You dont have javascript enabled! Please enable it!

গোপালপুর নর্থবেঙ্গল সুগার মিল গণহত্যা (লালপুর, নাটোর)

গোপালপুর নর্থবেঙ্গল সুগার মিল গণহত্যা (লালপুর, নাটোর) সংঘটিত হয় ৫ই মে। নাটোর থানা থেকে ৩৫ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে গোপালপুর। এখানকার গণহত্যায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী গোপালপুর চিনিকলে আক্রমণ করে ঐ মিলে কর্মরত ৪২ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী, শ্রমিক এবং স্থানীয় আখচাষিসহ ৩০০ জনের অধিক মানুষকে হত্যা করে। এখানে হানাদারদের সহযোগিতা করেছিল অবাঙালি বিহারিসহ কয়েকজন বাঙালি। এসব অবাঙালি মূলত মিলে বিভিন্ন কর্মে নিয়োজিত ছিল। পাকিস্তানি হানাদাররা তাদের এ দেশীয় দালাল ঈদু মোহাম্মদ ঈদুর সহযোগিতা এবং প্রেরিত তথ্য থেকে অবহিত হয়েছিল যে, মিলে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ আর সহযোগিতা দেয়া হয় এবং তারা দিনের বেলা শ্রমিক-কর্মচারী হিসেবে কাজ করে আর রাতের বেলা সুযোগমতো পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এবং তাদের সমর্থকদের বিরুদ্ধে অপারেশন চালায়। মিলের প্রশাসক ছিলেন বাঙালি সেনাকর্মকর্তা লে. আনোয়ারুল আজিম। তাঁর প্রশ্রয় ও পরামর্শে এসব চলছে বলে হানাদারদের জানানো হয়। তাদেরও বিশ্বাস ছিল, মিলের প্রশাসক যেহেতু সামরিক বাহিনীর সদস্য এবং বাঙালি, সেহেতু যুদ্ধের প্রশিক্ষণ দেয়া তাঁর পক্ষে অসম্ভব কিছু নয়। সর্বোপরি, তিনি যেহেতু পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সদস্য, তাই পাকিস্তানিদের যুদ্ধরীতি এবং যুদ্ধকৌশল তাঁর জানার কথা। অতএব, পাকিস্তানিদের দুর্বল স্থানে আঘাত করে তাদের বেকায়দায় ফেলার মতো কৌশল তিনি শিক্ষা দেবেন, এটাই স্বাভাবিক। তাই, তাঁকে ও তাঁর দলবলকে আকস্মিক আঘাত করে পর্যুদস্ত করা ছিল পাকিস্তানি হানাদারদের লক্ষ্য। এরূপ তথ্যের ভিত্তিতে পাকিস্তানি সেনাসদস্যরা ৫ই মে অতর্কিতে গোপালপুর চিনিকলে আক্রমণ করে ও গণহত্যা চালায়। কিন্তু লেফটেন্যান্ট (অব.) আজিমের বাসভবন তল্লাশি করে যখন কিছুই পাওয়া যায়নি, তখন তারা আরো ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। হানাদার বাহিনী লে, আজিমের বিরুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ আর আশ্রয় দেয়ার অভিযোগ উত্থাপন করে। তিনি অস্বীকার করলে মিলের কর্মচারীদের ধরে এনে তার কাছে জানতে চাওয়া হয় এরা মুক্তিযোদ্ধা কি- না। তিনি বলেন, সবাই মিলের শ্রমিক-কর্মচারী। এরা শিফট ডিউটিতে এসেছে, কেউ মুক্তিযোদ্ধা নন। কিন্তু তবু তাঁর কথা বিশ্বাস না করে দাঁড় করানো সকলকে মিলের নিকটস্থ পুকুরপাড়ে নিয়ে হায়েনারা হত্যা করে।
পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ২৯শে মার্চ পাবনার দাশুড়িয়াতে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে নাটোরের দিকে রওনা দেয়। তারা গোপালপুর-বনপাড়া রোড হয়ে অগ্রসর হতে থাকে এবং গোপালপুর রেলক্রসিংয়ে পুলিশ, ইপিআর, আনসার ও মিলের কর্মচারীসহ স্থানীয় প্রতিরোধকারীদের প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়। এখানে স্থানীয় অনেকে শহীদ হন। এরপর পাকিস্তানি বাহিনী ৩০শে মার্চ সকালে রাজশাহী যাওয়ার পথে ওয়ালিয়ার ময়না গ্রামে প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়। সেখানে ৩০ ও ৩১শে মার্চ স্থানীয় জনগণ, ইপিআর, আনসার ও পুলিশ সমন্বয়ে গঠিত প্রতিরোধকারীদের সঙ্গে তাদের সংঘর্ষ হয়। উল্লেখ্য, এখানকার প্রতিরোধযুদ্ধে গোপালপুর চিনিকলের অনেক কর্মচারীও যোগ দিয়েছিলেন। লে. আজিমও প্রতিরোধ বাহিনীর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। পাকিস্তানি বাহিনী এ-সময় পরাজিত হয়। তাদের কয়েকজন ছদ্মবেশে পালানোর চেষ্টা করলে প্রতিরোধকারীদের হাতে ধরা পড়ে। তাদের মধ্যে হানাদার বাহিনীকে নেতৃত্বদানকারী মেজর আসলামও ছিল। বিক্ষুব্ধ জনতার আক্রমণে তারা নিহত হয়।
৫ই মে সকালে গোপালপুর বাজার আক্রমণ করে ১২ জন মানুষকে হত্যা করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। এরপর তারা মেজর উইলিয়ামের নেতৃত্বে দ্রুত গোপালপুর মিলে প্রবেশ করে। সেদিন অবাঙালি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা মাথায় সাদা পট্টি ও হাতে লাল সালু কাপড়ের ব্যাজ পরে মিলে প্রবেশ করেছিল, যাতে বাঙালি আর অবাঙালি চেনা যায়। এ থেকে প্রমাণিত হয় যে, ৫ই মে গোপালপুর মিলের আক্রমণ ছিল পূর্বপরিকল্পিত। হানাদার বাহিনী তড়িৎ বেগে মিলে প্রবেশ করে এবং গেইটে তালা ঝুলিয়ে দেয়। লে. আনোয়ারুল আজিমের স্ত্রীর ভাষ্যমতে, হানাদার বাহিনী দুটি দলে বিভক্ত হয়ে গোপালপুর নর্থ বেঙ্গল সুগার মিলে ঢুকেছিল। তাদের দোসর ছিল স্থানীয় অবাঙালিরা। প্রথম দলটি ঢুকেছিল মূল মিলের অভ্যন্তরে, অপর দলটি একই সঙ্গে প্রবেশ করে মিলের পাশের কলোনিতে। প্রথম দলটি মিলে ঢুকে ৩শরও বেশি কর্মকর্তা-কর্মচারী, শ্রমিক ও আখচাষিকে মিলের পাশে দিঘির আকৃতির গোপাল পুকুরের কিনারে লাইন করে দাঁড় করায়। তারপর তাদের ওপর গুলি চালানো হয়। গোপালপুরের এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে যে-সমস্ত পাকিস্তানি সামরিক অফিসার প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিল, তারা হলো— মেজর শেরওয়ানী, ক্যাপ্টেন মোখতার ও মেজর উইলিয়াম। এদের মধ্যে প্রথমোক্ত দুজন থাকত নাটোরে আর তৃতীয়জন থাকত ঈশ্বরদীতে।
প্রশাসক লে. আনোয়ারুল আজীম সবাইকে নির্দোষ দাবি করে হানাদারদের কাছে সবার প্রাণ ভিক্ষা চেয়েছিলেন, কিন্তু তাতে তাদের মন একটুও গলেনি। ব্রাশ ফায়ারে সৃষ্টি হয় এক বেদনাময় ইতিহাস। যারা আহত অবস্থায় পানির ধারে বা সিঁড়িতে পড়েছিল, তাদের ওপর চলে বেয়নেট চার্জ। এ গণহত্যায় গুরুতর আহত অবস্থায় ৭ জন এবং অক্ষত দেহে ২ জন বেঁচে যান। গণহত্যার পর দীর্ঘদিন পুকুরের জল রক্তাক্ত হয়ে ছিল। ঐদিন মিলের প্রশাসক লে. আনোয়ারুল আজিমসহ ৩শর অধিক লোককে হত্যা করা হয়। এসব শহীদের স্মরণে ১৯৭২ সাল থেকে ‘গোপাল পুকুর’ ‘শহীদ সাগর’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করে এবং সেখানে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মিত হয়েছে। তাতে মিলের শহীদ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নাম খোদিত রয়েছে।
গোপালপুর চিনিকল গণহত্যায় মিলের যেসব কর্মকর্তা- কর্মচারী শহীদ হন, তাদের মধ্যে ৪১ জনের পরিচয় পাওয়া গেছে। তারা হলেন— লে. আনোয়ারুল আজিম (প্রশাসক), শহীদুল্লাহ (প্রশাসনিক অফিসার), গোলজার হোসেন (একাউন্টট্যান্ট ইনচার্জ), গোলজার হোসেন তালুকদার (কেইন সুপারিনটেনডেন্ট), আবুল হাসেম (এসিডিও), আব্দুল মান্নান ভূঁইয়া (সহ-হিসাব রক্ষণ অফিসার), এস এম এ রউফ (স্টেনেগ্রাফার), মো. নুরুল হক (হেড ক্যাশিয়ার), আজাহার আলী (ক্যাশিয়ার), মকবুল হোসেন (হিসাব সহকারী), আবুল বাসার খান (একাউন্টস ক্লার্ক), আজিজুর রহমান (একাউন্টস ক্লার্ক), মুনসুর আলী (একাউন্টস ক্লার্ক), সাজেদুল রহমান (একাউন্টস ক্লার্ক), ইসমাইল হোসেন (করণিক), মো. আবুল কাশেম (খালাসি), আব্দুর রব (খালাসি), এস এম নজরুল ইসলাম (বৈদ্যুতিক ফিটার), আয়েজ উদ্দিন (খালাসি), মোসলেম উদ্দিন (শ্রমিক), হাবীবুর রহমান (পেট্রোল পাম্প করণিক), মোসাদ্দারুল হক (ক্লার্ক), মোকসেদুর আলম (ক্লার্ক), আব্দুর রহমান আমিন (সিআইসি), মোহাম্মদ আলী (নিরাপত্তা প্রহরী), মোজ্জাম্মেল হক (নিরাপত্তা প্রহরী), আব্দুল মান্নান (নিরাপত্তা প্রহরী), ফিরোজ মিঞা (নিরাপত্তা প্রহরী), আকতার উদ্দিন (নিরাপত্তা প্রহরী), সোহরাব আলী (নিরাপত্তা প্রহরী), আনোয়ারুল ইসলাম (পিওন), পরেশ উল্লাহ (পিওন), আব্দুল মান্নান (পিওন), সামসুল হুদা (হেড মিস্ত্রি), কামাল উদ্দিন (ম্যাশিন ম্যান), আ. মজিদ (ম্যাশিন ম্যান), তোফায়েল প্রামাণিক (শ্রমিক), এস এম এ কালাম (সিএসবিএ), আব্দুর রাজ্জাক (শ্রমিক), শহীদুল্লাহ (কুক) ও সাইফুদ্দীন আহমেদ (চিফ একাউন্টট্যান্ট)। নিহতদের শহীদ সাগর পুকুরপাড়ে গণকবর দেয়া হয়। [সুমা কর্মকার]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৩য় খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!