You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.03.31 | গাড়াগঞ্জ ব্রিজ প্রতিরোধযুদ্ধ (ঝিনাইদহ সদর) - সংগ্রামের নোটবুক

গাড়াগঞ্জ ব্রিজ প্রতিরোধযুদ্ধ (ঝিনাইদহ সদর)

গাড়াগঞ্জ ব্রিজ প্রতিরোধযুদ্ধ (ঝিনাইদহ সদর) সংঘটিত হয় ৩১শে মার্চ সকালে। এতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর মেজর শোয়েবসহ ৪০-৫০ জন হানাদার সৈন্য নিহত হয়।
ঝিনাইদহ সদর থেকে প্রায় ১২ কিলোমিটার উত্তরে কুমার নদীর ওপর নির্মিত গাড়াগঞ্জ ব্রিজ। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী যাতে ঝিনাইদহে প্রবেশ করতে না পারে সেজন্য গাড়াগঞ্জ ব্রিজে শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তোলা হয়। ২৫শে মার্চ রাতে যশোর সেনানিবাস থেকে ২৭তম বেলুচ রেজিমেন্টের অফিসারসহ দুই শতাধিক পাকিস্তানি সৈন্য ঝিনাইদহ হয়ে কুষ্টিয়া শহরে এসে অবস্থান গ্রহণ করে এবং প্রচুর ধ্বংসলীলা চালিয়ে কুষ্টিয়া শহরে ৩০ ঘণ্টার জন্য কারফিউ জারি করে। এর পরিপ্রেক্ষিতে চুয়াডাঙ্গা ইপিআর-এর ৪নং উইং-এর বাঙালি কমান্ডার মেজর আবু ওসমান চৌধুরীর নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা কুষ্টিয়া শত্রুমুক্ত করার এক দুঃসাহসিক পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করে ৩০শে মার্চ পাকবাহিনীর ওপর আক্রমণের তারিখ নির্ধারণ করা হয়। এ পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ২৮শে মার্চ যশোর-কুষ্টিয়া সড়কে শৈলকুপার কাছে গাড়াগঞ্জে অবরোধ করার জন্য এক কোম্পানি মুক্তিযোদ্ধা পাঠানো হয়। যশোর সেনানিবাস থেকে কুষ্টিয়ার পাকিস্তানি ঘাঁটিতে রি-ইনফোর্সমেন্ট অর্থাৎ অধিক সৈন্য ও অস্ত্র এলে তা প্রতিহত করা এবং কুষ্টিয়া থেকে পাকিস্তানি সৈন্যরা যশোর সেনানিবাসে যাতে ফিরে যেতে না পারে সে-পথ রুদ্ধ করাই ছিল এ প্রতিরোধের উদ্দেশ্য। এজন্য পানি উন্নয়ন বোর্ডের ইঞ্জিনিয়ার আবদুল লতিফের পরিকল্পনায় গাড়াগঞ্জ ব্রিজের দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তের রাস্তাটি গভীর করে খুঁড়ে তার ওপর চাটাই বিছিয়ে, চাটাইয়ের ওপর আলকাতরা ঢেলে অবিকল পাকা রাস্তার মতো করে ফাঁদ তৈরি করে রাখা হয়। স্থানীয় জনতা এ কাজটি করতে সার্বিক সহযোগিতা করে। মুক্তিযোদ্ধারা ব্রিজের উভয় প্রান্তের রাস্তার দুপাশে বাংকার খনন করে হানাদার বাহিনীকে প্রতিরোধ করার জন্য বাংকারে অবস্থান নেন। অধ্যাপক শফিকউল্লাহর নেতৃত্বে ৩০শে মার্চ সকাল থেকেই ১৪-১৫ জন পিএনসিসির অস্ত্র ট্রেনিংপ্রাপ্ত ছাত্র মুক্তিযোদ্ধা, কিছু ইপিআর মুক্তিযোদ্ধা ও কয়েকজন ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালি সেনা মুক্তিযোদ্ধা গাড়াগঞ্জ ব্রিজের দক্ষিণ পাশে বাঁশঝাড়ের আড়ালে অবস্থান নেন।
এদিকে ঝিনাইদহের ওপর যাতে সহজে আক্রমণ হতে না পারে সে বিষয় চিন্তা করে মেজর আবু ওসমান চৌধুরীর সহযোগিতায় এসডিপিও মাহবুব উদ্দিন আহমেদ ঝিনাইদহ সদর থানার অন্তর্গত দক্ষিণে বিষয়খালী বাজারে এক কোম্পানি, ঝিনাইদহের কালীগঞ্জে অপর এক কোম্পানি এবং সুবেদার মজিদ মোল্লার নেতৃত্বে কোর্টচাদপুরে দুই প্লাটুন মুক্তিযোদ্ধাকে প্রতিরক্ষায় মোতায়েন করেন।
৩০শে মার্চ মেজর আবু ওসমান চৌধুরীর নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা কুষ্টিয়া শহরের তিন দিক থেকে হানাদারদের ওপর আক্রমণ চালান। এতে পাকিস্তানি সৈন্যরা মারাত্মকভাবে পর্যুদস্ত হয়। তাদের অধিকাংশ সৈন্য নিহত হয়। কয়েকজন অফিসারসহ ৪০-৫০ জন হানাদার সৈন্য কিছু গোলাবারুদসহ মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে টিকে থাকতে না পেরে রাতের অন্ধকারে ২টি জিপ ও ২টি ডজগাড়িযোগে কুষ্টিয়া থেকে যশোর সেনানিবাসের উদ্দেশে ঝিনাইদহের দিকে পালিয়ে যেতে থাকে।
৩১শে মার্চ সকালে হানাদারদের বহনকারী দুটি জিপ গাড়াগঞ্জ ব্রিজের দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তে আসতেই গভীর গর্তে পড়ে যায়। একটি ঝুলন্ত অবস্থায় আটকে থাকে। সঙ্গে- সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধারা গুলি ছুড়তে থাকেন। খাদে পড়ে কয়েকজন হানাদার নিহত হয়। অন্যরা তাদের যানবাহন ফেলে পালানোর চেষ্টা করলে এলাকার মুক্তিকামী জনতা তীর-ধনুক, ফালা-বর্শা, ঢাল-সড়কি, দা-বটি ইত্যাদি নিয়ে পলায়নরত হানাদারদের ওপর আক্রমণ চালিয়ে তাদের হত্যা করে। এ-যুদ্ধে ২৭ বেলুচ রেজিমেন্টের মেজর শোয়েবও নিহত হয়। গাড়াগঞ্জ ব্রিজ প্রতিরোধযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে রহমত আলী মন্টু (খাজুরা), লুৎফর রহমান (চাঁদপুর), নায়েব আলী সরদার (দুধসর), কামালুজ্জামান কামাল (খালিশপুর), আবদুর রশিদ (কালিকাপুর), মোকাদ্দেস হোসেন (খাজুরা), রবিউল ইসলাম রবি (দুধসর), ওলিয়ার রহমান আলম (মাগুরা), ইবনে সউদ খোকন (বাকড়ি), মীর শাহাবুদ্দিন (গাড়াগঞ্জ), খ ম আমির আলী (গাড়াগঞ্জ), মোশারফ হোসেন (সেনাবাহিনী), ওসি বাদশা মিয়া (শৈলকুপা), আলম কাজী (শৈলকুপা), ওস্তাদ বিশারত আলী (শৈলকুপা), রফিকউদ্দিন শাহ (সেনাসদস্য), মুজাহিদ আবেদ আলী (গাড়াগঞ্জ) প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। এ-যুদ্ধে প্রচুর পরিমাণ অস্ত্র ও গোলাবারুদ মুক্তিযোদ্ধাদের হস্তগত হয়। [শফিউদ্দিন তালুকদার]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৩য় খণ্ড