You dont have javascript enabled! Please enable it!

বীর বিক্রম গিয়াস উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী

গিয়াস উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী, বীর বিক্রম (জন্ম ১৯৪৩) বীর মুক্তিযোদ্ধা। তিনি ১৯৪৩ সালের ১লা সেপ্টেম্বর কুমিল্লা জেলার বরুরা উপজেলার পায়েলগাছা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম শামসুদ্দিন চৌধুরী এবং মাতার নাম আফছরের নেছা চৌধুরী। তিনি ১৯৫৮ সালে পায়েলগাছা মাল্টিলেটারাল হাইস্কুল থেকে মেট্রিকুলেশন, ১৯৬০ সালে ঢাকা কলেজ থেকে আইএসসি এবং ১৯৬৩ সালে একই কলেজ থেকে বিএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এ বছরই তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে ক্যাডেট| হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৬৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তিনি পশ্চিম পাকিস্তানের কাকুলস্থ মিলিটারি একাডেমি থেকে সফলতার সঙ্গে প্রশিক্ষণ শেষ করে কমিশন লাভ করেন এবং এবোটাবাদে ১৬ ফ্রন্টিয়ার ফোর্স রেজিমেন্টে যোগদান করেন।
১৯৬৯ সালে গিয়াস উদ্দিন আহমেদকে প্রেষণে ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস (ইপিআর)-এর ইন্টেলিজেন্স শাখার প্রধান হিসেবে ঢাকায় বদলি করা হয়। ১৯৭০ সালের জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ-এর অভাবনীয় জয়ের পর পাকিস্তানি সামরিক শাসক সকল বাঙালি ইন্টেলিজেন্স অফিসারকে তাঁদের পদ থেকে সরিয়ে দেয়। গিয়াস উদ্দিনকেও ১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ইপিআর-এর রাজশাহী সেক্টরের অধীন নওগাঁ উইং-এ সেকেন্ড-ইন-কমান্ড হিসেবে বদলি করা হয়।
২৫শে মার্চ রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ঢাকাসহ সারা দেশে ব্যাপক নৃশংস গণহত্যা ও নির্যাতন শুরু করলে এর প্রতিবাদে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে বাঙালি সামরিক, ইপিআর ও পুলিশ বাহিনীর সদস্য এবং ছাত্র-জনতা বিদ্রোহ করে প্রতিরোধযুদ্ধে অংশ নেয়। গিয়াস উদ্দিনও ২৬শে মার্চ তাঁর অধীনস্থ বাঙালি ইপিআর সদস্যদের নিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। তাঁর নেতৃত্বে থাকা ৬নং উইং (ব্যাটালিয়ন) ও ৭নং উইং-এর একটি কোম্পানি নিয়ে তিনি বৃহত্তর বগুড়া, রাজশাহী ও দিনাজপুর জেলায় দুর্বার প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। তাঁর বাহিনী নিয়ে তিনি ২৭শে মার্চ বগুড়া শহরে পৌঁছে সেখানে অবস্থিত পাক গোলন্দাজ বাহিনীকে হটিয়ে দেন এবং সেখানকার গোলা-বারুদের ডিপো দখলে নেয়ার ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। ৬ই এপ্রিল তাঁর নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা রাজশাহীতে ২৫ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের সৈন্যদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে রাজশাহী মুক্ত করেন। ১৩ই এপ্রিল পাকিস্তানি বাহিনীর বি-ইনফোর্সমেন্ট আসার পূর্ব পর্যন্ত তাঁর নেতৃত্বে রাজশাহী হানাদারমুক্ত ছিল। ২১শে এপ্রিল থেকে তিনি পদ্মার ওপারে ফরিদপুর জেলায় ঘাঁটি স্থাপন করেন এবং সেখান থেকে পাকসেনাদের বিরুদ্ধে অনেকগুলো অপারেশন পরিচালনা করেন।
সেক্টরভিত্তিক মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে গিয়াস উদ্দিন আহমেদ ৭নং সেক্টরের লালগোলা সাব-সেক্টর কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বৃহত্তর রাজশাহী অঞ্চলে তিনি অনেকগুলো দুঃসাহসিক অপারেশন পরিচালনা করেন। এজন্য পাকসেনাদের কাছে মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ‘টেরর’ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। উল্লেখ্য যে, সে-সময় পাকিস্তানি সেনা-শাসকরা তাঁকে হত্যার জন্য পঞ্চাশ হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছিল।
মহান মুক্তিযুদ্ধে অসাধারণ বীরত্ব ও সাহসিকতার স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশ সরকার গিয়াস উদ্দিন আহমেদ চৌধুরীকে ‘বীর বিক্রম’ খেতাবে ভূষিত করে (গেজেট নং ৮০, খেতাবের সনদ নং ৫)। মুক্তিযুদ্ধ শেষে তিনি তাঁর কর্মস্থল বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন এবং পর্যায়ক্রমে পদোন্নতি পেয়ে ১৯৭৭ সালে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল পদে উন্নীত হন। ১৯৮২ সালে কোনো কারণ দর্শানো ছাড়াই তাঁকে সেনাবাহিনী থেকে অবসর প্রদান করে তাঁর পদ বেসামরিক চাকরিতে ন্যস্ত করা হয় ৷ পরবর্তীতে তাঁর চাকরি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ন্যস্ত করা হয় ৷ তিনি সুদীর্ঘ ১৩ বছর রাষ্ট্রদূত হিসেবে অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুর, সুইডেন (একই সঙ্গে ডেনমার্ক, নরওয়ে, ফিনল্যান্ড ও আইসল্যান্ড) ও বাহরাইনে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন।
ব্যক্তিজীবনে গিয়াস উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী দুই কন্যা ও এক পুত্র সন্তানের জনক। তাঁর স্ত্রীর নাম মাহমুদা চৌধুরী। বর্তমানে তিনি অবসর জীবন যাপন করছেন। [সাজাহান মিয়া] গিয়াসউদ্দিন আহাম্মদ, বীর প্রতীক (১৯৪৩-২০০৪) হাবিলদার, পরবর্তীতে মেজর ও একজন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা। তিনি ১৯৪৩ সালের ৩রা জানুয়ারি কুমিল্লা জেলার কোতয়ালী উপজেলার চাঁন্দপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মো. বাদশা মিয়া এবং মাতার নাম চাঁন বানু।
গিয়াসউদ্দিন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সিগন্যাল কোরে ১৯তম ব্যাটালিয়নে কর্মরত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে তাঁর কর্মস্থল ছিল ঢাকায়। ২৫শে মার্চ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর গণহত্যা শুরু করলে তিনি মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। প্রথমে তিনি মেজর খালেদ মোশাররফ, বীর উত্তম- এর অধীনে ২ নম্বর সেক্টরে যুদ্ধ করেন। বিভিন্ন যুদ্ধে তিনি সাহসিকতার পরিচয় দেন। পরবর্তীতে ‘কে’ ফোর্স গঠিত হলে তিনি তাতে যোগ দেন। ১৪ই ডিসেম্বর কুমিল্লার হোমনা থানার পঞ্চবটি গ্রামের কাছে পাকিস্তানি সৈন্যদের বিরুদ্ধে সম্মুখ যুদ্ধে গিয়াসউদ্দিন আহাম্মদ আহত হন।
মহান মুক্তিযুদ্ধে সাহসিকতাপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক তাঁকে ‘বীর প্রতীক’ খেতাবে ভূষিত করা হয়। স্বাধীনতার পর তিনি মেজর পদমর্যাদায় উন্নীত হন। তিনি ২ কন্যা ও ৩ পুত্র সন্তানের জনক। তাঁর স্ত্রীর নাম সাবিহা বেগম। ২০০৪ সালের ৫ই এপ্রিল এ বীর মুক্তিযোদ্ধা মৃত্যুবরণ করেন। [হারুন রশীদ]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৩য় খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!