You dont have javascript enabled! Please enable it!

মুক্তিযুদ্ধে গোয়ালন্দ উপজেলা (রাজবাড়ী)

গোয়ালন্দ উপজেলা (রাজবাড়ী) গোয়ালন্দ বাংলাদেশের একটি প্রসিদ্ধ নদীবন্দর হিসেবে পরিচিত। রাজবাড়ী জেলা শহরের পূর্বদিকে পদ্মা নদীর পাড় ঘেঁষে গোয়ালন্দ উপজেলার অবস্থান। এর উত্তরে পাবনা জেলার বেড়া উপজেলা, দক্ষিণে ফরিদপুর সদর উপজেলা, পূর্বে মানিকগঞ্জ জেলার শিবালয় উপজেলা এবং পশ্চিমে রাজবাড়ী সদর উপজেলা। ৫২-র ভাষা-আন্দোলন, ৫৪-র যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ৫৮-র সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন, ৬২-র ছাত্র আন্দোলন, ৬৬-র ৬ দফা আন্দোলন ও উনসত্তরের গণআন্দোলনসহ প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে গোয়ালন্দের আপামর জনসাধারণ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ১৯৭০ সালের নির্বাচনী প্রচারণার অংশ হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান- ১২ই নভেম্বর গোয়ালন্দের জনসমাবেশে যোগদানের মধ্য দিয়ে দক্ষিণ বাংলায় সফর শুরু করেন। এদিন দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া উপেক্ষা করে তিনি আরিচা ঘাট হয়ে সকালে গোয়ালন্দে এসে পৌঁছান এবং গোয়ালন্দ ঘাটে একটি ফেরির ওপর স্থাপিত মঞ্চে দাঁড়িয়ে ভাষণ দেন।
এরপর তিনি রাজবাড়ী রেলের মাঠে একটি জনসভায় আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীদের পরিচয় করিয়ে দিয়ে শিবরামপুর-ফরিদপুর-যশোর-খুলনা অভিমুখে রওনা হন।
নির্বাচনে গোয়ালন্দ-রাজবাড়ী আসনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী এ বি এম নূরুল ইসলাম এমএনএ এবং কাজী হেদায়েত হোসেন এমপিএ নির্বাচিত হন। সারা বাংলায় সংখ্যারিষ্ঠ আসনে আওয়ামী লীগ জয়লাভ করে। কিন্তু পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী আওয়ামী লীগের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর না করে ষড়যন্ত্র শুরু করলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে এক ঐতিহাসিক ভাষণ দেন। বঙ্গবন্ধুর সেই ভাষণে উদ্বুদ্ধ হয়ে সারা দেশের মতো গোয়ালন্দের মুক্তিকামী মানুষও মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের প্রস্তুতি নিতে থাকে।
সাতই মার্চের ভাষণ-এর পর গোয়ালন্দে সর্বদলীয় সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়। এ কমিটির সদস্যদের মধ্যে ইন্তাজ মুন্সি (গোয়ালন্দ থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি), ডা. জয়নাল আবেদীন (গোয়ালন্দ থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক), হাজী আব্দুল লতিফ (গোয়ালন্দ থানা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি), আব্দুল কাদির (উজানচর), আব্দুল মাজেদ চৌধুরী (গোয়ালন্দ থানা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, কাটাখালি), নিতাই রাহা (গোয়ালন্দ বাজার), নাজিরুল ইসলাম দুলু (উজানচর), আব্দুল মজিদ মিয়া মেম্বার (দেওয়ানপাড়া), জালাল উদ্দিন মিয়া (কাশিমা), মনিরুজ্জামান চৌধুরী
(কাটাখালি), হাসান ইমাম চৌধুরী (কাটাখালি), আব্দুল মান্নান চৌধুরী (কাটাখালি), হাবিবুর রহমান মণ্ডল (চরআন্ধার মানিক), যতীশ চন্দ্র সরকার (ছোটভাকলা), হাসমত আলী (গোয়ালন্দ থানা ছাত্রলীগের সভাপতি, দেবগ্রাম), কালিপদ মজুমদার (গোয়ালন্দ), সবেদ আলী শেখ (দেওয়ানপাড়া), আব্দুল মজিদ শেখ (দেওয়ানপাড়া), জীবন ঘোষ (ক্ষুদিরাম দত্তের পাড়া), নেকবর আলী মোল্লা (দেবগ্রাম), আব্দুল জলিল (জুরান মোল্লারপাড়া), ফকির আব্দুল জব্বার (রাজবাড়ী কলেজ ছাত্র সংসদের ভিপি), কেরামত আলী প্রামাণিক (গোয়ালন্দ থানা ছাত্রলীগ-এর সাধারণ সম্পাদক), ফকির মহিউদ্দিন (আনসার কমান্ডার), আজিজুল ইসলাম (আনসার কমান্ডার), গোয়ালন্দের আব্দুল হাকিম বিকম, চেনিরুদ্দিন মুন্সি, ছালাম ডাক্তার, শেখ মো. ইসমাইল, মুন্সি এজাজ উদ্দিন প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য।
সংগ্রাম কমিটির নেতৃত্বে গোয়ালন্দের জনগণ হাট-বাজার বন্ধ করে দিয়ে মিছিল-মিটিংয়ে অংশগ্রহণ করে। প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে ঢাল, সড়কি, বল্লম, রামদা, লাঠিসহ গোয়ালন্দ এসে লোকজন মিছিলে অংশ নেয়। ২৩শে মার্চ গোয়ালন্দের প্রতিটি অফিস-আদালত ও দোকানপাটে স্বাধীন বাংলাদেশের মানচিত্রখচিত পতাকা উত্তোলন করা হয়।
বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণের পর বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠনসহ গোয়ালন্দের স্বাধীনতাকামী মানুষ অসহযোগ আন্দোলন-এ সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে। তারা পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে চূড়ান্ত লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকে। মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে সাধারণ জনতার মধ্যেও বাঁশের লাঠি, তীর-ধনুক, বর্ণা-ফালা, টেটা, ঢাল-তলোয়ার, রামদা ইত্যাদি দেশীয় অস্ত্র তৈরির প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়। কাজী হেদায়েত হোসেন এমপিএ, অমল চক্রবর্তী (ডাকসু সদস্য), কমরেড আশু ভরদ্বাজ (কমিউনিস্ট নেতা) প্রমুখ বন্দুক সংগ্রহ, পুলিশ ও সিভিল প্রশাসনকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে আনার জন্য গোপন বৈঠক করেন। সংগ্রাম কমিটির নেতৃত্বে গোয়ালন্দের রেলের মাঠ, বেড়াভাঙ্গা, গোয়ালন্দ হাইস্কুল মাঠ, গোয়ালন্দ থানা, তোনাপঁচা (কাটাখালি) প্রাইমারি স্কুল, এ এস ক্লাব ফুটবল মাঠ, বরাট খেলার মাঠ, নবগ্রাম (পাঁচুরিয়া) বাজার সংলগ্ন পুকুর চালা, তহশিল অফিস চত্বর প্রভৃতি স্থানে মুক্তিযুদ্ধের প্রাথমিক প্রশিক্ষণ শুরু হয়। প্রথমে গুলিবিহীন অস্ত্র ও কাঠের ডামি রাইফেল দিয়ে প্রশিক্ষণ চলে। পরে রাজবাড়ী কলেজ থেকে পিএনসিসি’র রাইফেল সংগ্রহ করা হয়। আব্দুল বারী মণ্ডল (পালিয়ে আসা সেনাসদস্য, মণ্ডলপাড়া), মোফাজ্জল হোসেন চাঁদ (ছুটিতে আসা সেনাসদস্য, বরাট), মতিয়ার রহমান (আনসার সদস্য, বরাট), কাজী আব্দুর রব (আনসার সদস্য, বরাট) প্রমুখ প্রশিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। কমরেড অমল গুহ, ডা. আসজাদ, ফকির আব্দুল জব্বার, আব্দুল লতিফ বিশ্বাস (রাজবাড়ী কলেজ ছাত্র সংসদের সাবেক ভিপি), নাজিবুর রহমান (রাজবাড়ী কলেজ ছাত্র সংসদের সাবেক জিএস), মকছুদ আহমেদ রাজা (রাজবাড়ী কলেজ ছাত্র সংসদের সাবেক জিএস) প্রমুখ ছাত্র-যুবকদের সংগঠিত করে প্রশিক্ষণ শিবিরে নিয়ে আসতেন। গোয়ালন্দের উজান চর, দৌলদিয়া, দেবগ্রাম, ছোটভাকলা, বরাট, কাটাখালিসহ প্রত্যন্ত এলাকা থেকে ছাত্র-যুবকরা এসে প্রশিক্ষণ নিতে ভিড় জমায়। এসডিও অফিসের কর্মকর্তা ফজলুল হক চৌধুরী তাঁর লাইসেন্সকৃত ২২ বোর-এর একটি বন্দুক নিয়ে প্রশিক্ষণ শিবিরে যোগ দেন। যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে নির্বাচিত আইন পরিষদ সদস্য আওয়ামী লীগের বর্ষিয়ান নেতা আব্দুল ওয়াজেদ চৌধুরী তাঁর নিজ এলাকা বরাট-কাটাখালি- ছোটভাকলায় মুক্তিযুদ্ধের প্রথমদিকে নিয়মিত যোগযোগ রাখতেন এবং তাঁর নির্দেশে ঐ অঞ্চলে একটি সংগ্রাম কমিটি গঠনের মাধ্যমে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গড়ে তোলা হয়।
গোয়ালন্দে যুদ্ধকালীন কমান্ডার ছিলেন দুজন। তাঁরা হলেন- রফিকুল ইসলাম ওরফে ইসলাম (পিতা মোকছেদ আলী, চরবারকি পাড়া) ও আব্দুস সামাদ মোল্লা (পিতা মহর আলী মোল্লা, চরবারকি পাড়া)।
গোয়ালন্দ উপজেলায় মুক্তিযোদ্ধাদের দুটি স্থানীয় বিশেষ বাহিনী ছিল – ইসলাম কমান্ডারের বাহিনী ও মোহাম্মদ আলী কমান্ডারের বাহিনী। ভারতের চাকুলিয়া থেকে ট্রেনিং শেষে বরাটের রফিকুল ইসলাম কমান্ডারের নেতৃত্বে মোট ৮ জন মুক্তিযোদ্ধার একটি গ্রুপ অক্টোবর মাসের প্রথম দিকে নিজ গ্রামে এসে ক্যাম্প স্থাপন করে, যারা এলাকায় ইসলাম কমান্ডার বাহিনী নামে পরিচিত ছিল। এ বাহিনীর ডেপুটি কমান্ডার ছিলেন আব্দুস সামাদ মোল্লা। অন্যরা হলেন- মো. ওমর আলী শেখ, মো. আমিনুল ইসলাম শফি, মো. আবদুল গফুর, আব্দুর রাজ্জাক ওরফে গেদু, মো. তমিজ উদ্দিন মিয়া ও মো. সকির উদ্দিন কুটি। পরবর্তীতে সিরাজ কমান্ডার বাহিনীর সদস্য আবদুল আজিজ খুসি এ বাহিনীতে যোগ দেন। তাঁরা মিলিতভাবে কাটাখালির নিভৃত পল্লীতে আবদুস ছালাম মোল্লার বাড়িতে ক্যাম্প স্থাপন করে সেখানে ছাত্র- যুকদের সশস্ত্র ট্রেনিং দেন। এছাড়াও আনসার বাহিনীর সদস্যরাও বেশ কয়েকজনকে টেনিং দেন। এভাবে শতাধিক মুক্তিযোদ্ধা ইসলাম কমান্ডারের বাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত হন। বেতকা চরের বাঘাবাড়ি মোকন সরদারের বাড়িতেও ট্রেনিং সেন্টার খোলা হয়। এখানে আবদুস সামাদ মোল্লা ও কুটি মিয়ার নেতৃত্বে ট্রেনিং নেন তমিজ, ওমর আলী, মজিবর, সোহরাব, আজিজুল, আলাউদ্দিন, আকবর, চাঁদ আলী, জলিল, মজিদ, হাদিস, হেলাল, হাই, মোকলেছ, জয়নাল ও আজিজসহ আরো ৭-৮ জন। এ বাহিনী গোয়ালন্দ থানা এলাকাসহ রাজবাড়ী সদরের আংশিক এলাকা জুড়ে প্রতিরোধব্যূহ গড়ে তোলে।
শাওরাইলের মোহাম্মদ আলী জুলাই মাসে ভারতের বয়ড়া থেকে ট্রেনিং নিয়ে এসে কাটাখালিতে অবস্থান নেন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন মো. আজিজুর রহমান মোল্লা (টেংরাপাড়া) ও সিদ্দিকুর রহমান (তোনাপঁচা)। তাঁরা গোপনে এলাকা থেকে আরো কিছুসংখ্যক যুবককে তাঁদের গ্রুপে অন্তর্ভুক্ত করে তাদেরকে গেরিলা ট্রেনিং দেন। এভাবে মোহাম্মদ আলীর নেতৃত্বে ছোট একটি বাহিনী গড়ে ওঠে। এ বাহিনী পাঁচুরিয়া রেলস্টেশনে রাজাকার অপারেশন, দেবগ্রাম রাজাকার ক্যাম্প অপারেশন ও অস্ত্র উদ্ধারসহ গোয়ালন্দ-কুষ্টিয়া, গোয়ালন্দ- পাঁচুরিয়া-ফরিদপুর লাইনে ট্রেন যোগাযোগ মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে সহযোগিতা করে। এ বাহিনী কাটাখালি- বরাট এলাকা শত্রুমুক্ত রাখতে সক্ষম হয়েছিল।
২৫শে মার্চ পাকবাহিনী কর্তৃক ঢাকায় নৃশংস গণহত্যার খবর পেয়ে ২৬শে মার্চ সকাল থেকেই পাকবাহিনীকে প্রতিরোধ করার জন্য গোয়ালন্দের হাজার-হাজার মানুষ রাস্তায় নেমে আসে। সিএন্ডবি রাস্তার দুপাশে বড়বড় গাছ কেটে গাছের গুঁড়ি রাস্তার ওপর ফেলে গোয়ালন্দ থেকে ফরিদপুর- কামারখালি ও রাজবাড়ীর রাস্তায় ব্যারিকেড তৈরি করা হয়। এদিন ফরিদপুর থেকে সাইক্লোস্টাইল করা স্বাধীনতা ঘোষণার বাণী ব্যারিস্টার সৈয়দ কামরুল ইসলাম সালাহউদ্দিনের মাধ্যমে গোয়ালন্দে পৌঁছলে সংগ্রাম কমিটি তথা আওয়ামী লীগসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ তা বাস্তবায়নে স্থানীয় প্রশাসনের ওপর চাপ সৃষ্টি করেন। এ ব্যাপারে গোয়ালন্দের এসডিও শাহ মোহাম্মদ ফরিদ সংগ্রাম কমিটিকে সার্বিক সহযোগিতা করেন। ঢাকা থেকে আরিচা অথবা শিবালয় দিয়ে পদ্মা নদী পার হয়ে পাকবাহিনী যাতে দক্ষিণাঞ্চলে প্রবেশ করতে না পারে, সে জন্য গোয়ালন্দ ঘাটে প্রতিরোধ গড়ে তোলা হয়। ইতোমধ্যে ঢাকা ও অন্যান্য স্থান থেকে বাঙালি ইপিআর, পুলিশ ও আনসার সদস্যরা তাঁদের আগ্নেয়াস্ত্রসহ পাকবাহিনীকে প্রতিরোধ করার জন্য গোয়ালন্দ ঘাটে এসে অবস্থান নেন। গোয়ালন্দ বাজার থেকে প্রায় দেড় কিলোমিটার ভাটিতে কামারডাঙ্গিতেও প্রতিরোধ গড়ে তোলা হয়। সেখানে হাজার-হাজার মানুষ দেশীয় অস্ত্র নিয়ে জড়ো হতে থাকে। এপ্রিল মাসের প্রথম থেকেই পাকবাহিনী পদ্মা নদীর পূর্ব তীরে আরিচায় অবস্থান নেয়। সেখান থেকে তারা নদী পার হয়ে দক্ষিণাঞ্চলে প্রবেশের চেষ্টা চালাতে থাকে। এমতাবস্থায় স্থানীয় আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, আনসার ও গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সহযোগিতায় গোয়ালন্দ থানায় ডা. জয়নাল আবেদীনের নেতৃত্বে একটি প্রতিরোধ কমিটি গঠন করা হয়। এসডিও শাহ মোহাম্মদ ফরিদের সহযোগিতায় গোয়ালন্দের বাহাদুরপুর থেকে মমিন খাঁর হাট পর্যন্ত ইপিআর মুক্তিযোদ্ধারা বাঙ্কার তৈরি করে অবস্থান নেন। শুধু তাই নয়, শাহ মোহাম্মদ ফরিদ প্রতিরোধযোদ্ধাদের বেশকিছু অস্ত্র ও গোলাবারুদ দিয়েও সহযোগিতা করেন। গোয়ালন্দের ফকির মহিউদ্দিন, আজিজুল ইসলাম, কমেদ, বরাট-কাটাখালির মতিয়ার রহমান, আহাম্মদ আলী, মন্তাজ, আবু মাস্টার, খালেক খন্দকার, কানাই, নেকবর, দুলাল, নজর কাজী, আব্দুর রব, রাজবাড়ীর আকরাম, পাংশার বন্ধু চৌধুরী প্রমুখ আনসার কমান্ডারগণ গোয়ালন্দ রণাঙ্গনে এসে অবস্থান নেন।
৮ই এপ্রিল পাকবাহিনী গোয়ালন্দের ঘোষপট্টিতে বিমান থেকে বোমা হামলা চালায়। এতে সুশীল রাণী ঘোষ (স্বামী প্যারি মোহন ঘোষ), শরৎচন্দ্র ঘোষ (পিতা প্যারি মোহন ঘোষ), নিয়তি রাণী ঘোষ (স্বামী অনিল চন্দ্ৰ ঘোষ), দিলীপ চন্দ্র ঘোষ (পিতা পরেশ চন্দ্র ঘোষ), শংকরী রাণী ঘোষ (স্বামী রসিক চন্দ্র ঘোষ), দিনাচন্দ্র ঘোষ, সবিতাবালা ঘোষ ও কাঞ্চনবালা ঘোষ নিহত হন এবং বেশ কয়েকজন আহত হন।
ঘোষপট্টিতে বোমা হামলায় প্রাণহানির ঘটনায় মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। এ পরিস্থিতিতে রাজবাড়ী ও ফরিদপুর থেকে নেতৃবৃন্দ গোয়ালন্দ ঘাটে এসে প্রতিরোধযোদ্ধাদের মনোবল চাঙ্গা করার উদ্যোগ নেন। বড় ধরনের বিপর্যয়ের আশংকায় সাধারণ লোকজনকে গোয়ালন্দ থেকে দূরে সরিয়ে নেয়ার ব্যবস্থা করা হয়।
ইতোমধ্যে গোয়ালন্দ থানার জনৈক হাবিলদারের সহযোগিতায় কতিপয় অবাঙালি পাকবাহিনীর সোর্স হিসেবে প্রায়শই নদীর এপার-ওপার যাতায়াতের মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধাদের খবরাখবর পাকবাহিনীকে অবহিত করছিল। এ কারণে গোয়ালন্দের প্রতিরোধযোদ্ধা ও বিক্ষুব্ধ জনতার আক্রমণে তিনজন সোর্স নিহত হয়। জনতা নিহতদের লাশ গোয়ালন্দ বাজারের পাশের খালে ফেলে দেয়। গোয়ালন্দ ঘাটে প্রতিরোধ ব্যবস্থা জোরদার করতে চুয়াডাঙ্গা সেনানিবাসের বিদ্রোহী বাঙালি অফিসার খানসামাপুরের কৃতী সন্তান আবু ওসমান চৌধুরীর সঙ্গে যোগযোগ করলে তিনি বেশকিছু বাঙালি সেনা সদস্যকে প্রয়োজনীয় অস্ত্র ও গোলাবারুদ দিয়ে গোয়ালন্দ ঘাটে পাঠান। এদিকে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে মুক্তিযুদ্ধের প্রাথমিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ছাত্র- যুবকরা গোয়ালন্দের আশপাশে অবস্থান নেয়। গ্রামের নারী- পুরুষরা ডাব, রুটি, গুড়, কলা ইত্যাদি শুকনো খাবার নিয়ে প্রতিরোধযোদ্ধাদের পাশে এসে দাঁড়ান।
২০শে এপ্রিল রাতে পাকবাহিনী স্থল, নৌ ও আকাশপথে প্রতিরোধযোদ্ধাদের ওপর ত্রিমুখী আক্রমণ চালিয়ে গোয়ালন্দ ঘাটের দিকে এগিয়ে আসতে থাকে। ২১শে এপ্রিল সকালে পাকবাহিনীর তীব্র আক্রমণে টিকতে না পেরে প্রতিরোধযোদ্ধরা পিছু হটেন। সেদিন পাকবাহিনীর গুলিতে শহীদ হন আনসার কমান্ডার ফকির মহিউদ্দিন (পিতা ফকির বদর উদ্দিন, দৌলদিয়া) এবং বেশ কয়েকজন আহত হন। ২১শে এপ্রিল পাকবাহিনী গোয়ালন্দে প্রবেশ করে এবং গোয়ালন্দঘাট, জামতলা, গোয়ালন্দ রেলওয়ে স্টেশন সংলগ্ন আনসার ক্যাম্পে ক্যাম্প স্থাপন করে। পরবর্তীতে দেবগ্রামে একটি রাজাকার- ক্যাম্প স্থাপিত হয়। ২২শে এপ্রিল গোয়ালন্দের প্রতিরোধযোদ্ধা সেলিম মণ্ডল ওরফে ছলিম (গোয়ালন্দ বাজার) ও মো. নূরুল ইসলাম (গোয়ালন্দ বাজার) সহ কালুখালি উপজেলার আরো দুজন আনসার নিরাপদ আশ্রয়ে যাওয়ার পথে পাকবাহিনীর হাতে বন্দি হন। দীর্ঘদিন তাঁরা কারাগারে আটক থাকার পর কোর্ট মার্শালের বিচারে ছাড়া পান এবং ফিরে এসে আবার মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। পাকবাহিনী গোয়ালন্দঘাট অতিক্রম করে রাজবাড়ীতে প্রবেশের পর শান্তি কমিটির সদস্য হওয়ার জন্য স্থানীয় মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী ছাত্র সংঘ, এনএসএফ-এর সদস্যরা মুক্তিযোদ্ধা ও হিন্দু পরিবারের বিরুদ্ধে পাকবাহিনী ও অবাঙালিদের লেলিয়ে দিতে শুরু করে। তারা আওয়ামী লীগ, ন্যাপ ও কমিউনিস্ট পার্টির নেতা-কর্মীদের নাম-ঠিকানা সংগ্রহের পাশাপাশি তাদের ঘরবাড়ি চিনিয়ে দিতে থাকে।
২৪শে এপ্রিল পাকবাহিনীর মেজর খুরশীদ আলমের উপস্থিতিতে গোয়ালন্দ ডাকবাংলোয় বসে গোয়ালন্দ থানা শান্তি কমিটি গঠন করা হয়। নিজাম উদ্দিন আহমেদ (মুসলিম লীগ নেতা) গোয়ালন্দ থানা শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান ও হানিফ উদ্দিন মোল্লা (চরচাঁদপুর) এর সেক্রেটারি নির্বাচিত হয়। এ কমিটির সদস্যদের মধ্যে মৌলভী রহমত আলী (গোয়ালন্দ বাজার), লোকমান হোসেন মৌলভী (গোয়ালন্দ বাজার), ডা. ইন্তাজ উদ্দিন (দেওয়ানপাড়া), বদর উদ্দিন দেওয়ান (দেওয়ানপাড়া) প্রমুখের নাম বিশেষভাবে উল্লেখ্যযোগ্য। এছাড়াও মৌলভী মনছুর আহমেদ (ছোটভাকলা ইউনিয়ন শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান), হাফিজুল ইসলাম চৌধুরী (ছোটভাকলা ইউনিয়ন শান্তি কমিটির সম্পাদক, চেয়ারম্যান ছোটভাকলা ইউনিয়ন কাউন্সিল, চর বাগলিকান্দি), আরশাদ আলী চৌধুরী (দেবগ্রাম ইউনিয়ন কাউন্সিলের চেয়ারম্যান, চরপাড়া) প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য।
৩০শে এপ্রিল গোয়ালন্দঘাটে রাজাকার বাহিনী গঠিত হয়। রাজাকারদের সবাই ছিল গোয়ালন্দের বাসিন্দা। আব্দুর রব মৌলভী ও বাবলু ছিল বাঙালি। অবাঙালি রাজাকারদের মধ্যে সামাদ সরদার (রেল ও স্টিমারের কুলি সরদার), কালু, আনিস, মো. ইসমাইল, হাবিবুল্লাহ, আলী, রহমান, গোলাম মোহাম্মদ, ইয়াকুব, মোস্তাক ডাক্তার, শরিফের মা প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য।
পাকবাহিনী এসব রাজাকারদের নিয়মিত প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের হাতে আগ্নেয়াস্ত্র তুলে দেয়। কাইয়ুম সর্দার (মিলিশিয়া বাহিনী প্রধান) ও কুখ্যাত রাজাকার আহাম্মদ আলী মওলানা ছিল পাকবাহিনীর অন্যতম দোসর। ডাকাত সর্দার সেকেন্দার (বেথুর চর) ও আফাজ স্বাধীনতাবিরোধীদের সঙ্গে যোগ দেয়।
খুন, ধর্ষণ, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের কারণে ১৯৭২ ও ৭৩ সালে যাদের বিরুদ্ধে দালাল আইনে মামলা হয়েছিল, তাদের মধ্যে ময়েন উদ্দিন আহমেদ ওরফে মাইনদ্দিন জমিদার (পিতা বকাই সরদার, গোয়ালন্দ), নিজাম উদ্দিন আহমেদ (পিতা বকাই সরদার, গোয়ালন্দ), আলহাজ্ব হানিফ উদ্দিন মোল্লা (পিতা সেফায়েত মোল্লা, চরচাঁদপুর), মজিদ মোল্লা (পিতা পরেস মোল্লা, চরচাঁদপুর), তোরাপ আলী শেখ (পিতা নাসির উদ্দিন, গোয়ালন্দঘাট), আব্দুল শেখ (পিতা জনাব আলী শেখ, গোয়ালন্দঘাট), কালুয়া বিহারি (গোয়ালন্দঘাট), কায়েম বেপারী (গোয়ালন্দঘাট), আনিস (গোয়ালন্দঘাট), আলিয়া বিহারি (গোয়ালন্দঘাট), ময়েন উদ্দিন ফকির (পিতা মফিজ উদ্দিন ফকির, উজানচর), দানেস মোল্লা (পিতা সিফাতল্লাহ, উজানচর), ইমান সরদার (দানেস সরদার, উজানচর), জয়েন উদ্দিন সরদার (পিতা দানেস সরদার, উজানচর), মজনু সরদার (পিতা নিজাম সরদার, উজানচর), ইমান আলী (পিতা নেপাল, গোয়ালন্দঘাট), ফারুক (গোয়ালন্দ ঘাট বিহারি কলোনি), আরশেদ আলী চৌধুরী (পিতা বশির উদ্দিন চৌধুরী, চরপাড়া), আহম্মদ আলী মণ্ডল (পিতা দানেস উদ্দিন মণ্ডল, শীতলপুর), মনসুর আহম্মেদ (শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান, চরবাগরিকান্দি), হাফিজুল ইসলাম চৌধুরী (শান্তি কমিটির সেক্রেটারি, চরবাগরিকান্দি), মাইনুদ্দিন ফকির (পিতা মফিজুদ্দিন ফকির, উত্তর দৌলদিয়া), ওমর আলী মোল্লা (পিতা আমির আলী মোল্লা, শান্তি কমিটির সেক্রেটারি, গোয়ালন্দ), মো. সিদ্দিকুর রহমান (রাজাকার কমান্ডার, পিতা আজিজ উদ্দিন, উজানচর), পিসি রহমাত আলী (পিতা আনসার আলী, দেবগ্রাম), পিসি কারী হোসাইন (পিতা জনাব আলী, ছোটভাকলা), পিসি আফজাল সরদার (পিতা তাইজুদ্দিন, চরপাঁচুরিয়া), পিসি এস এম মতিয়ার রহমান (পিতা এ. মান্নান, গোয়ালন্দঘাট) প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য।
২১শে এপ্রিল পাকবাহিনী গোয়ালন্দে প্রবেশ করেই আশপাশের গ্রামগুলোতে ভয়াবহ গণহত্যা চালায়। এদিন তারা উজানচর ইউনিয়নের বালিয়াডাঙ্গা গ্রামে প্রবেশ করে নারী-পুরুষ ও শিশুসহ শতাধিক গ্রামবাসীকে গুলি করে হত্যা করে, যা বালিয়াডাঙ্গা গণহত্যা নামে পরিচিত। এদিন পাকবাহিনীর অত্যাচার ও নির্যাতনের ভয়ে বিভিন্ন এলাকা থেকে শতশত মানুষ নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য গোয়ালন্দের কুমরাকান্দি, বাহাদুরপুর, কাতলমারি প্রভৃতি গ্রামে আসে। পাকবাহিনী এদিন ঐসব গ্রামে অভিযান চালালে আশ্রিত সাধারণ মানুষগুলো গণহত্যার শিকার হয়। পাকবাহিনী লুটতরাজ শেষে গ্রামগুলোতে অগ্নিসংযোগ করে। এদিন পল্লিকবি তোফাজ্জল হোসেন (বাহাদুরপুর) ও তাঁর পরিবাররের সদস্যদের পাকবাহিনী গুলি করে হত্যা করে।
একই দিন আহাম্মদ আলী মওলানা মগরব মাতব্বরের বাড়িতে ঢুকে আরশাদ হোসেন ও ইমান নামে দুজনকে পাকবাহিনীর হাতে ধরিয়ে দেয়। ছবদার নামে আরো একজনকে পাকবাহিনী পিতার সামনে গুলি করে হত্যা করে। সূর্য নামে একজন গ্রামবাসীকে কাইয়ুম সর্দার ধরিয়ে দিলে পাকবাহিনী তাকেও গুলি করে হত্যা করে।
রাজবাড়ী জেলখানা মসজিদের ইমাম শামসুদ্দিন আহমেদ ওরফে ইয়াকুব মওলানা (গোয়ালন্দ) নিরাপত্তার জন্য আটক অবাঙালিদের উদ্দেশে খুতবায় ‘জয় বাংলা’ তথা বাংলাদেশকে সমর্থন করার আহ্বান জানাতেন। ২১শে এপ্রিলের পর অবাঙালিরা জেলাখানা থেকে বেরিয়ে এসে হানাদারদের সঙ্গে যোগ দেয়। ইয়াকুব মওলানার পুত্র ভারতে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিতে যাওয়ার অপরাধে ৬ই মে বাড়ি ফেরার পথে অবাঙালিরা তাকে রেলগেট থেকে গোয়ালন্দে ধরে নিয়ে গিয়ে প্রথমে অবাঙালি সৈয়দ খামারের নির্দেশে ইউনুস, আনিস ও কালু রেল স্টেশন সংলগ্ন আকুয়া বিল্ডিংয়ে আটকে রাখে। তারপর গোয়ালন্দঘাটে স্থাপিত হানাদার ক্যাম্পের বন্দিশিবিরে নিয়ে গিয়ে ৭ই মে অন্যান্য বন্দিদের সঙ্গে ইয়াকুব মওলানাকে হত্যা করে তার লাশ পদ্মা নদীতে ফেলে দেয়।
মে মাসের প্রথম দিকে গোয়ালন্দের কুঠিপাঁচুরিয়ায় স্থানীয় মুসলিম লীগের সহযোগিতায় পাকবাহিনীর দালাল অবাঙালিরা হিন্দু পরিবারগুলোর ওপর নির্যাতন ও তাদের ঘরবাড়িতে লুটতরাজ চালায়। এদিন পাকবাহিনী কুঠিপাঁচুরিয়ার জমিদার বাড়িতেও লুটতরাজ চালায় এবং ঐ বাড়িতে আশ্রিত পণ্ডিত পরেশ চন্দ্র চক্রবর্তী (গোয়ালন্দ হাইস্কুলের শিক্ষক), জমিদারপুত্র মৃগেন্দ্ৰনাথ সাহা, হরেকৃষ্ণ বৈরাগীসহ আরো দুজন অপরিচিত ব্যক্তিকে গুলি করে হত্যা করে। হানাদার বাহিনী ক্যাম্পে ফিরে গেলে সন্ধ্যায় কুঠিবাড়ির প্রাচীরের পাশে তাদের গণকবরে সমাহিত করা হয়।
২৭শে অক্টোবর পাকবাহিনী গোয়ালন্দঘাট থেকে মমিন খাঁর হাট পর্যন্ত অপারেশন চালায়। ইপিআর মুক্তিযোদ্ধারা মমিন খাঁর হাট গ্রামের কাদের ডাক্তারের বাড়িতে প্রতিরোধযুদ্ধের ক্যাম্প স্থাপন করেছিলেন। এই অপরাধে মিলিশিয়া বাহিনীর প্রধান কাইয়ুম সরদার ও কুখ্যাত রাজাকার আহাম্মদ আলী মওলানার ইঙ্গিতে পাকবাহিনী কাদের ডাক্তারের পুত্র মোফাজ্জল হক মঞ্জু ডাক্তারসহ আরো ১৯ জন নিরীহ গ্রামবাসীকে গোয়ালন্দঘাট বন্দিশিবিরে ধরে নিয়ে যায়। এরপর ঐ ১৯ জনকে পদ্মা নদীর পাড়ে মাল্লাপট্টিতে নিয়ে গিয়ে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে-খুঁচিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে লাশ পানিতে ফেলে দেয়, যা গোয়ালন্দ ঘাট মাল্লাপট্টি হত্যাকাণ্ড নামে পরিচিত। শহীদদের শরীরের ফিনকি দেয়া রক্তে বন্দি মঞ্জু ডাক্তারের জামা ভিজে যায়। রক্তে রঞ্জিত হয় পদ্মার জল। শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান নিজাম উদ্দিন আহমেদের অনুরোধে পাকবাহিনী মঞ্জু ডাক্তারকে ছেড়ে দেয়। গোয়ালন্দ রেলওয়ে স্টেশন সংলগ্ন আনসার ক্যাম্পে স্থাপিত হানাদার ক্যাম্পের সঙ্গেই ছিল নির্যাতনকেন্দ্র ও বন্দিশিবির। পাকবাহিনী বিভিন্ন স্থান থেকে এই বন্দিশিবিরে সাধারণ মানুষজনকে ধরে এনে হাত-পা বেঁধে গাছের ডালে ঝুলিয়ে নির্মম নির্যাতন শেষে হত্যা করে লাশ মাল্লাপট্টির ঘাটে পদ্মা নদীতে ফেলে দিত। নারীদের ধরে এনে বন্দিশিবিরে আটকে রেখে তাদের ওপর পাশবিক নির্যাতন চালাত। তারা মোকলেছুর রহমান ওরফে মকুল (গোয়ালন্দঘাট) ও আব্দুস ছালাম মন্নু দেওয়ান (আনসার কমান্ডার, দেওয়ানপাড়া)-কে বন্দিশিবিরে ধরে নিয়ে গিয়ে নির্যাতন করে।
গোয়ালন্দের সবচেয়ে বড় বধ্যভূমি হলো পদ্মা নদীর পাড়ে মাল্লাপট্টির ঘাট। এখানে পাকবাহিনী বিভিন্ন এলাকা থেকে মানুষজনকে ধরে এনে বন্দিশিবিরে নির্যাতন শেষে হত্যা করে লাশ নদীতে ফেলে দিত। বালিয়াডাঙ্গা, কামারডাঙ্গি, কাতলমারি ও পাঁচুরিয়া জমিদার বাড়ির প্রাচীর প্রভৃতি স্থানে গণকবর রয়েছে।
গোয়ালন্দঘাটে পাকবাহিনী তাদের শক্তিশালী ঘাঁটি স্থাপন করে। তারা বিপুল পরিমাণ জ্বালানি তেল ফেরিতে এনে ঘাট এলাকায় মজুদ রাখত। সাধারণ মানুষকে জোর করে ধরে নিয়ে এসে তা লোড-আনলোড করাত। গোয়ালন্দঘাটে পাকবাহিনীর শক্ত অবস্থানের কারণে দক্ষিণাঞ্চলের মুক্তিযোদ্ধারা সুবিধা করতে পারছিলেন না। কাজেই বোয়ালমারী থানার নতুবদিয়া ক্যাম্পে নৌ কমান্ডোদের এক বৈঠকে গোয়ালন্দঘাটের জ্বালানি তেলবাহী ফেরি ধ্বংসের পরিকল্পনা করা হয়। ২৮শে আক্টোবর নৌ কমান্ডো মোহাম্মদ আলী ও আবুল কাসেম গোয়ালন্দঘাটে তেলবাহী ফেরিতে মাইন বিস্ফোরণ ঘটিয়ে তা ধ্বংস করে দেন, যা গোয়ালন্দঘাটে পাকবাহিনীর তেলবাহী ফেরি ধ্বংস নামে পরিচিত। এ কাজে শিক্ষক আব্দুর রশিদ খান সহযোগিতা করেন।
গোয়ালন্দের কাটাখালি ব্রিজে রাজাকাররা সশস্ত্র পাহারায় থাকত। ডিসেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে কমান্ডার রফিকুল ইসলামের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা কাটাখালি ব্রিজে অপারেশন চালান। এ অপারেশনে ব্রিজে পাহারায় থাকা ৭ জন রাজাকার মুক্তিযোদ্ধাদের নিকট আত্মসমর্পণ করলে ৭টি থ্রি-নট-থ্রি রাইফেল মুক্তিযোদ্ধাদের হস্তগত হয়। ৯ই ডিসেম্বর গোয়ালন্দ উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়।
গোয়ালন্দ উপজেলায় তিনজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার নাম পাওয়া যায়। তাঁরা হলেন ফকির মহিউদ্দিন (পিতা ফকির বদর উদ্দিন, দৌলদিয়া), নায়েক আমীর আলী শেখ (পিতা বাউল আলী শেখ, দেওয়ানপাড়া) ও আবুল কাসেম (পিতা হারাধন মণ্ডল, কৃষ্ণতলা)।
শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে গোয়ালন্দ আনসার ক্লাবের পাশে একটি শহীদ মিনার নির্মিত হয়েছে। গোয়ালন্দের প্রতিরোধযুদ্ধে শহীদ ফকির মহিউদ্দিনের নামে গোয়ালন্দের আনসার ক্লাবটির নামকরণ করা হয়েছে শহীদ ফকির মহিউদ্দিন আনসার ক্লাব। মুক্তিযোদ্ধা ফকির আব্দুল জব্বার নিজ উদ্যোগে শহীদ স্মৃতি বালিকা বিদ্যালয় ও তাঁর নিজের নামে বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল জব্বার কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। এছাড়াও উত্তরাধিকার-৭১ নামের স্থানীয় একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের উদ্যোগে ২১শে এপ্রিল সংঘটিত গোয়ালন্দের বালিয়াডাঙ্গা গণহত্যার স্থানে একটি স্মারক নির্মিত হয়েছে। এখানে ৩৪ জন শহীদের নামফলক স্থাপন করা হয়েছে। ১৯৯৩ সালে গোয়ালন্দ মোড়ে খানখানাপুরের বিশিষ্ট রাজনৈতিক মুজিব আলম বুকলের নেতৃত্বে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধরা একটি স্মৃতিস্তম্ভ স্থাপন করেন। রাজবাড়ী-১ আসনের জাতীয় সংসদ সদস্য কাজী কেরামত আলীর উদ্যোগে গোয়ালন্দে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের কাজ এগিয়ে চলেছে। গোয়ালন্দ উপজেলার ছোটভাকলা ইউনিয়নের কাশিমা গ্রামে গোলাম মোস্তফা গিয়াসের ব্যক্তিগত উদ্যোগে একটি মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি যাদুঘর স্থাপিত হয়েছে। [আবু রেজা আশরাফুল মাসুদ (বাবু মল্লিক)]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৩য় খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!