You dont have javascript enabled! Please enable it!

মুক্তিযুদ্ধে গোবিন্দগঞ্জ উপজেলা (গাইবান্ধা)

গোবিন্দগঞ্জ উপজেলা (গাইবান্ধা) ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমল থেকেই গোবিন্দগঞ্জের মানুষ রাজনৈতিক সচেতনতার পরিচয় দিয়ে আসছে। ব্রিটিশ-যুগের কৃষক বিদ্রোহ, তেভাগা আন্দোলন; পাকিস্তান আমলের ভাষা-আন্দোলন- ও পরে ৬-দফার আন্দোলনে গোবিন্দগঞ্জের ছাত্র-জনতা অংশগ্রহণ করে। ১৯৬৮ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান – ও অন্যান্যদের বিরুদ্ধে জারিকৃত আগরতলা মামলা, ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান, ১৯৭০-এর সাধারণ নির্বাচনেও তারা বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করে। নির্বাচনে বিজয়ী দলের নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধুর কাছে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ক্ষমতা হস্তান্তরে তালবাহানা শুরু করলে এ-অঞ্চলের মানুষের মনে তীব্র অসন্তোষ ও ক্ষোভ দানা বাঁধে। ১৯৭১ সালের সাতই মার্চের ভাষণ-এ বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ডাক দিলে গোবিন্দগঞ্জে তাঁর পূর্ব-ঘোষিত অসহযোগ আন্দোলন- তীব্রতর হয়। বঙ্গবন্ধুর ভাষণ গোবিন্দগঞ্জের ছাত্র-জনতাকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে উদ্বুদ্ধ করে।
৬-দফার আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত গোবিন্দগঞ্জের প্রতিটি সংগ্রামে ছাত্র সংগঠনগুলোর জোরদার ভূমিকা ছিল। ছাত্রনেতাদের মধ্যে আব্দুল লতিফ মৃধা, আব্দুল মতিন তালুকদার, মোতাহারুল ইসলাম, আমিরুল ইসলাম ভোলা, নির্মলেন্দু মোহন রায়, কুমারেশ চাকী পিনু, এজাজুল করিম বাদশা, জোবাইদুর রহমান, আব্দুল লতিফ প্রধান, শামসুজ্জোহা মৃধা, রণজিৎ মোহন্ত, সাদেকুল ইসলাম, আকবর হোসেন, বেলাল হোসেন, আব্দুল মান্নান আকন্দ, মনোরঞ্জন মোহন্ত বাবলু প্রমুখ মুক্তিযুদ্ধ সংগঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে তখন নেতৃত্ব দেন থানা আওয়ামী লীগ-এর সভাপতি নাদের হোসেন সরকার, সাধারণ সম্পাদক জামালুর রহমান প্রধান, রাধিকামোহন রায়, বারীন্দ্র নাথ দেব, ফারাজ উদ্দিন মোল্লা, শাহ ফজলুর রহমান প্রমুখ। ১৯৭০ সালে সাধারণ নির্বাচনে গোবিন্দগঞ্জ-পলাশবাড়ী থানা নিয়ে গঠিত জাতীয় পরিষদ আসনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী এডভোকেট শাহ আব্দুল হামিদ এবং প্রাদেশিক পরিষদে একই দলের জামালুর রহমান প্রধান নির্বাচিত হন।
৭ই মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর দেয়া ঘোষণার তাৎক্ষণিক প্রভাব পড়ে গোবিন্দগঞ্জে। জামালুর রহমান প্রধান এমপিএ-কে সভাপতি এবং ছাত্রলীগ নেতা আব্দুল মতিন তালুকদারকে সম্পাদক করে থানা সংগ্রাম কমিটি গঠন করা হয়। সংগ্রাম কমিটির নেতৃবৃন্দ মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়ার জন্য স্থানীয় যুবকদের সংগঠিত করেন। ছাত্রনেতা রণজিৎ মোহন্তের নেতৃত্বে ছাত্র-যুবকরা গোবিন্দগঞ্জ কলেজ মাঠে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ শুরু করে। রংপুর, বগুড়া, গাইবান্ধার সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা ও মুক্তিযুদ্ধের কার্যক্রম পরিচালনার জন্য প্রথমে গোবিন্দগঞ্জ কলেজের অধ্যক্ষ সিরাজুল ইসলামের বাসায় ও পরে ব্যবসায়ী সন্তোষ কুমার আগরওয়ালার বাসায় গোপন কন্ট্রোল রুম স্থাপন করা হয়।
কন্ট্রোল রুমে সংবাদ সংগ্রহের দায়িত্বে ছিলেন মো. আফতাব। গোবিন্দগঞ্জ থানা ছাত্রলীগ ও সংগ্রাম কমিটি বাংলাদেশের মানচিত্রখচিত জাতীয় পতাকা ওড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয়। শত্রুদের ভয়ে কোনো দর্জি পতাকা তৈরি করতে রাজি না হওয়ায় কন্ট্রোল রুমে সংবাদ সংগ্রহের দায়িত্বে ছিলেন মো. আফতাব। গোবিন্দগঞ্জ থানা ছাত্রলীগ ও সংগ্রাম কমিটি বাংলাদেশের মানচিত্রখচিত জাতীয় পতাকা ওড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয়। শত্রুদের ভয়ে কোনো দর্জি পতাকা তৈরি করতে রাজি না হওয়ায় জনৈক মোকাম্মেল হকের মেয়ে বকুলের কাছ থেকে হাতে সেলাই করা একটি পতাকা তৈরি করে নেয়া হয়। এ পতাকা ২২শে মার্চ গোবিন্দগঞ্জ কলেজ মাঠে প্রশিক্ষণস্থলে উত্তোলন করা হয়। পরদিন ২৩শে মার্চ থানা আওয়ামী লীগ কার্যালয়েও পতাকাটি উত্তোলিত হয়।
২৫শে মার্চ রাতে ঢাকায় সংঘটিত গণহত্যার খবর ২৬শে মার্চ ওয়ারলেসের মাধ্যমে গোবিন্দগঞ্জে এসে পৌঁছে। পাকহানাদার বাহিনী যাতে গোবিন্দগঞ্জে অনুপ্রবেশ ও বগুড়া- রংপুরের মধ্যে চলাচল করতে না পারে, তার উপায় বের করার জন্য ২৬শে মার্চ রাতে আব্দুল মতিন তালুকদার, রণজিৎ মোহন্ত, প্রদীপ কর, আমিরুল ইসলাম ভোলা, নির্মলেন্দু মোহন রায় প্রমুখ ছাত্রনেতা কিছু ছাত্র-যুবক নিয়ে গোবিন্দগঞ্জের কুঠিবাড়িতে গোপন বৈঠকে বসেন। এ বৈঠকে গোবিন্দগঞ্জের অনতিদূরে কাটাখালী ব্রিজ ধ্বংস করে পাকবাহিনীর অগ্রযাত্রা প্রতিহত করার সিদ্ধান্ত হয়। সিদ্ধান্ত মোতাবেক ২৭শে মার্চ আওয়ামী লীগ অফিসের সামনে প্রায় তিন-চারশ মানুষ সমবেত হয়। তাদের প্রত্যেকের হাতে শাবল, হাতুরি, কোদাল, বেলচা ইত্যাদি দেশীয় অস্ত্র ছিল। সকাল দশটা নাগাদ তিনটি ট্রাকে করে কয়েকশত মানুষ এবং সংগ্রাম পরিষদের সদস্যরা করতোয়া নদীর ওপর অবস্থিত কাটাখালী ব্রিজের দিকে রওনা দেন। এদিকে সেদিন সূর্য ওঠার আগেই ছাত্রনেতা মতিন তালুকদার এবং রণজিৎ মোহন্ত কাটাখালী ব্রিজ এলাকায় ফুলবাড়ীতে আওয়ামী লীগ নেতা খলিল মণ্ডলের বাড়িতে আশ্রয় নিয়ে ব্রিজ ধ্বংস করার উপায় ঠিক করেন। কংক্রিটে নির্মিত হওয়ায় অত্যন্ত শক্ত হাতুড়ি-শাবল দিয়েও এটি ভাঙ্গা অসম্ভব হবে বলে ব্রিজের পশ্চিম দিকে সড়কের ওপর ব্রিজ ঘেঁষে একটি বিশাল গর্ত করার চেষ্টা করা হয়। প্রায় দুঘণ্টা কাজ করার পর সেটি তৈরি হয়। হঠাৎ অনতিদূরে গুলির আওয়াজ এবং পরে কয়েকটি গুলি ব্রিজের ওপর এসে পড়লে ছাত্র-জনতা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। ইতোমধ্যে কয়েকটি জিপে করে পাকসেনারা ব্রিজের কাছে এসে এলোপাথারি গুলি ছুড়তে থাকে। তাদের গুলিতে গোবিন্দগঞ্জ কলেজের ছাত্র বাবলু মোহন্ত ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র মান্নান ঘটনাস্থলে শহীদ হন। বাবু দত্ত নামে অপর এক ছাত্র গুলিবিদ্ধ হয়ে মারাত্মক আহত হয় এবং পরে বিনা চিকিৎসায় সে মৃত্যুবরণ করে। এ তিন ছাত্রের সঙ্গে সেদিন কাটাখালীতে একটি রাখাল বালকও পাকিস্তানি বাহিনীর বেয়নেটের নির্মম আঘাতে প্রাণ হারায়। কাজী শামছুল হক নামের একজন আওয়ামী লীগ কর্মী গুলিবিদ্ধ হন। এরপর সুবেদার শাহ আলমের নেতৃত্বে পাকিস্তানি বাহিনী সেদিন ব্রিজের আশেপাশের গ্রামগুলি জ্বালিয়ে দেয়। পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে পরিচালিত এ কাটাখালী ব্রিজ প্রতিরোধযুদ্ধ- সমগ্র উত্তরাঞ্চলের প্রথম রক্তাক্ত প্রতিরোধ প্রচেষ্টা বলে পরিচিত।
২৭শে মার্চ গোবিন্দগঞ্জে পাকিস্তানি বাহিনীর অনুপ্রবেশ ঘটে। ১০ই এপ্রিল কাটাখালী ব্রিজ পার্ক ও সিএন্ডবি রেস্টহাউস, গোবিন্দগঞ্জের কুঠিবাড়ি এবং পরে মহিমাগঞ্জ সুগার মিলস গেস্টহাউস, মহিমাগঞ্জ আলিয়া মাদ্রাসা, দেওয়ানতলা ব্রিজ, ফাসিতলা ও কামদিয়ায় পাকিস্তানি বাহিনী তাদের ক্যাম্প স্থাপন করে।
গোবিন্দঞ্জ থানায় মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে পাকবাহিনীর সহযোগী দালাল, রাজাকার- ও শান্তি কমিটি-র ব্যাপক তৎপরতা ছিল। যুদ্ধ শুরু হওয়ার প্রাক্কালে জামায়াতে ইসলামী- ও মুসলিম লীগ-এর নেতারা গোবিন্দগঞ্জে শান্তি কমিটি গঠন করে। শান্তি কমিটির চেয়ারম্যানের দায়িত্বে ছিল কামারদহ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম। তার নেতৃত্বে থানার বিভিন্ন ইউনিয়নে হত্যাকাণ্ড, নারীধর্ষণ ও লুটপাটের ঘটনা ঘটে। এতে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ ভূমিকা পালন করে শিবপুর ইউপি চেয়ারম্যান কাজেম উদ্দিন সরকার, কেয়ামত আলী (মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে নিহত), মোফাজ্জল হোসেন, মাজেদ হোসেন, মহিমাগঞ্জের ব্লাক মজিদ, শালমারা ইউপি চেয়ারম্যান জালাল উদ্দিন, গোবিন্দগঞ্জ থানা সদরের ডা. ফজলার রহমান, খাজা মিয়া, সালাম মিয়া, বদের কাজী, বর্ধনকুঠির সবেদ বানিয়া প্রমুখ। হত্যা, নারীধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট ছাড়াও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের যারা ভারতে পালিয়ে যেতে ব্যর্থ হয়, তাদের কাছ থেকে মোটা অংকের অর্থ আদায় এবং তাদের ধর্মান্তরিত করার কাজও এরা করে।
গোবিন্দগঞ্জ উপজেলায় শান্তি কমিটির সদস্যদের মধ্যে ছিল শাখাহার ইউপির আব্বাস আলী মণ্ডল, মওলানা আফাজ উদ্দিন; নাকাইহাট ইউপির ডা. আব্দুর রহমান; হরিরামপুর ইউপির রেজাবউদ্দিন; রাখালবুরুজ ইউপির শাহারুল হুদা চৌধুরী; দরবস্ত ইউপির মজিবর রহমান; কোচাশহর ইউপির আব্দুস সালাম মৌলবী, মোহাম্মদ আলী, ফারাজ মাস্টার, হামেদ আলী গাছু, মহিতউল্লা আকন্দ, তালেব উদ্দিন মণ্ডল, জামাত আলী ফকির, তছলিম উদ্দিন সরকার প্রমুখ। রাজাকারদের মধ্যে গোবিন্দগঞ্জ থানা সদরের চকগোবিন্দর মোজাফ্ফর আলী, কাজী বদিউজ্জামান, দরবস্ত ইউনিয়নের মজিদ মৌলবি, কুন্দেরপাড়ার মজিবর রহমান, পচাদহের ওসমান গণি, সাতাইল বাতাইলের আশকর আলী, কোচাশহর ইউপির আকরাম আলী, দিলবর হোসেন, ধারাইকান্দির মীর হোসেন, শক্তিপুরের আবুল মাস্টার, আব্দুর গফুর সরকার, মাগুড়ার রহিম উদ্দিন, তারাগণার মোফাজ্জল হোসেন, ফেরুসার আব্দুল কাফি আকন্দ এবং রাজাকার কমান্ডার হিসেবে কোচাশহর ইউপির জহির উদ্দিন সরকার (মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে নিহত), আব্দুল কুদ্দুস সরকার, হরিপুরের আকরাম আলী, দিলবর হোসেন, শ্রীমুখের মোফাজ্জল হোসেন প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। এসব রাজাকার ও শান্তি কমিটির সদস্যরা মুক্তিযোদ্ধা ও স্বাধীনতার পক্ষের লোকজনকে পাকবাহিনীর হাতে তুলে দিত এবং সংখ্যালঘুদের বাড়িঘরে লুঠ, অগ্নিসংযোগ, নারীনির্যাতন, ধর্ষণ ইত্যাদি কাজে পাকবাহিনীকে সহায়তা করত। এছাড়া মুসলিম লীগের প্রাদেশিক পরিষদের প্রাক্তন সদস্য গুমানীগঞ্জ ইউনিয়নের পারগয়ড়া গ্রামের সিরাজুল ইসলাম বুদু মিয়া রংপুর জেলার শান্তি কমিটির একজন কুখ্যাত ব্যক্তি হিসেবে গোবিন্দগঞ্জের শান্তি কমিটি ও রাজাকারদের কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করত। স্বাধীনতার পর রাজাকার ও দালাল হিসেবে বিচারের জন্য এদের অনেককে গ্রেফতার করা হয়েছিল।
গোবিন্দগঞ্জের কাটাখালী ব্রিজের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে ছোট একটি পার্ক ছিল। পাকসেনা ও রাজাকাররা মহাসড়কের ওপর দিয়ে চলমান যাত্রীবাহী বাস থামিয়ে সেখান থেকে মেয়েদের নামিয়ে এনে পার্কের একটি কক্ষে ধর্ষণ করত। এরপর হত্যা করে পার্কের পাশে নদীতে ফেলে দিত। গোবিন্দগঞ্জ এবং পাশ্ববর্তী অঞ্চল থেকে মুক্তিযোদ্ধা সন্দেহে ছাত্র-যুবকদের ধরে এনে এই পার্কের কক্ষে রেখে নির্যাতন ও পরে হত্যা করা হতো। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে এখানে পাঁচ শতাধিক মানুষ পাকবাহিনীর হাতে নিহত হয়। যুদ্ধের পর কাটাখালী বধ্যভূমি ও গণকবর-তে শতাধিক মানুষের মাথার খুলি পাওয়া যায়।
৪ঠা এপ্রিল রংপুর ক্যান্টনমেন্টগামী পাকসেনাদের একটি কনভয় হঠাৎ গুমানীগঞ্জে হামলা চালায়। সেখানে আওয়ামী লীগের জয়েন দরবেশকে গুলি করে হত্যা করে এবং বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়। এ ঘটনার পর কাটাবাড়ীর আওয়ামী লীগ সভাপতি হায়দার আলী মাস্টার এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তাকারী নরেশ চন্দ্র বর্মণকে ধরে নিয়ে রংপুর- দিনাজপুর সীমান্তের একটি মাজারের পাশে গুলি করে হত্যা করে। শাপমারা ইউনিয়নে খোকা মোহন্তকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।
এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে পাকবাহিনী কাটাখালী ক্যাম্প থেকে গোবিন্দগঞ্জের বিভিন্ন ইউনিয়নে এসে স্বাধীনতার পক্ষের মানুষদের হত্যার জন্য অভিযান চালাতে থাকে। এপ্রিল মাসের শেষের দিকে গোবিন্দগঞ্জ-মহিমাগঞ্জ চিনিকল সড়কের কোচাশহর নামক স্থানে কোচাশহর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ সভাপতি দুদু সরদার এবং পালপাড়ার কালা পাল গাছ কেটে ব্যারিকেড সৃষ্টি করেন। পাকবাহিনীর চলাচলে বাধা সৃষ্টি করায় পাকবাহিনী তাদের ধরে এনে রাস্তার ওপর ব্রাশ ফায়ারে হত্যা করে। পাকবাহিনী এ এলাকার হিন্দুপাড়া, গোপালপুর এবং কুমড়াডাঙ্গা গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়। শুধু তাই নয়, চিনিকল সড়কের গাবতলা নামক স্থানে জুন মাসে রাজাকারদের সহযোগিতায় পাকবাহিনী মহিমাগঞ্জের আওয়ামী লীগ নেতা এবারত মিয়া, সোবহান ও কাদের সরকারকে আটক করে। পরে তাদের লাইনে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করে।
শাখাহার ইউনিয়নে পালপাড়া গ্রামে হোমো পাল, সতীশ পাল, ধীরেন, জামাল, টুরু মণ্ডল এবং গোয়ালু পালকে পাকসেনারা ঘোড়াঘাট ক্যাম্পে নিয়ে গিয়ে তাঁদের অপর অমানবিক নির্যাতন করে। পরে সবাইকে গুলি করে হত্যা করে। এদিন গোয়ালু পাল গুলিবিদ্ধ হয়ে মারাত্মক আহত হন।
ছাত্রলীগের নেতা আব্দুল লতিফ মৃধাকে ধরে পাকসেনারা তার ওপর তিনদিন ধরে শারীরিক নির্যাতন চালায়। পরে তার মাথায় গুলি করে তাকে হত্যা করে। ১৮ই অক্টোবর পাকবাহিনী স্থানীয় রাজাকারদের সহায়তায় পাখোয়া গ্রামের বাঁশঝাড়ের নিচে পাখোয়া ও ক্রোড়গাছা গ্রামের ৭ জন নিরীহ মানুষকে গুলি করে হত্যা করে। পাকবাহিনীর হাতে পাখোয়া গণহত্যায় শহীদরা হলেন— দীনেশ চন্দ্র চক্রবর্তী, ভবানীকান্ত সরকার, খোকারাম সরকার, অশ্বিনী চন্দ্র দাস এবং ক্রোড়গাছা গ্রামের হরিচাকী বর্মণ, কৈলাশ চন্দ্ৰ বর্মণ ও গোরাচাঁদ বৰ্মণ।
দরবস্ত ইউনিয়নের রাজাকার মজিদ মৌলবী খোকা মোহন্তের বাড়িতে যাতায়াত করত। প্রতিবেশী অনেকে ভারতে চলে গেলেও মাটির টানে খোকা তার পরিবার নিয়েই বাড়িতে থাকত। যুদ্ধের শেষদিকে মজিদ মৌলবী খোকার বাড়িটি আত্মসাৎ করার উদ্দেশ্যে খোকা মোহন্তের নামে পাকিস্তানি বাহিনীর ঘোড়াঘাট ক্যাম্পে মিথ্যা তথ্য দিলে পাকসেনারা খোকাকে ক্যাম্পে নিয়ে অমানবিক নির্যাতন করে ছেড়ে দেয়। পরে মজিদ মৌলবী মুমূর্ষু খোকাকে নিজ হাতে জবাই করে হত্যা করে তাঁর মরদেহ পার্শ্ববর্তী একটি কূপে ফেলে দেয়। পাকবাহিনী কাটাখালী ব্রিজ সংলগ্ন পার্কের একটি পাকা ভবনে বন্দিশিবির ও তার পাশেই একটি টিনশেড ঘরে নির্যাতন কক্ষ গড়ে তোলে। পাকবাহিনী উপজেলার বিভিন্ন স্থান থেকে লোকজনকে ধরে এনে এ বন্দিশিবিরে আটকে রেখে নির্যাতন করার পর গুলি করে হত্যা করত। পরে তাদের লাশ ক্যাম্পের পার্শ্বে করতোয়া নদীতে ফেলে দিত। মহিমাগঞ্জের চিনিকল রেস্টহাউসেও তাদের একটি নির্যাতনকেন্দ্র ছিল।
রাজাকার ও শান্তি কমিটির সদস্যদের সহযোগিতায় পাকবাহিনী গোবিন্দগঞ্জ এবং পার্শ্ববর্তী অঞ্চল থেকে ছাত্র- যুবকদের ধরে এনে কাটাখালী পার্কের নির্যাতন কক্ষে রেখে নির্যাতন করে হত্যা করত। হত্যার পর কাটাখালী গণকবরে সবাইকে কবর দিত। নয় মাস এখানে প্রায় পাঁচ শতাধিক মানুষ পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে নিহত হয়েছে। ১৮ই অক্টোবর পাকবাহিনীর গুলিতে পাখোয়া গ্রামে নিহত সাতজনকে এ গ্রামে গণকবর দেয়া হয়। মহিমাগঞ্জ রংপুর চিনিকলেও একটি গণকবর রয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধের নয়মাস গোবিন্দগঞ্জের বিভিন্ন মুক্তিযোদ্ধারা গেরিলা আক্রমণের মাধ্যমে পাকবাহিনীকে বিপর্যস্ত করেন। পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি সম্মুখ যুদ্ধ হয় গোবিন্দগঞ্জ-সাঘাটা থানার মিলনস্থল ত্রিমোহিনী ঘাটে। ২৪শে অক্টোবর সংঘটিত এ-যুদ্ধে ১২ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ ও ৭ জন আহত হন। রোস্তম আলী খন্দকার (<রোস্তম কোম্পানি)এর নেতৃত্বে পরিচালিত এ- যুদ্ধে পাকবাহিনীর ২৭ সেনা নিহত হয়। এছাড়া গোবিন্দগঞ্জে সংঘটিত গেরিলা যুদ্ধের মধ্যে গোবিন্দগঞ্জ সংলগ্ন বগুড়ার ভেলুরপাড়া, বোনারপাড়া-বগুড়া রেলপথের সুখানপুকুর ও কলেজ স্টেশন অভিযান বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এসব অভিযানে গোবিন্দগঞ্জ থানার মহিমাগঞ্জের মুক্তিযোদ্ধা মোখলেসুর রহমান দুলুর গেরিলা দল বিশেষভাবে অংশ নেয়। মোখলেসুর রহমান দুলু ৭নং সেক্টরের একটি গেরিলা দলের প্রধান ছিলেন। এসব অভিযানে অবদানের জন্য তিনি মিত্রবাহিনীর পক্ষ থেকে ‘অশোক প্রতীক’ উপাধি লাভ করেন।
গোবিন্দগঞ্জ থেকে মাত্র ২০ কিমি দূরত্বে দক্ষিণ-পশ্চিমে ভারতের হিলি সীমান্ত। ৯ই ডিসেম্বর সীমান্ত দিয়ে হিলিতে পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর আক্রমণ করে ভারতীয় বাহিনীর একটি বিগ্রেড। হিলি পতনের পর ৬৬ ব্রিগেডের অধিনায়ক শর্মার নেতৃত্বে একটি গোলন্দাজ বাহিনী ১১ই ডিসেম্বর ঘোড়াঘাট দখলে নিয়ে গোবিন্দগঞ্জের দিকে এগিয়ে আসতে থাকে। ভোররাতে ৬৬ ব্রিগেড ঘোড়াঘাটের দিক থেকে এবং মুক্তিবাহিনীর সহায়তায় ভারতীয় বাহিনীর ৩৪০ ব্রিগেডের একাংশ নাকাইহাটের দিক থেকে গোবিন্দগঞ্জে পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থানের কাছাকাছি পৌঁছে যায়। এরপর মিত্রবাহিনী ও মুক্তিযোদ্ধাদের যৌথদল তিনদিক থেকে (ঘোড়াঘাট, পলাশবাড়ী ও গোবিন্দগঞ্জের নাকাইহাট) পাকবাহিনীর বড় ঘাঁটি কাটাখালী ব্রিজে অবস্থিত কাটাখালী ক্যাম্পে আক্রমণ চালায়। গোবিন্দগঞ্জের মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে হামিদ পালোয়ান, শ্যামলেন্দু মোহন জীবু, শামসুজ্জোহা মৃধা ও প্রদীপ কর আলো এ অভিযানে অংশ নেন। তিনদিক থেকে ঘিরে আক্রমণ পরিচালনার ফলে পাকবাহিনী হতভম্ব হয়ে পড়ে এবং প্রতি-আক্রমণ চালায়। সারাদিন যুদ্ধ চলে। প্রায় দুশ পাকসেনা এ যুদ্ধে নিহত হয়। বিকেলের মধ্যেই ত্রিমুখী আক্রমণে পরাজিত পাকসেনারা অস্ত্র ফেলে ইউনিফর্ম খুলে লুঙ্গি-গেঞ্জি পরিধান করে সাধারণ বেশে পালাতে থাকে। এ যুদ্ধ কাটাখালী ক্যাম্প যুদ্ধ নামে পরিচিত। ১২ই ডিসেম্বর ‘জয় বাংলা’ স্লোগানে আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত করে মুক্তিযোদ্ধারা স্বাধীন বাংলার পতাকা উড়িয়ে থানা বন্দরে সমবেত হন এবং গোবিন্দগঞ্জ সম্পূর্ণভাবে হানাদারমুক্ত হয়।
উপজেলার খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- মো. বদিউল আলম, বীর উত্তম (পিতা মোজাম্মেল হক সরকার, রামপুরা) ও শেখ আবদুল মান্নান, বীর প্রতীক (পিতা এম এল শেখ, দিঘুহাট)।
গোবিন্দগঞ্জের শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- আব্দুল মান্নান আকন্দ (পিতা ওসমান আলী আকন্দ, গোলাপবাগ), মনোরঞ্জন মোহন্ত বাবলু (পিতা দেবেন্দ্র নাথ মোহন্ত, গোলাপবাগ), বাবু দত্ত (পিতা ইন্দ্রেশ্বর দত্ত ওরফে বুদু দত্ত, গোলাপবাগ), আ. হারেছ আকন্দ (পিতা ওসমান আলী আকন্দ, তুলশীপাড়া), জালাল মাহমুদ (পিতা জিতু মণ্ডল, কাটাবাড়ী), মো. ভোলা শেখ (পিতা আবেদ আলী শেখ, হামিদপুর), দেলোয়ার হোসেন দুলাল (পিতা সৈয়দ আশরাফ আলী, কাটাবাড়ী), গোলাম হায়দার (পিতা সিরাজুল হক, বোগদহ), আলতাফ রহাসেন (পিতা মফিজ উদ্দিন, গোপালপুর), মো. মনোয়ারুল হক (পিতা হাছেন আলী সরকার, বিরাট), সিরাজুল ইসলাম (পিতা হাসান আলী, শাখাহার), ফেরদৌস সরকার (পিতা খালেছ উদ্দিন সরকার, শাখাহার), তোবারক আলী সাবু (পিতা মমতাজ আলী, নীলকণ্ঠপুর), ফজলুল করিম (পিতা দেলোয়ার হোসেন, পুনতাইড়), মোজাম্মেল হক (পিতা মোজাহার আলী প্রধান, উত্তর ধর্মপুর), মাহবুবুর রহমান (পিতা আফতাব উদ্দিন, রামপুরা), ল্যান্স নায়েক খয়বর আলী (পিতা কাদের বকস্, দিঘলকান্দি), সৈয়দ আশরাফুল আলম (পিতা সৈয়দ আব্দুল গফুর, ধর্মকাজী পাড়া), অমূল্য চন্দ্র কর্মকার (পিতা প্রসন্ন কর্মকার, শ্রীপতিপুর), আ. সাত্তার (পিতা নছির উদ্দিন, পুনতাইড়), অমরলাল চাকী (পিতা অমৃতলাল চাকী, ফতেউল্লাপুর), আলতাফ হোসেন (পিতা মফিজ উদ্দিন, গোপালপুর), রিয়াদ হোসেন (পিতা হারেজ উদ্দিন, কামদিয়া), আ. মজিদ ফকির (পিতা নঈম উদ্দিন ফকির, বিশুবাড়ী), কছি মৃধা (পিতা বাসরতউল্লা, গোপালপুর), কুদ্দুস (পাটোয়া), আ. সাত্তার মণ্ডল (পিতা আলহাজ্ব আফাতুল্লা, নিয়ামতের বাইগুনি) ও ছানোয়ার হোসেন (পিতা আজিজার রহমান, নিয়ামতের বাইগুনি)।
শহীদদের স্মরণে ১৯৭২ সালে গোবিন্দগঞ্জ ডিগ্রি কলেজে একটি শহীদ মিনার নির্মাণ করা হয়। ১৯৯০ সালের ফেব্রুয়ারিতে গোবিন্দগঞ্জের কুঠিবাড়িতে জামরুল গাছের নিচে তিনটি কংক্রিট স্তম্ভের ছোট্ট আকারের অস্থায়ী শহীদ মিনার নির্মাণ করা হয়। ১৯৯৬ সালে সাবেক সংসদ সদস্য ও থানা আওয়ামী লীগ সভাপতি জামালুর রহমান প্রধান, বাসদ নেতা আব্দুল মতিন তালুকদার, ছাত্রনেতা জাকারিয়া ইসলাম জুয়েল, আতাউর রহমান বাবলু, মুক্তিযোদ্ধা শামসুজ্জোহা মৃধাসহ স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিলের উদ্যোগে গোবিন্দগঞ্জের গোলাপবাগ হাটের গরুহাটীতে মুক্তিযুদ্ধ ও ভাষা-আন্দোলনে শহীদদের স্মরণে গোবিন্দগঞ্জের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার নির্মিত হয়। ২০০৮ সালে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্যোগে গোবিন্দগঞ্জের শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে প্রথম স্মৃতিফলক নির্মাণ করা হয় কাটাখালী ব্রিজের দক্ষিণ প্রান্তে বগুড়া-রংপুর মহাসড়কের পাশে। গোবিন্দগঞ্জে পাকিস্থানি সেনাদের বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিরোধযুদ্ধে বাঙালিদের শহীদ হওয়ার স্থান কাটাখালী ব্রিজ এলাকায় সংসদ সদস্য মনোয়ার হোসেন চৌধুরীর উদ্যোগে ২০১১ সালে বগুড়া-রংপুর মহাসড়কের পূর্বপ্রান্তে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মিত হয়। [বিষ্ণু নন্দী]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৩য় খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!