গোমদণ্ডী সিও অফিস রাজাকার ক্যাম্প অপারেশন (বোয়ালখালী, চট্টগ্রাম)
গোমদণ্ডী সিও অফিস রাজাকার ক্যাম্প অপারেশন (বোয়ালখালী, চট্টগ্রাম) পরিচালিত হয় ২৮শে আগস্ট। এতে বহু রাজাকার নিহত হয়। অপরদিকে ২ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ ও একজন আহত হন।
চট্টগ্রাম শহর থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে গোমদণ্ডী সিও অফিস অবস্থিত। এখানে রাজাকার বাহিনীর হেডকোয়ার্টার্স ছিল। ১০০ জন রাজাকার সার্বক্ষণিক সিও অফিস পাহারা দিত। সিও অফিস একটি দোতলা ভবনে ছিল। এ ভবনের দ্বিতীয় তলায় রাজাকার ক্যাম্প স্থাপিত হয়। সার্কেল অফিসারের বাংলো ছিল টর্চার সেল। রাজাকাররা চট্টগ্রামের গুডস্ হিল- থেকে তাদের প্রয়োজনীয় অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহ করত। এরপর তারা বিভিন্ন স্থানে অপারেশনে বের হতো। তারা কধুরখীল গ্রামে প্রথম অপারেশন চালায় এবং ৩ জন গ্রামবাসীকে হত্যা করে। বোয়ালখালীর মুক্তিযোদ্ধারা সিও অফিস রাজাকার ক্যাম্প অপরেশনের সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু তাঁদের কাছে আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র ছিল না।
১৪ই আগস্ট পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবসে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের বসর গ্রুপ দোহাজারী রেলপথে পাকিস্তানি সেনাদের টহলরত রেলগাড়ি উড়িয়ে দেয়ার পরিকল্পনা করেন। দোহাজারী লাইনে রাত ১০টা পর্যন্ত যাত্রীরা চলাচল করত। যাত্রী সাধারণের ক্ষতি এড়ানোর লক্ষ্যে মুক্তিযোদ্ধারা রাত ১০টার পর এ রেলপথের ১৩ ও ১৪ নং রেলসেতুর মাঝামাঝি স্থানে এন্টিট্যাঙ্ক মাইন স্থাপন করেন। রাত ১২টার দিকে চট্টগ্রাম থেকে পাকবাহিনীর একটি টহল রেল মাইন বসানো স্থান অতিক্রম করে। স্থাপিত প্রথম মাইনটি বিস্ফোরিত না হলেও দ্বিতীয়টি বিস্ফোরিত হয়। বিস্ফোরণে রেলের ২-৩টি বগি সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস হয় এবং বগিতে অবস্থানরত বেশকিছু পাকিস্তানি সৈন্য হতাহত হয়। পরদিন সকালে প্রতিশোধ নেয়ার জন্য পাকিস্তানি সৈন্যরা সিও অফিসের রাজাকারদের নিয়ে ঘটনাস্থলের আশপাশে অবস্থিত কয়েকশ ঘরবাড়িতে আগুন লাগায় এবং অনেককে গুলি করে হত্যা করে। পাল্টা প্রতিশোধ নেয়ার জন্য মুক্তিযোদ্ধারা পুনরায় সিও অফিস রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নেন। শক্তি সঞ্চয়ের জন্য তাঁরা পদুয়ায় অবস্থানকারী টি এম আলী গ্রুপের সহায়তা চান। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে লড়াই করার জন্য স্থানীয় জনগণকেও উদ্বুদ্ধ করা হয়।
১৪ই আগস্ট কানুরখীল অপারেশনের পর কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা করলডেঙ্গা পাহাড়ে বিশ্রাম করছিলেন। সেখানে বোয়ালখালীর মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে টি এম আলী গ্রুপের মুক্তিযোদ্ধাদের পরিচয় হয়। টি এম আলী গ্রুপও গোমদণ্ডী রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণের সুযোগ খুঁজছিল। টি এম আলী গ্রুপ রাঙ্গুনীয়া থানায় অবস্থান করত। করলডেঙ্গা পাহাড়ের পাদদেশে জৈষ্ঠ্যপুরার সেন বাড়িতে বোয়ালখালীর এফএফ মুক্তিযোদ্ধাদের স্থায়ী ঘাঁটি ছিল। মুক্তিযোদ্ধারা গোমদণ্ডী রাজাকার ক্যাম্প অপারেশনের ছক তৈরি করেন। ২৮শে আগস্ট সন্ধ্যায় টি এম আলী গ্রুপের ২৫ জন সদস্য বোয়ালখালীর মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে করলডেঙ্গা লিচু বাগানে মিলিত হন। সেখান থেকে তাঁরা সেন বাড়িতে পৌঁছান। তাঁদের সঙ্গে অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধা গ্রুপও যোগদান করেন।। কমান্ডার সোলাইমান, কমান্ডার আবুল বশর, প্রদ্যুৎ পাল, আ হ ম নাসির উদ্দিন চৌধুরী ও আবুল হোসেনের গ্রুপ এদের সঙ্গে ছিল।
টি এম আলী ছিলেন সেনাবাহিনীর সুবেদার। তাঁর গ্রুপের ২৫ জনই ছিলেন সেনাসদস্য। ২৮শে আগস্ট রাত ১২টায় সিও অফিস রাজাকার ক্যাম্প অপারেশনের সিদ্ধান্ত হয়। সিদ্ধান্ত হয় ফজলু কমান্ডারের নেতৃত্বে ৩০ জনের একটি মুক্তিযোদ্ধা দল মূল ক্যাম্প আক্রমণ করবে। এতে থাকবেন ওয়াজেদ, বেবী, শফি, ইদ্রিচ, রহম আলী, হারুনর রশীদ প্রমুখ। অপারেশনে বোয়ালখালী উপজেলার মুক্তিযোদ্ধারা ছোট-ছোট গ্রুপে বিভক্ত হয়ে অংশগ্রহণ করেন। কমান্ডার সোলায়মান, কমান্ডার আবুল বশর, কমান্ডার আবুল হোসেন, আ হ ম নাসির উদ্দিন চৌধুরী, সুজিত নাগ, প্রদ্যুৎ পাল, এস এম সেলিম, মনছুর আহমদ সিদ্দিকী, ওয়াজেদ, ওবায়দুল হক সিকদার ও বেবীসহ মোট ১০ জন অভিযানে অংশগ্রহণ করেন। ৩টি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে মুক্তিযোদ্ধারা অপারেশনে অংশ নেন। ১নং গ্রুপের দায়িত্বে ছিলেন হাবিলদার ফজলুল হক বারী। তাঁর সহযোদ্ধা ছিলেন সার্জিং গ্রুপের সদস্য আবদুল ওয়াজেদ ও রেজাউল করিম আরবী। এ গ্রুপটির দায়িত্ব ছিল সরাসরি রাজাকার ক্যাম্পের ভেতরে প্রবেশ করা। ২নং গ্রুপের ২০-২৫ জন গোমদণ্ডী হাসপাতালের কাছে এবং ৩নং গ্রুপ গোমদণ্ডী রেলওয়ে স্টেশনের নিকটবর্তী ১৩নং রেলওয়ে ব্রিজের নিকট অবস্থান নেয়া। ৩নং গ্রুপের দায়িত্ব ছিল চট্টগ্রাম শহর থেকে রাজাকারদের উদ্ধারে যারা অগ্রসর হবে তাদের প্রতিরোধ করা। কমান্ডার আবুল বশরের নেতৃত্বে এ গ্রুপের ২৫ জন সদস্য অপারেশনে অংশগ্রহণ করেন।
রাত ১টায় মুক্তিযোদ্ধাদের সবগুলো এলএমজি, স্টেনগান ও রাইফেল একসঙ্গে গর্জে ওঠে। এক ঘণ্টা ধরে যুদ্ধ চলে। এ অপারেশনে বহু রাজাকার নিহত হয়। কমান্ডার ফজলু গ্রেনেড হাতে ক্রলিং করে রাজাকারদের মূল ভবনের দোতলার সিঁড়ি পর্যন্ত উঠে যান। তখন চট্টগ্রামের দিক থেকে একটি আর্মির পেট্রোল রেল গোমদণ্ডী রেলস্টেশনের কাছাকাছি চলে আসে। ১৩নং ব্রিজের কাছাকাছি হওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে তারা ট্রেনের সার্চ লাইটগুলো একসঙ্গে জ্বালিয়ে দেয়। এতে পাকিস্তানি সৈন্যরা মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান দেখে ফেলে। ফলে মুক্তিযোদ্ধাদের অপারেশন বাধাগ্রস্ত হয়। ৩নং গ্রুপ পজিশন থেকে সরে যায়। এ-সময় রাজাকারদের গুলিতে হাবিলদার ফজলু কমান্ডার ও রেজাউল করিম আরবী শহীদ হন। গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হন আবদুল ওয়াজেদ। ফজলুল কাদের চৌধুরীর ছেলে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী লোক পাঠিয়ে আহত মুক্তিযোদ্ধা ওয়াজেদকে গুডস্ হিলে নিয়ে আসে। সেখানে তাঁর ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালানো হয়। নির্যাতনের এক পর্যায়ে তিনি শহীদ হন। [উদয়ন নাগ]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৩য় খণ্ড