You dont have javascript enabled! Please enable it!

মুক্তিযুদ্ধে গাংনী উপজেলা (মেহেরপুর)

গাংনী উপজেলা (মেহেরপুর) ষাটের দশকের শেষভাগে আওয়ামী লীগ এর ৬-দফা আন্দোলন সারা দেশে জনপ্রিয় হয়ে ওঠার সময় থেকে গাংনী উপজেলায় রাজনৈতিক সক্রিয়তা বৃদ্ধি হয় এবং ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান-এর পর আওয়ামী লীগ এ উপজেলায় অপ্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক শক্তিতে পরিণত হয়। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে তারই প্রতিফলন ঘটে। জাতীয় পরিষদ সদস্য হিসেবে মেহেরপুরের মোহাম্মদ শহীদ উদ্দীন এবং প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য হিসেবে গাংনীর মো. নূরুল হক নির্বাচিত হন। ৮ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ- রেডিওতে প্রচারিত হওয়ার পর এদিন বিকেল পাঁচটায় থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. নূরুল হক এমপিএ-র সভাপতিত্বে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ এক জরুরি বৈঠকে মিলিত হন। বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের তত্ত্বাবধানে প্রত্যেক ইউনিয়নে সংগ্রাম কমিটি গঠন করা হয় এবং সংগ্রাম কমিটির নেতৃত্বে জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। জনসাধারণকে মুক্তিসংগ্রামে উদ্দীপিত করতে এসব জনসভায় বক্তৃতা করেন মো. নূরুল হক এমপিএ, হিসাবউদ্দীন, জালাল উদ্দিন, আব্দুর রহমান, এনামুল হক, গোলাম রহমান, আবদুল গনি, আ ফ ম ইদ্রিস, আবদুর ওয়াহেদ মওলা, আবদুল আজিজ প্রমুখ আওয়ামী লীগ নেতা। মুক্তিযুদ্ধের প্রাথমিক প্রস্তুতি হিসেবে সংগ্রাম কমিটি সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করা, গ্রামে-গ্রামে ছড়িয়ে থাকা আনসার, মুজাহিদ, অবসরপ্রাপ্ত সৈনিক ও পুলিশ সদস্যদের একত্রিত করা, বিভিন্ন গ্রামের মালিকদের কাছ থেকে ব্যক্তিগত বন্দুক সংগ্রহ করে বন্দুক বাহিনী গঠন করা, স্থানীয় জলিল মিয়ার মিলঘরে কন্ট্রোল রুম খোলা, স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী কর্তৃক গ্রাম থেকে খাদ্য ও রসদ সংগ্রহ করে মজুদ করা ইত্যাদি পদক্ষেপ গ্রহণ করে। বন্দুক সংগ্রহে আওয়ামী লীগ নেতা হিসাবউদ্দীন, আফজালুল হক, নূরুল হুদা, আক্তারুজ্জামান অন্ড্রাম, আব্দুর রহমান এবং খোকন বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। এছাড়া ইসমাঈল ডাক্তার, শামসুদ্দীন পোস্টমাস্টার, জালালউদ্দিন ও আব্দুর রশিদ কন্ট্রোল রুমে দায়িত্ব পালন করার করেন। আর খাদ্য সংগ্রহে নেতৃত্ব দেন স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর রহমান মিয়া।
মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতিপর্ব পর্যন্ত রাজনৈতিক সংগঠনের ভূমিকা মুখ্য হলেও সুশিক্ষিত পাকাহিনীর মোকাবেলার জন্য একটি সামরিক সংগঠনও অনিবার্য হয়ে ওঠে। তাই কিছু সংখ্যক ইপিআর, পুলিশ, আনসার ও বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈনিক নিয়ে একটি সামরিক সংগঠন গঠন করা হয়, যদিও তাদের সামরিক সরঞ্জাম ছিল খুবই অপ্রতুল। মুক্তিযুদ্ধের প্রথম থেকেই দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ ছাত্র-যুবক ও কৃষক-শ্রমিকরা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণে আগ্রহী হয়ে ওঠে। তাদের অভ্যর্থনা ও প্রশিক্ষণের জন্য বাংলাদেশ সরকারের নেতৃবৃন্দ ভারতীয় সীমান্ত এলাকার বেশকিছু শহরে যুব অভ্যর্থনা ক্যাম্প এবং প্রশিক্ষণ কেন্দ্র চালু করেন। এসব ক্যাম্পের কোনো-কোনোটিতে সংগঠকের দায়িত্ব পালন করেন এ উপজেলার রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ। এরূপ কয়েকটি অভ্যর্থনা ক্যাম্প হলো-
বেতাই যুব অভ্যর্থনা ক্যাম্প: মেহেরপুরের আওয়ামী লীগ নেতা মোহাম্মদ শহীদ উদ্দীন এমএনএ, খাদেমুল ইসলাম, পটল মিয়া এবং গাংনীর নেতা হিসাবউদ্দীনের নেতৃত্বে ২১শে এপ্রিল মেহেরপুরের সীমান্তবর্তী ভারতীয় শহর বেতাইয়ে এ ক্যাম্পটি খোলা হয়। প্রধানত মেহেরপুরের ছাত্র-যুবকরা এখানে আশ্রয় নিলেও চুয়াডাঙ্গা, গাংনী ও কুষ্টিয়ার অনেকেও এখানে যুক্ত হয়। প্রথমে কয়েকজন সেনা এবং ইপিআর সদস্য এ ক্যাম্পে প্রাথমিক প্রশিক্ষণ দেন। পরে এ দায়িত্ব পালন করেন সোনাপুরের আনসার কমান্ডার আব্দুল ওয়াহেদ এবং নূর মোহাম্মদ।
শিকারপুর যুব অভ্যর্থনা ক্যাম্প: এপ্রিলের শেষ সপ্তাহে ভারতীয় সীমান্ত শহর শিকারপুরে নিয়মিত বাহিনীর এ্যাকশন ক্যাম্পের পাশাপাশি যুব অভ্যর্থনা ক্যাম্পও খোলা হয়। গাংনী থানাসহ বৃহত্তর কুষ্টিয়া জেলার ছাত্র-যুবকরা এখানে আশ্রয় ও প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে। এ ক্যাম্প পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন গাংনী থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. নূরুল হক এমপিএ এবং কুষ্টিয়া জেলার আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ। উল্লেখ্য, ৮ নম্বর সেক্টরের অধীন বেতাই (লাল বাজার) এবং শিকারপুরে পৃথক দুটি সাবসেক্টরের দপ্তর স্থাপন করা হয়। বেতাই সাবসেক্টরের অধিনায়ক ছিলেন এ আর আজম চৌধুরী, আর শিকারপুরে পর্যায়ক্রমে অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেন ক্যাপ্টেন আব্দুল হালিম, লেফটেন্যান্ট জাহাঙ্গীর আলম ও ক্যাপ্টেন তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী।
করিমপুর যুব অভ্যর্থনা ক্যাম্প: মে মাসের শুরুতে ভারতের থানা শহর করিমপুরে এ ক্যাম্প গড়ে তোলেন গাংনী থানা আওয়ামী লীগের নেতা হিসাবউদ্দীন, জালাল উদ্দিন, আব্দুর রহমান এবং কুষ্টিয়া জেলার নেতৃবৃন্দ। প্রধানত গাংনী থানার ছাত্র-যুবকরা এ ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে।
এসব ক্যাম্পে প্রাথমিক প্রশিক্ষণের পর নির্বাচিত মুক্তিযোদ্ধাদের উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য মে মাসের ৮ তারিখ থেকে বিহারের চাকুলিয়া এবং উত্তর ভারতের দেরাদুনে পাঠানো হয়। তারা মাত্র ছয় সপ্তাহের প্রশিক্ষণে চৌকস গেরিলা যোদ্ধা হয়ে দেশে প্রবেশ করেন। অবশিষ্টরা উপর্যুক্ত ক্যাম্পগুলোতে প্রাথমিক প্রশিক্ষণ শেষে মে মাসের শেষদিকে দেশে ফিরে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।
মুক্তিযুদ্ধকালে গাংনী উপজেলায় কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন আবুল কাশেম কোরাইশী (পিতা হাজী নূর মহাম্মদ কোরাইশী), আজগর আলী, আজমাইন হোসেন, তাহাজ উদ্দীন, মামুনুর রশিদ, আব্দুল ওহাব, আব্দুল হান্নান, আবু বকর, মহসিন আলী, সেকেন্দার আলী (পিতা আবুল হোসেন মল্লিক, চৌগাছা), আব্দুল হান্নান (হিন্দা), আব্দুর রহমান, আব্দুল হালিম প্রমুখ।
গাংনী উপজেলার তদানীন্তন জেলা শহর কুষ্টিয়ায় পাকবাহিনী ২৫শে মার্চ রাতে প্রবেশ করে। এর আগেই চুয়াডাঙ্গার ইপিআর প্রধান মেজর আবু ওসমান চৌধুরী, ঝিনাইদহের পুলিশ প্রধান মাহবুব উদ্দীন আহমেদ এবং মেহেরপুরের এসডিও তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী (মুক্তিযুদ্ধের সময় ‘ক্যাপ্টেন’ উপাধিপ্রাপ্ত) চুয়াডাঙ্গা-মেহেরপুরের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে পাকবাহিনীর সম্ভাব্য হামলা প্রতিরোধের উদ্দেশ্যে চুয়াডাঙ্গাকে হেডকোয়ার্টার্স করে গঠন করেন দক্ষিণ-পশ্চিম রণাঙ্গন। ২৬শে মার্চ রাতের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার খবর বিভিন্ন মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে পৌঁছে যায়। এসডিও তৌফিক-ই- এলাহী চৌধুরীর পরামর্শে ঐ রাতেই মহকুমা আওয়ামী লীগের সেক্রেটারি ইসমাঈল হোসেন গাংনী এসে আনসার- মুজাহিদসহ রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের রাস্তায় বেরিয়ে আসার এবং গাছ কেটে রাস্তায় বেরিকেড তৈরির আহ্বান জানান।
রাতেই জোড়পুকুরিয়ার আব্দুর রহমান এবং আকুবপুরের মাতু বিশ্বাসের নেতৃত্বে কুষ্টিয়া-গাংনী সংযোগসেতু (খলিসাকুণ্ডি কাঠের ব্রিজ) ধ্বংস করা হয়। গাংনী উপজেলার সীমান্তবর্তী তেঁতুলবাড়িয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নূরুল হুদা ও শাহাদৎ হোসেনের নেতৃত্বে একদল বিক্ষুব্ধ জনতা ২৭শে মার্চ সকালে তেঁতুলবাড়িয়া ইপিআর ক্যাম্পে গিয়ে পাকিস্তানের পতাকা নামিয়ে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করে। বিক্ষুব্ধ জনতার দ্বারা এদিন অবাঙালি ইপিআর সদস্য আকরাম খান আক্রান্ত হয়ে পরে মারা যায়।
মেজর আবু ওসমান চৌধুরী প্রমুখের নেতৃত্বে কুষ্টিয়াকে পাক হানাদারদের হাত থেকে মুক্ত করার লক্ষ্যে ৩০ ও ৩১শে মার্চ সংঘটিত হয় সফল প্রতিরোধযুদ্ধ। ইপিআর, পুলিশ, আনসার ও মুজাহিদদের সমন্বয়ে গঠিত মুক্তিবাহিনীর পাশাপাশি আপামর জনসাধারণও এ-যুদ্ধে অংশ নেয়। প্রকৃত অর্থেই ‘যার যা আছে তাই নিয়ে’ সাধারণ মানুষ রাস্তায় নেমে আসে, কুষ্টিয়া শহর ঘিরে ধরে চতুর্দিক থেকে। পাকবাহিনী সম্পূর্ণরূপে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। শেষপর্যন্ত তারা পরাজিত হয়ে যশোরে পালিয়ে যাওয়ার সময় ঝিনাইদহ মহকুমার গাড়াগঞ্জে পুনরায় প্রতিরোধের সম্মুখীন হয় এবং লেফটেন্যান্ট আতাউল্লাহ শাহ নামের একজন আহত অবস্থায় ধরা পড়ে, বাকি সবাই মারা যায়।
৩০ ও ৩১শে মার্চ সফল প্রতিরোধযুদ্ধের মধ্য দিয়ে কুষ্টিয়া দখলমুক্ত হলেও এ বিজয় দীর্ঘদিন ধরে রাখা যায়নি। ১৫ই এপ্রিল পাকসেনারা পুনরায় কুষ্টিয়া দখল করে এবং ১৫ ও ১৬ই এপ্রিল বিমান হামলা চালিয়ে চুয়াডাঙ্গা দখল করে নেয়।
ফলে মেহেরপুর-গাংনী থেকে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ ভারতে আশ্রয় নেন এবং মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু করেন। ১৮ই এপ্রিল মেহেরপুরে পাকবাহিনীর প্রথম অনুপ্রবেশ ঘটলেও গাংনীতে আসে ২১শে এপ্রিল সকাল দশটায়। এদিন গাংনী থানা সদর ও তদসংলগ্ন গ্রামে হত্যা ও ত্রাসের রাজত্ব সৃষ্টি করে মেহেরপুর কলেজ ক্যাম্পে ফিরে যায়। এপ্রিল মাসের শেষ নাগাদ পাকবাহিনী গাংনী উপজেলার বামুন্দি, কাথুলি, ভাটপাড়া, সাহেবনগর এবং থানা পরিষদের স্টাফ কোয়ার্টার্সে ক্যাম্প স্থাপন করে। বামুন্দি এবং কাথুলিতে ক্যাম্প স্থাপনের সময় তারা সাধারণ মানুষের ঘরের চালের টিন জোর করে খুলে নেয়। বাংকার খননের জন্য বিভিন্ন গ্রাম থেকে লোক ধরে আনে এবং তাদের ওপর অত্যাচার-নির্যাতন চালায়।
গাংনীতে প্রথম প্রবেশের (২১শে এপ্রিল) পথে পাকবাহিনী গাঁড়াডোব গ্রামে হামলা চালিয়ে মহসিন খন্দকারের ছেলে গোলাম রসুল কিদুকে হত্যা করে। এই কিদুই গাংনী উপজেলার প্রথম শহীদ। হানাদার বাহিনী গাংনীতে এসে বিভিন্ন পাড়ায় ফাঁকা গুলি ছুড়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করে। থানাপাড়ার অমূল্য বৈরাগীকে গুলি করে হত্যা করে।
মে মাসের প্রথমার্ধে গাংনীর শামসুদ্দীন আহমদকে সভাপতি, মজিবর রহমান মাস্টারকে সেক্রেটারি (বাঁশবাড়িয়া), নিজাম মাস্টারকে জয়েন্ট সেক্রেটারি এবং নৈমদ্দিন মিয়া (চেংগাড়া), আইজদ্দিন বিশ্বাস (জোড়পুকুর) প্রমুখকে সদস্য করে শান্তি কমিটি গঠিত হয়। এদের অধিকাংশই ছিল জামায়াতে ইসলামী-র সদস্য। দাউদ মিয়াসহ কয়েকজন ছিল মুসলিম লীগ-এর সমর্থক। যুদ্ধের শুরু থেকেই এরা গ্রামে-গ্রামে শান্তি কমিটি গঠন ও রাজাকার বাহিনীর জন্য লোক সংগ্রহের অভিযান শুরু করে। অনেককে ভয়ভীতি দেখিয়ে রাজাকার বাহিনীতে ভর্তি করায়। পাকবাহিনী রাজাকারদের সঙ্গে নিয়ে গ্রামে-গ্রামে গিয়ে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। মুক্তিযুদ্ধের সমর্থক অথবা মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দেয়ার অভিযোগে রাজাকাররা বিভিন্ন গ্রাম থেকে নিরীহ মানুষদের ধরে এনে আর্মি ক্যাম্পে তুলে দেয়। আবার পাকসেনাদের সঙ্গে নিয়ে তারা বিভিন্ন গ্রামে একযোগে হামলা চালিয়ে অগ্নিসংযোগ, লুটপাট ও নারী-নির্যাতন করে।
পাকবাহিনী ও তাদের দোসররা মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে গাংনী উপজেলায় চারটি গণহত্যা চালায়- কাজীপুর গণহত্যা, তেরাইল গণহত্যা, টেপুর মাঠ গণহত্যা, জোড়পুকুরিয়া গণহত্যা। ৩০শে মে ও ২রা জুন সংঘটিত কাজীপুর গণহত্যায় ১৬ জন গ্রামবাসী শহীদ হয়। তেরাইল গণহত্যায় (১৮ ও ১৯শে জুলাই) ৯ জন গ্রামবাসী শহীদ হয়। ১৫ই অক্টোবর টেপুর মাঠ গণহত্যায় ৮ জন এবং ২৮শে জুলাই জোড়পুকুরিয়া গণহত্যায় প্রায় পাঁচশ ভারতগামী শরণার্থী শহীদ হয়।
গাংনী উপজেলায় পাকবাহিনীর নির্যাতনকেন্দ্রগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে— বামুন্দি ক্যাম্প, ভাটপাড়া ক্যাম্প, গাংনী থানা পরিষদ ক্যাম্প এবং কাথুলি ক্যাম্প। এর মধ্যে বড় নির্যাতনকেন্দ্র ছিল বামুন্দির তহশিল অফিস ও প্রাইমারি স্কুল ক্যাম্প। দ্বিতীয়টি ছিল ভাটপাড়া কুঠি। এ-দুটি স্থানে বন্দিশিবিরও ছিল। এলাকার বহু নিরীহ মানুষ, ভারতগামী শরণার্থী এবং আটকে পাড়া মুক্তিযোদ্ধাদের বন্দি করে এখানে নির্মমভাবে নির্যাতন করা হয়। অনেককে হত্যা করা হয়। বিজয় লাভের পর এসব নির্যাতনকেন্দ্রের আশপাশে বহু মানুষের হাড়গোড় ও মাথার খুলি পাওয়া যায়। এ-দুটি কেন্দ্রে বহু নারীর ওপর নির্যাতন চালানো হয়।
গাংনী উপজেলায় বেশ কয়েকটি স্থানে হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে। তার মধ্যে বধ্যভূমি হিসেবে প্রধানত দুটি স্থানকে চিহ্নিত করা হয়— বামুন্দি প্রাইমারি স্কুল বধ্যভূমি ও ভাটপাড়া কুঠি বধ্যভূমি। এছাড়া টেপুর মাঠ ও তেরাইল প্রাইমারি স্কুলেও হত্যাকাণ্ড চালানো হয়। উপজেলায় চারটি গণকবরের সন্ধান পাওয়া গেছে— কাজীপুর গণকবর (৬ জন শহীদের কবর), টেপুর মাঠ গণকবর (৮ জন শহীদের কবর), বামুন্দি প্রাইমারি স্কুল গণকবর (অসংখ্য মানুষের কবর) এবং ভাটপাড়া কুঠি গণকবর (অসংখ্য মানুষের হাড়গোড় পাওয়া গেছে)।
গাংনী উপজেলায় পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর সংঘটিত উল্লেখযোগ্য যুদ্ধগুলো হলো- রামনগরের যুদ্ধ, তেঁতুলবাড়িয়ার যুদ্ধ, কাজীপুরের যুদ্ধ, পাগলার পুলের যুদ্ধ ও বামুন্দি ক্যাম্প যুদ্ধ। রামনগরের যুদ্ধ সংঘটিত হয় ১৮ই আগস্ট হাবিলদার আজগর আলীর নেতৃত্বে। এতে পাকসেনাদের প্রায় সবাই নিহত হয়। তেঁতুলবাড়িয়ার যুদ্ধ সংঘটিত হয় ২২শে সেপ্টেম্বর। এতে ২ জন পাকসেনা নিহত ও ৩ জন আহত হয় এবং বাকি পাকসেনা ও রাজাকাররা পালিয়ে যায়। হানাদারদের বেশকিছু অস্ত্র ও গোলাবারুদ মুক্তিযোদ্ধাদের হস্তগত হয়। কাজীপুরের যুদ্ধ সংঘটিত হয় ২৬শে সেপ্টেম্বর। ৩ ঘণ্টা ব্যাপী এ-যুদ্ধে ২ জন পাকসেনা ও ৪ জন রাজাকার নিহত হয় এবং কাজীপুরের একজন মহিলা আহত হন। পাগলার পুলের যুদ্ধ সংঘটিত হয় ৪ঠা নভেম্বর। এ-যুদ্ধে ৫ জন পাকসেনা নিহত হয়। কিন্তু পাকসেনাদের পাল্টা আক্রমণে মুক্তিযোদ্ধারা পিছিয়ে আসতে বাধ্য হন। বামুন্দি ক্যাম্প যুদ্ধ সংঘটিত হয় ৬ই ডিসেম্বর। এতে বেশ কয়েকজন পাকসেনা হতাহত হয়।
এরপর বিভিন্ন ক্যাম্পের পাকসেনারা রাতের অন্ধকারে মেহেরপুর চলে গেলে ৮ই ডিসেম্বর গাংনী থানার পুলিশ আত্মসমর্পণ করে এবং গাংনী থানা হানাদারমুক্ত হয়। গাংনী উপজেলার শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- শাফাতুল্লাহ (পিতা আফেলউদ্দীন, গাড়াবাড়িয়া, আনসার সদস্য; ১৪ই এপ্রিল ঝিনাইদহের বিষয়খালিতে প্রতিরোধযুদ্ধে শহীদ), আব্দুস সাত্তার (পিতা জাফর মণ্ডল, পীরতলা, ইপিআর সদস্য; জুলাই মাসের শেষ সপ্তাহে সাতক্ষীরার শ্রীপুরে সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ), আব্দুল জলিল (পিতা খবির উদ্দীন, চৌগাছা, আনসার সদস্য; আগস্টের মাঝামাঝি নিজ বাড়ি থেকে এ্যাকশন ক্যাম্পে যাবার পথে হিজলবাড়িয়ার কাছে পাকসেনাদের গুলিতে শহীদ), একরামুল হক ছোট (পিতা হাফিজ উদ্দীন বিশ্বাস, চৌগাছা, ছাত্র; ১০ই সেপ্টেম্বর কাঁঠালপোতার শান্তি কমিটির নেতা আব্দুল জলিলের গুলিতে শহীদ), পাঞ্জাব আলী (পিতা খোকা শেখ, কাজীপুর; মাইন অপসারণ করতে করতে গিয়ে শহীদ), হারেজ উদ্দীন (পিতা তুস্টু মণ্ডল, চৌগাছা; নিজ বাড়িতে রাজাকারদের হাতে শহীদ), খবিরউদ্দিন (পিতা রহিম বক্স, রাধাগোবিন্দপুর), সিপাহি রহিতুল্লাহ (পিতা রহিম বক্স, রাধাগোবিন্দপুর), ওমর শাহ (পিতা খোকন শাহ, তেরাইল), নায়েক সুবেদার আবুল কাশেম, হাবিলদার আব্দুস সালাম এবং সিপাহি আসাদুজ্জামান (ইপিআর সদস্য; সাহেবনগরে পাকবাহিনীর অতর্কিত হামলায় শহীদ)।
মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতি রক্ষার্থে উপজেলার টেপুর মাঠ গণকবর ও কাজীপুর গণকবরের ওপর দুটি স্মৃতিফলক নির্মিত হয়েছে। কুলবাড়িয়া গ্রামে মুক্তিযোদ্ধা হারেজ উদ্দীনের নামে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে শহীদ হারেজ উদ্দীন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। বাওট গ্রামে মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল গনির নামে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল গনি কলেজ। [রফিকুর রশীদ]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৩য় খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!