গোয়ালমারি-জামালকান্দি যুদ্ধ (দাউদকান্দি, কুমিল্লা)
গোয়ালমারি-জামালকান্দি যুদ্ধ (দাউদকান্দি, কুমিল্লা) সংঘটিত হয় ২০শে নভেম্বর। ২নং সেক্টরের বড় যুদ্ধগুলোর মধ্যে এটি একটি। দাউদকান্দি, মতলব ও গজারিয়া উপজেলা অঞ্চলে পাকবাহিনীর তৎপরতা সীমিত করতে এবং এ অঞ্চলকে শত্রুমুক্ত করতে এ যুদ্ধের প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী। পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের এ-যুদ্ধে বহু পাকসেনা নিহত হয় এবং ৬ জন মুক্তিযোদ্ধা ও ৮ জন সাধারণ গ্রামবাসী শহীদ হন।
গোয়ালমারি ও জামালকান্দি কুমিল্লা জেলার দাউদকান্দি উপজেলার পাশাপাশি দুটি গ্রাম। গ্রামদুটি ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের গোমতী সেতুর পূর্বপাড়ে বিশ্বরোড থেকে ৪ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত। গোয়ালমারিতে রয়েছে একটি বিখ্যাত বাজার। বাজারের প্রায় ৫শ গজ উত্তরে চৌধুরী বাড়িতে ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের গোপন ঘাঁটি। রণকৌশলগত কারণে মুক্তিযোদ্ধাদের এ ঘাঁটিটি ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এর প্রায় সাড়ে ৩ কিলোমিটার উত্তরে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক এবং দাউদকান্দি ফেরিঘাট অবস্থিত। এই ফেরিঘাট হয়ে মহাসড়ক দিয়ে পাকবাহিনী নিয়মিত যাতায়াত করত। পাকিস্তান থেকে আনা যাবতীয় সামরিক অস্ত্র চট্টগ্রাম বন্দর হয়ে এই সড়ক দিয়েই ঢাকাসহ সারাদেশে সরবরাহ করা হতো। মুক্তিযোদ্ধাদের এ ঘাঁটির ঠিক পশ্চিম পাশেই খালের সঙ্গে সংযুক্ত গোমতী-মেঘনা নৌ-পথ। দক্ষিণ দিকে চাঁদপুর উপজেলার মতলব। এখান থেকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে পাকবাহিনীর অবস্থানের ওপর সহজেই আক্রমণ পরিচালনা করা যেত, নজরদারি করা যেত দাউদকান্দি ফেরিঘাট হয়ে পাকবাহিনীর সৈন্য ও অস্ত্র আনা নেয়ার ওপরও।
জুলাই-আগস্ট মাসে সারাদেশ বন্যায় প্লাবিত। এই সুযোগে দেশব্যাপী মুক্তিযোদ্ধাদের গেলিরা আক্রমণে পাকবাহিনী বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। দাউদকান্দি ও পার্শ্ববর্তী গজারিয়া অঞ্চলে অবস্থানকারী পাকসেনারা ছিল আরো বেশি বিপর্যস্ত। কারণ, অপারেশন জ্যাকপট-এর সময় নৌ-কমান্ডো শাহজাহান সিদ্দিকী, বীর বিক্রম-এর নেতৃত্বে ১৬ই আগস্ট রাতে মাইন বিস্ফোরণে ডুবিয়ে দেয়া হয় দাউদকান্দি ফেরিঘাটে থাকা পাকবাহিনীর দুটি ফেরি ও একমাত্র পন্টুনটি। এর ফলে চট্টগ্রামসহ দেশের পূর্ব-দক্ষিণাঞ্চলে অবস্থান করা পাকবাহিনী ঢাকা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।
২০শে নভেম্বর ঈদুল ফিতর। ভোরে উঠে নামাজ পড়তে ও সেমাই রান্না করতে হবে। তাই আগেরদিন একটু তাড়াতাড়িই মুক্তিযোদ্ধারা মুক্তিযোদ্ধারা ঘুমিয়ে পড়েন। গার্ড মুক্তিযোদ্ধারাও ঈদের রাত ভেবে ঘুমিয়ে পড়েন। তাঁদের ধারণা ছিল – হানাদার হলেও পাকিস্তানিরাও তো মুসলমান। তাই এ পবিত্র রাতে আর আক্রমণের ভয় নেই। কিন্তু স্থানীয় -রাজাকার-রা মুক্তিযোদ্ধাদের এ গোপন ঘাঁটির খবর দাউদকান্দি থানা, ডাকবাংলো ও আশপাশের কয়েকটি ক্যাম্পে থাকা পাকসেনাদের কাছে পৌঁছে দেয়। তারা ঈদের দিন ভোররাতেই মুক্তিবাহিনীর ঘাঁটিতে আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নেয় এবং মুক্তিযোদ্ধারা যখন ফজর ও ঈদের নামাজের জন্য ব্যস্ত, তখন ভোর ৪টার দিকে ঘাঁটি আক্রমণ করতে এগিয়ে আসে।
গোয়ালমারি বাজারের বটগাছের নিচে ইয়াসমিন নামে এক পাগলি (ইনসান পাগলি) থাকত। পাকসেনাদের দূর থেকে আসতে দেখে সে দৌড়ে মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাঁটির কাছে চলে আসে এবং চিৎকার করে বলতে থাকে, ‘আইয়ে রে আইয়ে রে, আইয়ে রে আইয়ে রে।’ তার চিৎকার-চেঁচামেচি শুনে মুক্তিযোদ্ধারা ঘুম থেকে জেগে ওঠেন এবং কেউ অস্ত্র হাতে নেন, কেউ বা পাগলিকে গালমন্দ করেন। হঠাৎ বাজারের দিক থেকে গুলি আসতে থাকে। এবার মুক্তিযোদ্ধারা নিশ্চিত হন যে, তাঁরা সত্যই অক্রান্ত। তখন তাঁরা অস্ত্র নিয়ে ঘাঁটি থেকে কিছুটা পশ্চিম দিকে সরে গিয়ে পাল্টা গুলি ছুড়তে শুরু করেন। কৌশলগত কারণে তাঁরা আরো পেছনে জামালপুর গ্রামের দিকে যেতে থাকেন। পাকসেনারাও গুলি ছুড়তে- ছুড়তে এগিয়ে যায়। এর ফলে পাকবাহিনীকে তিনদিক থেকে ঘিরে ফেলার সুযোগ তৈরি হয়।
গোয়ালমারি-জামালকান্দির দক্ষিণে চাঁদপুরের মতলব উপজেলা। মতলবের সুজাতপুর নেছারিয়া উচ্চ বিদ্যালয় ছিল ঐ অঞ্চলের এফএফ – বাহিনীর প্রধান ঘাঁটি। এ ঘাঁটির অধিনায়ক ছিলেন লেফটেন্যান্ট এম এ ওয়াদুদ। সে- রাতে মেঘনা ও ধানগোদা নদীতে সারারাত টহলশেষে ক্লান্ত মুক্তিযোদ্ধারা রাত সোয়া ৪টার দিকে ঘাঁটিতে কেবল ফিরে এসেছেন। এরই মধ্যে সুজাতপুরে সাইরেন বাজিয়ে পাকবাহিনী কর্তৃক গোয়ালমারি-জামালকান্দি আক্রান্ত হওয়ার খবর জানানো হয় এবং হেডকোয়ার্টার্স থেকে গোয়ালমারির মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্যে এগিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়। অধিনায়ক এম এ ওয়াদুদ সুইসাইড ইউনিটগুলোকে দ্রুত প্রস্তুত করেন। বিবাহিত অধিকাংশ মুক্তিযোদ্ধাকে ঈদের ছুটি দেয়ায় তিনি কিছুটা বিপাকে পড়েন। সুজাতপুর রক্ষার দায়িত্ব তখন ৬০ জন মুক্তিযোদ্ধার ওপর। তাঁদের মধ্য থেকে বাছাই করে একটি বাহিনী নিয়ে তিনি গোয়ালমারির দিকে রওনা হন। নৌকায় ধানগোদা নদী হয়ে তাঁরা ভোর সাড়ে পাঁচটার দিকে গোয়ালমারি বাজারের কাছাকাছি পৌঁছান। ভোরের আলো ফোটার পর বাইনোকুলারে শত্রুর অবস্থান দেখে অধিনায়ক মুক্তিযোদ্ধাদের ৩টি গ্রুপে ভাগ করেন। এ-সময় শত্রুবাহিনীর অবস্থান ছিল গোয়ালমারি বাজারে। মাঝখানে একটি খালের ব্যবধান। মুক্তিবাহিনীর একটি ইউনিট খালের পশ্চিম পাড়ে খন্দকার বাড়ির পশ্চিম পাশে অবস্থান নেয়। এ ইউনিটের দায়িত্বে ছিলেন অধিনায়ক নিজে। ২নং ইউনিটটি অবস্থান নেয় গোয়ালমারি-জামালকান্দি রাস্তার মাঝে এবং ৩নং ইউনিটটি অবস্থান নেয় গোয়ালমারি বাজারের উত্তর- পশ্চিম দিকে। পূর্বদিকে ছিল স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের সমন্বয়ে গঠিত মূল ইউনিট। সকাল ৬.৪৫ মিনিটের দিকে মুক্তিযোদ্ধাদের ৪টি ইউনিট একযোগে পাকসেনাদের আক্রমণ করে। পূর্বেই নির্দেশ ছিল ‘র্যাপিড ফায়ার’ করার। বেলা বাড়ার সঙ্গে-সঙ্গে স্থানীয় জনতাও মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে যোগ দেয়। তারা যুদ্ধ-উপকরণ এগিয়ে দেয়া, খাবার পানি যোগানো, শত্রুবাহিনীর অবস্থান ও তৎপরতার খবর পৌঁছানোসহ নানাভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করে। বেলা ১১টার দিকে গোয়ালমারি বাজারে অবস্থানরত হানাদার বাহিনীর দলটি কিছুটা দুর্বল হয়ে পড়ে। মুক্তিযোদ্ধাদের সাঁড়াশি আক্রমণে তাদের একটি দল বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। তারা পালাতে গিয়ে জামালকান্দি গ্রামে ঢুকে পড়ে। সেখানে তারা আওয়ামী লীগ নেতা মুস্তাফা সারওয়ারের বাড়িসহ আরো কয়েকটি বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়।
শত্রুবাহিনীর বিচ্ছিন্ন হওয়া এই দলটির পুনরায় দলভুক্ত হওয়া বা দাউদকান্দি থানার দিকে নিরাপদ আশ্রয়ে যাওয়ার একটাই পথ ছিল, তা হলো গোয়ালমারি বাজার হয়ে যাওয়ার পথ। মুক্তিযোদ্ধারা এ সুযোগটি কাজে লাগান। আব্দুল আজিজ ও মহিউদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বাধীন মুক্তিযোদ্ধারা পাকসেনাদের এই ফিরতিপথে এম্বুশ করেন এবং হানাদারদের দলটি কাছাকাছি আসামাত্রই একযোগে গুলি চালান। এতে ৩০ জন পাকসেনা নিহত হয় এবং তাদের অস্ত্র ও গোলাবারুদ মুক্তিযোদ্ধারা হস্তগত করেন। যুদ্ধের এ সাফল্য ও অস্ত্র পেয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল বেড়ে যায়। বিজয়ের এ খবর দ্রুত মুক্তিযোদ্ধাদের সবকটি ইউনিটে পৌঁছে যায়।
দুপুর নাগাদ হানাদারদের গোয়ালমারি বাজারের দলটি উত্তরে দাউদকান্দি থানার দিকে পিছু হটতে থাকে। তখন অধিনায়ক এম এ ওয়াদুদের নেতৃত্বাধীন ইউনিট তাদের ওপর তুমুল আক্রমণ চালায়। এতে বেশ কয়েকজন পাকসেনা নিহত হয় এবং বাকিরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। এ সুযোগে অধিনায়কের দলটি গোয়ালমারি বাজার দখল করে নেয়। বিকেল সোয়া ৪টার দিকে হানাদাররা বাজারের দিকে গুলি ছুড়তে থাকলে মুক্তিযোদ্ধা রুহুল আমীন শহীদ হন। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে মুক্তিযোদ্ধারা সর্বশক্তি দিয়ে হানাদারদের আক্রমণ করেন। কমান্ডার শফিকের নেতৃত্বাধীন দাউদকান্দির পূর্বাঞ্চলের ইউনিট, গোয়ালমারি চৌধুরী বাড়ি ঘাঁটির দল এবং অধিনায়ক ওয়াদুদের দল এ তিনটি ইউনিট একযোগে হানাদারদের ওপর আক্রমণ করে। পাকসেনারাও পাল্টা জবাব দেয়। এদিকে গোমতী-মেঘনা নদীর পশ্চিম পাড়ে গজারিয়ায় অবস্থানরত একটি দল নিয়ে মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলাম, বীর প্রতীক অগ্রসর হন। সন্ধ্যার পূর্বমুহূর্তে হানাদারদের গুলিতে লেফটেনান্ট ওয়াদুদ আহত হন। যুদ্ধক্ষেত্রেই তাঁকে প্রাথমিক চিকিৎসা দেন সেখানকার ডাক্তার আনোয়ার হোসেন।
মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে দিশেহারা পাকবাহিনী সন্ধ্যার পর দাউদকান্দি থানার দিকে পালিয়ে গিয়ে কালারকান্দি আনাল খালের কাঠের পুল এলাকায় অবস্থান নেয়। এর মধ্যে মুক্তিযোদ্ধারা দক্ষিণ, পূর্ব ও পশ্চিম তিনদিক থেকে তাদের ঘিরে ফেলেন। মুক্তিযোদ্ধাদের গুলিতে এখানে প্রায় ৪০ জনের মতো পাকসেনা নিহত হয়। জীবিতদের মধ্যে দুজন মুক্তিযোদ্ধাদের হতে ধরা পড়ে এবং বাকিরা দাউদকান্দি থানার দিকে পালিয়ে যায়। ধরাপড়া দুজনকে পরে মেরে ফেলা হয়। রাত ১০টার দিকে শহীদদের লাশ ও ১৩ জন আহত মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়ে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিতে-দিতে অধিনায়ক ওয়াদুদের নেতৃত্বাধীন দলটি সুজাতপুর ঘাঁটিতে ফিরে যায়।
গোয়ালমারি-জামালকান্দি যুদ্ধে ৬ জন মুক্তিযোদ্ধা ও ৮ জন গ্রামবাসী শহীদ হন। শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- মো. রুহুল আমীন (পিতা মো. নুরুল ইসলাম, দক্ষিণ গাজীপুর), মোস্তাক আহমেদ (পিতা মো. ছাদের ভূঁইয়া, ঝাউতলী, জুরানপুর), মজিবুর রহমান মজনু (পিতা মো. আলফু ভূঁইয়া, সুন্দলপুর), নুরুল ইসলাম (পিতা মো. আব্দুল হামিদ, রফারদিয়া), গিয়াস উদ্দিন (পিতা আব্দুস সুবহান, কামারকান্দি) এবং আব্দুস সাত্তার (পিতা মো. আব্দুল কাদের সরকার, সোনাকান্দা)। এছাড়া ইনসান পাগলিও শত্রুর গুলিতে শহীদ হয়। সে তালিকাভুক্ত মুক্তিযোদ্ধা না হলেও এ- যুদ্ধে তার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার কারণে তাকে মুক্তিযোদ্ধার মর্যাদা দেয়া হয়। এঁরা সকলেই ছিলেন দাউদকান্দি উপজেলার অধিবাসী। এঁদের স্মরণে গোয়ালমারিতে একটি স্মৃতিসৌধের ভিত্তি স্থাপন করা হয়।
যুদ্ধে শহীদ গ্রামবাসীরা হলেন— শামসুন্নাহার (স্বামী মো. গিয়াস উদ্দিন সরকার, জামালকান্দি), রেজিয়া খাতুন (পিতা ঐ, জামালকান্দি), আছিয়া খাতুন (স্বামী মো. ফজলুল হক আকন্দ, জামালকান্দি), সাইদুর রহমান (পিতা মো. আব্দুল মজিদ, জামালকান্দি), হুমায়ুন কবির (পিতা ডা. আফতাব উদ্দিন, লামছরি), শহীদ উল্লাহ (পিতা মো. কফিল উদ্দিন সরকার, সোনাকান্দা), জুলফিকার আহমেদ (পিতা মো. সাইজউদ্দিন মিয়া, মোল্লাকান্দি) এবং মো. আব্দুর রহমান সরকার (পিতা রুহুল আমিন সরকার, জামালকান্দি)। এঁরাও সকলে ছিলেন দাউদকান্দি উপজেলার অধিবাসী। যুদ্ধে ৩ বছরের একটি শিশু আহত হয়। তার নাম জায়েদা (পিতা গিয়াস উদ্দিন সরকার, জামালকান্দি, কুমিল্লা)। [বাশার খান]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৩য় খণ্ড