয় হঠাৎ ঘোড়াঘাটে আসে। তারা এসেই বিদ্রোহী বাঙালি সৈন্যদের ওপর বেপরোয়াভাবে গুলি ছুড়তে থাকে। বাঙালি সৈনিকরাও পাল্টা গুলি ছোড়েন। এ-যুদ্ধে ৩ জন বাঙালি সৈনিক শহীদ হন, অপরপক্ষে ৩১ জন পাকসেনা নিহত হয়। অতঃপর সাদা পতাকা উত্তোলনের মাধ্যমে মীমাংসার উদ্যোগ নেয়া হয়। পারস্পরিক আলাপ-আলোচনার পর চলে যাওয়ার সময় পাকবাহিনীর গ্যারিসন কমান্ডার আরশাদ কোরশী করমর্দন করা অবস্থায় লে. রফিককে হেচকাটানে জীপে তুলে দ্রুত সরে পড়ে এবং বাঙালি সৈনিকদের ওপর গুলি ছুড়তে থাকে। এ ঘটনার পর ঘোড়াঘাটে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রকাশ্য যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। উল্লিখিত ঘটনার পর পাকবাহিনী আর সি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, হোসেনপুর আমবাগান, বলাহার ও দক্ষিণ জয়দেবপুর বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে ক্যাম্প স্থাপন করে। এ ক্যাম্পগুলোতে বেশকিছু সংখ্যক রাজাকার ও আলবদর- ছিল। এর দায়িত্বে ছিল উর্দুভাষী লে. আফজাল। লুণ্ঠন- নির্যাতনের জন্য এ ক্যাম্পটি ছিল কুখ্যাত।
বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের মতো ঘোড়াঘাট উপজেলায়ও পাকবাহিনীর নির্মম অত্যাচার-নির্যাতন চলে। পাকবাহিনীর সদস্যরা রংপুর, বগুড়া, পাঁচবিবির সন্নিকটস্থ করমজা হাইস্কুল প্রভৃতি স্থান থেকে শেল নিক্ষেপ করে। এতে অনেক লোক হতাহত হয়। ঘোড়াঘাটের অধিকাংশ অবাঙালি আনসার ও মুজাহিদ বাঙালিদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করে। তারা পাকবাহিনীর সহযোগী হিসেবে প্রশিক্ষণ কর্মসূচি পরিচালনা করে। তাদের মধ্যে এ খালেদ, মো. মনসুর (মুজাহিদ) প্রমুখ ছিল উল্লেখযোগ্য। এদের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় স্বাধীনতাবিরোধী নানা সংগঠন গড়ে ওঠে। তারা ধর্মের দোহাই দিয়ে পাকিস্তান রক্ষার নামে স্থানীয় তরুণদের রাজাকার ও আলবদর বাহিনীতে যোগ দিতে উদ্বুদ্ধ করতে সচেষ্ট হয়। পাশাপাশি শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার নাম করে শান্তি কমিটি গড়ে তোলে। শান্তি কমিটি গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে কানাগাড়ীর আবুল হোসেন ও ভটর্নপাড়ার গোলাম মোস্তফা, দক্ষিণ জয়দেবপুরের রাজাকার আব্দুল ওয়াদুদ প্রমুখ। রাজাকার, শান্তি কমিটি ও আলবদর বাহিনীর সদস্যরা আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মী এবং মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মুজাহিদ ও আনসার বাহিনীর লোকদের ধরিয়ে দিতে সহায়তা করে। এদের মধ্যে মোজাফ্ফর হোসেন (কালিতলা), মো. ইব্রাহীম খান ওরফে মিস্টার খান (নূরজাহানপুর), মো. ইসাহাক খান (নূরজাহানপুর), মো. আকবর খান (নূরজাহানপুর), মো. আমিরুল ইসলাম (নূরজাহানপুর), মো. ইলিয়াস আলী (নূরজাহানপুর), মো. আব্দুল হালিম (নূরজাহানপুর), আব্দুল মান্নান ওরফে মোনা নাপিত (নয়াপাড়া), মো. শামসুর রহমান জিন্নাহ (নূরজাহানপুর), আব্দুস সামাদ (নয়াপাড়া), মহিরউদ্দিন মাস্টার (পুরইল), আমির উদ্দিন (ভূতগাড়ী), মোজাম হোসেন (পালসা), দিলজার হোসেন (আবিরের পাড়া), আবু সিদ্দিক (রামেশ্বরপুর), সাগের আলী মণ্ডল (খাইরুল), মো. মনসের টেপা (রামাপুর টুপঘুরিয়া), মো. ইয়াছিন আলী মণ্ডল (খাইরুল), খিরোদ আলী (শ্যামপুর), মো. কাসেম আলী মণ্ডল (শ্যামপুর), মো. শাহজাহান মালি, মো. মোস্তাক (নূরজাহানপুর), মো. গোলাম মোস্তাক (নূরজাহানপুর, বর্তমান রংপুর সদর), মোস্তাক আহম্মেদ (নূরজাহানপুর), আহমেদুর রহমান খোকন (আজাদমোড়), মো. আয়নুল (নূরজাহানপুর), মো. ওয়াদুদ (বলগাড়ী), মো. খরু মিয়া (ইসলামপুর) এবং মো. আশরাফ আলী সরকার মাস্টার (ওসমানপুর)-এর নাম বিশেভাবে উল্লেখযোগ্য।
২৫শে মার্চের নারকীয় ঘটনার পর থেকে পাকবাহিনী ও তাদের দোসররা বাঙালিদের ওপর নানারকম অত্যাচার- নির্যাতন শুরু করে। হত্যা, গণহত্যা ও নারীনির্যাতনের মাধ্যমে তারা বাঙালিদের মধ্যে ত্রাসের সৃষ্টি করে। ২৬শে মার্চ বিকেলে অতর্কিত আক্রমণ, লে. রফিককে অপহরণ এবং ২৩শে মে মুজাহিদ বাহিনীর মেজর সৈয়দ বদরউদ্দীন আহমেদকে অমানুষিক নির্যাতনের পর হত্যার ঘটনা ঘোড়াঘাটবাসীকে স্তম্ভিত ও আতঙ্কিত করে তোলে। তারা কুলানন্দপুরের আইয়ুব আলী, রানীগঞ্জ বাজারের সোহরাব আলী, গোলজার হোসেন ও মোশাররফ হোসেনকে নির্মমভাবে হত্যা করে। এছাড়া, খায়রোল গ্রামের নিত্যরঞ্জন ও নবানু সরকার, পালসা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আব্দুল রশিদ চৌধুরী ও সাইফুল ইসলামকে নির্মমভাবে নির্যাতনের পর হত্যা করে। এদের মৃতদেহ পরদিন লালদহ বিলের পাড়ে পাওয়া যায়। ডুগডুগি হাটের বগা মণ্ডল ও তার ছেলে সিরাজ উদ্দিনকে পাকবাহিনী গুলি করে হত্যা করে। হিজলগাড়ীর ওসমান আলী চৌধুরী, তোষাইরের সাঈদ আলী ও ডেভাসি গ্রামের আব্দুস সাত্তার পাকবাহিনীর নির্যাতনে শহীদ হন। মহেন্দ্ৰ নাথ সরকারের বাড়িতে অগ্নিসংযোগ ও লুণ্ঠনের ঘটনা ঘটে। স্বাধীনচেতা বাঙালিদের দমনের জন্য পাকবাহিনী নানা পদ্ধতি অবলম্বন করে। তারা বিভিন্ন এলাকার নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ এবং মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের আত্মীয়-স্বজন, বিশেষত নারীদের ওপর অকথ্য নির্যাতন চালায়। এসব হত্যাকাণ্ড ও নির্যাতনের ঘটনা ঘোড়াঘাটবাসীকে প্রতিশোধপরায়ণ করে তোলে।
পাকবাহিনী ঘোড়াঘাট উপজেলার পূর্ব ও পূর্ব-দক্ষিণ দিকস্থ কান্দিয়ার হাট থেকে প্রায় ১০০ জন হাটুরেকে ধরে লালদহের বিলের পাড়ে নিয়ে হত্যা করে। অনুরূপভাবে এপ্রিল-মে মাসের দিকে কাশিয়াবাড়ি হাট থেকেও প্রায় ২০০ জন হাটুরেকে ধরে নিয়ে ওখানেই হত্যা করে। এ গণহত্যায় রাজাকার ও আলবদররা মুখ্য ভূমিকা পালন করে। হত্যার এ ঘটনা লালদহ বিল গণহত্যা- নামে পরিচিত।
ঘোড়াঘাট উপজেলায় আর সি গার্লস স্কুল ও বলাহারে পাকবাহিনীর নির্যাতনকেন্দ্র ছিল। এ-দুটি স্থানে সন্দেহভাজনদের ধরে এনে আটকে রাখা হতো এবং নির্মম নির্যাতনের পর হত্যা করা হতো। পাকবাহিনী মুজাহিদ বাহিনীর মেজর সৈয়দ বদরউদ্দীন আহমেদকে ২৩শে মে ধরে নিয়ে ২১ দিন নির্মম নির্যাতনের পর হত্যা করে।
ঘোড়াঘাট উপজেলায় পাঁচটি গণকবর রয়েছে- লালদহ বিল গণকবর, ঘোড়াঘাট ডাকবাংলো গণকবর, ডুগডুগি গণকবর, বলাহার গণকবর এবং গোপালপুর গণকবর।
ঘোড়াঘাট ও তৎসন্নিহিত এলাকায় পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের বেশ কয়েকটি যুদ্ধ হয়। মেজর নিজাম ও সুবেদার আব্দুস শুকুরের নেতৃতে ১১ই এপ্রিল ফুলবাড়ীতে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে তুমুল যুদ্ধ হয়। মেজর আনোয়ার, বীর বিক্রম-এর নেতৃত্বে ১৯শে এপ্রিল হিলিতে একটি যুদ্ধ হয়। এখানে মুক্তিবাহিনী পাকবাহিনীর আক্রমণ প্রতিহত করে। ঘোড়াঘাটের দক্ষিণ-পশ্চিমে হিলি ও পশ্চিম-উত্তরের ফুলবাড়ী উপজেলার ভারত সীমান্তবর্তী রুদ্রানী, জলপাইতলী, পানিকাটা ও রানীনগর থেকে মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনী প্রায়শই পাকবাহিনীর ক্যাম্প লক্ষ্য করে আক্রমণ চালাত। কখনো-কখনো সম্মুখ ও গেরিলা যুদ্ধও হয়।
হাকিমপুর-ঘোড়াঘাট সীমান্ত-সংলগ্ন বলাহারে পাকসেনাদের একটি বড় ঘাঁটি ছিল। মুক্তিযোদ্ধাদের উপর্যুপরি আক্রমণে বিপর্যস্ত এখানকার পাকসেনাদের মনোবল বৃদ্ধির জন্য আগস্ট মাসে একদিন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের অধিনায়ক টিক্কা খান সেখানে গিয়েছিল। এ খবর আগেই পেয়ে তাকে হত্যা করার উদ্দেশ্যে বীর মুক্তিযোদ্ধা হযরত আলী (<এফএফ) ঘোড়াঘাট থানার খুদখুর গ্রামের দক্ষিণ পার্শ্বস্থ ঘোড়াঘাট-হিলি রাস্তার উত্তর পাশে গাড়িবিধ্বংসী মাইন পুঁতে রাখেন। ঘটনার দিন ভোর ৫টার দিকে পাকসেনাদের একটি লরি সেখানে যাওয়ার সময় মাইন বিস্ফোরণে ধ্বংস হয়ে যায়। এতে বেশ কয়েকজন পাকসেনা হতাহত হয়।
ঘোড়াঘাট উপজেলার পশ্চিম-উত্তরে নবাবগঞ্জ উপজেলার একটি ইউনিয়ন ভাদুরিয়া। এটি ঘোড়াঘাট সীমানার কোলঘেঁষে অবস্থিত। দাউদপুর বাজার থেকে আগত মিত্রবাহিনীর একটি পদাতিক দলের সঙ্গে ভাদুরিয়া স্কুলে লুকিয়ে থাকা পাকবাহিনীর যুদ্ধ হয়। এতে উভয় পক্ষের ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতি হয়। মিত্রবাহিনীর বেশ কয়েকজন সৈন্য শহীদ হন। তাঁদের অনেকের লাশ ভাদুরিয়া স্কুল মাঠ ও দাউদপুর স্কুল মাঠে কবর দেয়া হয়। অনেকের লাশ দাউদপুর বাজারস্থ বৈরাগী পাড়ায় দাহ করা হয়। এ যুদ্ধটি ভাদুরিয়া যুদ্ধ নামে পরিচিত।
৯ই ডিসেম্বর থেকে পরবর্তী তিনদিন পর্যন্ত বিরামপুর ক্যাম্প থেকে পালিয়ে আসা পাকসেনারা দারোগার আমবাগানে আশ্রয় নেয়। সেখান দিয়ে মিত্রবাহিনীর একটি দল যাওয়ার সময় পাকসেনারা তাঁদের আক্রমণ করে। এতে মিত্রবাহিনীর অগ্রযাত্রা কিছুটা ব্যাহত হয়।
ঘোড়াঘাটের পূর্ব-দক্ষিণে সীমান্ত-সংলগ্ন গোবিন্দগঞ্জের কাটাখালিতে পাকবাহিনীর একটি ক্যাম্প ছিল। এখানে পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি যুদ্ধ হয়। ডিসেম্বর মাসের ১১ তারিখ মুক্তিবাহিনীর ভাদুরিয়া, রংপুরের পলাশবাড়ি এবং গাইবান্ধার নাকাইহাটের তিনটি দল এসে তিনদিক থেকে একযোগে পাকসেনাদের এ ক্যাম্প আক্রমণ করে। মুক্তিযোদ্ধাদের ত্রিমুখী আক্রমণে টিকতে না পেরে পাকসেনারা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। এরপর মিত্রবাহিনীর ট্যাংকবহর ভাদুরিয়া থেকে রানীগঞ্জ হয়ে ঘোড়াঘাটে প্রবেশ করে। ১৩ই ডিসেম্বর ঘোড়াঘাট উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়। ঘোড়াঘাট উপজেলার শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- আমিরুল ইসলাম মণ্ডল (পিতা মো. জহির উদ্দিন মণ্ডল, চোপাগাড়ি), আব্দুর রশীদ মিয়া (পিতা আলহাজ্জ আজিম উদ্দিন, বিন্যগড়ি), দাউদ হোসেন মণ্ডল (পিতা মো. করিম উদ্দিন মণ্ডল, সাহেবগঞ্জ), দেলোয়ার হোসেন (পিতা দুলাল সোনার, মরিচপাড়া), ইসমাইল হোসেন মণ্ডল (পিতা ইব্রাহিম মণ্ডল, জোলাপাড়া), সৈয়দ বদরউদ্দীন আহমেদ (পিতা মতিখার রহমান, এসকে বাজার), মফিজ উদ্দিন (পিতা হানিফ শেখ, এসকে বাজার), সৈয়দ গোলজার হোসেন (পিতা সুলতান নাসির উদ্দিন, আফসারাবাদ) এবং নায়েক সুবেদার নেক মোহাম্মদ (পিতা কফিল উদ্দিন, নূরজাহানপুর)।
ঘোড়াঘাট উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধের স্মরণে কাদিমনগর ডাকবাংলোর প্রবেশদ্বারে একটি স্মৃতিফলক নির্মিত হয়েছে। [মো.ওসমান গনী]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৩য় খণ্ড