দি টাইম্স, মঙ্গলবার, ৭ই ডিসেম্বর, ১৯৭১
ঢাকা মোমের আলোয় খাবার খাচ্ছে দিনভর বিমান থেকে গুলিবর্ষণের পর
একটি কুকুর ডাকছে, শিশুরা ছাদ থেকে দেখছে বিমান মহড়ার জমকালো প্রদর্শনী …… যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত রাজধানীতে জীবন এগিয়ে চলে
ঢাকা থেকে জেমস পি. স্টেরবা কর্তৃক, ডিসেম্বর ১ (বিলম্বিত)
পুরো শহর অন্ধকারে ঢেকে আছে রাত ৮:৩০ মিনিটে। কোনোকিছুই নড়ছে না। সন্ধ্যা ৫:৩০ মিনিট থেকে জারি করা কারফিউর কারণে রাস্তায় কেউ নেই। ঘরের পর্দা টানা, জানালা থেকে দূরে ঢাকা দেয়া মোমবাতি জ্বলছে। খুব সামান্যই শব্দ হচ্ছে। মাঝে মাঝে একটা কুকুর ডাকছে, একটা জীপ বা লরি (ট্রাক) চলে যাচ্ছে, বাতি নেভানো।
মেঘ চাঁদের আলো স্তিমিত করে দিয়েছে, তারাগুলো ঝাপসা। কাকগুলো, দিনভর ভারতীয় এবং পাকিস্তানী জঙ্গিবিমানগুলোর সাথে আকাশে ওড়ার পর, তাদের কোলাহলপূর্ণ সতর্ক প্রহরায় ক্ষান্ত দিয়েছে। পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী কান পেতে অপেক্ষায় রয়েছে।
রাত ৮:৩২ মিনিটে দূর থেকে তিনটি বিস্ফোরণের শব্দ শুনতে পায় ঢাকা। একটি সাইরেন বাজতে থাকে। জেটবিমানের কোন শব্দ নেই। আবারো গভীর-শব্দের একটি সাইরেন বাজতে থাকে।
এখন রাত ৮:৩৭ মিনিটে একটি জেটবিমানের উড়ে যাবার শব্দ শোনা যায়। সেটি অনেক উঁচুতে এবং দূরে রয়েছে। একের অধিক বিমান রয়েছে, তাদের কোনটিই এখনো পর্যন্ত গুলি ছুঁড়ছে না।
জাতি সঙ্ঘের কর্মচারী, ঠিকাদার, ত্রান-সংস্থার কর্মী – মার্কিন, ব্রিটিশ, অস্ট্রেলীয় এবং অন্যান্য দেশের – তাড়াহুড়ো করে গুছানো স্যুটকেস নিয়ে গাদাগাদি করে আশ্রয় নিয়েছে ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে, উদ্ধারের অপেক্ষায়।
তাদেরকে বলা হয়েছিল জাতিসংঘের একটি বিমান, একটি মার্কিন সি-১৩০ হারকিউলিস, ব্যাংকক থেকে আসছে তাদেরকে বের করে নিয়ে যেতে। শিশুরা বিহ্বল, কেউ কেউ কান্না করছে। হোটেলটির হলঘরের আলো জ্বলছে কিন্তু অন্য ঘরগুলোর এবং নিচ-তলার আলোগুলো নিভিয়ে দেয়া হয়েছে এবং জানালাগুলো টেপ দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়েছে।
স্কটল্যান্ডের বাবুর্চি আরেকটি রাতের খাবার তৈরী করেছে মুরগী এবং ভেড়ার মাংসের তরকারি, ভাত, শসা দিয়ে রান্না করা মাছ, ঠাণ্ডা বাসনকোসন দিয়ে; কোন বিয়ার বা কোক নেই। খাদ্য পরিবেশনের দায়িত্বে থাকা লোকটি আমাকে জানায় বিকেল থেকেই সবাই জড়ো হতে শুরু করেছে। সবাই মোমের আলোতে রাতের খাবার খাচ্ছে, গুজব নিয়ে এবং অবস্থা আরো খারাপ হবে না ভালো হবে তাই নিয়ে আলোচনা করছে। বেশীরভাগই মনে করছে যে অবস্থা আরো খারাপ হবে।
প্রায় ৫০ জন সাংবাদিক এই হোটেলে অবস্থান করছে মোমের আলোয় তাদের টাইপরাইটার টিপছে এবং ছিটেফোঁটা তথ্য সংগ্রহ করছে। চিত্রগ্রাহক এবং চলচিত্র কর্মী এবং লেখকেরা তাদের চলচিত্র এবং লেখা কিভাবে পাঠাবে তাই নিয়ে চিন্তিত। বাইরের খবরের আশায় ক্রমাগত রেডিওর ষ্টেশন খোঁজা হচ্ছে।
বিকেলেই হোটেল পরিপূর্ণ হয়ে গেছে। উদ্ধারের অপেক্ষায় থাকা মানুষদের পাশাপাশি বিমান বন্দর থেকে পাকিস্তান আন্তর্জাতিক বিমান পরিবহণের কর্মীরাও এসে জড়ো হয়েছে, প্রতি ঘরে তিন বা চার জন করে। আজকে বিমান বন্দরের উপর চালানো ভারতীয় বিমান হামলায় তাদের নয়জন সহকর্মী নিহত হয়েছে। তারা জানায় এই বিমান হামলাগুলো গতকাল রাত ৩ টায় শুরু হয় এবং মাঝ বিকালে শেষ হয়।
“অবশ্যই, তাদেরকে চা পানের বিরতি নিতেই হতো”, কেউ একজন বলে ওঠে।
এখন রাত ৯:১৪ মিনিট এবং দূর থেকে আরেকটি বিস্ফোরণের ভোঁতা শব্দ শোনা যায়, আরেকটি সাইরেন বেজে ওঠে।
সরকারী তথ্য দপ্তরের কর্মকর্তারা সন্ধ্যা ৭:৩০ মিনিটে বলেন যে আজ পাকিস্তানের দুই অংশ মিলিয়ে ৩১টি ভারতীয় বিমান ভূপাতিত করা হয়েছে, যদিও কেউই আসলে তা বিশ্বাস করছে না। পূর্ব পাকিস্তানে তেরটি বিমান ভূপাতিত করা হয়েছে, সে বলে। সাংবাদিকেরা ঢাকার আকাশে চারটি বিমানকে ভূপাতিত হতে দেখেছে এবং অন্য তিনটি বিমান থেকে ধোঁয়া বের হতে দেখেছে বিমান-বিধ্বংসী কামানের গোলা লেগে।
পাকিস্তান বিমান বাহিনীর দাবী তারা নয়জন ভারতীয় পাইলটকে আটক করেছে, তাদের মধ্যে একজন উইং কমান্ডারসহ। তারা আরো জানায় একটি ভারতীয় এস ইউ ৭, রাশিয়ার তৈরী জঙ্গিবিমান, কে বিমান ঘাঁটিতে অক্ষত অবস্থায় অবতরণ করতে বাধ্য করা হয়।
দুটি পাকিস্তানী এফ-৮৬ জঙ্গিবিমান ভূপাতিত হয়েছে, তারা বলে, এগুলোর মধ্যে একটি ভারতীয় একটি মিগ ২১ বিমানকে ধাওয়া করার সময় পাকিস্তানী বিমান-বিধ্বংসী গোলায় আঘাতগ্রস্ত হয়। “এটি খুবই দুঃখজনক ব্যপার, কিন্তু অন্তত ভারতীয়রা তো আর এটিকে ভূপাতিত করতে পারেনি”, তারা যোগ করে।
এই বিমান হামলাগুলো হাজার হাজার ঢাকা বাসীর জন্য এক জমকালো প্রদর্শনীর আয়োজন করেছে। ছোট্ট শিশুরা ছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে ভালো করে দেখার জন্য যখন ভারতীয় মিগ জঙ্গিবিমানগুলো শহরের মাঝখান দিয়ে উড়ে যায় বিমানবন্দরে তাদের গুলি এবং বোমা বর্ষণের জন্য।
মানুষেরা দালানের উপর থেকে দেখছিল মাঝে মাঝে মাথা নিচু করে যখন বিমান-বিধ্বংসী গোলা খুব কাছে বিস্ফোরিত হয়। হোটেলের বাসিন্দারা ছাদে উঠে আসে, যেখানে রঙিন-টেলিভিশনের ক্যামেরা দিয়ে রেকর্ড করা হয় ব্যালে নৃত্যের মতো বিমান যুদ্ধ এবং বিমানবন্দরের উপর তাদের আক্রমণ।
একটি চলচিত্র গ্রাহক দল তাদের সাঁতারের পোশাক পড়ে কাজ করছিল এই বলে যে এই সুযোগে তারা সূর্যস্নান করে নিতে চায়। অন্যরা ঠাণ্ডা পানীয় এবং দুপুরের খাবার পরিবেশন করতে বলে সেখানেই।
যখন একটি মিগ বিমান পিছনে দুটি স্যাবর বিমানের তাড়া খেয়ে উড়ে যায় এবং তারপর নিচু দিয়ে উড়ে যায় বিমান বন্দরের উপর দিয়ে, একজন ক্যামেরাম্যান তখন একজন ওয়েটারের দিকে ফিরে বলেঃ “হে ওয়েটার, ওয়েটার। দ্বিগুণ পানীয়ের ফরমাশ করছি – ফল মিশ্রিত পানীয় এবং লেবুর রস আর বরফ দেয়া চা”।
দুপুর ১২:৩০ মিনিটে সামরিক অফিসাররা সাংবাদিকদেরকে বিমানবন্দরে নিয়ে যায় ভূপাতিত একটি ভারতীয় মিগ বিমান দেখাতে। তারা ঠিক এমন সময়ে পৌঁছে যে তাদের কাছ থেকে মাত্র কয়েক গজ দূরে একটি হ্যাঙ্গারের পাশে রাখা জাতি সঙ্ঘের এক-ইঞ্জিন বিশিষ্ট তিনটি বিমানের মধ্যে দুটি মিগ বিমানের গুলির আঘাতে ধ্বংস হয়ে যায়।
কয়েকজন টেলিভিশনের ক্যামেরাম্যান চিত হয়ে শুয়ে পড়ে, বিমান-বিধ্বংসী গোলাবৃষ্টির মধ্যে দিয়ে ভারতীয় জঙ্গিবিমানের চলচিত্র গ্রহণ করার জন্য, যখন ওগুলি পরপর চারবার আক্রমণ করে। ওগুলির মধ্যে একটি গোলার আঘাতে, আগুনের কুণ্ডলীর মতো বিস্ফোরিত হয় এবং কাছেই ভূপাতিত হয়।
জঙ্গিবিমানগুলি – মিগ, ন্যাট এবং এস ইউ ৭ – রকেট এবং গুলি চালায়, বোমা হামলা নয়, সরকারী কর্মকর্তাদের ভাষ্য অনুযায়ী। জঙ্গিবিমানগুলি বিমান এবং হ্যাঙ্গারগুলোকে আক্রমণ করেছে। ওগুলি কাছের সামরিক ক্যান্টনমেন্ট আক্রমণ করেনি বা রানওয়ের কোন ক্ষতি করেনি।
কর্মকর্তারা বলেন যে চট্টগ্রাম হচ্ছে একমাত্র অন্য আরেকটি শহর যেটি ভারতীয় জঙ্গিবিমানের আক্রমণের শিকার হয়, সেখানে জ্বালানী তেল সঞ্চয় করে রাখার আধার এবং একটি তেল শোধনাগারকে নিশানা করা হয়।
রাত ১০:০২ মিনিটে চারিদিক আবার নিশ্চুপ। আজ রাতে আর কোন বিমান আক্রমণ হয়নি এখনো পর্যন্ত। একটি কুকুর ডেকেই চলেছে।
-নিউইয়র্ক টাইমসের সংবাদ সেবা থেকে