You dont have javascript enabled! Please enable it!

মুক্তিযুদ্ধে গুরুদাসপুর উপজেলা (নাটোর)

গুরুদাসপুর উপজেলা (নাটোর) নাটোর জেলা সদর থেকে প্রায় ৩৪ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে নন্দকুজা নদীর তীরে অবস্থিত। ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান- ঘোষিত বাঙালির মুক্তিসনদ ৬ দফাতেই বাংলার স্বাধীনতার বীজ রোপিত হয় এবং ৬ দফা আন্দোলন থেকে ১৯৬৯ সালের গণআন্দোলনে অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে এ উপজেলার মানুষ পাকিস্তানি শাসনের প্রতি বিরূপ মনোভাব পোষণ করতে থাকে। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের প্রতি গভীর আস্থা রেখে ঊনসত্তরের গণআন্দোলন-এ গুরুদাসপুরের কৃতী সন্তান রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. শামসুজ্জোহার শহীদ হওয়ার ঘটনা গুরুদাসপুরবাসীকে মারাত্মকভাবে বিক্ষুব্ধ করে তোলে এবং জাতীয়তাবাদী চেতনায় ঐক্যবদ্ধ হতে সাহস ও অনুপ্রেরণা জোগায়। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করার পর থেকেই এ অঞ্চলের মানুষের মনে বাঙালির অধিকার প্রতিষ্ঠা ও জাতীয় মুক্তির বিষয়টি প্রবলভাবে দেখা দেয়। ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পর থেকে গুরুদাসপুরবাসী স্বাধীনতার লক্ষ্যে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে শুরু করে।
মার্চ মাসের শুরু থেকেই নাটোর ও রাজশাহীর মতো গুরুদাসপুরের গমেজ উদ্দিন, আব্দুল কদ্দুস (রাজশাহী কলেজ ও পরবর্তীতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেতা), মহসিন আলী (রাজশাহী কলেজ ও ‘৭০-এ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেতা) প্রমুখের নেতৃত্বে বিভিন্ন স্থানে মিটিং-মিছিলের পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি চলতে থাকে। বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ – বেতারে সরাসরি সম্প্রচারিত না হওয়ায় সেদিন সন্ধ্যায় গুরুদাসপুরে একটি প্রতিবাদ মিছিল বের হয়। ৮ই মার্চ হরিপদ কুণ্ডুর বাসভবনের সামনে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয় এবং উপস্থিত ছাত্র- জনতা দেশের স্বাধীনতার জন্য নিজেদের উৎসর্গ করতে শপথ গ্রহণ করে। গুরুদাসপুর শহীদ শামসুজ্জোহা কলেজ মাঠে ছাত্রনেতা মহসিন আলী, আবদুস সাত্তার, রবিউল ইসলাম, তোফাজ্জল হোসেন, মোবারক আলী, রেকাতুল্লাহ ও আব্দুল কদ্দুসের উদ্যোগে মুক্তিযুদ্ধের প্রাথমিক প্রশিক্ষণ শুরু হয়। একই সঙ্গে থানা সদরের সন্নিকটে সরকারি কর্মকর্তা- কর্মচারীদের আবাসিক এলাকার দক্ষিণ-পশ্চিম পার্শ্বস্থ আমবাগানেও প্রশিক্ষণ চলে। এছাড়া বড়াইগ্রামের মুলাডুলী স্কুল মাঠে আনসার সদস্য হযরত আলী ও আলী আজম এবং ছুটিতে আসা বাঙালি সেনাসদস্য আবু মোহাম্মদ এলাকার ছাত্র-যুবকদের প্রশিক্ষণ দেন।
মুক্তিযুদ্ধের সময় গুরুদাসপুর ও তদ্সংলগ্ন অঞ্চলে বিচ্ছু বাহিনী নামে একটি গেরিলা বাহিনী গড়ে উঠেছিল। এর কমান্ডার ছিলেন ছাত্রনেতা মহসিন আলী। এ বাহিনী পাকসেনা ও তাদের দালালদের বিরুদ্ধে বহু অপারেশন পরিচালনা করে।
২৫শে মার্চ রাতে অপারেশন সার্চলাইট-এর নামে পাকবাহিনী গণহত্যা শুরু করলে ২৬শে মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। পাকবাহিনী দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে অনুপ্রবেশের চেষ্টা করে। গুরুদাসপুরের মানুষ এখানে তাদের অগ্রযাত্রা প্রতিহত করার উদ্যোগ নেয় এবং এপ্রিল মাসের প্রথম দিকে বিয়াঘাট এলাকায় প্রতিরোধ গড়ে তোলে। জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে রাস্তা খুঁড়ে এবং গাছ ফেলে প্রতিরোধে অংশগ্রহণ করে। কিন্তু জনগণের এ প্রতিরোধ ভেঙ্গে পাকবাহিনী ১৭ই এপ্রিল গুরুদাসপুরে অনুপ্রবেশ করে। প্রথমে তারা গুরুদাসপুরে স্থায়ী ক্যাম্প স্থাপন না করলেও প্রতিদিন নাটোর থেকে টহলে আসত। পরবর্তীতে তারা গুরুদাসপুর থানা ও শহীদ শামসুজ্জোহা কলেজে স্থায়ী ক্যাম্প স্থাপন করে। এছাড়া গুরুদাসপুর হাইস্কুল, চাঁচকৈড় বাজার তহশিল অফিস, বিয়াঘাট বাজার ও মশিন্দা ইউনিয়ন বোর্ড অফিসে পাকবাহিনীর দোসর রাজাকার ও আলবদর-এর ক্যাম্প ছিল।
গুরুদাসপুরে পাকবাহিনীর সহযোগী দালাল-রাজাকার-আলবদরদের সংখ্যা ছিল অনেক। তাদের মধ্যে আলহাজ আব্দুল জলিল(গুরুদাসপুর; শান্তি কমিটি-র নেতা ও কুখ্যাত দালাল), আলহাজ আবুল কাশেম মোল্লা (চাঁচকৈড়, কুখ্যাত দালাল), ইয়ার উদ্দিন মিঞা (চাঁচকৈড়; দালাল ও গুরুদাসপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান), আলহাজ আমির হোসেন (গুরুদাসপুর), তারা (গুরুদাসপুর; জল্লাদ ও লুটেরা), আবুল কাশেম মেম্বার (গুরুদাসপুর; লুটেরা), মেহের আলী বিশ্বাস (চাঁচকৈড় কাচারিপাড়া), আবুল কাশেম (ধারাবরিষা; শিক্ষক, জল্লাদ ও লুটেরা), মওলানা ইসহাক আলী (মহারাজপুর; মাদ্রাসা শিক্ষক, জল্লাদ ও লুটেরা) প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। সশস্ত্র রাজাকার ও আলবদর বাহিনীর মধ্যে মোশারফ হোসেন (আব্দুলপুর; কুখ্যাত রাজাকার), দাউদ হোসেন, আবুল কালাম, জামাল হোসেন, মোকা বিশ্বাস, শাহজাহান বিশ্বাস, আমজাদ হোসেন (চাঁচকৈড়), মমতাজ বিহারি, শামসুল হক মাস্টার (হাসমারি), মৌলবী মতিউর রহমান (জ্ঞানদানগর; মসজিদের ইমাম ও খুনি-লুটেরা), ভাদু হাজি (খুবজিপুর) প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে পাকবাহিনী ও তাদের দোসর শান্তি কমিটি, রাজাকার ও আলবদর বাহিনীর সদস্যরা গুরুদাসপুর, নাড়ীবাড়ি, চাঁচকৈড়, কাছিকাটা বাজার, বিয়াঘাট, মশিন্দা, পোয়ালশুড়া-পাটপাড়া, নাজিরপুর প্রভৃতি গ্রামে হত্যা, গণহত্যা, নারীনির্যাতন, লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটায়। ১৭ই এপ্রিল পাকবাহিনী নাড়ীবাড়ি গ্রামে হিন্দু সম্প্রদায়ের ১৬ জনকে নির্মমভাবে হত্যা করে, যা নাড়ীবাড়ি গণহত্যা- নামে পরিচিত। তারা নাড়ীবাড়িসহ গুরুদাসপুর-চাঁচকৈড় বাজারে লুণ্ঠন শেষে বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে।
২১শে মে এবং আগস্ট মাসের মাঝামাঝি সময়ে পাকবাহিনী রাজাকার-দালালদের সহযোগিতায় বিয়াঘাট বাজারে লুণ্ঠন চালায়। বাজার থেকে স্বাধীনতার পক্ষের ১৫ জন সাধারণ মানুষকে ধরে নিয়ে দক্ষিণ পাশের নন্দকুজা নদীর তীরে দাঁড় করিয়ে হত্যা করে। এ ঘটনা বিয়াঘাট গণহত্যা- নামে পরিচিত। রাজাকার-দালালরা মাঝে-মাঝেই বিয়াঘাট বাজারে এসে ব্যবসায়ী ও বিত্তশালী কৃষকদের নিকট থেকে জোরপূর্বক চাঁদা আদায় করত। চাঁদা না দিলে তাদের ওপর শারীরিক নির্যাতন চালাত।
২৩শে মে ৫০-৬০ জন দালাল-রাজাকার কাছিকাটা বাজারে লুটতরাজ শেষে অগ্নিসংযোগ করে। শুধু তাই নয়, তারা মন্দিরে গিয়ে দেবদেবীর শরীরের স্বর্ণালংকার লুট করে এবং মন্দিরের ভেতরে আশ্রয় নেয়া দুজন হিন্দু ব্যবসায়ীকে গুলি করে হত্যা করে।
অক্টোবর মাসের শেষদিকে পোয়ালশুড়া-পাটপাড়া গ্রামে মুক্তিযোদ্ধারা অবস্থান করছেন এমন সংবাদ পেয়ে পাকবাহিনী অতর্কিতভাবে গ্রামটি ঘিরে ফেলে এবং বাড়ি-বাড়ি তল্লাশী চালায়। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের না পেয়ে ৬ জন নিরীহ গ্রামবাসীকে গুলি করে হত্যা করে। নিহতরা হলেন- মজের উদ্দিন প্রামাণিক, আক্কাস আলী, সাছির উদ্দিন, গোঁসাইপদ সরকার, তারাপদ সরকার এবং বণেশ্বর হালদার।
গুরুদাসপুরে দুটি গণকবর আছে— নাড়ীবাড়ি গণকবর- ও <পোয়ালশুড়া-পাটপাড়া গণকবর।
গুরুদাসপুর উপজেলায় পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি যুদ্ধ হয়, সেটি হলো বিয়াঘাট বাজার যুদ্ধ। পাকবাহিনী প্রায়ই বিয়াঘাট বাজারে এসে লুটপাট করত। অক্টোবর মাসের মাঝামাঝি সময়ে পুনরায় লুট করতে আসবে এ সংবাদ পেয়ে মুক্তিযোদ্ধারা বাজারের দিকে অগ্রসর হন এবং উভয় পক্ষের মধ্যে এক সম্মুখ যুদ্ধ হয়। এতে তিনজন পাকসেনা নিহত হয় এবং সালাম নামে একজন সাধারণ যুবক শহীদ হন। ১৮ই ডিসেম্বর গুরুদাসপুর উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়।
গুরুদাসপুরে দুজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। তাঁরা হলেন- রেকাতুল্লাহ (পিতা বুলু মণ্ডল, চাঁচকৈড়) এবং লুৎফর রহমান (পিতা শেখ আব্দুল মজিদ, ধারাবরিষা)।
গুরুদাসপুর থানার পাশে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মিত হয়েছে। বিয়াঘাট হাইস্কুল প্রাঙ্গণে একটি ও উত্তর নাড়ীবাড়িতে দুটি মোট তিনটি গণহত্যার স্মৃতিফলক এবং নাজিরপুর উচ্চ বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে শহীদ মুক্তিযোদ্ধা লুৎফর রহমানের নামে একটি স্মৃতিফলক নির্মিত হয়েছে। এছাড়া কালান্দর গ্রামের ছাত্র ও পাকবাহিনীর হাতে শহীদ মোবারক হোসেনের স্মৃতি রক্ষার্থে গুরুদাসপুর বাজার থেকে চাঁচকৈড় বাজার পর্যন্ত নির্মিত সড়কের নাম ‘শহীদ মোবারক হোসেন সরণি’ রাখা হয়েছে। [শাকিল হোসেন]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৩য় খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!