You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.08.19 | গোপালপুর গণহত্যা (বেগমগঞ্জ, নোয়াখালী) - সংগ্রামের নোটবুক

গোপালপুর গণহত্যা (বেগমগঞ্জ, নোয়াখালী)

গোপালপুর গণহত্যা (বেগমগঞ্জ, নোয়াখালী) সংঘটিত হয় ১৯শে আগস্ট। এতে অর্ধশতাধিক লোক শহীদ হন। গোপালপুর নোয়াখালী জেলার বেগমগঞ্জ উপজেলাধীন গোপালপুর ইউনিয়নের একটি বাজার। প্রত্যন্ত এলাকার এই বাজারে মুক্তিযোদ্ধাদের শক্ত ঘাঁটি এবং রিক্রুটিং সেন্টার ছিল। কোম্পানি কমান্ডার সুবেদার লুৎফর রহমান, ছাতনেতা মোস্তাফিজুর রহমান (মুজিব বাহিনীর সংগঠক ও সমন্বয়ক), হায়াত খান, ডাক্তার আনিসুল ইসলাম, নজির আহম্মদ মেম্বার, হাবিলদার জাবেদ আলী, নায়েক হাসমত উল্যাহ, ইঞ্জিনিয়ার আবদুর রহিম, নৌবাহিনীর আবদুল খালেক, এডভোকেট ফজলুল করিম, আবদুল নোমান, নুরুল আমিন চৌধুরী, আবু কায়েস মাহমুদ, মোস্তফা মহসিন দুলাল, জাকির হোসেন, মাহমুদুল হাসান চৌধুরী প্রমুখ ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং ক্যাম্পের প্রশিক্ষক এবং স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠক। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এই এলাকাটি মুক্তিবাহিনীর দখলমুক্ত করার জন্য একাধিকবার অভিযান পরিচালনা করে, কিন্তু প্রতিবারই ব্যর্থ হয়। ১০ই আগস্ট পাকবাহিনী শতাধিক সৈন্য নিয়ে গোপালপুর দখল করার উদ্দেশ্যে অভিযান পরিচালনা করে। কিন্তু তিতা হাজরা নামক স্থানে তারা মুক্তিযোদ্ধাদের দ্বারা ব্যাপক প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়। এই প্রতিরোধযুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর ২ জন সৈন্য নিহত হয়। অবশিষ্টরা পিছু হটে তাদের ক্যাম্পে ফিরে যায়।
হানাদার বাহিনী তাদের ১০ই আগস্ট অভিযানের বিপর্যয়ের প্রতিশোধ নিতে ১৯শে আগস্ট গভীর রাতে বিশাল সৈন্যবহর এবং আশপাশের বিভিন্ন রাজাকার- ক্যাম্প থেকে রাজাকার, আলবদর ও আলশামস বাহিনী নিয়ে বেগমগঞ্জের লক্ষ্মীপুরমুখী সড়কের পাশে বাংলাবাজার শামছুন নাহার হাই স্কুলের রাজাকার ক্যাম্পে অবস্থান নেয়। তাদের নেতৃত্বে রাজাকার ও অন্যান্য বাহিনীর সদস্যরা ২ ভাগে বিভক্ত হয়। একদল গোপালপুর বাজারের পশ্চিম দিক দিয়ে এবং অপর দল মূল রাস্তা দিয়ে এসে গোপালপুর বাজারের চারদিক ঘিরে ফেলে। তখন সকাল ৭-৮টা। মুক্তিযোদ্ধারা শুত্রুপক্ষের আক্রমণের আগেই বিভিন্ন অপারেশনে চলে যান। এলাকায় মাত্র কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা অবস্থান করছিলেন। স্বল্প সংখ্যক হওয়া সত্ত্বেও মুক্তিযোদ্ধারা শত্রুপক্ষকে প্রতিরোধ করার সিদ্ধান্ত নেন। স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান ও মুসলিম লীগ – নেতা মাহবুবুল হায়দার চৌধুরী নসা মিয়া নিজকে পাকিস্তানের পক্ষের লোক পরিচয় দিয়ে হানাদার বাহিনীর গোপালপুর বাজারে গণহত্যা ও অগ্নিসংযোগ ঠেকানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু হানাদাররা তার কথায় কর্ণপাত করেনি, বরং মাত্র আধাঘণ্টার মধ্যে গোপালপুর বাজারের পূর্বদিকের রাস্তার খালপাড়ে নসা মিয়াসহ বিভিন্ন স্থান থেকে অর্ধশতাধিক নিরীহ মানুষকে ধরে এনে দাঁড় করায় এবং ব্রাশ ফায়ার করে তাদের নির্মমভাবে হত্যা করে। শহীদদের রক্তে খালের পানি লাল হয়ে যায়। সৌভাগ্যক্রমে গণহত্যা থেকে একজন মুক্তিযোদ্ধা বেঁচে যান। তাঁর নাম লোকমান হোসেন। পরবর্তীতে শহীদদের লাশ নিজ-নিজ পারিবারিক করবস্থানে সমাহিত করা হয়। গোপালপুর গণহত্যায় শহীদ ২৫ জনের নাম ও পরিচয় পাওয়া গেছে। তাঁরা হলেন- মাহবুবুল হায়দার চৌধুরী নসা মিয়া (গোপালপুর), দ্বীন মোহাম্মদ (তুলাচরা), ইসমাইল মিয়া (তুলাচরা), হাবিব উল্ল্যাহ (তুলাচরা), অহিদ উল্যাহ (সাহাদাতপুর), মোহাম্মদ উল্যাহ-১ (সাহাদাতপুর), মোহাম্মদ উল্যাহ-২ (সাহাদাতপুর), দুলাল মিয়া (সাহাদাতপুর), শামছুল হক মাস্টার (আটিয়াকান্দি), মজিব উল্যা (আটিয়াকান্দি), বসির উল্যাহ (আটিয়াকান্দি), আবুল কাসেম মিয়া (মির্জানগর), আবু বকর সিদ্দিক (মির্জানগর), হারিছ মিয়া, (দেবকালা), ছিদ্দিক উল্যাহ মিয়া (সিরাজউদ্দিনপুর), মমিন উল্যাহ মিয়া (মহুল্লাপুর), মন্তাজ মিয়া (মহল্লাপুর), নুর মোহাম্মদ (মহল্লাপুর), আবদুল মন্নান (মহল্লাপুর), মোবারক উল্ল্যাহ (পানুয়াপাড়া), মোহাম্মদ উল্যাহ দর্জি (চাঁদ কাসেমপুর), আবদুর রশিদ (আমিরাবাদ), আবদুস সাত্তার (বারাহী নগর), আবদুল করিম (হীরা নগর) ও মোহাম্মদ সুজায়েত উল্যাহ (দশ ঘরিয়া, চাটখিল)।
স্থানীয় জনতা ক্লাবের সভাপতি রতন মাস্টারের ব্যক্তিগত উদ্যোগে শহীদদের স্মরণে ১৯৮০ সালে গোপালপুর বাজারের কেন্দ্রস্থলে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়। স্মৃতিস্তম্ভে শহীদদের নাম ও পরিচয় খোদাই করা হয়েছে। প্রতিবছর ১৯শে আগস্ট বিভিন্ন সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে। দেশ স্বাধীনের ৪২ বছর পর নোয়াখালী জেলা পরিষদের উদ্যোগে শহীদদের স্মরণে নতুন একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছে। [মো. ফখরুল ইসলাম]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৩য় খণ্ড