You dont have javascript enabled! Please enable it!

মুক্তিযুদ্ধে গোলাপগঞ্জ উপজেলা (সিলেট)

গোলাপগঞ্জ উপজেলা (সিলেট) ৫২-র ভাষা- আন্দোলন, ৬৬-র ছয়দফা আন্দোলন, গণঅভ্যুত্থান এবং ৭০-এর নির্বাচন গোলাপগঞ্জে মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি তৈরি করে। ৭০-এর নির্বাচন উপলক্ষে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান- গোলাপগঞ্জে আসেন। তাঁর আগমনে এ এলাকায় আওয়ামী লীগ-এর পক্ষে গণজোয়ারের সৃষ্টি হয়। আওয়ামী লীগ প্রার্থী মসুদ আহমদ চৌধুরী বিপুল ভোটে এমপিএ নির্বাচিত হন। ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে অনুষ্ঠিত ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের জনসভায় গোলাপগঞ্জ থেকে মসুদ আহমদ চৌধুরী এমপিএ, আওয়ামী লীগ নেতা ওজি উদ্দিন চৌধুরী (রণকেলী), আব্দুল জব্বার (বারকোট) প্রমুখ নেতা উপস্থিত ছিলেন। ঢাকা থেকে ফিরে তাঁরা বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ অনুযায়ী উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতিমূলক কার্যক্রম শুরু করেন।
গোলাপগঞ্জ উপজেলার আওয়ামী লীগ নেতারা যুদ্ধ পরিচালনার জন্য সংগ্রাম কমিটি গঠন করেন। তাঁরা সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি দেওয়ান ফরিদ গাজী- এমএনএ, সাধারণ সম্পাদক ডা. নুরুল ইসলাম চঞ্চল, জেলা আওয়ামী লীগ নেতা ইসহাক মিয়া প্রমুখের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রক্ষা করতেন। গোলাপগঞ্জের নেতারা পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধের পক্ষে জনমত তৈরির জন্য সভা-সমাবেশের আয়োজন করেন। আওয়ামী লীগ ছাড়াও রাজনৈতিক দল হিসেবে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ, মোজাফফর) এ-সময় গোলাপগঞ্জে সক্রিয় ছিল। পাকিস্তানি সামরিক জান্তা কর্তৃক বাঙালিদের ওপর আক্রমণ চালানোর আশঙ্কায় আন্দোলনরত বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা- কর্মীরা উদ্বিগ্ন ছিলেন এবং তাঁরা সতর্ক অবস্থান গ্রহণ করেন। গোলাপগঞ্জ উপজেলার যেসব নেতা মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন, তাঁরা হলেন— আব্দুর রহিম এমএনএ, মসুদ আহমদ চৌধুরী এমপিএ, আব্দুল ফাত্তাহ চৌধুরী (বাঘা), সামছুদ্দিন আহমদ খেতু মিয়া (ফুলবাড়ি), আব্দুল মুঈদ চৌধুরী (ফুলবাড়ি), আব্দুল খালিক চৌধুরী ছাবু মিয়া (রণকেলী), নোমান উদ্দিন চৌধুরী (ভাদেশ্বর), মহিদুজ্জামান চৌধুরী (ভাদেশ্বর), আব্দুল জব্বার (বারকোট), সালাহউদ্দিন ফারুক (কানিশাইল), আব্দুজ জহির চৌধুরী সুফিয়ান (রণকেলী), এডভোকেট ইকবাল আহমদ চৌধুরী (রফিপুর, ফুলপুর), আমিন উদ্দিন ছাদেক (কানিশাইল), মতছির আলী সারং (লক্ষীপাশা), আব্দুস ছালিক (ভাদেশ্বর), আবুল বশর মো. ছদরুল উলা চৌধুরী (কানিশাইল), খয়রুল হুদা চৌধুরী (কানিশাইল), আবুল মিয়া (লক্ষণাবন্দ), আব্দুল ময়িদ ফটিক মিয়া (নগর), ছালেহ আহমদ চৌধুরী (গোলাপগঞ্জ), শামছুদ্দিন আহমদ চৌধুরী বাদশা (রণকেলী), ভানু ভূষণ দাস (রায়গড়, ঢাকা দক্ষিণ), আব্দুল মজিদ রুশন মিয়া (নগর), সুন্দর মিয়া (কালীকৃষ্ণপুর), মফজ্জিল আলী পাখি মিয়া (খাটকাই), আব্দুল মতলিব (কানিশাইল), আফতাব উদ্দিন আহমদ ননী মিয়া (কানিশাইল), আব্দুল মতিজ (কানিশাইল), আব্দুল বাছিত (ফুলবাড়ি), ওমর আলী (নগর), ময়নুল হক (ভাদেশ্বর), আব্দুল মুতলিব (ভাদেশ্বর দক্ষিণভাগ), জমির উদ্দিন (রায়গড়), সিরাজ উদ্দিন আহমদ (বহরগ্রাম), লুৎফুর রহমান (বহরগ্রাম), সাধন চন্দ্র রাউত (শরীফগঞ্জ), নীরেন্দ্র চন্দ্ৰ নাথ (খাটকাই), গজনফর আলী (আমকোনা), কমর উদ্দিন (চন্দরপুর), নজমুল হক (বাগির ঘাট), মুরাকিব আলী (কালিজুরি) প্রমুখ।
১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ ঢাকায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী কর্তৃক গণহত্যা শুরু হলে সিলেটে মোতায়েন ৩১ পাঞ্জাব ব্যাটালিয়নও হত্যাকাণ্ডে মেতে ওঠে। ২৫শে মার্চের আগে পরিকল্পনামাফিক তাদের সিলেট শহরে জড়ো করা হয়। ২৭শে মার্চ হবিগঞ্জ থেকে মেজর চিত্তরঞ্জন দত্ত, বীর উত্তম, লে. কর্নেল এম এ রব ও আওয়ামী লীগ নেতা মানিক চৌধুরীর নেতৃত্বে ইপিআর, আনসার, মুজাহিদ, সৈনিক ও ছাত্র-যুবকদের প্রায় ১৫০ জনের একটি দল সিলেটের উদ্দেশ্যে রওনা হয়। শ্রীমঙ্গল-মৌলভীবাজার হয়ে সিলেটের দিকে আসার পথে সীমান্তে নিয়োজিত ইপিআর সদস্য এবং ছাত্র-জনতা মিলে প্রায় ৪৫০ জনের এ মুক্তিযোদ্ধা দল শেরপুর ও সাদীপুরে পাকসৈন্যদের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যুদ্ধে টিকতে না পেরে পাকসেনারা সিলেটের দিকে পালিয়ে যায়।
সুরমা নদীর দক্ষিণ পাড়ে সিলেট-জকিগঞ্জ রোডে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে ক্যাপ্টেন আজিজের নেতৃত্বে ২য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের এক কোম্পানি সৈনিক মৌলভীবাজার, কুলাউড়া, বিয়ানীবাজার, শেওলা হয়ে ৫ই এপ্রিল গোলাপগঞ্জের রানাপিং-এ অবস্থান নেয়। তাঁদের সঙ্গে বড়গ্রাম- গজুকাটা বিওপি থেকে এক প্লাটুন ইপিআর সদস্য যোগ দেন। ৬ই এপ্রিল আরো অগ্রসর হয়ে তাঁরা রণকেলীতে অবস্থান নেন। ৭ই এপ্রিল ক্যাপ্টেন আজিজের নেতৃত্বে ২য় ইস্ট বেঙ্গল কোম্পানি ধারাবহরের টিলায় অবস্থান নেয় এবং ইপিআর জওয়ানরা ধারাবহর বইটিকরের দিকে এগিয়ে গিয়ে প্রতিরক্ষা-অবস্থান নেন৷ ৮ই এপ্রিল ক্যাপ্টেন আজিজ সিলেটের দিকে অগ্রসর হন এবং নায়েক সুবেদার মতিউর রহমানের নেতৃত্বে এক দল ইপিআর সদস্য বইটিকরে অবস্থান করেন। ১০ই এপ্রিল বইটিকর ছেড়ে ইপিআর প্লাটুন সিলেটের কদমতলীতে যায় এবং ক্যাপ্টেন আজিজ ২য় ইস্ট বেঙ্গল কোম্পানি নিয়ে কিনব্রিজ এলাকায় পৌঁছেন। বেলা ১টার দিকে পাকবাহিনী বিমান হামলা এবং ভারী অস্ত্রের গোলাবর্ষণ শুরু করলে মুক্তিযোদ্ধারা ছত্রভঙ্গ হয়ে যান। ক্যাপ্টেন আজিজ তাঁর সৈনিকদের নিয়ে পিছু হটে শেরপুর হয়ে মৌলভীবাজারের দিকে যান। ইপিআর জওয়ানরা ১১ই এপ্রিল পর্যন্ত কদমতলীতে অবস্থান করেন। এদিন সকাল ১০টার দিকে শত্রুসৈন্যরা আবার হামলা করলে তাঁরা পিছু হটে ফুলবাড়িতে অবস্থান নেন৷
এদিকে মেজর চিত্তরঞ্জন দত্ত ৭ই এপ্রিল থেকে ৯ই এপ্রিল পর্যন্ত সিলেট দখল করে রাখলেও পাকিস্তানি সৈন্যরা সংখ্যা বৃদ্ধি করে ১০ই এপ্রিল পাল্টা হামলা চালায়। ফলে ভারী অস্ত্র ও বিমান হামলার মুখে মেজর দত্তের নেতৃত্বাধীন মুক্তিবাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে একদল তামাবিলের দিকে এবং অন্য দল গোলাপগঞ্জের দিকে পিছু হটে।
১১ই এপ্রিল ন্যাপ নেতা কফিল উদ্দিন চৌধুরীর রণকেলীর বাড়িতে স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও ন্যাপ নেতাদের এবং স্বাধীনতাকামী ছাত্র-জনতার এক জরুরি সভা হয়। এ সভায় মুক্তিবাহিনী ও বিএসএফ-কে সর্বাত্মক সহযোগিতা প্রদানের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। মুক্তিবাহিনীকে সহায়তা প্রদানের লক্ষ্যে আব্দুজ জাহির চৌধুরী সুফিয়ানকে আহ্বায়ক করে সর্বদলীয় সমর পরিষদ গঠিত হয়। গোলাপগঞ্জে আত্মগোপনরত কেন্দ্রীয় ন্যাপ নেতা পীর হাবিবুর রহমান ও কমরেড বরুণ রায় এ সভায় উপস্থিত ছিলেন। এ-সময় স্থানীয় নেতাদের মধ্যে আব্দুজ জাহির চৌধুরী সুফিয়ান (রণকেলী), আবুল বশর মো. ছদরুল উলা চৌধুরী (কানিশাইল), আব্দুল মতলিব (কানিশাইল), নূর উদ্দিন মছলাই (রায়গড়), এডভোকেট ইকবাল আহমদ চৌধুরী (রফিপুর), খয়রুল হুদা চৌধুরী (কানিশাইল), আফতাব উদ্দিন আহমদ ননী মিয়া (কানিশাইল), আব্দুল জব্বার (বারকোট), ওজি উদ্দিন চৌধুরী (রণকেলী), কফিল উদ্দিন চৌধুরী (রণকেলী), আসলমউল্লাহ (ফুলবাড়ি), সামছুদ্দিন আহমদ খেতু মিয়া (ফুলবাড়ি), তকলিছ উল্লাহ (রণকেলী), শামছুদ্দিন আহমদ চৌধুরী বাদশা (রণকেলী), ছালেহ আহমদ চৌধুরী (গোলাপগঞ্জ), আব্দুস সোবহান (দত্তরাইল), হারুন রশিদ খান হিরন (দত্তরাইল)-সহ আরো অনেক নেতা-কর্মী উপস্থিত ছিলেন। গোলাপগঞ্জ সরকারি খাদ্য গুদাম খুলে মুক্তিবাহিনীর জন্য চাল, আটা ইত্যাদির ব্যবস্থা করা হয়। নেতৃবৃন্দ মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য রান্নার ব্যবস্থা করেন।
১২ই এপ্রিল বইটিকরে অবস্থানরত ইপিআর জওয়ানরা ও মেজর দত্তের বাহিনী শেওলা ঘাটে জড়ো হয় এবং এদিনই অগ্রসর হয়ে রানাপিং (গোলাপগঞ্জ) আসে। এরপর বেশকিছু আনসার, মুজাহিদ এ দলে যোগ দিলে ৩০০ জনের একটি দল গঠিত হয়। ইপিআর জওয়ানরা আরো এগিয়ে হেতিমগঞ্জে অবস্থান নেন। বাকিরা বইটিকরে প্রতিরোধের জন্য অবস্থান নেন। ব্রিগেডিয়ার পান্ডের নেতৃত্বে প্রায় ৩০০ বিএসএফ মুক্তিবাহিনীকে সহায়তা দিতে গোলাপগঞ্জ এমসি একাডেমি মাঠে ঘাঁটি করে।
১৩ই এপ্রিল সকাল ৯টার দিকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বইটিকরে মুক্তিবাহিনীর অবস্থানে তীব্র হামলা চালায়। মুক্তিযোদ্ধারাও পাল্টা জবাব দেন। আধঘণ্টা স্থায়ী এ-যুদ্ধে বিপুল সংখ্যক পাকসেনা তিন দিক থেকে হামলা করে। মুক্তিবাহিনী ও বিএসএফ ভারী অস্ত্রের গোলাবর্ষণের মুখে টিকতে না পেরে পিছু হটে শেওলার দিকে চলে যায়। বিএসএফ দলটি সীমান্তের ওপারে চলে যায়। এ-যুদ্ধে ১ জন বিএসএফ জওয়ান শহীদ হন। পাকসেনারা ২ জন বিএসএফ জওয়ানকে আটক করে। পরে পাকিস্তানি বাহিনী সিলেট বেতার কেন্দ্র থেকে এ-যুদ্ধের কথা প্রচার করে। এ-সময় বন্দি বিএসএফ জওয়ানদের বক্তব্য প্রচার করা হয়। বইটিকর যুদ্ধে স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও ন্যাপ নেতারা এবং এলাকাবাসী মুক্তিবাহিনীকে নানাভাবে সহযোগিতা করেন। এ-যুদ্ধের পর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রাথমিক প্রতিরোধ প্রচেষ্টার সমাপ্তি ঘটে। বইটিকর পতনের পর স্থানীয় নেতৃবৃন্দ আত্মগোপন করেন। কেউ-কেউ সীমান্তের ওপারে যান। ন্যাপ-নেতা পীর হাবিবুর রহমান ও কমরেড বরুণ রায় শামছুদ্দিন আহমদ বাদশার বাড়িতে (রণকেলী) কয়েকদিন অবস্থান করে ধারাবহর শিলঘাট হয়ে ভারতে যান। আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুল জব্বার (বারকোট) গাইড হিসেবে তাঁদের সঙ্গে যান।
১৩ই এপ্রিল পাকবাহিনী গোলাপগঞ্জে অনুপ্রবেশ করে। শহরে ঢুকে তারা ব্যাপক লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে। তারপর তারা শেওলার দিকে যায়। এর দুদিন পর মিলিশিয়া বাহিনী গোলাপগঞ্জে আসে। তারা গোলাপগঞ্জ, রণকেলী ও রাঙাডহর এলাকায় লুটপাট ও নির্যাতন চালায়। পরে তারা চারখাই বাজারে (বিয়ানীবাজার উপজেলা) ক্যাম্প স্থাপন করে। ২৬শে এপ্রিল পাকবাহিনীর একটি দল মোগলা বাজার, চৌধুরী বাজার সড়ক পথে ঢাকা দক্ষিণে প্রবেশ করে ব্যাপক লুটপাট, অগ্নিসংযোগ ও হত্যাকাণ্ড চালায়। এ দলের নেতৃত্বে ছিল ক্যাপ্টেন ইফতেখার উদ্দিন মণ্ডল। প্রথমে তারা ঢাকা দক্ষিণ বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ে ক্যাম্প স্থাপন করে। এরপর বাজারের পূর্ব পাশের নগর গ্রামের টেকই মিয়ার বাড়িতে ক্যাম্প স্থাপন করে। এ গ্রামের পূর্বদিকে রাধাজুরি খালের তীর ঘেঁষে বাংকার বানিয়ে তাতে পাকসৈন্যরা অবস্থান নেয়। ১১ই ডিসেম্বর ঢাকা দক্ষিণ ছেড়ে যাওয়ার পূর্ব পর্যন্ত তারা এ ক্যাম্পে অবস্থান করে।
গোলাপগঞ্জ উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিদের মধ্যে ছিল ছাদেক আহমদ চৌধুরী (রণকেলী), হোসেন আহমদ চৌধুরী (রণকেলী), আব্দুল মালিক চৌধুরী মাখন মিয়া (আমুড়া), সোনাহর আলী চৌধুরী (আমনিয়া), নূর উদ্দিন (খাগাইল), মাহমুদ হোসেন (ফুলবাড়ি), মৌলানা আব্দুল মতিন চৌধুরী (ফুলবাড়ি), মৌলানা আব্দুল কুদ্দুছ (ঘোষগাঁও), হাবিবুর রহমান ওরফে মালা দারোগা (ভাদেশ্বর) প্রমুখ। এ উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধবিরোধী রাজনৈতিক দল হিসেবে মুসলিম লীগ – ও জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম সক্রিয় ছিল। মুসলিম লীগের নেতাদের মধ্যে মাহমুদ হোসেন (হাজীপুর, ফুলবাড়ি), ছাদেক আহমদ চৌধুরী (রণকেলী), হোসেন আহমদ চৌধুরী (রণকেলী), রকিব উদ্দিন (গোলাপগঞ্জ), সৈয়দ মশাহিদ আলী (রণকেলী), নূর উদ্দিন (খাগাইল), সোনাহর আলী সোনা মিয়া (আমনিয়া), আব্দুল মালিক চৌধুরী মাখন মিয়া (আমুড়া), শওকত আলী (খাটকাই), মফিদ উদ্দিন আহমদ ধন মিয়া (বারকোট), ছালেহ আহমদ চৌধুরী (শিলঘাট), হাবিবুর রহমান মালা দারোগা (ভাদেশ্বর), আব্দুস ছবুর চৌধুরী হাছনু মিয়া (শিলঘাট), মঈন উদ্দিন (কালিজুরী), শুক্কুর চেয়ারম্যান (কালিজুরী), ইমরান আলী (রায়গড়), আনফর আলী (কালিজুরী), ইদ্রিস আলী (কালিজুরী), আব্দুল আহাদ ময়না মিয়া (বাঘা), সহির উদ্দিন (নগর), আকমল আলী (আমকোনা) ও আব্দুল গফ্ফার (বাগলা) এবং জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের মৌলানা আব্দুল মতিন চৌধুরী (ফুলবাড়ি), মৌলানা আব্দুল কুদ্দুছ (ঘোষগাঁও), মৌলানা হেলাল আহমদ (ঘোষগাঁও) প্রমুখ সক্রিয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করে। গোলাপগঞ্জ থানা শান্তি কমিটির সভাপতি ছিল মুসলিম লীগের নেতা ছাদেক আহমদ চৌধুরী (রণকেলী) এবং সহ-সভাপতি ছিল হোসেন আহমদ চৌধুরী হাছনু মিয়া (রণকেলী)। মুসলিম লীগ ও জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের নেতাদের মাধ্যমে এখানে শান্তি কমিটির কর্মকাণ্ড পরিচালিত হতো।
পাক হানাদারদের সহযোগী হিসেবে গোলাপগঞ্জ উপজেলায় -রাজাকার- বাহিনী গড়ে তোলা হয়। গোলাপগঞ্জ থানার রাজাকার বাহিনীর দায়িত্বে ছিল রাজাকার কমান্ডার শফিক। তার বাড়ি পার্শ্ববর্তী বিয়ানীবাজার থানায়। অত্যন্ত নিষ্ঠুর প্রকৃতির এ রাজাকার এলাকায় পুরো নয় মাস জুড়ে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। হত্যা, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট, নির্যাতন ছিল তার নিয়মিত কাজ। গোলাপগঞ্জ চৌমুহনীতে তার অফিস ছিল। সেখানে ধরে এনে সাধারণ মানুষকে নির্যাতন করা হতো। তার সহযোগীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল মনাই মোল্লা (রণকেলী), আসমান (ইয়াগুল), মকলিছ মাস্টার (ইয়াগুল), আব্দুল মালিক চৌধুরী মাখন (আমুড়া), মুহিব উদ্দিন ওরফে মইয়ব (আমুড়া), আরকান আলী (আমুড়া), ঈমানী (আমুড়া), মাতাব মোল্লা (বাঘা), লাল মিয়া (বাঘা), মাকুলি (বাঘা), আবদুল্লাহ (দাঁড়িপাতন), মাশুক উদ্দিন (বারকোট), আবুল (দত্তরাইল), মো. জিয়াউদ্দিন (বারকোট), আব্দুল্লাহ (দত্তরাইল), পদী (রায়গড়), মাশুক (বাণীগ্রাম), শরাফত (বাণীগ্রাম), কনুহর আলী (বাগির ঘাট), সোনাহর আলী (বাগির ঘাট), সিরাজ (খাটকাই), আফতাব (খাগাইল), আলীজ্জর (খাগাইল), মোশাররফ (খাগাইল) প্রমুখ।
১৩ই এপ্রিল বইটিকরের যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর প্রতিরোধ ভেঙ্গে পড়লে গোলাপগঞ্জ পাকবাহিনীর দখলে চলে যায়। বইটিকর যুদ্ধের পর পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলোতে হানাদাররা ব্যাপক লুটপাট ও হত্যাকাণ্ড চালায়। পরিকল্পনা অনুযায়ী হত্যা করার জন্য তারা আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী ও হিন্দুদের খুঁজতে থাকে। ১৩ই এপ্রিল রফিপুর গ্রামে ৬ জন নিরীহ মানুষকে হত্যা করে। এ ঘটনা রফিপুর গণহত্যা- নামে পরিচিত। তারা এদিন হরিপুর গ্রামের নরোত্তম পালকেও হত্যা করে। রফিপুর গ্রামের তঞ্জই এবং কালা মিয়া নামের দুই রাজাকার এ হত্যাকাণ্ডে সহযোগিতা করে।
১৪ই এপ্রিল পাকবাহিনী ও রাজাকাররা গীৰ্দ্দ গ্রামের ৪ জন নিরীহ নারী-পুরুষকে হত্যা করে। নিহতরা হলেন- নসিদ আলী, কামাল উদ্দিন কাবু, ইলু মিয়া এবং মনোরঞ্জনের মা। বইটিকর পতনের দুদিন পর পাক মিলিশিয়া দল এলে ফুলবাড়ি মাদ্রাসার অধ্যক্ষ জমিয়ত নেতা মাওলানা আব্দুল মতিন চৌধুরী তাদের আওয়ামী লীগ নেতাদের বাড়িঘর চিনিয়ে দেয়। রাজাকারদের সহযোগিতায় তারা আওয়ামী লীগ নেতা মসুদ আহমদ চৌধুরীর বাড়ি (রণকেলী) লুটপাটের পর জ্বালিয়ে দেয়। এদিন আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুল খালিক চৌধুরী ওরফে ছাবু মিয়া (রণকেলী)-র বাড়িসহ রণকেলী গ্রামের ৪টি বাড়ি পুড়িয়ে দেয় হানাদাররা। গোলাপগঞ্জ, রাঙাডহর ও পার্শ্ববর্তী বাজারে পাকবাহিনী ও তাদের সহযোগীরা ব্যাপক লুটতরাজ চালায়।
২৬শে এপ্রিল সড়ক পথে পাকবাহিনীর একটি দল ঢাকা দক্ষিণ বাজারে প্রবেশ করে। তারা রাইফেলের গুলি ছুড়তে- ছুড়তে বাজারে ঢুকে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। ঢাকা দক্ষিণ বাজার ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় নির্বিচারে লুটপাট চালায়। দত্তরাইল গ্রামের কালীকৃষ্ণ দত্ত চৌধুরীর বাড়ি লুটপাটের পর পুড়িয়ে দেয়। ঢাকা দক্ষিণে অবস্থিত শ্রীচৈতন্য দেবের মন্দিরে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে। প্রথমে ঢাকা দক্ষিণ বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ে অস্থায়ী ক্যাম্প বানিয়ে কিছুদিন সেখানে অবস্থান করে। তারপর বাজারের পূর্বদিকে নগর গ্রামে চলে যায়। গ্রামের পূর্ব পাশে রাধাজুরি নদীর তীরে বাংকার তৈরি করে তারা অবস্থান নেয়। ১১ই ডিসেম্বর পর্যন্ত এ দলটি এখানে অবস্থান করে। ক্যাপ্টেন ইফতেখার উদ্দিন মণ্ডল এ দলের অধিনায়ক ছিল।
এপ্রিল মাসের শেষদিকে পাকহানাদাররা বারকোট গ্রামের মনোরঞ্জন চক্রবর্তীকে হত্যা করে। প্রতিবেশী মলিক উদ্দিনের চক্রান্ত ও সহযোগিতায় এ হত্যাকাণ্ড ঘটে। মুসলিম লীগ নেতা হোসেন আহমদ চৌধুরী ও মইয়ব রাজাকারের চক্রান্তে রণকেলী গ্রামের ১৭ জন ছাত্র-যুবককে পাকসেনারা ধরে নিয়ে যায়। তাদের ওপর তারা ব্যাপক নির্যাতন চালায়। রাজনীতিবিদ ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ছালেহ আহমদ চৌধুরী (রণকেলী), কফিল উদ্দিন চৌধুরী (রণকেলী), ওজি উদ্দিন চৌধুরী (রণকেলী), আব্দুল ময়িদ ফটিক মিয়া (ঢাকা দক্ষিণ), লুৎফর রহমানকে (বহরগ্রাম) ধরে নিয়ে সিলেট বিমান বন্দর এলাকায় তাদের ক্যাম্পে চরম নির্যাতন করে। বাগির ঘাট গ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা নজমুল হক, গ্রামের বাসিন্দা ময়না মিয়া, কাপ্তান আলী, তৈয়ব আলী, সুলেমান আলী এবং আরো ২ জনকে আটক করে বিয়ানীবাজার ক্যাম্পে নিয়ে পাকহানাদার ও রাজাকাররা নির্যাতন করে। কনুহর আলী নামে এক রাজাকার তাদের গ্রেফতারে সহায়তা করে।
২৫ ও ২৬শে অক্টোবর গোলাপগঞ্জ উপজেলার আমুড়া ইউনিয়নের সুন্দিশাইল গ্রামে এ এলাকার সবচেয়ে বড় গণহত্যা সংঘটিত হয়। সুন্দিশাইল গণহত্যায় ১৮ জন নিরীহ গ্রামবাসী শহীদ হন। স্থানীয় রাজাকাররা পাকসেনাদের সহযোগিতা করে।
নভেম্বর মাসের শেষদিকে মুক্তিযোদ্ধা জ্ঞানেন্দ্র চক্রবর্তী নিতাই (বারকোট) রায়গড় গ্রামে পুলিশের গুলিতে আহত ও গ্রেফতার হন। আহত অবস্থায় তাঁকে ঢাকা দক্ষিণ বাজারের মধ্য দিয়ে সিলেট বিমান বন্দর এলাকায় স্থাপিত টর্চার সেলে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে নিষ্ঠুর নির্যাতনের পর তাঁকে হত্যা করা হয়। রায়গড় গ্রামের শান্তি কমিটির নেতা ইরমান আলী ও তার ছেলে আমিনুরের চক্রান্তে এ হত্যাকাণ্ড ঘটে।
বাগলা (বাদেপাশা ইউনিয়ন) গ্রামের সনজিদ আলী ও তার ছেলেকে কুখ্যাত রাজাকার কমান্ডার শফিক ও তার সহযোগীরা ধরে নিয়ে যায়। পরে বিয়ানীবাজার ক্যাম্পে তাদের হত্যা করা হয়। শেখপুর গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা আশুককে ধরে নিয়ে হত্যা করে রাজাকার শফিক, আসলম (মানিকোনা) ও তার সহযোগীরা। কুখ্যাত আসলম রাজাকারের বাড়ি পার্শ্ববর্তী ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার মানিকোনা গ্রামে হলেও সে গোলাপগঞ্জ উপজেলার শরীফগঞ্জ, বাদেপাশা, ভাদেশ্বর ইউনিয়নের গ্রামগুলোতে ব্যাপক অত্যাচার ও নির্যাতন চালায়।
গোলাপগঞ্জ উপজেলায় পাকবাহিনী ও রাজাকারদের ক্যাম্পগুলোকে তারা নির্যাতনকেন্দ্র ও বন্দিশিবির হিসেবে ব্যবহার করত। এ উপজেলায় কোনো বধ্যভূমি ও গণকবর নেই। তবে সুন্দিশাইল গণহত্যায় নিহতদের কবর সুন্দিশাইল ও কালীডহর গ্রামের বিভিন্ন স্থানে রয়েছে।
১৩ই এপ্রিল বইটিকরে প্রতিরোধযুদ্ধের পর গোলাপগঞ্জ উপজেলায় পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের বেশ কয়েকটি যুদ্ধ হয়। ৮ই আগস্ট ৪ নম্বর সেক্টরের বারপুঞ্জি ক্যাম্প থেকে দুজন মুক্তিযোদ্ধা গোলাপগঞ্জ পোস্ট ও টেলিফোন অফিস ধ্বংস করেন। ১ জন মুক্তিযোদ্ধা রাজাকারদের হাতে ধরা পড়লে পাকবাহিনী তাঁকে নির্যাতনের পর হত্যা করে।
২৫শে অক্টোবর সুন্দাইল গ্রামের মোকাম টিলায় আত্মগোপনরত মুক্তিযোদ্ধারা পাকবাহিনীকে লক্ষ করে গুলি করলে দুপক্ষের মধ্যে ব্যাপক গোলাগুলি হয়। বিপুল শত্রুসৈন্য ও গোলা-বারুদের মুখে টিকতে না পেরে মুক্তিযোদ্ধারা মোকাম টিলার অবস্থান থেকে নিরাপদ স্থানে সরে যেতে বাধ্য হন। মোকাম টিলা যুদ্ধ-এ ৫ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।
অক্টোবর মাসের শেষদিকে বারপুঞ্জি ক্যাম্প থেকে আসা এক দল মুক্তিযোদ্ধা মোল্লারকোণা গ্রামে (বাদেপাশা) অবস্থান নেয়। পার্শ্ববর্তী খাগাইল গ্রামের আফতাব নামে এক রাজাকার তাঁদের দেখে ঢাকা দক্ষিণ (নগর) ক্যাম্পে পাকসেনাদের সংবাদ দেয়। পাকসৈন্য এবং রাজাকাররা মোল্লারকোণা গ্রামে হামলা চালায়। মুক্তিযোদ্ধারাও পাল্টা জবাব দেন। প্রায় এক ঘণ্টার যুদ্ধে ১ জন মুক্তিযোদ্ধা ঘটনাস্থলে শহীদ হন।
নভেম্বর মাসে ৪ নম্বর সেক্টরের কুকিল ক্যাম্প থেকে ৮০ জন মুক্তিযোদ্ধার একটি দলকে হাকালুকি হাওর অতিক্রম করে ফেঞ্চুগঞ্জের ঘিলাছড়া পাহাড়ে কৌশলগত অবস্থান নিয়ে পাকবাহিনীর ওপর চোরাগোপ্তা হামলা চালানোর জন্য পাঠানো হয়। ৪টি নৌকায় মুক্তিযোদ্ধাদের দলটি হাকালুকি হাওরে প্রবেশ করার পর ফেঞ্চুগঞ্জের দিক থেকে ১৫-১৬টি স্পিডবোটে আসা বিপুল সংখ্যক পাকসৈন্য তাঁদের ওপর হামলা চালায়। মুক্তিযোদ্ধারা পাল্টা জবাব দিলে উভয় পক্ষে প্রায় ১ ঘণ্টা যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে একজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। এক সময় মুক্তিযোদ্ধারা ছত্রভঙ্গ হয়ে একদল বড়লেখা উপজেলাধীন বর্ণি গ্রাম এবং অন্য দল গোলাপগঞ্জ উপজেলার শরীফগঞ্জ ইউনিয়নের মেহেরপুর গ্রামে যায়। পাকবাহিনী ভারী অস্ত্রের গোলাবর্ষণ শুরু করলে মেহেরপুর থেকেও তাঁদের পিছু হটতে হয়। পরে উভয় দল সীমান্তের ওপারে চলে যায়। বশির, খায়ের, আলাউদ্দিন, গফুর ও আর একজন মুক্তিযোদ্ধা দলছুট হয়ে মাটিজুরার দিকে যান। পরে চন্দরপুর হয়ে তাঁরা নালিউরী (ভাদেশ্বর ইউনিয়ন) গ্রামে ১ সপ্তাহ আত্মগোপনে থেকে সীমান্তের ওপারে কুকিতল ক্যাম্পে ফিরে যান।
৬-৮ই ডিসেম্বর গোলাপগঞ্জ-ঢাকা দক্ষিণ থেকে আসা পাকসেনা, রাজাকার ও পুলিশের একটি দল বারপুঞ্জি ক্যাম্প থেকে আসা লামা মেহেরপুর গ্রামে অবস্থানরত এক দল মুক্তিযোদ্ধার ওপর আক্রমণ করে। শত্রুরা পনাইরচক গ্রামে অবস্থান নিয়ে গুলিবর্ষণ শুরু করলে মুক্তিযোদ্ধারা পাল্টা জবাব দেন। উভয় পক্ষে সারারাত গুলি বিনিময়ের পর মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণের মুখে টিকতে না পেরে পাকিস্তানি হানাদাররা কুশিয়ারা নদী পাড়ি দিয়ে ভাদেশ্বর হয়ে ঢাকা দক্ষিণের দিকে পালিয়ে যায়।
১১ই ডিসেম্বর ভাদেশ্বর ইউনিয়নের নালিউরী গ্রামে কমান্ডার মাহবুবের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা মাইন অপারেশন চালান। ভাদেশ্বরেরর দিক থেকে আসা পাকিস্তানি সৈন্যভর্তি একটি বাস ধ্বংস করার জন্য তাঁরা রাস্তায় মাইন পুঁতে রাখেন। বাসের চাকার চাপে মাইন বিস্ফোরণ ঘটায় ১ জন হানাদার সেনা ঘটনাস্থলে নিহত হয় এবং বাকিরা পালিয়ে যায়। মুক্তিযুদ্ধের শেষদিকে ফতেপুর (ভাদেশ্বর) গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার কুখ্যাত রাজাকার আসলাম-কে কাদিপুর খেয়াঘাটে আক্রমণ করে। এখানে মুক্তিযোদ্ধাদের ব্রাশ ফায়ারে সে নিহত হয়। ১১ই ডিসেম্বর গোলাপগঞ্জ উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়।
উপজেলার খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- নায়েক শফিক উদ্দিন চৌধুরী, বীর উত্তম- (পিতা আব্দুল করিম চৌধুরী, রণকিনি), আফতাব আলী, বীর উত্তম ও বীর প্রতীক- (পিতা ইদ্রিস আলী, দক্ষিণ ভাদেশ্বর), হাবিলদার জুম্মা মিয়া, বীর বিক্রম – (পিতা ওসমান আলী, হেতিমগঞ্জ), শমসের মবিন চৌধুরী, বীর বিক্রম- (পিতা আব্দুল মুমিন চৌধুরী, ভাদেশ্বর), তৌহিদ আলী, বীর বিক্রম- (পিতা মিছির আলী, মুকিতলা), ইয়ামিন চৌধুরী, বীর বিক্রম- (পিতা আব্দুল হামিদ চৌধুরী, রণকিনি), মো. তাহের আলী, বীর বিক্রম- (পিতা শেখ আবরু মিয়া, কিছমতমাইবাগ, হাতিমগঞ্জ), আব্দুল মালেক, বীর প্রতীক- (পিতা মজির আলী, নগর), নান্নু মিয়া, বীর প্রতীক- (পিতা আবদুল হক, দাড়িপত্তন), মো. আব্দুস সালাম, বীর প্রতীক – (পিতা হাফিজ মোজাম্মেল আলী, বরায়া) ও ফকরুদ্দিন চৌধুরী, বীর প্রতীক (পিতা বোরহানউদ্দিন চৌধুরী, ফুলবাড়ি)।
উপজেলার শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন— শফিক উদ্দিন চৌধুরী, বীর উত্তম (১৬ই সেপ্টেম্বর কলারোয়া যুদ্ধে শহীদ), তৌহিদ আলী, বীর বিক্রম (১৫ই ডিসেম্বর – রাধাকান্তপুর যুদ্ধে শহীদ), জুম্মা মিয়া, বীর বিক্রম (৯ই মে বিবির বাজার যুদ্ধে শহীদ), লে. কর্নেল মুজিবুর রহমান চৌধুরী (পিতা তুতিউর রহমান চৌধুরী, রণকেলী), নায়েব সুবেদার এম শওকত আলী (পিতা ফয়াজ আলী, ফুলসাইন্দ), নায়েক আছাব আলী (পিতা ওয়াহিদ আলী, দড়া মোল্লারচক), সিপাহি সৈয়দ আমিরুল ইসলাম (পিতা তোফাজ্জল আলী, কদমরসূল), সিপাহি মোক্তাদা কামাল (পিতা আব্দুল মজিদ, লীপাশা), সিপাহি আব্দুল মন্নান (পিতা হাজী নুরুল ইসলাম, কিসমত মাইজভাগ), সিপাহি সোয়াব আলী (পিতা হাজী নুরুল ইসলাম, কিসমত মাইজভাগ), সিপাহি মো. সাজেদ আলী (পিতা সাইফ আলী, পূর্বভাগ), সিপাহি সাইফ উদ্দিন (পিতা মাসি উদ্দিন, বাঘা), সিপাহি খলিলুর রহমান (পিতা আলতাফুর রহমান, করগাঁও), সিপাহি জহুর উদ্দিন (পিতা হাসেম আলী, কাদিপুর), সিপাহি আব্দুল খালেক (পিতা আরফান আলী, হিলালপুর), সিপাহি ইসফার আলী (পিতা তরিকুল্লাহ, কায়স্থগ্রাম), সিপাহি আব্দুল মুকিত (পিতা কুতুব আলী, চন্দনভাগ), সিপাহি এখলাছ উদ্দিন (পিতা মোছাদ্দার আলী, খৰ্দ্দাপাড়া), সিপাহি মোস্তফা মিয়া (পিতা ওয়াছিল আলী, বাউসী), লুলু মিয়া (পিতা মজম্মিল আলী, শেখপুর), মো. ছমির উদ্দিন (পিতা আমির আলী, আমকোনা), আশরাফ আলী (পিতা আব্দুস ছাত্তার, শেখপুর), সিপাহি মো. আব্দুল রফিক (পিতা আছদ আলী, লণাবন্দ), সিপাহি আব্দুল খালেক (পিতা আব্দুল ওয়াদ, মাইজভাগ), সিপাহি ইসবর আলী (পিতা ওছির আলী, কায়স্থগ্রাম), সিপাহি মফিজ আলী (পিতা ওছির আলী, ঘোষগাঁও), সিপাহি ছয়েফ উদ্দিন চৌধুরী (পিতা মশিহর উদ্দিন চৌধুরী, বাঘা), সিপাহি মো. তৌহিদ আলী (পিতা মিছির আলী, মুকিতলা), সিপাহি ইরপান আলী (পিতা ইজ্জাদ আলী, করগাঁও), সিপাহি আতিক আহমদ চৌধুরী (পিতা ইলাছ চৌধুরী, রণকেলী), সিপাহি লিচু মিয়া (পিতা সাজ্জাদ আলী, তুরুক ভাগ), সিপাহি নুরুল হক (পিতা মোফাজ্জল আলী চৌধুরী, শেরপুর), সিপাহি মুক্তাদির আলী (পিতা সোনাহর আলী, হাজীপুর), সিপাহি মাতুক মিয়া (পিতা আকাদুর মিয়া, নিমাদল), সিপাহি সোহরাব উদ্দিন (পিতা হাজী মদরিছ আলী, বাদেপাশা), আনুর আলী (পিতা জহির আলী, কানিশাইল), সিপাহি আব্দুর রাজ্জাক (পিতা আছদ্দর আলী, বাগলা), নামর হোসেন (পিতা তকবুল আলী, বাণীগ্রাম), জ্ঞানেন্দ্ৰ চক্রবর্তী (পিতা গোপীকা রঞ্জন চক্রবর্তী, বারকোট), কাজী মাতু মিয়া (পিতা কাজী জাহান বক্স, কালিকৃষ্ণপুর) ও মানিক উদ্দিন (পিতা নজিব উদ্দিন, নগর)।
গোলাপগঞ্জ উপজেলায় শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে ২টি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ ও ৪টি সড়কের নামকরণ করা হয়েছে। সেগুলো হলো শহীদ স্মৃতিসৌধ (সুন্দিশাইল), লক্ষণাবন্দ স্মৃতিসৌধ এবং শহীদ শফিক উদ্দিন সড়ক (রণকেলী), শহীদ সিপাহি জুম্মা মিয়া সড়ক (হেতিমগঞ্জ), শহীদ আব্দুল মন্নান সড়ক (কায়স্থ গ্রাম) ও শহীদ লুলু মিয়া সড়ক (শেখপুর)। [কাজল কান্তি দাস]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৩য় খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!