You dont have javascript enabled! Please enable it!

মুক্তিযুদ্ধে গৌরনদী উপজেলা (বরিশাল)

গৌরনদী উপজেলা (বরিশাল) বরিশাল জেলা সদর থেকে ৪৫ কিমি উত্তর দিকে অবস্থিত। এ উপজেলার উত্তরে মাদারীপুর জেলা, পূর্বে বরিশাল জেলার মুলাদি ও বাবুগঞ্জ, মাদারীপুর জেলার কালকিনি এবং পশ্চিমে বরিশালের আগৈলঝাড়া উপজেলা। একটি পৌরসভা ও ৭টি ইউনিয়ন নিয়ে এ উপজেলা গঠিত। বরিশাল বিভাগের প্রবেশদ্বার হওয়ায় এবং ঢাকা-বরিশাল মহাসড়ক মাঝখান দিয়ে চলে যাওয়ায় মুক্তিযুদ্ধকালে এ উপজেলা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে গৌরনদী উপজেলায় আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী আবদুর রব সেরনিয়াবাত এমএনএ এবং আবদুল করিম সরদার এমপিএ নির্বাচিত হন। নিরঙ্কুশ বিজয় লাভ করা সত্ত্বেও পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ক্ষমতা হস্তান্তর না করে ষড়যন্ত্র শুরু করে। ১৯৭১ সালের ১লা মার্চ পাকিস্তানের সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খান ৩রা মার্চের জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করলে সমগ্র দেশের ন্যায় এখানকার মানুষও বিক্ষুদ্ধ হয়ে ওঠে। শুরু হয় বঙ্গবন্ধুর ডাকে অসহযোগ আন্দোলন। গৌরনদী উপজেলার সর্বস্তরের মানুষ এ আন্দোলনে যোগ দেয়। গৌরনদী কলেজের ভিপি ছাত্রনেতা নুরুজ্জামান আকন, এম এ বারী, কুতুবউদ্দিন ফকির, জন বোস ও নিহাজ উদ্দিনের উদ্যোগে মার্চের প্রথম দিকে বিভিন্ন স্কুল-কলেজে পাকিস্তানের স্বৈরশাসকের অগণতান্ত্রিক কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে মিছিল-সমাবেশ শুরু হয়। উপজেলা আওয়ামী লীগ নেতা আবদুর রব সেরনিয়াবাত এমএনএ বিভিন্ন স্থানে ছাত্র-যুবক ও কৃষকদের সঙ্গে মত বিনিময় করে স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য সবাইকে সংগঠিত করার কাজ শুরু করেন।
৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের পর উপজেলায় আবদুর রব সেরনিয়াবাত এমএনএ ও আব্দুল করিম সরদার এমপিএ-র নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের কার্যক্রম শুরু হয়। ৫ই মার্চ প্রথমে বাঁশের লাঠি দিয়ে গৌরনদী কলেজ মাঠে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ শুরু হয়। ১৭ই মার্চ গৈলা হাইস্কুল প্রাঙ্গণে ৩০-৪০ জনের একটি দলকে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রশিক্ষণ দেয়া শুরু হয়। ১লা এপ্রিল গৌরনদী কলেজ মাঠে ২৫ জন যুবককে অস্ত্র প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। পরবর্তীতে আরো ৫০-৬০ জন যুবক প্রশিক্ষণ নেয়। প্রশিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন সেনাসদস্য সৈয়দ আবুল হোসেন, মোশাররফ হোসেন ও সৈয়দ আবুল হাসেম। ক্যাম্প পরিচালনার যাবতীয় ব্যয়ভার বহন করেন আব্দুর রব সেরনিয়াবাত এমএনএ, মতিয়ার রহমান তালুকদার, সৈয়দ মতলুবুর রহমান (মধু মীর), কেশব রায় প্রমুখ আওয়ামী লীগ নেতা। মার্চের মাঝামাঝি সময়ে গৌরনদী থানা, বামরাইল, নলচিড়া ও ভুরঘাটা পুলিশ ফাঁড়ি থেকে প্রায় ১০০টি থ্রি-নট-থ্রি, ২টি এলএমজি ও ৫টি এসএমজিসহ প্রচুর গুলি মুক্তিযোদ্ধারা হস্তগত করেন। এছাড়া ব্যক্তিমালিকানাধীন বেশকিছু অস্ত্র সংগ্রহ করা হয়। এ-সময় চাইনিজ রাইফেলসহ বেশকিছু অস্ত্রও মুক্তিযোদ্ধাদের হস্তগত হয়। চার শতাধিক মুক্তিযোদ্ধা গৌরনদী কলেজ মাঠে প্রশিক্ষণ নেন। মাহিলাড়া হাইস্কুল মাঠে প্রশিক্ষণ নেন ৬০-৭০ জন মুক্তিযোদ্ধা। এছাড়া শরিকল হাইস্কুল, আশোকাঠী স্কুল, নলচিড়া রায়ের বাড়ি, গৌরনদী গার্লস স্কুলের উত্তর পার্শ্বে হরলাল গাঙ্গুলীর বাড়ি ও কাণ্ডপাশা রায়ের বাড়িতে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ও ক্যাম্প স্থাপিত হয়। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত ও ছুটিতে আসা সদস্যরা এসব প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে প্রশিক্ষণ দিতেন। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন- মো. আবুল কাসেম, সার্জেন্ট আবদুর রাজ্জাক চোকদার, সুবেদার গোলাম মোস্তফা, আনসার কমান্ডার শাহ সেকেন্দার, মৌজে আলী, তৈয়ব আলী হাওলাদার, আবদুল জব্বার তালুকদার, কাদের শিকদার, আব্দুস সাত্তার খন্দকার, আলতাফ হোসেন, সৈয়দ আবুল হাসেম, সৈয়দ অলিউল ইসলাম, মোক্তার হোসেন, সিপাহি আলাউদ্দিন সরদার ওরফে আলা বক্স, মোসলেম উদ্দিন, মুজিবুর রহমান, আমিনুল ইসলাম, নূর মোহাম্মদ গোমস্তা প্রমুখ। আবদুর রব সেরনিয়াবাতের নির্দেশে কেশব রায়সহ সংগঠকবৃন্দ ধনাঢ্য ব্যক্তিদের কাছ থেকে চাল, ডাল ও নগদ অর্থ সংগ্রহ শুরু করেন। কেশব রায়ের অভ্যুদয় লাইব্রেরি রসদ সংগ্রহ ও সংরক্ষণ কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হতো।
মো. আবুল কাশেম, নিজামউদ্দিন আকন, শাহ সেকেন্দার, মৌজে আলী, তৈয়ব আলী হাওলাদার, আবদুল জব্বার তালুকদার, কাদের শিকদার, আব্দুস সাত্তার খন্দকার আলতাফ হোসেন, সৈয়দ আবুল হোসেন, নূর মোহাম্মদ গোমস্তা ও খালেক বিভিন্ন পর্যায়ে গৌরনদী উপজেলার যুদ্ধকালীন কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
আবদুর রব সেরনিয়াবাত এমএনএ, আবদুল করিম সরদার এমপিএ, মিহির দাশগুপ্ত, রকিব সেরনিয়াবাত, উসান কাজী, ডা. কামিজ উদ্দিন আহম্মেদ, ইদ্রিস মিয়া, গোলাম মালেক, বিল্ব রায়, ডা. হারেজ মোল্লা, ফখরুল ইসলাম, দ্বিজেন ঘটক, মোসলেম মোল্লা, জব্বার মোল্লা প্রমুখ মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। গৌরনদীতে স্থানীয়ভাবে বিশেষ কোনো বাহিনী গড়ে ওঠেনি। তবে কোটালীপাড়ার <হেমায়েত বাহিনী- এ অঞ্চলে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে বিভিন্ন গেরিলা অভিযান চালায়। এছাড়া হোসনাবাদের নিজাম উদ্দিন ভারত থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে এলাকায় এসে একটি দল গঠন করেন এবং পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে বিভিন্ন যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন।
২৫শে এপ্রিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ঢাকা থেকে সড়ক, নৌ এবং আকাশ পথে বরিশাল আক্রমণ করতে এগিয়ে আসে। এদিন বেলা ১১টার দিকে লক্ষ্মণ দাস সার্কাসের মালিক অরুণ দাসের মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধারা এ খবর জানতে পারেন। খবর পেয়ে আবদুল করিম সরদার এমপিএ-এর নির্দেশে গৌরনদী কলেজ ক্যাম্প থেকে বেইজ কমান্ডার সৈয়দ আবুল হোসেনের নেতৃত্বে ৩৩ জন এবং ডা. আ ন ম আবদুল হাকিম বাহরামের নেতৃত্বে ৩০ জন মুক্তিযোদ্ধা হানাদার বাহিনীকে প্রতিরোধ করতে ভুরঘাটা অভিমুখে রওনা হন। মুক্তিযোদ্ধারা ৩টি সেকশনে বিভক্ত হয়ে কটকস্থলের সউদের খাল নামক স্থানে অবস্থান নেন। হানাদার বাহিনী কটকস্থলে পৌঁছলে মুক্তিযোদ্ধারা তাদের প্রতিরোধ করেন এবং উভয় পক্ষের মধ্যে মুখোমুখি যুদ্ধ হয়, যা কটকস্থল প্রতিরোধযুদ্ধ নামে পরিচিত। এ-যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধারা হানাদার বাহিনীর ভারী অস্ত্রের কাছে টিকতে না পারলেও প্রায় ৩ ঘণ্টা প্রতিরোধ করতে সক্ষম হন। যুদ্ধে ৭ জন পাকিস্তানি সৈন্য নিহত হয় এবং মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ আবুল হাসেম (নাঠৈ), পরিমল মণ্ডল (চাঁদশী), সিপাহি আলাউদ্দিন সরদার (গৈলা) ও মোক্তার হোসেন (দেওপাড়া, বাটাজোড়) শহীদ হন।
২৫শে এপ্রিল দুপুরে পাকিস্তানি বাহিনী গৌরনদী উপজেলায় প্রবেশ করে। প্রথমে তারা গৌরনদী কলেজ, গৌরনদী থানা ও ভুরঘাটায় ক্যাম্প স্থাপন করে। পরবর্তীতে বাটাজোড় অশ্বিনী কুমার ইনস্টিটিউশন, মাহিলাড়া ও বামরাইলে ক্যাস্প স্থাপন করে। এসব ক্যাম্প থেকে তারা প্রতিদিন বিভিন্ন জনপদে ঢুকে নির্বিচারে গণহত্যা, লুণ্ঠন, আগ্নিসংযোগ ও নারীনির্যাতন চালাত।
আফতাব উদ্দিন মুন্সী (গৈলার মুসলিম লীগ- সভাপতি)- কে সভাপতি করে এ উপজেলায় শান্তি কমিটি গঠিত হয়। কমিটির অন্য সদস্যরা হলো— মুন্সী মজিবুর রহমান, মতি সর্দার, নজর আলী, আজিজ মোল্লা, ওমর আলী প্রমুখ। -আলবদর বাহিনীর সদস্য ছিল শাহজাহান, শাহ আলী গোমস্তা, নূর মোহম্মাদ গোমস্তা প্রমুখ। আফতাব উদ্দিন মুন্সী, শাহজাহান ও শাহ আলী গোমস্তা পরবর্তীতে মুক্তিবাহিনীর হাতে নিহত হয়। পাকবাহিনীর অন্যতম দোসর ছিল খাদেম মিলিটারি। সে পাকহানাদারদের পথ দেখিয়ে বিভিন্ন স্থানে নিয়ে যেত। স্বাধীনতার পর মুক্তিবাহিনীর হাতে খাদেম মিলিটারিসহ তার পরিবারের ১০ জন সদস্য নিহত হয়। গৈলা ইউনিয়নের নেছের উদ্দিন বেপারী ছিল কুখ্যাত রাজাকার।
গৌরনদী উপজেলায় হানাদার বাহিনী অনুপ্রবেশের পর গৌরনদী কলেজে ক্যাম্প স্থাপন করে। এ ক্যাম্পের নিকট গয়নাঘাটা ব্রিজে তারা ২৫শে এপ্রিল থেকে ৮ই ডিসেম্বর পর্যন্ত একাধিকবার গণহত্যা চালায়। হানাদার বাহিনীর গয়নাঘাটা ব্রিজ গণহত্যায় কয়েকশ মানুষ শহীদ হন।
২৫শে এপ্রিল অনুপ্রবেশের পরই হানাদার বাহিনী বাটাজোড় ইউনিয়নের বঙ্কুরা গ্রাম আক্রমণ করে লুণ্ঠন ও হত্যাকাণ্ড চালায়। এ-সময় বঙ্কুরা গ্রামের নিরীহ মানুষ নলিনী মণ্ডল (৩০) (পিতা প্রভাত মণ্ডল), গোপাল মাঝি (৪০) (পিতা সুরেন মাঝি), মুজাহার বেপারী (৪৫) (পিতা হাতেম আলী বেপারী) প্রমুখ হানাদার বাহিনীর হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। ২৭শে এপ্রিল হানাদার বাহিনী গৌরনদী থানার সামনে নদীর পাড়ে গণহত্যা চালায়। গৌরনদী থানার সামনে নদীর পাড় গণহত্যায় অর্ধশতাধিক মানুষ শহীদ হন। ২৯শে এপ্রিল তাদের হাতে শহীদ হন বাটাজোড় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সোনামদ্দিন মিয়া। ৫ই মে হানাদার বাহিনী স্থানীয় রাজাকার দলিল উদ্দিন এবং পুলিশ ক্যাম্পের সিরাজ পুলিশের নেতৃত্বে লক্ষ্মণকাঠী গ্রামের সরদার বাড়িতে আক্রমণ করে। তারা সেখানে লুণ্ঠন, নির্যাতন, অগ্নিসংযোগ ও হত্যাকাণ্ড চালায়। এ-সময় কয়েকজন নারী তাদের নির্যাতনের শিকার হন। লক্ষ্মণকাঠী গ্রামের মো. মোদাচ্ছের হোসেন জিলানী বিশ্বাস (১৮) (দাখিল পরীক্ষার্থী), আবদুল খালেক হাওলাদার (৪০), সামসুল হক সরদার (১৫) প্রমুখ হানাদার বাহিনীর হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। ১৪ই মে হানাদার বাহিনী উপজেলার সীমান্ত এলাকার হিন্দু অধ্যুষিত বাকাই গ্রাম আক্রমণ করে লুণ্ঠন, গণহত্যা এবং অগ্নিসংযোগ করে। গ্রামে প্রবেশ করে প্রথমে তারা বাকাই সংস্কৃত কলেজ আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়। এ সময় গ্রামের নিরীহ মানুষ বগলা (৩৫) (স্বামী তুলশী বৈদ্য), গীতা (১২) (পিতা তুলশী বৈদ্য), যজ্ঞেশ্বর বেপারী (৫০) (পিতা লোকনাথ বেপারী) ও সুবাস হালদার (৬৫) হানাদার বাহিনীর গণহত্যার শিকার হন। একই দিন হানাদার বাহিনী মেজর সিরাজের নেতৃত্বে ডোনারকান্দি গ্রামে প্রবেশ করে লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ ও গণহত্যা চালায়। হানাদারদের এ গণহত্যায় রামকৃষ্ণ (৬০) (পিতা বিনয় কৃষ্ণ, ডোনারকান্দি), কালিপদ গাইন (৫০) (পিতা যোগেন্দ্ৰ গাইন, ডোনারকান্দি), বিরাট গাইন (৭০) (ডোনারকান্দি), অনিল মল্লিক (২১) (পিতা জগবন্ধু মল্লিক, নবগ্রাম, কালকিনি, মাদারীপুর) প্রমুখ শহীদ হন। ১৫ই মে হানাদার বাহিনী চাঁদশী কিনাই সিকদার বাড়ি গণহত্যা সংঘটিত করে। হানাদারদের এ গণহত্যায় নারী ও শিশুসহ বেশ কয়েকজন সাধারণ মানুষ শহীদ হন। একই দিন হানাদার বাহিনী স্থানীয় রাজাকারদের সহায়তায় হিন্দু অধ্যুষিত রামসিদ্ধি বাজারে অগ্নিসংযোগ, লুণ্ঠন ও গণহত্যা চালায়। -রামসিদ্ধি বাজার গণহত্যায় মন্দিরে অবস্থানরত পিতা- পুত্রসহ কয়েকজন সাধারণ মানুষকে তারা হত্যা করে। ১৬ই মে হানাদার বাহিনী বাঙ্গিলা গ্রামে গণহত্যা চালায়।
বাঙ্গিলা গ্রাম গণহত্যায় ভূঁইয়া বাড়ির বেশ কয়েকজন নিরীহ মানুষ শহীদ হন। ১৮ই মে হানাদার বাহিনী রাজাকার কমান্ডার খাদেম মিলিটারি, আদম আলী মাস্টার, মানিক রাঢ়ী প্রমুখের সহযোগিতায় আধুনা গ্রাম আক্রমণ করে লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ ও হত্যাকাণ্ড চালায়। হানাদার বাহিনীর আগমনের খবরে অনেকের মতো অমল কৃষ্ণ চক্রবর্তী (৮০) তার মাকে নিয়ে বসন্ত দত্তের বাড়িতে আশ্রয় নেন। হানাদাররা বাড়িতে কাউকে না পেয়ে তার ঘরে আগুন লাগিয়ে দেয়। এরপর তারা বসন্ত দত্তের বাড়িতে আগুন দিলে অনেকে এর পূর্বে প্রফুল্ল দত্তের বাগানে পালিয়ে থাকে। পাকিস্তানি বাহিনী সেখান থেকে অমল কৃষ্ণ চক্রবর্তীকে ধরে পাঁজরে গুলি করলে মারাত্মকভাবে আহত হয়ে শেষ পর্যন্ত তিনি বেঁচে যান। এ-সময় হানাদার বাহিনী গ্রামের বেশ কয়েকজন সাধারণ মানুষকে হত্যা করে। তাদের মধ্যে ৪ জনের পরিচয় জানা গেছে। তারা হলেন— আধুনা গ্রামের প্রভাত ব্যানার্জী, জগদীশ মণ্ডল, নলিনী মিস্ত্রি ও কিশোর বয়সী দিলীপ।
হানাদার বাহিনী বাটাজোড় ইউনিয়নের হরহর মৌজায় ১৮ই মে গণহত্যা চালায়। এ গণহত্যায় দেড় শতাধিক নারী ও শিশু শহীদ হয়। স্থানীয় লোকজন গণহত্যার এ স্থানটির নাম দিয়েছে ‘মরারভিটা’। এটি বাটাজোড় হরহর গণহত্যা- নামে পরিচিত। নিহতদের মধ্যে ৫ মাসের শিশু থেকে ৮৫ বছরের বৃদ্ধ ছিল। হরহর মৌজায় গণহত্যা সংঘটিত করে একই দিন হানাদার বাহিনী জয়শীরকাঠী গ্রামের মণ্ডল বাড়ি, ঘরামি বাড়ি ও শীল বাড়ি আক্রমণ করে লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ এবং হত্যাকাণ্ড চালায়। হানাদারদের ভয়ে জীবন রক্ষার্থে অনেকে পানের বরজে আশ্রয় নেয়। হানাদাররা পানের বরজে আশ্রয় নেয়া মানুষদের গুলি করে হত্যা করে। জয়শীরকাঠী গ্রামের গোপাল শীল (৬০) (পিতা বনমালী শীল), সুনীল শীল (৪৫) (পিতা অক্ষয় শীল), কুঞ্জ ঠাকুর (৬০) (পিতা উমা শংকর চক্রবর্তী), যজ্ঞেশ্বর ঠাকুর (৬৫) (পিতা রবি লোচন), রত্না (৭০) (স্বামী সম্ভু শীল) প্রমুখ হানাদার বাহিনীর হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। এরপর হানাদার বাহিনী এদিনই রাজাকার কমান্ডার খাদেম মিলিটারির সহযোগিতায় দেওপাড়া গ্রাম আক্রমণ করে। তারা দেওপাড়া গ্রামের মণ্ডল বাড়িতে প্রবেশ করে গণহত্যা, লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগ করে। দেওপাড়া গ্রামের অন্নদা মণ্ডল (৬৫) (পিতা পাঁচুরাম মণ্ডল), কেষ্ট মণ্ডল (৬০) (পিতা অমৃকা মণ্ডল), সন্তোষ মণ্ডল (১৩), (পিতা কেষ্ট মণ্ডল), জামিনী কুলু (৬০) (স্বামী নিশি কুলু) প্রমুখ হানাদার বাহিনীর হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। এরপরই হানাদার বাহিনী রাজাকার খাদেম মিলিটারির নেতৃত্বে চন্দ্রাহার গ্রামে হামলা করে এবং হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করে। হানাদার বাহিনীর ভয়ে অধিকাংশ গ্রামবাসী এলাকা ছেড়ে গেলেও বৃদ্ধরা বাড়িতেই অবস্থান করেন। তারা হানাদার বাহিনীর হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। তারা হলেন— উত্তর চন্দ্রাহার গ্রামের নারায়ণ দে (পিতা সুধীর দে), সুরেন দাস (পিতা বকুল দাস) ও নারায়ণ দাস (পিতা দুর্গাচরণ দাস)। মে মাসের শেষদিকে হানাদার বাহিনী মাহিলাড়া ইউনিয়নের বিল অঞ্চলের ছয়গ্রামে হামলা করে। তারা গ্রামে ব্যাপক লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ শেষে হাওলাদার বাড়ি ও হাজী বাড়ি থেকে লাল মিয়া (৩৫), রব হাওলাদার (৪৫) (পিতা ইসমাইল হাওলাদার), সাত্তার হাওলাদার (৩৫) (পিতা আবতাব হাওলাদার)-সহ কয়েকজন সাধারণ মানুষকে ধরে নিয়ে ছয়গ্রাম বাজারে গুলি করে লাশ খালের মধ্যে ফেলে দেয়।
অক্টোবর মাসের মাঝামঝি হানাদার বাহিনী ঘেয়াঘাট গ্রামে গণহত্যা চালায়। ঘেয়াঘাট গণহত্যায় ৫ জন গ্রামবাসী শহীদ হন। ১১ই নভেম্বর হানাদার বাহিনী -লাখেরাজ কসবা গণহত্যা চালায়। এতে ৪ জন মুক্তিযোদ্ধাসহ কয়েকজন গ্রামবাসী শহীদ হন। ২৮শে নভেম্বর কসবা যুদ্ধের পর হানাদার বাহিনী কসবা ব্রিজ সংলগ্ন ঋষি বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে। তারা কালাচান ঋষিসহ কয়েকজনকে ধরে নিয়ে কসবা ব্রিজের ওপর দাঁড় করিয়ে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে লাশ পানিতে ফেলে দেয়
বাটাজোড় অশ্বিনী কুমার মাধ্যমিক বিদ্যালয় ক্যাম্প থেকে প্রতিদিন পাকবাহিনী অপারেশনে গিয়ে এলাকার পর এলাকা জ্বালিয়ে দিত এবং নিরীহ মানুষদের হত্যা করত।
শান্তি কমিটির সভাপতি আফতাব উদ্দিনের পরামর্শে বহু পরিবারের লোকজনকে পাকসেনারা ধরে নিয়ে যায়। পরে আফতাব উদ্দিন অর্থের বিনিময়ে তাদের ছাড়িয়ে আনে।
মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের পর থেকেই হত্যাকাণ্ড, অগ্নিসংযোগ ও নারীনির্যাতনের অভিযোগে পাকবাহিনীর যে-সকল দোসর গ্রেফতার হয়েছিল, তারা হলো- মানিক ফকির (বাটাজোড়), জাহাঙ্গীর তালুকদার (বিল্বগ্রাম), আবদুল গফুর খান (চকরিবন, গৌরনদী), ইসাহাক শেখ (বড়পাইকা), ফজল আলী খান (কসবা), আবদুল মালেক হাওলাদার, আমজাদ আলী সরদার (টিকাসুর), শাহেব খান (কসবা), হোসেন আলী মুন্সী (শংকরদী), নুরুল হক খান (বানগিলা), পাঁচু নিকারী (কসবা), লালু খান (বিজয়পুর), ড. আবদুস সাকেন (বিজয়পুর), মির আজগর আলী (বিজয়পুর), আবদুস সাত্তার মৃধা (বিল্বগ্রাম), বক্তা খান (ছোটো কসবা), মতিউর রহমান সরদার (নাঠৈ), জয়নুল আবেদিন হাওলাদার (আমবোলা), জয়নুল আবেদিন বেপারী (শাহজিরা), জয়নুল আবেদিন (মোল্লাপাড়া), গিয়াসউদ্দিন খান, আক্কাস আলী বেপারী (হরহর), আবদুল মালেক (উত্তর বিজয়পুর), ওয়াজেদ আলী বেপারী (হোসনাবাদ), আবদুল জলিল (গৌরনদী), সিরাজ গাজী (বিনগিলা), আবদুল হাই (নাঠৈ) ও সিরাজুল হক খান (পিঙ্গলাকাঠী)।
গৌরনদী কলেজ ক্যাম্প ছিল পাকবাহিনীর সবচেয়ে বড় নির্যাতনকেন্দ্র ও বধ্যভূমি। গৌরনদী কলেজ বধ্যভূমি-তে মুক্তিযুদ্ধকালে হানাদার বাহিনী কয়েকশ মানুষকে নির্যাতন শেষে হত্যা করে। কলেজ ভবনের ছাদের অংশবিশেষ তারা ভেঙ্গে ফেলে তাদের নিরাপত্তার উপযোগী হিসেবে গড়ে তোলে। এখানে তারা একটি গভীর কূপ খনন করে। নির্যাতনের পর এই কূপে তারা লাশ ফেলে দিত। স্বাধীনতার পর এ কূপটি ভরাট করে ফেলা হয়। এছাড়া হাতেম পিয়নের ঘাটলাও ছিল হানাদার বাহিনীর আরেকটি বধ্যভূমি। হাতেম পিয়নের ঘাটলা বধ্যভূমি-তে হানাদার বাহিনী কয়েকশ মানুষকে হত্যা করে। গৌরনদী থানাকেও তারা নির্যাতনকেন্দ্র ও বন্দিশিবির হিসেবে ব্যবহার করত। এছাড়া কসবা ব্রিজ এবং বাটাজোড় ব্রিজকে হানাদার বাহিনী বধ্যভূমি হিসেবে ব্যবহার করে। হানাদার বাহিনী তাদের অশ্বিনী কুমার ইনস্টিটিউশন ক্যাম্পে আশপাশের লোকজন ধরে এনে উপজেলার খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা হলেন- আব্দুল হক, বীর বিক্রম- (পিতা মো. কফিল উদ্দিন মোল্লা, সাকোকাঠি)। গৌরনদী উপজেলার শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে যাঁদের নাম পাওয়া গেছে, তাঁরা হলেন- সেনাসদস্য মো. মোক্তার হোসেন (পিতা মিনহাজ উদ্দীন বেপারী; ২৫শে এপ্রিল কটকস্থল প্রতিরোধযুদ্ধে শহীদ), পরিমল মণ্ডল (পিতা কেশবনাথ মণ্ডল, চাঁদশী; ২৫শে এপ্রিল কটকস্থল প্রতিরোধযুদ্ধে শহীদ), পুলিশ সদস্য সৈয়দ আবুল হাসেম (পিতা সৈয়দ মোকসেদ আলী, নাঠৈ; ২৫শে এপ্রিল কটকস্থল প্রতিরোধযুদ্ধে শহীদ), আব্দুস সাত্তার খন্দকার (পিতা ওয়াজেদ আলী খন্দকার, কালনা, পিঙ্গলাকাঠী; ২৮শে নভেম্বর কসবা যুদ্ধে শহীদ), হাবিবুর রহমান (পিতা হামিজ উদ্দিন হাওলাদার, সরিকল), তালেব আলী সিকদার (পিতা ছাদেক আলী সিকদার, পিঙ্গলাকাঠী), সোনামুদ্দিন মিয়া (পিতা আইন উদ্দিন মিয়া, দেওপাড়া, বাটাজোড়), সেনাসদস্য কবির উদ্দীন আকন (পিতা আবদুল মান্নান আকন), সেনাসদস্য কাজী জালালউদ্দিন (পিতা কাজী করম আলী), পুলিশ সদস্য এইচ এম ফজলুল হক (পিতা কফিল উদ্দীন), পুলিশ সদস্য মো. হাতেম আলী (পিতা কালু বেপারী) ও পুলিশ সদস্য মো. মাহবুবুর রহমান (পিতা হাসেম আকন)।
মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে উপজেলা চত্বরে নির্মাণ করা হয়েছে ‘মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স’। শহীদ মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ আবুল হাসেমের নামে তাঁর বাড়ি নাঠৈ থেকে চাঁদশী পর্যন্ত রাস্তার নামকরণ করা হয়েছে ‘শহীদ মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ আবুল হাসেম সড়ক’। গয়নাঘাটা থেকে রাজিহার পর্যন্ত সড়কের নামকরণ করা হয়েছে ‘শহীদ পরিমল সড়ক’। মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার নিজামউদ্দিন আকনের নামে হোসনাবাদে স্থাপিত হয়েছে ‘নিজামউদ্দিন কলেজ’ এবং ‘নিজামউদ্দিন স্মৃতি পাঠাগার’। তাঁর কবর পাকা করে নামফলক লাগানো আছে। শহীদ কমান্ডার আবদুস সাত্তার খন্দকারের কবর বাঁধাই করা হয়েছে। ডোনারকান্দি যুদ্ধে শহীদ অনিল মল্লিক স্মরণে ডোনারকান্দি বাজারে একটি ভাস্কর্য নির্মাণ করা হয়েছে। কসবা ব্রিজে শহীদ কালাচান ঋষির স্মরণে তাঁর বাড়িতে একটি সমাধি নির্মাণ করা হয়েছে। [মনিরুজ্জামান শাহীন ও সুশান্ত ঘোষ]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৩য় খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!