বীর প্রতীক গোলাম দস্তগীর গাজী
গোলাম দস্তগীর গাজী, বীর প্রতীক (জন্ম ১৯৪৮) বীর মুক্তিযোদ্ধা, রাজনীতিবিদ ও ব্যবসা উদ্যোক্তা, স্বাধীনতা পদক প্রাপ্ত। তিনি ১৯৪৮ সালের ১৪ই আগস্ট ঢাকা শহরের নারিন্দায় জন্মগ্রহণ করেন। নারায়ণগঞ্জ জেলার রূপগঞ্জ উপজেলায় তাঁর পৈত্রিক বাড়ি। তাঁর পিতার নাম গোলাম কিবরিয়া গাজী এবং মাতার নাম শামসুন্নেছা বেগম। তিনি ১৯৬৩ সালে পগোজ স্কুল থেকে মেট্রিকুলেশন, ১৯৬৫ সালে নটরডেম কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট এবং ১৯৬৮ সালে জগন্নাথ কলেজ থেকে বিএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ছাত্রজীবন থেকেই তিনি আন্দোলন-সংগ্রামে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। তিনি ৬৬-র ৬ দফা আন্দোলন, ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ৭০-এর নির্বাচন ও ৭১-এর অসহযোগ আন্দোলন-এ ছাত্রলীগ-এর কর্মী হিসেবে রাজপথে সক্রিয় ছিলেন।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর প্রাক্কালে গোলাম দস্তগীর গাজী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে সেন্ট্রাল ল’ কলেজে আইনের ছাত্র হিসেবে অধ্যয়নরত ছিলেন। ২৫শে মার্চ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী অপারেশন সার্চলাইট-এর নামে ঢাকাসহ সারা দেশে নিরস্ত্র-নিরীহ বাঙালিদের ওপর হত্যাযজ্ঞ শুরু করলে তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। তিনি ২নং সেক্টরের অধীনে মেলাঘর মুক্তিযুদ্ধ প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে মেজর খালেদ মোশাররফ ও ক্যাপ্টেন এ টি এম হায়দারের অধীনে ক্র্যাক প্লাটুন-এ বিশেষ গেরিলা প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। প্রশিক্ষণ শেষে মুক্তিযোদ্ধাদের এ প্লাটুনটি অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে গেরিলা পদ্ধতিতে ঢাকা শহরে বহু সফল আক্রমণ পরিচালনা করে পাকিস্তানি সেনাদের মধ্যে ব্যাপক ত্রাসের সৃষ্টি করেন। বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে— সেনা শাসকদের এ প্রচারণা ব্যর্থ করার প্রয়াসে বিদ্যুৎকেন্দ্র, বিপণিকেন্দ্র, বিদেশী দাতা সংস্থার প্রতিনিধি ও বিদেশী সাংবাদিকদের অবস্থানের ওপর গেরিলা আক্রমণ করাই ছিল তাঁদের মূখ্য উদ্দেশ্য। গোলাম দস্তগীর গাজী এবং তাঁর দল ঢাকা শহরে যে-সকল সফল গেরিলা অপারেশন পরিচালনা করেন, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- ১৮ই জুলাই গ্যানিজ ও ভোগ বিপণিকেন্দ্রে গ্রেনেড ও বোমা নিক্ষেপ করে ক্ষতিসাধন এবং সেখানে অবস্থানরত -রাজাকার- ও পুলিশ বাহিনীকে হতাহত করা; ১৯শে জুলাই ঢাকার খিলগাও বিদ্যুৎ সাব-স্টেশন অপারেশন (এতে ট্রান্সফরমারটি বিস্ফোরিত হলে শহরে বিদ্যুৎ প্রবাহে বিঘ্ন ঘটে এবং রেডিও-টেলিভিশন সম্প্রচার বাধাগ্রস্ত হয়); ১৯শে জুলাই গোলাম দস্তগীর গাজী এবং তাঁর সহযোদ্ধাগণ উলুন বিদ্যুৎ কেন্দ্রে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে এর ব্যাপক ক্ষতিসাধন করেন এবং সেখানে পাহারারত ১৬ জন পুলিশ ও নিরাপত্তাকর্মীকে আত্মসমপর্ণে বাধ্য করেন। এছাড়াও ১১ই আগস্ট গোলাম দস্তগীর গাজী এবং তাঁর দল ঢাকা হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে ২ বার টাইম বোমার বিস্ফোরণ ঘটান এবং সে ঘটনা বহির্বিশ্বে গুরুত্বসহকারে প্রচার পায়।
মহান মুক্তিযুদ্ধে বীরত্ব ও সাহসিকতাপূর্ণ অবদানের জন্য গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার গোলাম দস্তগীর গাজীকে ‘বীর প্রতীক’ খেতাবে ভূষিত করে। ২০২০ সালে তিনি সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মাননা ‘স্বাধীনতা পদক’ প্রাপ্ত হন।
একজন সফল রাজনীতিবিদ হিসেবে গোলাম দস্তগীর গাজী নারায়ণগঞ্জ-১ (রূপগঞ্জ) নির্বাচনী এলাকা থেকে ২০০৮, ২০১৪ এবং ২০১৮ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে পরপর ৩ বার জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন। বর্তমানে তিনি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের বস্ত্র ও পাট মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
স্বাধীনতাপরবর্তী সময়ে গোলাম দস্তগীর গাজী তাঁর বুদ্ধিমত্তা, উদ্ভাবনী শক্তি ও কর্ম-প্রচেষ্টাকে কাজে লাগিয়ে যুদ্ধ-বিধ্বস্ত বাংলাদেশের উন্নোয়নে শিল্পখাতকে এগিয়ে নেয়ার লক্ষ্যে প্লাস্টিক ও রাবারজাত পণ্য উৎপাদনকারী কারখানা স্থাপন করেন। একজন সফল শিল্পপতি হিসেবে তিনি বর্তমানে গাজী স্যাটেলাইট টেলিভিশন লি. সহ গাজী গ্রুপের ১২টি শিল্প প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী। একজন সফল রাজনীতিবিদ ও শিল্প উদ্যোক্তার বাইরেও তিনি একজন বিশিষ্ট সমাজসেবক ও ক্রীড়ানুরাগী হিসেবে সুপরিচিত। সমাজসেবামূলক কার্যক্রমে বিশেষ অবদান রাখার জন্য এ বীর মুক্তিযোদ্ধা ২০১৮ সালে ‘মাদার তেরেসা’ পদকে ভূষিত হন। গোলাম দস্তগীর গাজীর স্ত্রী হাসিনা গাজীও রাজনীতিতে সক্রিয় রয়েছেন। এ দম্পত্তির ২ পুত্র সন্তান রয়েছে। [সাজাহান মিয়া]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৩য় খণ্ড