You dont have javascript enabled! Please enable it! গুডস হিল নির্যাতনকেন্দ্র (চট্টগ্রাম মহানগর) - সংগ্রামের নোটবুক

গুডস হিল নির্যাতনকেন্দ্র (চট্টগ্রাম মহানগর)

গুডস হিল নির্যাতনকেন্দ্র (চট্টগ্রাম মহানগর) চট্টগ্রাম শহরের কোতোয়ালি থানায় পাহাড়ের ওপর অবস্থিত। এর উত্তরে হযরত মিসকিন শাহ্ মাজার ও কাজেম আলী হাইস্কুল, পূর্বে সরকারি আলীয়া মাদ্রাসা ও নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা রোড, পশ্চিমে ডা. খাস্তগির সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় এবং দক্ষিণে রহমতগঞ্জ আবাসিক এলাকা। ১৮৬৪ সালে চট্টগ্রাম পৌরসভা গঠিত হলে চট্টগ্রামে বসবাসরত পর্তুগিজদের উত্তরপুরুষ মি. ই ও গুডস এর কমিশনার নিযুক্ত হন। গুডস হিলে তাঁর বাসভবন ছিল। তাঁর নামানুসারেই এ পাহাড়ের নাম হয় ‘গুডস হিল’এবং এ নামেই এটি সরকারি রেকর্ডভুক্ত হয়। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান ও ভারতের স্বাধীনতার পর গুডস সাহেবের পরিবার চট্টগ্রাম ছেড়ে চলে গেলে এটি মুসলিম লীগ নেতা ফজলুল কাদের চৌধুরীর মালিকানায় আসে। তখন থেকে তার পরিবার এখানে বসবাস করছে। এ বাড়িতে ৮টি কক্ষবিশিষ্ট একটি গাড়ির গ্যারেজ আছে। তার পাঁচটি কক্ষ মুক্তিযুদ্ধের সময় নির্যাতনকেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে পরাজয়ের প্রতিশোধ হিসেবে ফজলুল কাদের চৌধুরী ও তার পুত্র সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর নির্দেশে এখানে অসংখ্য স্বাধীনতাকামী বাঙালিকে নির্যাতন করা হয়।
ফজলুল কাদের চৌধুরীর নির্দেশমতো তার বাহিনী কর্তৃক অপহৃত বন্দিদের তার সামনে হাজির করার পর শুরু হতো প্রশ্নপর্ব ও নির্যাতনের পালা। তার জল্লাদ বাহিনীতে ছিল— হামিদুল কবির চৌধুরী খোকা (খোর্দ গহিরা, আনোয়ারা থানা), আনোয়ার ওরফে খুইন্যা আনোয়ার (আনোয়ারা থানা), ইউসুপ, মহসিন, সিদ্দিক, খলিল, গেনা সিকান্দার, মোহরা ও আরো পাঁচ-সাতজন।
গুডস হিল নির্যাতনকেন্দ্র ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি থেকে চালু করা হয়। চট্টগ্রাম শহরসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে মুসলিম লীগ নেতাদের সুপারিশ অনুযায়ী অগণিত লোকদের ধরে এনে এখানে নির্যাতন করা হয়। তাদের কেউ-কেউ নিখোঁজও হয়ে যান। এখানে নির্যাতিত কয়েকজন হলো— বিষ্ণু দে (রাজশাহী)। সে ছিল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পিয়ন; অবসর সময়ে গুডস হিলের নিকট একটি মোটর গ্যারেজে মেকানিকের কাজ করত। এপ্রিল মাসের শেষদিকে তাকে ধরে এনে হাতের একটি আঙ্গুলের মাথা কেটে সেখান দিয়ে লম্বা সুই ঢোকানো হয়। উরুতে ড্রিল মেশিন ঢুকিয়ে মাংস বের করে নেয়া হয়। এভাবে পাঁচ-সাত দিন নির্যাতনের পর দেশদ্রোহিতার মামলা দিয়ে তাকে কোর্টে চালান দেয়া হয়। দেশ স্বাধীনের পর সে মুক্তি ও মামলা থেকে অব্যাহতি পায়।
নিজাম উদ্দিন (পিতা মাওলানা জহির উদ্দিন, চকবাজার)। তাকে ৫ই জুলাই ধরে এনে বিভিন্নভাবে নির্যাতন করা হয়। সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী নিজহাতে লোহার রড দিয়ে তাকে এলোপাতাড়িভাবে পেটায়। মাথা নিচু করে পায়ের সঙ্গে বেঁধে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ঝুলিয়ে রাখে। রোদে তক্তাচাপা দিয়ে উল্লাস করে। তৃষ্ণায় পানি খেতে চাইলে তা দেয়নি। অবশেষে ১৮ই নভেম্বর পাকসেনারা তাকে ছেড়ে দেয়। যুদ্ধাপরাধের মামলায় সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ প্রমাণে তিনি যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দেন।
ড. সালেহ উদ্দিন (মশাজান, হবিগঞ্জ; শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য)। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সংস্পর্শে এসে বন্ধু সহিদুল আমিন চৌধুরী (নোয়াজিশপুর, রাউজান), জাফর উল্লাহ (ছাগলনাইয়া, নোয়াখালী), সাহাব উদ্দিন ফয়েজ (বটতলি, আনোয়ারা)-সহ আরো তিনজন মিলে আব্দুস সাত্তার রোডের ইউনাইটেড কেমিক্যালের গুদাম থেকে কিছু রাসায়নিক দ্রব্য হস্তগত করে বর্তমান বাকলিয়া হাইস্কুল এলাকায় গোপনে বোমা বানিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সরবরাহ করতেন। ফজলুল কাদের চৌধুরী এ সংবাদ পেয়ে জুলাই মাসের তৃতীয় সপ্তাহে বুড়িশ্চরের চেয়ারম্যান শামসু মিয়ার মাধ্যমে পাকসেনা দিয়ে মোহড়া রাজাখান চৌধুরীর বাড়ি থেকে তাঁকে গ্রেপ্তার করে গুডস হিলে নিয়ে আসে। মুক্তিযোদ্ধাদের সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি কিছুই জানেন না বলামাত্র ফজলুল কাদের চৌধুরীর নির্দেশে তাঁর ওপর নির্মম নির্যাতন শুরু হয়। তাঁকে ঘরের বাইরে নিয়ে বড় তক্তার নিচে রেখে ওপরে তিন-চার জন লাফাতে থাকে। ঘণ্টা খানেক পরে লাথি, গুঁতা এবং লোহার রড ও পানির হোস পাইপ দিয়ে পিটিয়ে পায়ে রশি বেঁধে ঝুলিয়ে রাখা হয়। এ খবর পেয়ে মোহড়া হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক মো. মোস্তফা এবং বিশিষ্ট ব্যক্তি বাদশা মিয়া সওদাগর গুডস হিলে এসে অনুরোধ করলে সন্ধ্যায় তাঁকে ছেড়ে দেয়া হয়৷
গুডস হিলে নির্যাতনের একজন প্রত্যক্ষদর্শী হচ্ছেন আব্দুল আজিজ (বর্তমানে ব্যবসায়ী)। তার পিতা ডা. ছমিউদ্দিন। তারা তখন চন্দনপুরা আয়েশা খাতুন লেনে থাকতেন। ফজলুল কাদের চৌধুরীর সঙ্গে তাদের পারিবারিক সম্পর্ক ছিল। ১৩ই এপ্রিল রাতে ফ কা চৌধুরীর আহ্বানে তিনি তার পিতাকে নিয়ে গুডস হিলে যান। সেখানে একটি গাড়িতে তিনি তিনজন লোককে শায়িত দেখেন। নির্যাতনের ফলে তাদের মুখ দিয়ে ফেনা বেরিয়ে এসেছে। ডা. ছমিউদ্দিন পরীক্ষা করে তাদের মৃত ঘোষণা করেন। পাশের বাগানে তখন আরো কয়েকজনকে বন্দি করে রাখা হয়েছিল। তাদের একজনকে ফ কা চৌধুরীর দু-নম্বর জন্মাদ খলিল তখনো পেটাচ্ছিল।
২৪শে এপ্রিল আজিজ আবার তার পিতাকে নিয়ে গুডস হিলে যান। গিয়ে দেখেন একজন মানুষ মাটিতে পড়ে আছে। তার মুখচোখ ফোলা। ডাক্তার পরীক্ষা করে তাকে মৃত ঘোষণা করেন। পাশে আরো দুজন লোক বসে ছিল। তাদের চোখমুখও ফোলা। পাকসেনাদের বুটের আঘাতে এ অবস্থা হয়েছিল। এর চেয়েও ভয়াবহ ব্যাপার হলো ফ কা চৌধুরীর প্রধান জন্মাদ হামিদুল কবির চৌধুরী খোকা তখন গাছের সঙ্গে পা ঝুলিয়ে একজনকে লোহার রড দিয়ে নির্দয়ভাবে মারছিল। কিছুক্ষণের মধ্যে তার আর্তনাদ বন্ধ হয়ে যায়, মুখ দিয়ে ফেনা বেরিয়ে আসে। ডা. ছমিউদ্দিন এর প্রতিবাদ করলে তার বাঁধন খুলে দেয়া হয়। কিন্তু ততক্ষণে তার মৃত্যু হয়।
চন্দনপুরার মুক্তিযোদ্ধা সায়ফুল্লাহ কামাল আগরতলার হরিণা ক্যাম্প থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে ৩রা আগস্ট বাড়িতে আসেন। এ খবর পেয়ে জল্লাদ হামিদুল কবির চৌধুরী খোকা এবং জাফর উল্লাহ ২০-২৫ জন পাকসেনা নিয়ে ২৮শে সেপ্টেম্বর তাঁকে বাড়ি থেকে ধরে গুডস হিলে নিয়ে আসে। এখানে চারদিন নির্মম নির্যাতনের পর মরণাপন্ন অবস্থায় কোতোয়ালি থানায় সোপর্দ করে। সেখান থেকে চারদিন পর আবার গুডস হিলে নিয়ে আসে। এবার ফ কা চৌধুরী তাকে শাসিয়ে বলে সত্যি কথা বললে তাঁকে মুক্তি দেয়া হবে, নইলে নিশ্চিত মৃত্যু। এরপর তাঁকে ক্যান্টনমেন্টে ফিল্ড ইনভেস্টিগেশন টিমের নিকট পাঠিয়ে দেয়া হয়। তিনি সেখানে একটি অসত্য বিবৃতি দেন। এরপর গুডস হিলে এনে জল্লাদরা দুদিন ধরে আবার তাঁকে নির্যাতন করে। পাকসেনারা তাঁর অবশ দেহটি নিয়ে প্রায় দেড়ঘণ্টা ফুটবল খেলে, হকিস্টিক দিয়ে প্রহার করে, বুট দিয়ে লাথি মারে, সজোরে কিল-ঘুষি মারে। এক পর্যায়ে হাঁটুর নিচে ও ওপরে লোহার রড রেখে তার ওপর উঠে দাঁড়ায়। তাঁর শরীরের ক্ষতস্থানে মরিচের গুঁড়ো লাগিয়ে দেয়। রাত দশটার দিকে পায়ে রশি বেঁধে মাথা নিচের দিকে দিয়ে ঝুলিয়ে রাখে। রাত বারোটার দিকে একজন বেলুচ সৈন্য তাকে নামিয়ে আনে। গভীর রাতে তাঁকে একটি কবরের কাছে নিয়ে পিস্তল ধরে সত্য কথা বলতে বলে। কিন্তু তারপরেও তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের সম্পর্কে কোনো কথা বলেননি। তাঁর সঙ্গে ছাত্রলীগ নেতা ও মুক্তিযোদ্ধা মুরিদুল আলম (চন্দনাইশ)-এর ভাগনে আবুল মুনসুরকেও নির্যাতন করা হয়। তিনি নির্যাতনের সময় অনর্গল অসত্য বক্তব্য দিয়ে যেতেন। মাসদেড়েক পরে ক্যাপ্টেন আনোয়ার তাঁদের কোতোয়ালি থানায় পাঠিয়ে দেয়। একদিন পর নিয়ে যাওয়া হয় সার্কিট হাউজে। সেখানেও চলে নির্যাতন। এরপর তাঁদের জেলখানায় পাঠিয়ে দেয়া হয়। হানাদারদের আত্মসমর্পণের পর তাঁরা মুক্ত হন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক প্রাণ গোপাল দত্ত গুডস হিলে নির্যাতনের প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে আগস্ট মাসের একটি ঘটনার বর্ণনা দেন। তিনি তখন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের ছাত্র। এক রাতে সা কা চৌধুরী টেলিফোন করে একজন রোগীকে দেখার জন্য কলেজের অধ্যাপক নুরুল আমীনকে গুডস হিলে যাওয়ার অনুরোধ করে। যুদ্ধকালীন সময়ের ব্যাপার বিবেচনা করে অধ্যাপক মাজেদ (কলেজের পরীক্ষা নিতে এখানে এসেছিলেন এবং অধ্যাপক আমীনের বাসভবনেই অবসস্থান করছিলেন) অধ্যাপক নুরুল আমীনের সঙ্গে গুডস হিলে যান। তাঁরা সেখানে গিয়ে দেখেন একজন যুবককে হাত-পা বেঁধে নির্যাতন করা হচ্ছে। কিন্তু সে কোনো কথা বলছে না। যুকবটি বোবা কি-না তা পরীক্ষা করে বলার জন্যই তাঁদের ডাকা হয়েছে। অধ্যাপক নুরুল আমীন যুবকটির প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে তাকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে তাঁর অধীনে ভর্তি করার পরামর্শ দেন। তাঁরা গুডস হিল থেকে বেরিয়ে আসার পর কয়েকটি গুলির শব্দ এবং আর্তচিৎকার শোনা যায়। পরদিন যুবকটিকে হাসপাতালের পরিবর্তে কোনো গণকবরে পাঠিয়ে দেয়া হয়।
গুডস হিলে আরো অনেকের সঙ্গে যাদের নির্যাতন করা হয়, তারা হলেন— তপন বড়ুয়া (সত্তার ঘাট), ফজলুল হক সওদাগর (কাগতিয়া), শেখ মোজাফ্ফর আহমেদ (হাটহাজারি), মুক্তিযোদ্ধা ওমর ফারুক (নির্যাতনে এখানেই মৃত্যু ঘটে), সাদেক সাইফুর রহমান স্বপন (পিতা লুৎফর রহমান, রুমঘাটা), ভুলু প্রমুখ।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মুক্তিযোদ্ধারা ফজলুল কাদের চৌধুরীকে গ্রেফতার করেন। ১৯৭২ সালের ২২শে ফেব্রুয়ারি তাকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানো হয় এবং ১৯৭৩ সালের ১৮ই জুলাই কারাগারে তার মৃত্যু হয়। তার পুত্র সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মামলা দায়ের করা হয়। মামলার বিচারে তার ফাঁসির দণ্ডাদেশ হয় এবং ২০১৫ সালের ২২শে নভেম্বর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে তার ফাঁসি কার্যকর করা হয়। [আহমেদ আমিন চৌধুরী]
তথ্যসূত্র: আবদুল হক চৌধুরী রচনাবলী, ১ম খণ্ড, বাংলা একাডেমি ২০১১; আহমেদ আমিন চৌধুরী, ইতিহাসের আলোকে মুক্তিযুদ্ধ ও রাউজান, বলাকা প্রকাশন ২০১২; জামাল উদ্দিন, শাশ্বত চট্টগ্রাম, বলাকা প্রকাশন ২০১৪; জামাল উদ্দিন, মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রাম শহর, বলাকা প্রকাশন ২০১৪

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৩য় খণ্ড