গুতমা-নিশ্চিন্তপুর গণহত্যা (নাসিরনগর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া)
গুতমা-নিশ্চিন্তপুর গণহত্যা (নাসিরনগর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া) সংঘটিত হয় নভেম্বর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে। এতে ১২ জন সাধারণ মানুষ নিহত ও একজন আহত হয়।
নাসিরনগরের দাউরা গ্রামে নির্মম হত্যাকাণ্ড ও লুটপাট শেষে কুখ্যাত মধু রাজাকারের সহায়তায় পাকিস্তানি বাহিনী পার্শ্ববর্তী নিশ্চিন্তপুর গ্রামে চড়াও হয়। তাদের আগমন টের পেয়ে গ্রামবাসী দ্রুত অন্য গ্রামে চলে যায়। এ সময় রাজাকারদের হাতে মণীন্দ্র ও প্রেমানন্দ নামে দুজন ধরা পড়ে। এ দুজনকে হাত বেঁধে তারা পার্শ্ববর্তী গুতমা গ্রামে নিয়ে যায়। যাবার সময় তারা নিশ্চিন্তপুর গ্রামের বাড়িঘরে আগুন লাগায়। গুতমা গ্রামে তখন কায়সার বাহিনী (স্থানীয়ভাবে গঠিত পাকিস্তানিদের সহযোগী বাহিনী)-র তাণ্ডব চলছিল। পাকিস্তানি বাহিনী এবং রাজাকাররাও তাদের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়। যৌথ দল গ্রামের বিভিন্ন বাড়িতে হামলা চালিয়ে যাকে যেখানে পায় ধরে ফেলে। ধৃত ব্যক্তিদের গুতমা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের উত্তর পাশে রাস্তার ওপর একটি তুলা গাছের নিচে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করায়। নিশ্চিন্তপুর থেকে ধরে আনা মণীন্দ্র এবং প্রেমানন্দকেও এ সারিতে দাঁড় করায়। মোট ১৩ জনকে এখানে দাঁড় করিয়ে হানাদার বাহিনী তাদেরকে গুলি করে। এতে ১২ জন ঘটনাস্থলে নিহত ও একজন আহত হয়। নিহত ১২ জনের লাশ ফেলে রেখে রাজাকার ও কায়সার বাহিনীর লোকেরা গ্রামের হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বাড়িগুলো লুট করে। এরপর বাড়িগুলোতে আগুন দেয়। দীর্ঘ সময় ধরে লুটপাটের পর পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দোসররা গুতমা গ্রাম ছেড়ে নাসিরনগর এবং মাধবপুরের দিকে চলে যায়। গুতমা গ্রামে শোকের ছায়া নেমে আসে। এলাকাবাসী এগিয়ে এসে নিহতদের মাটিচাপা দেয়। দেশ শত্রুমুক্ত হবার পর নিহতদের আত্মীয়-স্বজন লাশের কংকাল তুলে নিয়ে গুতমা শ্মশানে দাহ করে।
পাকিস্তানি বাহিনী, রাজাকার এবং কায়সার বাহিনীর হাতে যারা সেদিন হত্যার শিকার হন, তারা হলেন- গুতমা গ্রামের জীতেন্দ্র রায় (৪৫, সাধু), রসময় সূত্রধর (৫৫, গৃহস্থ), গুঞ্জন কর্মকার (৫৫), ফুল কিশোর (৪৫, গৃহস্থ), কুসুম লাল (৬০, কাঠমিস্ত্রি), দীনবন্ধু (৬০, গৃহস্থ), মহাদেব (৭০, গৃহস্থ), মধু (৭০, গৃহস্থ), রমাকান্ত (৬০, গৃহস্থ), বৈষ্ণব সাধু (৭০), নিশ্চিন্তপুরের প্রেমানন্দ (২১, গৃহস্থ) এবং মণীন্দ্র সরকার (৪০, গৃহস্থ)। গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত অবস্থায় গুতমা গ্রামের ধনঞ্জয় কয়েক বছর বেঁচে ছিলেন।
এছাড়া আগস্ট মাসের মাঝামাঝি সময়ে নিশ্চিন্তপুরের বিনোদ (৫৫) নামে একজন ভারতে যাবার পথে ইসলামপুরের কাছে পাকিস্তানি বাহিনীর গুলিতে নিহত হয়। তার লাশ উদ্ধার করা যায়নি। নিশ্চিন্তপুর ও গুতমায় লুটপাট, অগ্নিসংযোগ ও হত্যাকাণ্ডে পাকিস্তানি বাহিনীর সহযোগী হিসেবে যারা জড়িত ছিল, তাদের মধ্যে মধু রাজাকার, আবদাল মিয়া (শান্তি কমিটির সদস্য) আতাব আলী ও কায়সার মিয়ার (কায়সার বাহিনীর প্রধান) নাম জানা যায়। [জামিল ফোরকান]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৩য় খণ্ড