You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.09.17 | গোয়ালডাঙ্গা যুদ্ধ (আশাশুনি, সাতক্ষীরা) - সংগ্রামের নোটবুক

গোয়ালডাঙ্গা যুদ্ধ (আশাশুনি, সাতক্ষীরা)

গোয়ালডাঙ্গা যুদ্ধ (আশাশুনি, সাতক্ষীরা) সংঘটিত হয় ১৭ই সেপ্টেম্বর স ম বাবর আলীর নেতৃত্বে। বাবর আলী ছিলেন পাইকগাছা থানার গজালিয়া গ্রামের সন্তান এবং বি এল কলেজ ছাত্র সংসদের ভিপি। তিনি স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ-এর খুলনা জেলার যুগ্ম আহ্বায়ক ছিলেন। গোয়ালডাঙ্গায় মাত্র ২৫ জন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে তিনি দুশতাধিক রাজাকার -মিলিশিয়ার সঙ্গে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। যুদ্ধে তাঁর সহযোগী ছিলেন মনোরঞ্জন সমাদ্দার।
আশাশুনি থানায় অবস্থিত গোয়ালডাঙ্গা একটি ছোট গ্রাম। বড়দল বাজার থেকে তিন কিলোমিটার দূরে এর অবস্থান। পাশের গ্রামের নাম ফখরাবাদ। ঘটনার দিন হেতালবুনিয়ার কাজলনগর ক্যাম্পে বসে বাবর আলী ৯ম সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার মেজর এম এ জলিলের নির্দেশে একটি রিপোর্ট তৈরি করছিলেন। এমন সময় মুক্তিযোদ্ধাদের একজন সুহৃদ এসে খবর দেন যে, কেয়ারগাতির নিকটস্থ চাপড়া ক্যাম্পের রাজাকার- বাহিনী বড়দল বাজারে গেছে চাঁদা তুলতে।
গোয়ালডাঙ্গার পথে ফিরবে। রাজাকারদের একসঙ্গে পাওয়ার এমন একটি সুযোগই বাবর আলী এতদিন খুঁজছিলেন। তাই তৎক্ষণাৎ তিনি ফেরার পথে রাজাকারদের আক্রমণ করার পরিকল্পনা করেন এবং ২৫ জন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে গোয়ালডাঙ্গা গ্রামের শেষপ্রান্তে অবস্থান নেন। রাজাকারদের সঙ্গে ছিল সাতক্ষীরা থেকে আগত কয়েকজন বিহারি মিলিশিয়া। কুখ্যাত বিহারি আহসান তাদের নেতা।
বাবর আলী তাঁর ডেপুটি মনোরঞ্জনের সঙ্গে আলোচনাপূর্বক স্থির করেন যে, রাজাকারদের নির্জন নদীর পাড়েই ঘায়েল করতে হবে। শত্রুকে গ্রামের ভেতরে ঢুকতে দেয়া যাবে না। বড়দল বাজার থেকে চাপড়া রাজাকার ক্যাম্পে ফেরার মাঝামাঝি জায়গা হচ্ছে গোয়ালডাঙ্গা গ্রামের বিল এলাকা। বিলের পানি নদীতে বের করে দেয়ার জন্য ওয়াপদা রাস্তায় রয়েছে একটি সুইস গেট। একদিকে বড় খাল অন্যদিকে নদী। মাঝখান দিয়ে রাস্তা। সুইস গেটের কাছে ছিল একটি ইটের স্তূপ। মুক্তিযোদ্ধাদের এখানে রেখে বাবর আলী এবং মনোরঞ্জন যান এলাকাটি রেকি করতে। সেখানে গিয়ে দেখেন পাঁচজন রাজাকার তাদের রাইফেলগুলো তালগাছের সঙ্গে হেলান দিয়ে রেখে নিজেরা বসে গল্প করছে। তাদের পাকড়াও করার সিদ্ধান্ত নিয়ে মনোরঞ্জন আরো তিনজন মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়ে আসেন। তারপর তাঁরা অতর্কিতে আক্রমণ চালিয়ে রাজাকারদের রাইফেলগুলো হস্তগত করেন এবং তাদের বন্দি করে গাছের সঙ্গে বেঁধে রাখেন। তাদের কাছ থেকেও জানা যায় যে, রাজাকার ও মিলিশিয়ারা বড়দল বাজার থেকে এপথেই ফিরেবে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই রাজাকার ও মিলিশিয়ারা বড়দল বাজার থেকে এপথে ফিরে আসছিল। বাজার থেকে বড় অংকের চাঁদা আদায় হওয়ায় সবাই ছিল খুব খুশি। তাই অসতর্ক অবস্থায় অগ্রসর হতে হতে আয়ত্তের মধ্যে আসামাত্রই বাবর আলীর এসএলআর গর্জে ওঠে। অতর্কিত এ আক্রমণে রাজাকাররা প্রথমে একটু ঘাবড়ে যায়। কিন্তু দ্রুত পজিশন নিয়ে তারা পাল্টা গুলি চালায়। উভয় পক্ষে তুমুল যুদ্ধ হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের অবিরাম গুলিবর্ষণে ভয় পেয়ে কয়েকজন রাজাকার রাইফেল ফেলে পালিয়ে যায়। বাকি রাজাকার ও মিলিশিয়ারা যুদ্ধ করতে থাকে। আহসান বিহারি ক্ষিপ্রতার সঙ্গে গুলি করতে-করতে মুক্তিযোদ্ধাদের দিকে এগিয়ে আসছিল। এক পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধাদের গুলিতে সে নিহত হয়। কমান্ডারের মৃত্যুতে ভয় পেয়ে অবশিষ্ট মিলিশিয়ারা মরিচ্চাপ নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
কেউ-কেউ বড়দল বাজারের দিকে পালিয়ে যায়। যুদ্ধে ২০-২৫ জন রাজাকার নিহত ও প্রায় অর্ধশত রাইফেল মুক্তিযোদ্ধাদের হস্তগত হয়।
বিজয়ের এ আনন্দে মুক্তিযোদ্ধারা উদ্বেলিত হয়ে পড়েন। কিন্তু তাঁদের সে আনন্দ ম্লান হয়ে যায় সহযোদ্ধা মনোরঞ্জনের মৃত্যু সংবাদ শুনে। শত্রুর গুলিতে তিনি শহীদ হন। তাঁর বাড়ি ছিল হরিঢালীতে। কপিলমুনির রাজাকারদের অত্যাচারে টিকতে না পেরে তাঁর আত্মীয়-স্বজন সবাই ভারতে চলে যায়। কিন্তু মাতৃভূমিকে স্বাধীন করার জন্য মনোরঞ্জন থেকে যান। সহযোদ্ধারা হিন্দুমতে এই বীর মুক্তিযোদ্ধার সৎকার করেন।
গোয়ালডাঙ্গার যুদ্ধে হেতালবুনিয়ার কাজলনগর ক্যাম্পের মুক্তিযোদ্ধারা অংশ নেন। তাঁদের মধ্যে স ম বাবর আলী, মনোরঞ্জন সমাদ্দার, গাজী রফিকুল ইসলাম, আবুল খায়ের, তোরাব, আরশাদ, রমজান, সিদ্দিক, খলিল, কুদ্দুস প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। এঁদের অধিকাংশের বাড়ি পাইকগাছা ও আশাশুনি থানার বিভিন্ন গ্রামে। [জহুরুল আলম সিদ্দিকী]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৩য় খণ্ড