You dont have javascript enabled! Please enable it! মুক্তিযুদ্ধে গোমস্তাপুর উপজেলা (চাঁপাইনবাবগঞ্জ) - সংগ্রামের নোটবুক

মুক্তিযুদ্ধে গোমস্তাপুর উপজেলা (চাঁপাইনবাবগঞ্জ)

গোমস্তাপুর উপজেলা (চাঁপাইনবাবগঞ্জ) ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ- নিরংকুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করলেও পাকিস্তানি সামরিক জান্তা জনপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে নানা ষড়যন্ত্রের আশ্রয় নেয়। বাঙালিদের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান- এসবের প্রতিবাদে অসহযোগ আন্দোলন-এর ডাক দেন। দেশের অন্যান্য স্থানের মতো চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার গোমস্তাপুর থানাবাসীও অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দেয়। এ আন্দোলনের সময় ‘তোমার আমার ঠিকানা – পদ্মা মেঘনা যমুনা’, ‘তুমি কে আমি কে – বাঙালি বাঙালি’, ‘জয় বাংলা’ ইত্যাদি স্লোগান থানার সর্বত্র উচ্চারিত হয়। এখানকার ছাত্রসমাজ সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, অফিস- আদালত, ট্রেন, বাস সবকিছু বন্ধ করে দেয়। সারাদেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত গোমস্তাপুরের ছাত্রনেতৃবৃন্দ গোমস্তাপুর এসে প্রায় প্রতিদিন আওয়ামী লীগ থানা কার্যালয়ে সমাবেশ ও আলোচনা করে আইন-শৃঙ্খলা যাতে বিঘ্নিত না হয় সেজন্য নানা প্রচেষ্টা গ্রহণ করেন। এক-একজন ছাত্রনেতাকে থানার বিভিন্ন স্থানে দায়িত্ব দিয়ে পাঠানো হয়।
অসহযোগ আন্দোলনের সময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানে গোমস্তাপুরের জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে রাস্তায় নেমে আসে। ৬ই মার্চ পর্যন্ত একটানা সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়। যানবাহন, দোকানপাট, সব ধরনের অফিস ও ব্যাংক বন্ধ থাকে। সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতার মিছিল-সমাবেশ চলতে থাকে। বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের রেকর্ডকৃত ভাষণ পরের দিন শুনে গোমস্তাপুরের ছাত্রনেতারা মিছিল বের করেন। স্থানীয় নেতৃবৃন্দ পাকবাহিনীকে প্রতিরোধ করার জন্য বৈঠকে বসেন। খালেদ আলী মিয়া এমএনএ, আওয়ামী লীগ নেতা হাফিজুর রহমান হাসনু, উসমান আলী খান-সহ অন্য নেতারা অসহযোগ আন্দোলনকে তীব্রতর করার পক্ষে অবস্থান নেন। নেতৃবৃন্দের ডাকে বেগম কাছারি মাঠে এক জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় উসমান আলী খান, ডা. মইনুল ইসলাম, আবদুল খালেক বিশ্বাস, হাফিজুর রহমান হাসনু প্রমুখ বক্তব্য রাখেন। সভার সভাপতি খালেদ আলী মিয়া এমএনএ স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করার জন্য সকলকে আহ্বান জানান। তিনি আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে থানা, ইউনিয়ন এবং গ্রামে-গ্রামে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠন করার নির্দেশ দেন।
আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের আহ্বানে সাড়া দিয়ে হাফিজুর রহমান হাসনু, উসমান আলী খান, হাজী আবদুস সোবহান, গিয়াস উদ্দীন বিশ্বাস, আবদুল খালেক বিশ্বাস, এস এম আমজাদ আলী, সৈয়দ আহমদ, হারুন-অর-রশিদ পাঠান, জয়নাল আবেদীন, মো. আলতাফ হোসেন, সৈয়দ কিবরিয়া, জাইদুল ইসলাম, নাজির হোসেন, আবদুস সাত্তার, আবদুস সাত্তার-২, জিল্লুর রহমান ঝালু, আবদুল কাইউম, জিয়াউর রহমান, ইউনুস আলী, ইউসুফ আলী, আবদুল লতিফ, ডা. মাইনুল ইসলাম, নুরুল হুদা মণ্ডল, আফসার আলী, ইয়াসিন আলী, নেজামুদ্দিন মণ্ডল, এমরান আলী মুন্সি, গিয়াস উদ্দীন মণ্ডল, ইলিয়াস আলী, বাহার আলী মুন্সি, ফজলুর রহমান, লাইসেন আলী, মু. মোজাম্মেল হক, জুল মোহাম্মদ সর্দার, মনিরুল ইসলাম (চুটু), রমিজ উদ্দীন বিশ্বাস, রইসুদ্দীন আহমেদ মিয়া, ডা. ইয়াসিন আলী, এরশাদুল্লাহ মাস্টার, সুলতানুল ইসলাম, শামসুল ইসলাম কাদু, আহম্মদ উল্লাহ চৌধুরী, বেলাল উদ্দীন, আবদুস সালাম, ফজলুর রহমান ফুলু, হাজী ইয়াকুব আলী মণ্ডল, রিয়াজ উদ্দিন ওরফে ফাইজুদ্দিন মিয়া প্রমুখ প্রতিটি ইউনিয়নে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর ইউনিট গঠন করেন।
গোমস্তাপুরের ছাত্রনেতারা গ্রামে-গ্রামে গিয়ে জনগণকে স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নিতে উজ্জীবিত করেন। অন্যদিকে সরকারের গোয়েন্দা বিভাগ গোপনে এসব ছাত্রনেতার নামের তালিকা তৈরি করে। গোমস্তাপুরের পুলিশ ও ইপিআর-এর অনেক সদস্য স্বাধীনতা সংগ্রামের পক্ষে থাকায় তাঁদের মাধ্যমে গোপন তালিকা সম্পর্কে ছাত্রনেতারা অবহিত হন। এ কারণে ২৫শে মার্চের পর গোমস্তাপুরের ছাত্রনেতারা গ্রেফতার এড়িয়ে গা-ঢাকা দিতে সক্ষম হন। পুরো অসহযোগ আন্দোলনের সময় গোমস্তাপুর ছিল এক বিক্ষুব্ধ জনপদ।
গোমস্তাপুরে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতিমূলক কাজে সবচেয়ে বেশি সক্রিয় ছিল ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। মইনুদ্দিন মণ্ডল মহকুমা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি ছিলেন। তাঁর নেতৃত্বে ছাত্র- যুবকরা উদ্বুদ্ধ হয় এবং পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত হতে থাকে। তাঁরই নেতৃত্বে একটি স্কোয়াড এলাকার সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গিয়ে ঐক্যবদ্ধ সশস্ত্র সংগ্রামের জন্য ছাত্রদের প্রস্তুত করে। আওয়ামী লীগের নেতারা বিভিন্ন এলাকায় মিছিল ও সভা- সমাবেশের মাধ্যমে জনগণকে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করতে থাকেন। ছাত্রলীগ-এর একটি অংশ পুলিশ ও ইপিআর-এর বাঙালি সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করে।
সংগ্রাম কমিটি ছাত্র-যুবকদের প্রশিক্ষণ প্রদানের জন্য কার্যক্রম শুরু করে। গোমস্তাপুরের রহনপুর ইউনিয়ন সদরের বাজারে অবস্থিত উত্তরা প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে অস্ত্র প্রশিক্ষণ আরম্ভ হয়। স্কাউট লিডার আব্দুল কাইয়ুম এ প্রশিক্ষণের সূচনা করেন। যুবসমাজকে প্রশিক্ষণ দেন মুজাহিদ- বাহিনীর সদস্য জেসিও জয়নাল আবেদিন ও জেসিও আলতাফ হোসেন (ক্যাপ্টেন আলতাফ নামে পরিচিত)। স্বেচ্ছাসেবকদের মধ্যে প্রথম ব্যাচে প্রশিক্ষণ নেন আফজল হোসেন, আজমল হোসেন, মন্টু, এজাবুল, আকরাম, মারফত, টুলু, সেরাজুল ইসলাম-সহ আরো অনেকে। উল্লেখ্য, মার্চ মাসেই ৮০-৮৫ জন স্বেচ্ছাসেবককে দুই ব্যাচে দুই সপ্তাহের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। প্রথমদিকে বাঁশের লাঠি ছিল প্রশিক্ষণের উপকরণ। প্রশিক্ষণ দেয়া হতো খেলার মাঠে ও আমবাগানে। রহনপুর, আলিনগর, বাঙ্গাবাড়ি, বোয়ালিয়া, গোমস্তাপুর, রাধানগর প্রভৃতি গ্রাম থেকে স্বেচ্ছাসেবকরা প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ করতেন। এ-সময় এলাকার বিত্তবান ও প্রভাবশালীদের কাছ থেকে ১৩টি বন্দুক সংগ্রহ করা হয়। এসব দিয়ে বন্দুক পরিচালনা বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেয়া হতো। এ উপজেলায় সংগঠকের ভূমিকা পালন করেন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব মো. খালেদ আলী মিয়া এমএনএ, হাফিজুর রহমান হাসনু, উসমান আলী খান প্রমুখ।
৭নং সেক্টরের আওতাভুক্ত চাঁপাইনবাবগঞ্জে ২টি সাব-সেক্টর ছিল। একটি মেহেদিপুর সাব-সেক্টর। এ সাব-সেক্টরের কমান্ডারের দায়িত্বে ছিলেন ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর (পরে শহীদ ও বীরশ্রেষ্ঠ)। অন্যটি হলো দলদলি সাব- সেক্টর। এর কমান্ডার ছিলেন লে. রফিকুল ইসলাম। এ দুই সাব-সেক্টরই গোমস্তাপুর উপজেলার বাইরে ছিল। তবে গোমস্তাপুর শহর দখলের মূল যুদ্ধে দলদলি সাব-সেক্টরের কমান্ডাররা এ উপজেলায় অবস্থান করেন। ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীর, লে. রফিক ও লে. কাইউম গোমস্তাপুরের বোয়ালিয়া, শাহপুর গড়-সহ বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন। শহর দখলের যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর। লে. কাইউমও এ-যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য গোমস্তাপুর উপজেলা অতিক্রম করে শহরের দিকে অগ্রসর হন। গোমস্তাপুর উপজেলায় মুজিব বাহিনী-র নেতৃত্বে ছিলেন বোয়ালিয়ার মো. জামাল উদ্দীন।
২৫শে মার্চ বিকেলে ইপিআর হেডকোয়ার্টার্স থেকে ১৫-১৬ জন অবাঙালি ইপিআর সদস্য চাঁপাইনবাবগঞ্জ আসেন। সেদিন সকাল থেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জস্থ ৬নং উইং-এর বাঙালি ইপিআর সদস্যদের কাছ থেকে অস্ত্র কেড়ে নেয়ার জন্য অবাঙালি কর্মকর্তারা চেষ্টা করে। কিন্তু বাঙালিদের মনে সন্দেহ জাগায় তাঁরা অস্ত্র জমা দিতে অস্বীকৃতি জানান। চাঁপাইনবাবগঞ্জে বাঙালি ইপিআর সদস্যদের নিরস্ত্র করতে ব্যর্থ হয়ে একজন ক্যাপ্টেনের নেতৃত্বে ৩০ জন অবাঙালি ইপিআর রহনপুরের দিকে অগ্রসর হয়।
পাকিস্তানিদের নীলনকশার অংশ হিসেবে ২৫শে মার্চ রাতে ইপিআর বাহিনীর একটি দল রহনপুর বিওপি দখলের চেষ্টা করে। বাঙালি সৈন্যরা প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। এ-সময় ইপিআর-এর কয়েকজন অবাঙালি সিপাহি ও একজন অফিসার গুরুতর আহত হন। বাঙালি ইপিআর জওয়ান শামসুল ইসলাম ও অন্যদের দৃঢ়তা ও সাহসী প্রতিরোধে তারা পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। বিওপি দখলে ব্যর্থ হয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জ ফেরার পথে তারা রহনপুর বাজারে কয়েকজন অসহায় ও নিরীহ মানুষকে হত্যা করে।
অল্প সময়ের মধ্যে গোমস্তাপুরের সংগ্রামী নেতৃবৃন্দ তাঁদের তত্ত্বাবধানে এক স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গড়ে তুলতে সক্ষম হন। কিন্তু পর্যাপ্ত অস্ত্র না থাকায় চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে আসা পাকহানাদার বাহিনীকে তাঁদের পক্ষে বাধা দেয়া সম্ভব হয়নি। তাই কোনো শক্ত প্রতিরোধ ছাড়াই পাকবাহিনী গোমস্তাপুর দখল করে।
২১শে এপ্রিল পাক হানাদারবাহিনী গোমস্তাপুর থানা সদর ও রহনপুর শহর দখল করে। খুব ভোরে পাকবাহিনী গুলিবর্ষণ শুরু করে। এতে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরক্ষাব্যূহ পুরোপুরি ভেঙে পড়ে। হানাদার বাহিনীর প্রচণ্ড আক্রমণে ব্যাপক ক্ষতির আশঙ্কায় প্রতিরোধকারীরা পরবর্তী প্রস্তুতির জন্য নিরাপদ অবস্থানে চলে যান। কয়েকটি আর্মি জিপ ও আর্টিলারি বহর-সহ হানাদার বাহিনীর বিশাল কনভয় গোমস্তাপুর থানা ও রহনপুর শহরে প্রবেশ করে। তারা গোমস্তাপুর থানা কার্যালয় ও রহনপুর শহরের আহমদী বেগম উচ্চ বিদ্যালয়ে ক্যাম্প স্থাপন করে। হানাদার বাহিনী তাদের শক্তি বৃদ্ধির লক্ষ্যে সেখানে শান্তি কমিটি, রাজাকার- ও <আলবদর বাহিনী গঠন করে। এসব বাহিনীর ক্যাম্পও এ স্কুল মাঠে স্থাপিত হয়। রহনপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের ঘাঁটিই গোমস্তাপুর থানায় পাকবাহিনীর সবচেয়ে বড় অবস্থান ছিল। উপজেলার মকরমপুর ও আলীনগরেও পাকবাহিনীর শক্ত ঘাঁটি ও প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ছিল।
গোমস্তাপুর দখলের অল্প সময়ের মধ্যেই পাকবাহিনী থানার সর্বত্র তাদের দখল প্রতিষ্ঠা করে। রহনপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনে একটি বড় পাকা বাংকার তৈরি করে পাকবাহিনীর প্রধানের থাকার ব্যবস্থা করা হয়। রহনপুর ক্যাম্প থেকে তারা আশপাশের এলাকায় আক্রমণ, ধ্বংসযজ্ঞ ও হত্যাকাণ্ড চালাত।
পাকবাহিনী গোমস্তাপুর দখল করে শান্তি কমিটি, রাজাকার ও আলবদর বাহিনী গঠন করে। শান্তি কমিটির সদস্য হিসেবে যারা পাকবাহিনীর কার্যক্রমে সহায়তা করে, তাদের মধ্যে মো. তোজাম্মেল মিয়া, জোহর আহমেদ মিয়া (রহনপুর), দাউদ আলী মাস্টার (প্রসাদপুর), মাওলানা মোহাম্মদ আলী (চিনিয়াতলা), পালানু খলিফা (রহমতপাড়া), মাওলানা ইসাহাক আলী (রাধানগর), সাঈদ আলী (পুরাতন প্রসাদপুর), মোহাম্মদ মংলু চেয়ারম্যান (বোয়ালিয়া), গামজাদ মড়ল (বাবুপুর), তাহের আলী (কাসিয়াবাড়ি), এহিয়া মাস্টার, আফাজউদ্দীন বিশ্বাস (আলীনগর), লতিফ মিয়া প্রমুখ উল্লেখযোগ্য।
রাজাকারদের মধ্যে মুসলিম মিলিটারি (চৌডালা), হজাতুল্লাহ (চৌডালা), ইয়াসিন হালদার (গোমস্তাপুর), ভোদা (গোমস্তাপুর), আব্দুল খালেক (নিমতলা), মোহাম্মদ আলী (নন্দলালপুর, চৌডালা), পানু আলী (নন্দলালপুর), লাল মোহাম্মদ (নন্দলালপুর), তাজের আলী (শ্যামপুর), আব্দুল মজিদ ওরফে পাগলা মজিদ (রহমতপাড়া), আব্দুল খালেক (কাসিয়াবাড়ি), আব্দুর রহমান (কাসিয়াবাড়ি), ফন্টু মিয়া (কাসিয়াবাড়ি, বাবুপুর), কায়েস (কাসিয়াবাড়ি, বাবুপুর), মিন্টু (বড় বঙ্গেশ্বরপুর), আব্দুল্লাহ মামুন (খয়রাবাদ), আবেদ মুনশি (বোয়ালিয়া), আব্দুল লতিফ (বাবুর ঘোন), আব্দুল হক (স্টেশন বাজার) প্রমুখ এলাকায় লুটপাট, অগ্নিসংযোগ, হত্যা, গণহত্যা, ধর্ষণ-সহ বিভিন্ন ধ্বংসাত্মক কাজে লিপ্ত ছিল।
আইনাল হকের (রহনপুর) নেতৃত্বে আলবদর বাহিনী গড়ে ওঠে। আলবদর ও রাজাকার বাহিনীর সদস্যদের অধিকাংশই ছিল ইসলামি ছাত্র সংঘ-এর কর্মী। এসব বাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের সবচেয়ে বেশি ক্ষতিসাধন করে। কারণ এসব বাহিনীর সদস্যরা মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান সম্পর্কে ভালোভাবে জানত। এদের প্ররোচনা ছাড়া কোনো গ্রামে হানাদার বাহিনী যেত না। হানাদার বাহিনী যে গ্রামে যেত, সে গ্রামের কিছুই অক্ষত থাকত না। তারা নিরীহ গ্রামবাসীকে লাইনে দাঁড় করিয়ে ব্রাশ ফায়ারে হত্যা করত। গোমস্তাপুর থানার বোয়ালিয়া ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামে হানাদার বাহিনী অনেক নিরীহ মানুষকে নির্মমভাবে হত্যা করে।
দালালরা গোমস্তাপুরের ছাত্র-যুবকদের অবস্থানগত তথ্যাদি হানাদার বাহিনীকে সরবরাহ করত। এসব তথ্যের ভিত্তিতে তারা ছাত্র-যুবকদের ধরে নিয়ে নির্যাতনের মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্পর্কে খবর আদায়ের চেষ্টা চালাত। তথ্য দিতে অস্বীকার করলে তাদের নির্মমভাবে হত্যা করত। শুধু শারীরিক ও মানসিক অত্যাচার নয়, লুটপাট ও নারীধর্ষণেও এরা পাকবাহিনীকে সব ধরনের সহযোগিতা প্রদান করত। অসহযোগ আন্দোলন চলাকালে অবাঙালি ইপিআর সদস্যরা ২৩শে মার্চ মো. খালেদ আলী মিয়া এমএনএ-কে বন্দি করার জন্য রহনপুর যাবার পথে গোমস্তাপুর ও চৌডালা ইউনিয়নের অনেক মানুষের ওপর নির্যাতন চালায়। অনেকের বাড়িতে তারা অগ্নিসংযোগ করে। তারা রহনপুর ইউনিয়নের বদলী নারায়ণ, রাম প্রসাদ ভক্ত ও তার ছেলেকে হত্যা করে। এ ঘটনার ফলে গোমস্তাপুর থানায় পাকিস্তানিদের প্রতি এলাকাবাসীর ক্ষোভ ও ঘৃণা আরো বৃদ্ধি পায়।
২১শে এপ্রিল শহরে অনুপ্রবেশ করেই পাকবাহিনী ধ্বংসযজ্ঞ শুরু করে। তারা সমগ্র শহরে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। অনেকের বাড়িঘর ও দোকানপাট জ্বালিয়ে দেয়। অনেক নিরীহ মানুষ তাদের দ্বারা গুলিবিদ্ধ হয়ে রাস্তায় পড়ে থাকে। ভীত-সন্ত্রস্ত মানুষ নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য গ্রামের দিকে ছুটতে থাকে। পুরো শহর শূন্য বিরানভূমিতে পরিণত হয়।
গোমস্তাপুর দখল করার পর পাকহানাদার বাহিনী তাদের স্থানীয় দোসরদের সহায়তায় স্বাধীনতার পক্ষের ব্যক্তিদের নাম, পরিচয় ও ঠিকানা সংগ্রহ করে। এসব তথ্যের ভিত্তিতে তারা বাড়ি-বাড়ি হানা দিয়ে নির্যাতন ও হত্যাকাণ্ড চালায়। রহনপুরের ক্যাম্প থেকে পাকবাহিনী বাঙ্গাবাড়ি ও রাধানগর ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামে হানা দিত। তাদের সঙ্গে এদেশীয় দালালরা থাকত। তারা হানাদারদের আওয়ামী লীগের সমর্থক ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোকদের বাড়ি চিনিয়ে দিত। শত্রুসেনারা এসব বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিত। আগুন ধরানোর আগে তারা সমস্ত সম্পদ লুট করত। তারা মানুষের গবাদি পশুও নিয়ে যেত। নারীদের ধর্ষণ করত।
হানাদার বাহিনী গোমস্তাপুরের বিভিন্ন এলাকায় কয়েকটি বড় হত্যাকাণ্ড চালায়। মুক্তিযুদ্ধের শেষের দিকে তারা মরিয়া হয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সন্ধান করতে থাকে। কারণ ইতোমধ্যে তারা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। রাজাকার, আলবদর ও পাকবাহিনীর দালালরাও মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান জানার জন্য বেপরোয়া হয়ে ওঠে। মুক্তিযোদ্ধাদের সন্ধান না পেয়ে তারা গ্রামবাসীর ওপর অকথ্য নির্যাতন শুরু করে। মুক্তিযোদ্ধারা যেদিক থেকে আক্রমণ চালাতেন, হানাদার বাহিনী সেদিকের গ্রামগুলোর অধিবাসীদের ওপর বেশি নির্যাতন, অত্যাচার চালাত।
২৩শে এপ্রিল বেলা ১টার দিকে পাকবাহিনী দালালদের সহায়তায় গোমস্তাপুর থানা-সংলগ্ন হিন্দুপাড়ায় অতর্কিতে আক্রমণ চালায়। সেখান থেকে তারা ৩৫ জন নিরীহ মানুষকে থানার পার্শ্ববর্তী খালের ধারে নিয়ে লাইন করে দাঁড় করিয়ে ব্রাশ ফায়ারে নির্মমভাবে হত্যা করে। এ ঘটনা <গোমস্তাপুর হিন্দুপাড়া গণহত্যা হিসেবে পরিচিত।
পাকহানাদার বাহিনী চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার সবচেয়ে নৃশংস হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করে গোমস্তাপুর থানার বোয়ালিয়া ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামে। ১৯শে সেপ্টেম্বর বোয়ালিয়া গণহত্যা নামে পরিচিত এ ঘটনায় প্রায় ২৫০ জন নারী- পুরুষ নিহত হন। এ নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ড থেকে ১-২ মাসের শিশুরাও রেহাই পায়নি। হত্যাকাণ্ডের দু-তিন পরও অনেকের লাশ পানিতে ভাসছিল।
রহনপুর এ বি উচ্চ বিদ্যালয় ও গোমস্তাপুর থানায় পাকবাহিনী ও তাদের দোসররা নির্যাতনকেন্দ্র ও বন্দিশিবির স্থাপন করে।
গোমস্তাপুর থানায় উল্লেখযোগ্য বধ্যভূমি ও গণকবর হলো- রহনপুর উচ্চ বিদ্যালয় বধ্যভূমি, রহনপুর স্টেশন বাজার বধ্যভূমি, বোয়ালিয়া বধ্যভূমি ও গণকবর, টিকরামপুর, পার্বতীপুর, গোমস্তাপুর থানার পিছনের বধ্যভূমি ও গণকবর।
এপ্রিল মাসের শেষদিক থেকে মুক্তিযোদ্ধারা সামান্য অস্ত্র ও গোলা-বারুদ নিয়ে পাকবাহিনী ও রাজাকারদের ওপর আক্রমণ শুরু করেন। ২৫শে এপ্রিল হাফিজুর রহমান হাসনুরের নির্দেশে মুক্তিবাহিনীর একটি দল মুক্তিযোদ্ধা তুরফানের নেতৃত্বে মুশরীভুজার দিকে অগ্রসর হয়। ১৫-১৬ জনের এ দলের সবার কাছে অস্ত্র ছিল না। মুক্তিযোদ্ধা সুলতান ছিলেন সবার অগ্রভাগে এবং তাঁর হাতে ছিল একটি থ্রি-নট-থ্রি রাইফেল। এক পর্যায়ে তাঁরা হানাদার বাহিনীর মুখোমুখি হলে যুদ্ধ শুরু হয়। গাছের আড়ালে থেকে মুক্তিযোদ্ধারা গুলি করতে থাকেন। সুলতানের গুলিতে দুজন পাকসেনা নিহত হয়। গুলি কম থাকায় মুক্তিযোদ্ধারা থেমে- থেমে গুলি চালাতে থাকেন। এক সময় তাঁদের গুলি শেষ হয়ে যায়। সুলতানকে চারদিক থেকে পাকসেনারা ঘিরে ফেলে। তিনি গুলিবিদ্ধ অবস্থায় ধরা পড়েন। শত্রুসেনারা তাঁকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে। পরে তাঁর লাশ মহানন্দা নদীতে ভাসিয়ে দেয়।
পাকবাহিনী ১১ই জুলাই ২৫ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের মেজর সাজ্জাদের নেতৃত্বে ভোলাহাটের উদ্দেশ্যে অগ্রসর হয়। কিন্তু মুক্তিবাহিনীর বাধায় তারা রহনপুর ফিরে যেতে বাধ্য হয়। জুন মাসের শেষের দিকে ফজলুল, ভুলু (আলীনগর), সাত্তার (বাঙ্গাবাড়ি), দুলাল মাস্টার (বোয়ালিয়া) ও নিয়ামতপুর থানার একজন-সহ মোট পাঁচজন মুক্তিযোদ্ধার একটি গেরিলা দল সন্ধ্যার সময় ভোলাহাট থেকে আড়গাড়াহাট হয়ে চৌডালা পৌঁছে। তাঁদের লক্ষ্য ছিল কোদালকাটি ব্রিজ ধ্বংস করা। দুলাল মাস্টারের কাছে একটি স্টেনগান আর অন্যদের কাছে গ্রেনেড, বিস্ফোরক, জেনারেটর কার্ডেস, সেফটি ফিউজ ইত্যাদি উপকরণ ছিল। পাঁচজন গেরিলা ব্রিজে বিস্ফোরক স্থাপন করেন। নির্ধারিত সময়ে বিকট শব্দে ব্রিজটি ভেঙ্গে পড়ে। এ শব্দে এলাকাবাসীর ঘুম ভেঙ্গে যায়। কিছু পাকিস্তানি দালাল মুক্তিযোদ্ধাদের ধাওয়া করে। এক পর্যায়ে গেরিলা যোদ্ধা ফজলু ও সাত্তার ধরা পড়েন। তাঁদের গোমস্তাপুর থানায় সোপর্দ করা হয়। থানা থেকে নিয়ে হানাদার বাহিনী এ দুজন বীর যোদ্ধার ওপর পৈশাচিক নির্যাতন চালায়। মুক্তিযোদ্ধারা ব্রিজ ধ্বংস করার ফলে গোমস্তাপুরের একটি বিশাল এলাকায় পাকসেনাদের যাতায়াত বিঘ্নিত হয়।
মুক্তিযোদ্ধারা রহনপুরস্থ পাকিস্তানি সেনা ঘাঁটিতে প্রথম আঘাত হানেন জুলাই মাসে। মেজর নাজমুল হকের নেতৃত্বে উসমান, সেন্টু, হাসনু, ইমরান, শ্রীদা, বুদ্ধ প্রমুখকে নিয়ে গঠিত একটি গেরিলা দল সিংহাবাদ স্টেশন থেকে সরাসরি মকরমপুর সাঁকোতে আর্টিলারি দিয়ে পাকঘাঁটির ওপর গোলাবর্ষণ করে। পাকবাহিনীও পাল্টা গোলাবর্ষণ করে। অনেকক্ষণ ধরে গোলাগুলি চলে। এতে শত্রুসেনাদের কয়েকজন হতাহত হয়। গোলাগুলি বন্ধ হলে মুক্তিযোদ্ধা দলটি ভারত সীমান্তের ওপারে ফিরে যায়। এ ঘটনার পর হানাদার বাহিনী তাদের শক্তি বৃদ্ধি করে। অন্যদিকে মুক্তিবাহিনীও ইমামনগর ঘুন্টি, আলীনগর হাইস্কুল ও প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ঘাঁটি ও বাংকার স্থাপন করে।
জুলাই মাসে তিনজন গেরিলা রহনপুরে একটি গুরুত্বপূর্ণ অপারেশন চালান। গেরিলা যোদ্ধা ইঞ্জিনিয়ার নজরুল ইসলাম, একরাম মাস্টার ও গোলাম রসুল ভারতের সিংহাবাদ স্টেশন থেকে সরাসরি লক্ষীপুর গ্রামের মধ্য দিয়ে রহনপুরে পৌঁছেন। তাঁদের লক্ষ্য ছিল ট্রেনের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করা। লক্ষ্য অনুযায়ী অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে তাঁরা রেললাইন নষ্ট করে আবার নিরাপদে ভারতে ফিরে যান।
মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে হানাদার বাহিনীর একটি সম্মুখ যুদ্ধ হয় ১০ই আগস্ট কালুপুরে। এদিন উভয় পক্ষের মধ্যে ব্যাপক গোলাগুলির পর আর্টিলারি আবদুল মান্নান কৌশলগত কারণে মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে পিছু হটেন। তবে কালুপুর যুদ্ধ-এ ১০ জন পাকসেনা হতাহত হয়।
২২শে আগস্ট মেহেদীপুর ৩নং সাব-সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন মহিউদ্দীন জাহাঙ্গীরের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা পাকবাহিনীর প্রতিরক্ষা স্থল বোয়ালিয়া স্কুল আক্রমণ- করলে পাকবাহিনীর ১৫-২০ সৈনিক হতাহত হয়।
৮ই সেপ্টেম্বর সাব-সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন মহিউদ্দীন জাহাঙ্গীরের নেতৃতে ৩০-৩৫ জন মুক্তিযোদ্ধার একটি দল বোয়ালিয়া বাজারস্থ পাকবাহিনীর বাংকারে আক্রমণ করে। <বোয়ালিয়া বাংকার আক্রমণ- নামে পরিচিত এ-যুদ্ধে ৮- ১০ জন পাকিস্তানি সৈন্য নিহত হয়। বাকিরা নদীপথে রহনপুরে পালিয়ে যায়।
সেপ্টেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময়ে ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীর চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদরের রোজিউর রহমান বিশু, ফলতান, হাড্ডা, শিবগঞ্জের সেন্টু এবং রহনপুরের আলতাফ, জয়নাল, নাজির ও কচিকে নিয়ে কাশিয়াবাড়িতে একটি অপারেশন চালান। এখানে আবদুল খালেক নামে এক রাজাকার নিহত হয়।
৭নং সেক্টর কমান্ডার লে. কর্নেল কাজী নুরুজ্জামান, মোহদীপুর সাব-সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন মহিউদ্দীন জাহাঙ্গীর ও ক্যাপ্টেন ইদ্রিশ আলীর যৌথ পরিকল্পনায় গোমস্তাপুরে সবচেয়ে বড় অপারেশন পরিচালিত হয় ২৬শে সেপ্টেম্বর। এদিন পাকহানাদারদের এ অঞ্চলে সুসজ্জিত শক্তিশালী প্রতিরক্ষাব্যূহ বোয়ালিয়া-চৌডালা-নন্দলালপুর- আড়গাড়াহাটের ওপর মুক্তিবাহিনী তিনদিক থেকে সাঁড়াশি আক্রমণ চালায়। এ অভিযানে মুক্তিবাহিনী সফলতা লাভ করলেও ল্যান্স নায়েক হাফিজুদ্দিন শহীদ হন। মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণের প্রতিশোধ নিতে হানাদাররা বোয়ালিয়া ইউনিয়নে ব্যাপক লুণ্ঠন, ধ্বংসযজ্ঞ, অগ্নিসংযোগ ও গণহত্যা চালায়।
৩০শে সেপ্টেম্বর রাত প্রায় ১টার দিকে মুক্তিবাহিনীর ৫০ জন সদস্যের একটি দল আলীনগর পাকঘাঁটি আক্রমণ- করে। ৩ ঘণ্টার এ-যুদ্ধে ১৬ জন পাকসেনা নিহত এবং ৮ জন আহত হয়। মুক্তিযোদ্ধা জিন্নাত হোসেন হানাদারদের গুলিতে শাহাদত বরণ করলে ক্যাপ্টেন মহিউদ্দীন জাহাঙ্গীর তাদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় পাল্টা আক্রমণ করে সমুচিত জবাব দেন। এ ঘাঁটি আরো একবার মুক্তিযোদ্ধাদের দ্বারা আক্রান্ত হয়।
৬ই অক্টোবর স্থানীয় মুক্তিবাহিনীর প্রধান কমান্ডার ক্যাপ্টেন আলতাফের নেতৃত্বে শ্যামপুর-কালুপুর এলাকায় ব্যাপক যুদ্ধ হয়। এতে মুক্তিযোদ্ধা ভোলহাট থানার কামাল উদ্দিন হেনা শহীদ হন। ৭ই অক্টোবর ক্যাপ্টেন মহিউদ্দীন জাহাঙ্গীরের নেতৃতে মুক্তিযোদ্ধারা বোয়ালিয়া স্কুলে অবস্থিত পাকিস্তানি ডিফেন্সে আক্রমণ করেন। এখানে দুপক্ষের মধ্যে প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়। এক পর্যায়ে হানাদার বাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের ঘিরে ফেলে। ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীর সেক্টর কমান্ডারের সঙ্গে ওয়ারলেসে কথা বলে কৌশল অবলম্বন করে নিরাপদ স্থানে যেতে সক্ষম হন।
৮ই অক্টোবর দুপুরে ইমামনগর ঘুন্টি এলাকায় মুক্তিবাহিনী ও পাকসেনাদের মধ্যে ১ ঘণ্টাব্যাপী যুদ্ধ হয়। এ-সময় হানাদারদের নিক্ষেপ করা রকেট লান্সারের আঘাতে মুক্তিযোদ্ধা সমশের আলী শহীদ হন।
৭ই নভেম্বর লে. রফিকের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা আলীনগরস্থ পাকসেনা ক্যাম্পে আক্রমণ করেন। এটি ছিল এক দুঃসাহসিক অভিযান। আকস্মিক আক্রমণে পাকসেনারা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে এবং দ্রুত সে স্থান ত্যাগ করে। আলীনগর পাকঘাঁটি আক্রমণ হিসেবে পরিচিত এ আক্রমণে ৫ জন শত্রুসেনা নিহত হয়।
ভোলাহাট সাব-সেক্টরের পার্শ্ববর্তী মহানন্দা নদীর তীরে শিবরামপুর থেকে রহনপুর হয়ে বিশ্বনাথপুর পর্যন্ত পাকসেনাদের কংক্রিট বাংকার-সহ সুদৃঢ় প্রতিরক্ষা ছিল। ৭ই নভেম্বর লে. রফিকের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা মকরমপুর- আলীনগর পাকঘাঁটি আক্রমণ করেন। এ অতর্কিত আক্রমণে ৫ জন পাকসেনা নিহত হয়। অন্যরা মহানন্দা নদী পার হয়ে পালিয়ে যায়।
১৫ই নভেম্বর কালুপুর ঘাটের ওপার থেকে পাকহানাদার বাহিনী হঠাৎ মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর গুলিবর্ষণ শুরু করে। মুক্তিযোদ্ধারাও পাল্টা গুলি চালান। এতে উভয় পক্ষে হতাহতের ঘটনা ঘটে। মুক্তিযোদ্ধা কামালের মাথায় গুলি লাগলে সঙ্গে-সঙ্গে তিনি শহীদ হন।
১৮ই নভেম্বর ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা আলমপুর আম্রকাননে অবস্থিত পাকঘাঁটিতে আক্রমণ করেন। লে. রফিকুল ও লে. কাইউম দুই প্লাটুন সৈন্য ও মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে এতে অংশ নেন। প্রচণ্ড যুদ্ধের পর মুক্তিযোদ্ধারা আলমপুর দখল করেন। কিন্তু আকস্মিকভাবে পেছনের বাংকারে লুকিয়ে থাকা শত্রুরা গোলা ছোড়ে। তাদের আক্রমণে অগ্রসরমাণ মুক্তিযোদ্ধারা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়েন। পাকসেনারা আলমপুর পুনর্দখল করে।
২২শে নভেম্বর সোমস্তাপুরের শাহপুর গড়ে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি বড় যুদ্ধ হয়। এ-যুদ্ধে পাকবাহিনী পরাজিত হয়। কিন্তু ১৪ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। শাহপুর গড় যুদ্ধ- এ এলাকার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। এ-যুদ্ধের পর উত্তরবঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান শক্তিশালী হয় এবং পাকবাহিনীর দখল সংকুচিত হতে থাকে। ২৪শে নভেম্বর গোমস্তাপুরের কালুপুরে পাকবাহিনীর সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের দ্বিতীয়বার যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এতে পাকবাহিনীর প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়। অপরদিকে ২ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।
১০ই ডিসেম্বর পাকবাহিনী রাতের অন্ধকারে রহনপুর থেকে পশ্চাদপসরণ করে চাঁপাইনবাবগঞ্জ চলে যেতে বাধ্য হয়। পরদিন ১১ই ডিসেম্বর ভোরে লে. রফিক ও বজলুর রশীদের নেতৃত্বে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা এবং রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ রহনপুরে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেন। ১১ই ডিসেম্বর গোমস্তাপুর হানাদারমুক্ত হয়।
গোমস্তাপুরের শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- আস্তার আলী (পিতা মোহাম্মদ আলী, জাহিদ নগর), সুলতান আলী (পিতা লাল মোহাম্মদ, বেগুণবাড়ি), শমসের আলী (পিতা হাসিমুদ্দিন, ইমামনগর), সহীমুদ্দিন (পিতা আরিজ শেখ, রহমতনগর), খাবিরুদ্দিন জিন্নাহ (পিতা পাতানু মিয়া, উপজেলাপাড়া, ভোলাহাট উপজেলা), সেতাউর রহমান (পিতা তৈয়ব আলী, নসিবন্দিনগর), তৈমুর রহমান (পিতা হেদায়তুল্লাহ, শিশাটোলা), তাজাতুল হক (পিতা কলিমুদ্দিন, বাঙ্গাবাড়ি), আমিনুর রহমান (পিতা আলী মোহাম্মদ, শিশাটোলা), মিন্টু (পিতা সাইফুদ্দিন, শ্যামপুর), তাহের আলী (পিতা খোকা শেখ, মকরমপুর), তাজামুল হক (পিতা সাইফুদ্দিন, দুর্গাপুর), আব্দুর রাজ্জাক (পিতা মহসিন আলী, লক্ষ্মীনারায়ণপুর) ও শ্রীচরণ উরাও (পিতা টুডু উরাও, বেগপুর)।
গোমস্তাপুরে মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযোদ্ধা এবং শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে অনেক স্মৃতিসৌধ, স্মৃতিফলক ও প্রতিষ্ঠান নির্মিত হয়েছে। সেগুলো হলে— শহীদ স্মৃতি পাঠাগার ও সংস্কৃতি কেন্দ্র (রহনপুর), বধ্যভূমি ও গণকবর (বোয়ালিয়া মাদ্রাসা), শহীদ স্মৃতিসৌধ (উপজেলা চত্বর), শহীদ মুক্তিযোদ্ধা শমসের সেতু, শহীদ মুক্তিযোদ্ধা আস্তার আলী সেতু, শহীদ মুক্তিযোদ্ধা সুলতান সেতু, শহীদ মুক্তিযোদ্ধা জিন্নাহ সড়ক, মুক্তিযুদ্ধের স্মারক (স্টেশন সংলগ্ন বিজিপি ক্যাম্পের সামনে), স্মৃতিস্মারক (গোমস্তাপুর থানা চত্বর) ইত্যাদি। [মাযহারুল ইসলাম তরু]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৩য় খণ্ড