মুক্তিযুদ্ধে ঘিওর উপজেলা (মানিকগঞ্জ)
ঘিওর উপজেলা (মানিকগঞ্জ) মানিকগঞ্জ সদর থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার পশ্চিমে ৭টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত। আরিচা ফেরিঘাট এ উপজেলায় অবস্থিত হওয়ায় উত্তর ও দক্ষিণ বঙ্গের মধ্যে যোগাযোগের ক্ষেত্রে এর বিশেষ গুরুত্ব ছিল। অতীতকাল থেকেই এ উপজেলার রয়েছে রাজনৈতিক আন্দোলন ও সংগ্রামের এক গৌরবময় ইতিহাস। আইয়ুব- শাসনের বিরুদ্ধে পরিচালিত বিভিন্ন আন্দোলনে ঘিওরের মানুষ সক্রিয় অংশগ্রহণ করে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর ৬-দফা আন্দোলন ও ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান-এ এখানকার ছাত্রসমাজ ও সাধারণ মানুষ বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করে। এসব আন্দোলনের পটভূমিতে অনুষ্ঠিত ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী মো. নুরুল ইসলাম জাতীয় পরিষদে এবং মো. সিদ্দিকুর রহমান প্রাদেশিক পরিষদে বিপুল ভোটে বিজয়ী হন।
মানিকগঞ্জ ও ঘিওর ঢাকার খুব কাছাকাছি অবস্থিত বলে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় পর্যায় থেকে যখন যে নির্দেশ ও কর্মসূচি ঘোষিত হতো, তাৎক্ষণিকভাবে তা ঘিওরেও পালিত হতো। ১৯৭১ সালের ২৭শে মার্চ নৌবাহিনীর সাবেক কর্মকর্তা ও আওয়ামী লীগের সভাপতি আফছার আলী খান এবং সিদ্দিকুর রহমান এমপিএ ঘিওর কলেজ মাঠে ছাত্র, কৃষক, শ্রমিক ও জনতার এক সমাবেশের আয়োজন করেন। সমাবেশে তাঁরা ২৫শে মার্চ রাতে পাকবাহিনী ঢাকার রাজারবাগ পুলিশ লাইন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাস এবং ঢাকা শহরের অন্যত্র অতর্কিতে হামলা চালিয়ে নির্বিচারে যে মানুষ হত্যা করে তার বিবরণ তুলে ধরেন। পাকহানাদার বাহিনী যাতে ঘিওরে প্রবেশ করতে না পারে সেজন্য তাঁরা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান জানান। রাস্তায়-রাস্তায় বেরিকেড তৈরি করার নির্দেশ দেন। লাঠি, কাতরা, সড়কি, দা অর্থাৎ যার যাকিছু আছে তাই নিয়ে পাকসেনাদের প্রতিরোধ করার ঘোষণা দেন। তাঁরা প্রত্যেক গ্রামে প্রতিরোধ কমিটি গঠন করারও পরামর্শ দেন। আফছার আলী খান ও সিদ্দিকুর রহমানের নেতৃত্বে ঘিওরের ছাত্র, শ্রমিক ও জনতা মুক্তিযুদ্ধের প্রাথমিক প্রস্তুতি ও প্রতিরোধে অংশগ্রহণ করে। মূল যুদ্ধ শুরুর পর ঘিওরে মুজিব বাহিনীর কমান্ডার মনসুর আলম খান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।
ঘিওরে নাগরপুরের বাতেন বাহিনী বেশ সক্রিয় ছিল। ঘিওর থানা আক্রমণে এ বাহিনী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ঘিওর থানা সদরে পাকবাহিনীর অনুপ্রবেশ ঠেকাতে ২৭শে মার্চ রাস্তা কেটে এবং বিভিন্ন স্থানে গাছ ফেলে বেরিকেড দেয়া হয়। এদিন রাতে ছাত্র-যুবকদের বিভিন্ন গ্রুপ ঢাকা- আরিচা সড়কে ঘিওর থানার প্রবেশমুখে অবস্থান নেয়। কিন্তু এপ্রিল মাসের শেষদিকে পাকবাহিনী তাদের প্রতিরোধ ভেঙ্গে ঘিওরে প্রবেশ করে।
এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে মানিকগঞ্জ শহরে অনুপ্রবেশের পূর্বে পাকবাহিনী পাঁচ-সাতটি হেলিকপ্টারের সাহায্যে ঢাকা- আরিচা সড়কের বানিয়াজুরীতে বিপুলসংখ্যক ছত্রীসেনা নামায়। তারা তরাঘাটের ফেরি চলাচল নিয়ন্ত্রণে নেয়। এরপর তাদের সাঁজোয়া বহর বিনা বাধায় আরিচা দখল করে। আরিচা দখলের প্রথমদিন তারা তরাঘাটে একজন নিরীহ মানুষকে গুলি করে হত্যা করে। এপ্রিল মাসের শেষদিকে পাকবাহিনী ঘিওর থানা সদরে প্রবেশ করে সেখানে ক্যাম্প স্থাপন করে।
ঘিওর থানা ও এর বিভিন্ন ইউনিয়নে মুসলিম লীগ-এর সমর্থক এবং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানদের নেতৃত্বে শান্তি কমিটি ও রাজাকার বাহিনী গঠন করা হয়। এ দুই বাহিনীর সদস্যরা সংশ্লিষ্ট ইউনিয়নের মুক্তিযোদ্ধা এবং আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন-এর সমর্থকদের তালিকা তৈরি করে তাদের ধরে এনে অত্যাচার- নির্যাতন করত এবং পাকবাহিনীর হাতে তুলে দিত। তাদের কাউকে না পেলে তাদের অভিভাবকদের ওপর নানারকম নির্যাতন চালাত। ঘিওর শান্তি কমিটির নেতাদের মধ্যে মাইনুদ্দিন আহম্মেদ বিএসসি (ঘিওর), ডা. আ. গণি (বাংগালা), আ. ছাত্তার মৌলভী (কাশিমপুর), আ. রাজ্জাক ভুটন (ঘিওর, তেরশ্রী গণহত্যা ও অগ্নিকাণ্ডের অন্যতম হোতা), মো. শাহাদত ফকির (বাঘুটিয়া, তেরশ্রী গণহত্যা ও অগ্নিকাণ্ডের জন্য কুখ্যাত), ডা. মজিবর রহমান (বৈলট), হায়দার আলী (মাইলাগী), আছান (কুস্তা), আ. হাকিম ভূঁইয়া ওরফে মানিক ভূঁইয়া (শ্রীধরনগর), কাজী ইসমাইল হোসেন (বৈকণ্ঠপুর) প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। ঘিওরের বিভিন্ন গ্রামের নেতৃস্থানীয় রাজাকারদের মধ্যে মো. তামেজ উদ্দিন (বাংগালা), রশীদ মণ্ডল, সোহরাব (সিধুনগর), মো. দারোগা আলী (বৈলট), সিরাজ উদ্দিন (কুসুন্ডা), মো. বদর উদ্দিন (কালাচাঁদপুর), মো. বরকত (বাটরাকান্দি), মো. গণি দর্জি (কুস্তা), হানু বিশ্বাস (বালিয়াখোড়া), মিরু (পেচারকান্দা), আলম (পাটাইকোনা), আশ্রব আলী (চর পেচারকান্দা), মাখন (বিনোড়া), লেবু (বানিয়াজুরী), শাখায়াত হোসেন (জাবরা), আ. কাদের (রাথুরা), খলিল মোল্লা (বড়টিয়া), সফিজ উদ্দিন (করজনা), আমজাদ হোসেন (হিজুলিয়া), বিরাজ উদ্দিন (উভাজানী প্রমুখ উল্লেখযোগ্য।
পাকবাহিনী রাজাকার ও শান্তি কমিটির লোকদের সহযোগিতায় ঘিওরের বিভিন্ন গ্রামে ব্যাপক অগ্নিসংযোগ নির্যাতন, লুটতরাজ, হত্যাকাণ্ড চালায়।
তাদের পৈশাচিকতার শিকার হয় বিশেষত হিন্দুসম্প্রদায়ের লোকজন। ঘিওরে সবচেয়ে বড় নৃশংস হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয় তেরশ্রী গ্রামে। ২২শে নভেম্বর এখানে পাকবাহিনী স্থানীয় রাজাকারদের সহায়তায় ৩৫ জন নিরীহ মানুষকে হত্যা করে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এটি তেরশ্রী গণহত্যা হিসেবে পরিচিত।
তেরশ্রী ছাড়া ঘিওরের আরো অনেক জায়গায় পাকবাহিনী ও রাজাকাররা হত্যাকাণ্ড চালায়। থানার বড়টিয়া ইউনিয়নে তাদের হাতে নিহত হন বসন্ত কুমার দাস (পিতা অভয় চরণ দাস, কলিয়া), অনন্ত কুমার দাস (পিতা হেমন্ত কুমার দাস, কলিয়া), সুরেন্দ্রনাথ ভৌমিক (পিতা যতীন্দ্র চন্দ্র ভৌমিক, কলিয়া), প্রাণনাথ সরকার (পিতা প্রিয়নাথ সরকার, কলিয়া), সানা সরকার (পিতা প্রিয়নাথ সরকার, কলিয়া) এবং স্বদেশ বোস (শ্রীবাড়ি)। বানিয়াজুরী ইউনিয়নে নিহত হন খোকা অধিকারী ও তাঁর স্ত্রী (বানিয়াজুরী) এবং বলাই গোস্বামী ও তাঁর স্ত্রী (তরা)। নালী ইউনিয়নে নিহতরা হলেন রবীন্দ্রনাথ সরকার (পিতা উপেন্দ্র সরকার, হেলাচিয়া), কার্তিক রায় (হেলাচিয়া), প্রমা মণ্ডল (পিতা অবিনাশ মণ্ডল, হেলাচিয়া), গীতা মণ্ডল (স্বামী মণীন্দ্র মণ্ডল, হেলাচিয়া), রাখাল চন্দ্র সরকার (পিতা মানিক সরকার, উভাজানী), গেদু সাহা (পিতা মোহিনী সাহা, কলতাবাজার), জীবন কুমার সরকার (পিতা মেঘলাল সরকার, উভাজানী), ফকিরচান (পিতা মটর মল্লিক, উভাজানী), ভজন সরকার (পিতা বৃন্দাবন সরকার, উভাজানী), জিন্নত আলী (পিতা নজর আলী, উভাজানী), সৈয়দ আব্দুল ওহাব (পিতা দরবেশ লোকমান শাহ, দিয়াইল), মো. রহমত আলী বিশ্বাস (পিতা জলিল বিশ্বাস, দিয়াইল)। ঘিওর ইউনিয়নে নিহত হন মোহিনী কান্ত গুহ (ঘিওর), হীরেন্দ কুমার সাহা (ঘিওর), ধীরেন্দ্র নাথ সাহা (ঘিওর), নীলমাধব সাহা (ঘিওর), জগবন্ধু সাহা (ঘিওর), গৌর চন্দ্র সাহা (ঘিওর)। সিংজুরী ইউনিয়নে নিহত হন গোপীনাথ সরকার (সিংজুরী) ও শীবেন্দ্রনাথ সরকার (সিংজুরী)। বালিয়াখোড়া ইউনিয়নে নিহত হন ভানু গোসাই ও তার পিতা (ধুলন্ডী), চিত্ত রঞ্জন বসু (ধুলন্ডী)সহ আরো অনেকে। ঘিওরে কেবল হত্যা নয়, নারীনির্যাতনের ঘটনাও ঘটেছে। ঘিওর থানার বিভিন্ন ইউনিয়নে কমপক্ষে ২৫ জন নারী ধর্ষণের শিকার হন। পাকবাহিনী ও রাজাকাররা অনেক বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে। বরুরিয়া, বাহাদুরপুর, ধানগৌড়ী, তেরশ্রী, করজনা প্রভৃতি গ্রামের অন্তত ৪০টি বাড়ি তারা পুড়িয়ে দেয়। এছাড়া তেরশ্রী বাজারের ১১টি দোকান তারা লুট করে।
তরা, জাবরা ও ঘিওর থানায় পাকবাহিনীর নির্যাতনকেন্দ্র ও বন্দিশিবির ছিল। ঘিওর উপজেলার তরা গ্রামে একটি বধ্যভূমি ও গণকবর রয়েছে, যা বলাই গোস্বামীর বাড়ি বধ্যভূমি ও গণকবর নামে পরিচিত।
মুক্তিযোদ্ধাদের দ্বারা দুবার ঘিওর থানা আক্রমণ ছিল এখানকার মুক্তিযুদ্ধের উল্লেখযোগ্য ঘটনা। প্রথমবার ১৭ই জুন এবং দ্বিতীয়বার ১৭ই জুলাই এ আক্রমণ পরিচালিত হয়। প্রথম আক্রমণ হয় বাতেন বাহিনী কর্তৃক। ছদ্মবেশে থানায় প্রবেশ করে মুক্তিযোদ্ধারা বিনাযুদ্ধে থানা দখল করে নেন। এখান থেকে প্রচুর অস্ত্র ও গোলাবারুদ তাঁদের হস্তগত হয়। দ্বিতীয় আক্রমণ পরিচালিত হয় ক্যাপ্টেন আব্দুল হালিম চৌধুরীর নির্দেশে। ১২-১৩ জন মুক্তিযোদ্ধার একটি দল গেরিলা কায়দায় তিনদিক থেকে থানায় ঝটিকা আক্রমণ করে। একঘণ্টা স্থায়ী এ-যুদ্ধে কয়েকজন পাকসেনা আহত হয়।
ঘিওর উপজেলা ১২ই ডিসেম্বর হানাদারমুক্ত হয়। কিন্তু ১৪ই ডিসেম্বর বিকেলে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে খবর আসে যে, পাকবাহিনীর একটি দল যমুনা নদী পার হয়ে নারচি বিলের প্রান্তে এসেছে। এ খবর শুনে আফজাল হোসেন খান জকির নেতৃত্বে ২০-২৫ জন মুক্তিযোদ্ধা অতর্কিতে পাকসেনাদের আক্রমণ করেন। পাকবাহিনী প্রতিআক্রমণ করলে প্রায় ৩ ঘণ্টা যুদ্ধ চলে। এক পর্যায়ে পাকসেনারা ঢাকার দিকে পালিয়ে যায়। এ-যুদ্ধে একজন পাকসেনা আহত ও দুজন মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে বন্দি হয়।
ঘিওর উপজেলার শহীদ মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে যাঁদের নাম পাওয়া গেছে তাঁরা হলেন- ইমদাদুল হক (পিতা শামসুদ্দিন, হিজুলিয়া, বড়টিয়া; ইপিআর সদস্য, ঢাকার পিলখানায় শহীদ), আব্দুল আজিজ (পিতা মনতাজ মোল্লা, মৌহালী, বড়টিয়া; ঘিওরের বাইরে শহীদ), রমজান আলী (পিতা ইসারত আলী, বাইলজুরী, পয়লা; পুলিশ সদস্য, ঘিওরের বাইরে শহীদ) এবং আব্দুল মজিদ গোলাপ (পিতা জালাল উদ্দিন, গোলাপনগর; সেনাবাহিনীর সদস্য, ঘিওরের বাইরে শহীদ)।
ঘিওর উপজেলার যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- মোহাম্মদ আলী (পিতা মনসুর আলী, কাশিমপুর), ইমান আলী (পিতা মোহাম্মদ আলী, বীর সিংজুরী), আব্দুর রাজ্জাক চৌধুরী (পিতা মাহতাব উদ্দিন চৌধুরী, তরা), মনসুর আলম খান (পিতা ফুল খান, কাউটিয়া), শঙ্কর চন্দ্র দে (পিতা রায়মোহন দে, এবং মনসুর উদ্দিন (পিতা গিয়াস উদ্দিন, হিজুলিয়া)। তেরশ্রী গণহত্যায় শহীদদের স্মরণে তেরশ্রী হাইস্কুলের পূর্বপাশে একটি স্মৃতিফলক নির্মাণ করা হয়েছে। ঘিওর উপজেলা কমপ্লেক্সের সামনে উপজেলার মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের নাম খোদাই করা একটি ফলক রয়েছে। শহীদ মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল মজিদ গোলাপের নামানুসারে তাঁর গ্রামের নাম রাখা হয়েছে গোলাপনগর। [মনজুর আহমেদ]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৩য় খণ্ড