You dont have javascript enabled! Please enable it! মুক্তিযুদ্ধে গোয়াইনঘাট উপজেলা (সিলেট) - সংগ্রামের নোটবুক

মুক্তিযুদ্ধে গোয়াইনঘাট উপজেলা (সিলেট)

গোয়াইনঘাট উপজেলা (সিলেট) বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ- শুনে সারা দেশের মতো গোয়াইনঘাটের মানুষও স্বাধীনতার স্বপ্নে উদ্বেলিত হয়ে ওঠে। তারা বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে পাকিস্তানি শাসকদের বিরুদ্ধে অসহযোগ আন্দোলন শুরু করে। উপজেলার রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ক্রমাগত মিটিং-মিছিল করে জনসাধারণকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে তোলেন। বাঙালিদের স্বাধিকার আন্দোলন যে স্বাধীনতা আন্দোলনে পরিণত হয়েছে বিষয়টি তারা উপলব্ধি করতে পারে। এ উপলব্ধি থেকেই তারা একতাবদ্ধ হয় এবং আসন্ন মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করে।
জুন মাসের প্রথম দিকে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি হিসেবে ভারতের আসাম রাজ্যের কাছার জেলার ডাউকিতে একটি বৈঠক হয়। ঐ বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন মেজর সি আর দত্ত, বীর উত্তম দেওয়ান ফরিদ গাজী (সাবেক মন্ত্রী), এডভোকেট হাবিবুর রহমান, ইব্রাহিম আলী (বর্তমান সভাপতি, গোয়াইনঘাট উপজেলা আওয়ামী লীগ), কয়েছ আহমদ চৌধুরী প্রমুখ। পরবর্তীতে ভারতের মেঘালয় ও ইকোয়ানে গোয়াইনঘাটের মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। ভারতীয় সৈন্যরা ২১ দিন তাদের প্রশিক্ষণ দেন।
গোয়াইনঘাট উপজেলায় যাঁরা মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকের দায়িত্ব পালন করেন, তাঁরা হলেন- শওকত আলী (পশ্চিম জাফলং ইউনিয়নের চেয়ারম্যান), আব্দুল মজিদ, তৈয়ব আলী (লেংগুরা ইউনিয়ন), আজিজুর রহমান, মো. আব্দুল হক (লংগুরা ইউনিয়ন), মখলিছুর রহমান (আলীরগাঁও ইউনিয়ন), ইব্রাহীম আলী (তোয়াকুল ইউনিয়ন) প্রমুখ। এঁদের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখতেন মেজর সি আর দত্ত, কয়েছ আহমদ চৌধুরী ও মজিবুর রহমান।
মুক্তিযোদ্ধারা গোয়াইনঘাটে পাকবাহিনীকে প্রথম প্রতিরোধ করেন জাফলংয়ের আলমনগরে। এতে দুজন পাকিস্তানি সৈন্য নিহত ও দশজন আহত হয়। এরপর গোয়াইনঘাটের প্রবেশমুখ দরবস্তেও তাদের প্রতিরোধ করা হয়।
মে মাসের ২৮ তারিখ জৈন্তাপুরের সারিঘাট হয়ে পাকবাহিনী প্রথমে গোয়াইনঘাটে প্রবেশ করে এবং জাফলং ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আজির উদ্দিনের বাড়িতে ক্যাম্প স্থাপন করে। পরে আলমনগর, রাধানগর, সারিঘাট, পূর্ণানগর প্রভৃতি স্থানেও তারা ক্যাম্প স্থাপন করে।
গোয়াইনঘাট উপজেলায় পাকবাহিনীর সহায়তায় জাফলং ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আজিজুর রহমানের বাড়িতে বসে প্রথম শান্তি কমিটি গঠন করা হয়। পরবর্তীকালে টুনু মিয়া (নয়াগ্রাম), হারিছ আলী (পূর্ণানগর), ছোয়াব আলী (আলীরগাঁও), মুচিম আলী (পিরোজপুর), আব্দুল সালাম (লেংগুরা), মছদ্দর আলী (লেংগুরা), আব্দুল মালেক (গোয়াইনঘাট), সোনাফর আলী (নুনি) প্রমুখের নেতৃত্বে বিভিন্ন এলাকায় এর শাখা কমিটি গঠিত হয়। শান্তি কমিটির পাশাপাশি রাজাকার বাহিনীও গঠন করা হয়।
গোয়াইনঘাটে আজির উদ্দিনের বাড়ি, বশির উদ্দিনের বাড়ি ও হাসপাতাল ছিল পাকবাহিনীর নির্যাতনকেন্দ্র ও বন্দিশিবির। শান্তি কমিটি ও রাজাকার বাহিনীর সদস্যরা বিভিন্ন গ্রাম থেকে নিরীহ নারী-পুরুষদের ধরে এনে এখানে নির্যাতন করত। পাকবাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে তারা রাধানগর, সারিঘাট, কাইরাই, পূর্ণানগর, ছাতার, কামাইদ, কচুয়ারপাড়, গৌরীনগর, মিত্রিমহল, শিমুলতলা, গোয়াইন প্রভৃতি গ্রামের কয়েকশ লোককে হত্যা করে। মিত্রিমহলে পাকিস্তানি জঙ্গিবিমান থেকে নিক্ষিপ্ত শেলে ১৭ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। এ ঘটনা মিত্রিমহল ট্রাজেডি নামে পরিচিত। এছাড়া পাকবাহিনী ও তাদের দোসররা গোয়াইনঘাটের তাহির হোটেলসহ বহু বাড়িতে লুটপাট চালায় ও অগ্নিসংযোগ করে।
গোয়াইনঘাটে দুটি গণকবর আছে – তামাবিল শুল্ক স্টেশন গণকবর- এবং গোয়াইনঘাট গণকবর।
গোয়াইনঘাটে পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের একাধিক যুদ্ধ হয়। এর মধ্যে রাধানগর যুদ্ধ – উল্লেখযোগ্য। ৫ই মে থেকে শুরু হয়ে ৩০শে নভেম্বর পর্যন্ত একাধিকবার সংঘটিত রাধানগর যুদ্ধে ভারতীয় মিত্রবাহিনী-র ৩৬ জন সদস্য শহীদ ও ৫০ জনের অধিক আহত হন। অপরদিকে বহু সংখ্যক পাকিস্তানি সৈন্য হতাহত হয়। ২৫শে জুন সাব- সেক্টর কমান্ডার সুবেদার মেজর বি আর চৌধুরী দুই কোম্পানি মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে তামাবিল ও জাফলংয়ে অবস্থানরত পাকসেনাদের আক্রমণ করেন। এতে পাকবাহিনীর প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ে এবং তাদের বেশ কয়েকজন সেনা হতাহত হয়। নিহত সেনাদের লাশ ও প্রচুর অস্ত্র ও গোলাবারুদ ফেলে পাকবাহিনী পালিয়ে যায়।
জুলাই মাসের প্রথম দিকে পাকবাহিনীর দুই দালাল গফুর আলী ও আহমদ আলী অপারেশনের কথা বলে মুক্তিযোদ্ধাদের বারহালের নুরুখালের ব্রিজের কাছে নিয়ে যায়। সেখানে আগে থেকেই ওঁৎ পেতে ছিল পাকিস্তানি সৈন্যরা। মুক্তিযোদ্ধারা যাওয়ার সঙ্গে-সঙ্গেই পাকসেনারা তাদের আক্রমণ করে। এতে দুজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। গোয়াইন নদীর পারে পূর্ণানগর গ্রামে পাকসেনাদের একটি ঘাঁটি ছিল। সেখান থেকে খাবার নিয়ে প্রায়ই পাকসেনারা নৌকাযোগে রাধানগর ক্যাম্পে যেত। সঙ্গে থাকত রাজাকাররা। এ খবর শুনে মুক্তিযোদ্ধারা একদিন তাদের নৌকা আক্রমণ করেন। উভয় পক্ষে তুমুল গুলি বিনিময় হয়। এতে তিনজন পাকসেনা নিহত হয়। পরের দিন এর প্রতিশোধ নেয়ার জন্য পাকসেনারা গ্রামের সাধারণ মানুষ ও নৌকার অসহায় মাঝিদের ক্যাম্পে তলব করে। তাদের ওপর নির্মম নির্যাতনের পর ইসমাইল আলী, বসারত আলী, জায়ফর আলী (স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য) ও আব্দুল কাদির নামে চারজনকে হত্যা করে। গোয়াইনঘাট পাকসেনা ক্যাম্প অপারেশন – পরিচালিত হয় ২৪শে অক্টোবর থেকে ৪ঠা ডিসেম্বর পর্যন্ত কয়েকবার। শেষ অপারেশনে গোইনঘাট হানাদারমুক্ত হয়। ১০ই ডিসেম্বর পাক হানাদাররা হরিপুর হয়ে গোয়াইনঘাট ত্যাগ করলে উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়।
গোয়াইনঘাটের শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- আব্দুল মতিন বাচ্চু (পিতা আব্দুল কাদির, লাখেরপার), নবিন খেরোয়াল, (পিতা পতিকা খেরোয়াল, জাফলং চা-বাগান), বঙ্গিন দাস (পিতা লগুন দাস, জাফলং চা-বাগান), মো. ময়না মিত্রতা (পিতা মো. মজনু মিত্রতা, বাউরভাগ), মো. আজির উদ্দিন (পিতা মো. রজব আলী, বাউরভাগ), মো. হামিদ মিত্রতা (পিতা মো. সামুন মিত্রতা, কালিনগর), মো. আবুল হুসেন (পিতা মো. আহাম্মদ আলী, লাখেরপার), মো. আব্দুল খালেক মিত্রতা (পিতা মো. আবেদ আলী খন্দকার, ছৈলাখেল ৮ম খণ্ড), মো. হাকিম আলী (পিতা মো. আলী মুইনউদ্দিন, কালিনগর), সুহরাব হুসেন খান (পিতা মো. জমসের আলী খাঁন, ছৈলাখেল ৯ম খণ্ড), মো. আবুল হুসেন (পিতা মো. আকবর হুসেন, বাউরভাগ হাওর), মো. আব্দুল মালেক (পিতা মো. তাজ উদ্দিন, মুসলিম নগর), মো. মনির উদ্দিন (পিতা মো. ইয়াকুব আলী, জাফলং বস্তি), মো. ফজলুর রহমান (পিতা মো. আনোয়ার আলী, ইসলামপুর), মো. আবুল কাশেম (পিতা মো. ছাবেদ আলী, নয়াগাঙ্গের পার), মো. গিয়াস উদ্দিন (পিতা মো. লোকমান উদ্দিন সরকার, খানঞ্চী ভাঙ্গা), সাজিদ আলী (পিতা আতর আলী, মিত্রিমহল), ফরমান আলী (পিতা একরাম আলী, তারুখাল), আব্দুল আজিজ (পিতা ঢালু মিয়া, দক্ষিণ প্রতাপপুর) এবং আব্দুল গফুর (পিতা গণি বক্স, লামাছাতাইন)। [মো. এনামুল হক চৌধুরী সোহেল]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৩য় খণ্ড