You dont have javascript enabled! Please enable it!

ঘাটিনা রেলসেতু যুদ্ধ (উল্লাপাড়া, সিরাজগঞ্জ)

ঘাটিনা রেলসেতু যুদ্ধ (উল্লাপাড়া, সিরাজগঞ্জ) সংঘটিত হয় ২৪শে এপ্রিল। এটি ছিল মূলত প্রতিরোধযুদ্ধ এবং সিরাজগঞ্জের প্রথম প্রতিরোধযুদ্ধ হিসেবে খ্যাত। প্রায় ৩ ঘণ্টার এ-যুদ্ধে ১৫ জন পাকসেনা নিহত হয়। সিরাজগঞ্জের মহকুমা প্রশাসক এ কে এম শামসুদ্দিন আহমেদ এবং ছাত্রনেতা ও পলাশডাঙ্গা যুবশিবির-এর পরিচালক আব্দুল লতিফ মির্জা যৌথভাবে এ-যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন। এ-যুদ্ধে সিরাজগঞ্জ ও উল্লাপাড়ার লুৎফর রহমান অরুণ, বিমল কুমার দাস, বেতুয়ার শামছুল আলম, আব্দুস সামাদ, কয়ড়ার শামছুল আলম, সোহরাব হোসেন, আব্দুর রহমান, আলতাফ হোসেন প্রমুখ অংশগ্রহণ করেন।
এপ্রিল মাসে উল্লাপাড়ার সঙ্গে সড়ক ও ট্রেন যোগাযোগ বন্ধ ছিল। ২৪শে এপ্রিল সকালে শামসুদ্দিন আহমেদ ও আব্দুল লতিফ মির্জার নেতৃত্বে একদল মুক্তিযোদ্ধা ঘাটিনা রেল সেতুতে আসেন। সিরাজগঞ্জ থেকে ২২ কিলোমিটার দূরে ঈশ্বরদী সিরাজগঞ্জ রেলপথে করতোয়া নদীর ওপর অবস্থিত ঘাটিনা রেলসেতুর কয়েকটি পাত তাঁরা খুলে ফেলেন। ঈশ্বরদীর সঙ্গে সিরাজগঞ্জের রেল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করা ছিল তাঁদের উদ্দেশ্য। কারণ ২৫শে মার্চ রাতে ঢাকায় নারকীয় হত্যাযজ্ঞের পর ২১শে এপ্রিল পাকবাহিনী সড়কপথে সিরাজগঞ্জ অভিমুখে যাত্রার্থে প্রথমে শাহজাদপুর থানার বাঘাবাড়ি ঘাটে বাধাপ্রাপ্ত হয়। বড়াল নদীর ঘাটে তখন সেতু ছিল না। স্থানীয় লোকজন দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে হানাদার বাহিনীর ঢুকে পড়ার খবর পেয়ে ঘাট থেকে নৌকা- ডিঙ্গি সব সরিয়ে ফেলে। ফলে পাকবাহিনী নদীর পূর্বপাড়ে এসে আটকে যায়। অপরদিকে আওয়ামী লীগ নেতা এডভোকেট গোলাম হাসনায়েন এমপিএ ও আব্দুল লতিফ মির্জার নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী পশ্চিম পাড়ে সংগঠিত হয়ে প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তুললে পাকসেনারা দু-তিন দিন নদী পাড় হতে ব্যর্থ হয়। নিরুপায় হয়ে পাকবাহিনী রুট পরিবর্তন করে ওখান থেকে পাবনা হয়ে ঈশ্বরদী থেকে ট্রেনে সিরাজগঞ্জে অনুপ্রবেশের পরিকল্পনা করে। ২৩শে এপ্রিল রাতে এ গোপন খবর পেয়ে সিরাজগঞ্জ থেকে ২০ জন মুক্তিযোদ্ধা পায়ে হেঁটে ২২ কিলোমিটার পথ পেরিয়ে পরদিন সকালে ঘাটিনা রেলসেতুর পাশে শাহজাহানপুর গ্রামে অবস্থান নেন। এ- সময় শামসুদ্দিন আহমেদ ও লতিফ মির্জা ছাড়া মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে ছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের জিএস আব্দুস সামাদ ও পলাশডাঙ্গা যুবশিবিরের সাবেক ব্যাটালিয়ন কমান্ডার লুৎফর রহমান অরুণ (প্রয়াত)। তখন মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে বেশ কয়েকটি থ্রি-নট-থ্রি রাইফেল, ৩টি চাইনিজ রাইফেল ও একটি এলএমজি ছিল। সকাল থেকে প্রতিরোধ যোদ্ধারা ঘাটিনা সেতুর পাত অপসারণ ও শাহজাহানপুর গ্রামের সীমানায় বাংকার খনন করেন। এসব কার্যক্রমে শাহজাহানপুর ছাড়াও পার্শ্ববর্তী চরঘাটিনা, ঘাটিনা, মাটিকোড়া, লক্ষ্মীপুর, কানসোনা, সলপ, রামগাঁতী ইত্যাদি গ্রামের শতশত যুবক সহযোগিতা করে। শামসুদ্দিন আহমেদ ও আব্দুল লতিফ মির্জা বেলা ১২টার দিকে গ্রামবাসীকে ডেকে যে-কোনো বিপদ মোকাবেলায় প্রস্তুত থাকার আহ্বান জানান। বেলা আড়াইটার দিকে শতাধিক পাকসেনা বহনকারী একটি ট্রেন ঈশ্বরদী থেকে সিরাজগঞ্জ যাওয়ার উদ্দেশ্যে ঘাটিনা সেতুর পশ্চিম পাড়ে এসে দাঁড়ায়। রেলপথে মাইন থাকার আশংকায় তারা ইঞ্জিনের সামনে দুটি মালবাহী বগি জুড়ে দেয়। সেতুর রেললাইনে পাত না থাকায় ট্রেনটি অগ্রসর হতে পারছিল না। ১৫-২০ জন পাকসেনা সেতুর অবস্থা দেখার জন্য যখন নিচে নেমে আসে, তখন নদীর অপর পাড় থেকে মুক্তিযোদ্ধারা তাদের ওপর গুলিবর্ষণ করেন। আচমকা গুলিতে শত্রুবাহিনী হতচকিত হয়ে পড়ে। মুক্তিযোদ্ধাদের গুলিতে ১৫ জন পাকসেনা নিহত হয়। কিন্তু কয়েক মিনিট পর তারা পাল্টা গুলি শুরু করে। ভারী অস্ত্রের গুলি বৃষ্টির মতো আসতে থাকে। মুক্তিযোদ্ধারা পাল্টা গুলি করলে দুই পক্ষের মধ্যে ভয়াবহ যুদ্ধ শুরু হয়। ভয়ে-আতঙ্কে ঘাটিনা রেলসেতুর পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলোর হাজার-হাজার মানুষ পালাতে শুরু করে। পাকসেনাদের গুলিতে নারী-শিশু-সহ অন্তত ৩০ জন আহত হন। আহতদের পায়ে-হাতে-বুকে গুলি লাগে। অসহায় নারী-পুরুষ ও শিশুর আহাজারি চলতে থাকে। সন্ধ্যার আগে পাকবাহিনীর গুলিবর্ষণ থামে। ট্রেন পিছিয়ে উল্লাপাড়া স্টেশনে যায়। মুক্তিযোদ্ধারা প্রতিরোধ জোরদার করতে আরো উৎসাহী হন। কিন্তু গোলাবারুদ শেষ হয়ে যাওয়ায় তাঁরা প্রতিরোধযুদ্ধে বিরতি দিতে বাধ্য হন। সন্ধ্যায় মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল পার্শ্ববর্তী সলপ রেলস্টেশন ক্যাম্পে এবং অপর দল রামগাঁতী গ্রামে আশ্রয় নেয়। ২৫শে এপ্রিল পাকবাহিনী উল্লাপাড়া রেল স্টেশন থেকে ৬ কিলোমিটার দক্ষিণে গাড়াদহ বাজারে ৬ ইঞ্চি মর্টার বসিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের শাহজাহানপুর গ্রামের অবস্থানের ওপর শেলিং শুরু করে। বৃষ্টির মতো শেল তাদের বাংকার ও আশপাশের বাড়িগুলোতে পড়তে থাকে। এ অবস্থায় তাঁরা অবস্থান ত্যাগ করতে বাধ্য হন। এদিনই পাকবাহিনী রেলসেতুতে নতুন পাত বসিয়ে ট্রেন চলাচল শুরু করে। এরপর তারা রেলপথের পার্শ্ববর্তী শাহজাহানপুর, কর্মকারপাড়া, মাটিকোড়া, বেতকান্দি, লক্ষ্মীপুর ইত্যাদি গ্রামে হামলা করে ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। ব্যাপক লুটপাট শেষে গ্রামগুলো পুড়িয়ে দেয়। উল্লাপাড়ার ঘাটিনায় প্রতিরোধযুদ্ধের একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মিত হয়েছে। [কল্যাণ ভৌমিক]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৩য় খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!