You dont have javascript enabled! Please enable it! যুদ্ধাপরাধীদের বিচার-আবদুস সুবহান - সংগ্রামের নোটবুক

যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে প্রতিক্রিয়া

একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় আবদুস সুবহান পাবনা জেলা জামায়াতের আমীর ছিলাে। তার নেতৃত্বেই পাবনা জেলার বিভিন্ন এলাকায় হত্যা, গণহত্যা, লুটপাট চালায় রাজাকার, আলবদর বাহিনী। সুবহানের নেতৃত্বে পাবনার ঈশ্বরদীর তেলডিপাে, গােপালপুর, যুক্তিতলা গ্রামে নজনকে হত্যা করা হয়। গণহত্যা চালানাে হয় সাতবাড়িয়া, আটঘরিয়া এবং আতাইকুলা গ্রামে। মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরােধী সুনির্দিষ্ট অভিযােগে ২০১২ সালের ২০ সেপ্টেম্বর তাকে গ্রেফতার করা হয়। ২০১৪ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর সুবহানের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযােগ আমলে নেন ট্রাইব্যুনাল। ৩১ ডিসেম্বর তার বিরুদ্ধে অভিযােগ গঠন করা হয়। জামায়াতের এ নেতার বিরুদ্ধে গণহত্যা, হত্যা, অপহরণ, আটক, নির্যাতন, লুটপাট, অগ্নিসংযােগ। ও ষড়যন্ত্রসহ ৮ ধরনের ৯টি মানবতাবিরােধী অপরাধের কথা উল্লেখ রয়েছে।

ইতিহাসের দায় মেটালাে বাংলাদেশ নূরজাহান বেগম মুক্তা সাবেক প্রসিকিউটর, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ পাকিস্তানি হানাদার মুক্ত হবার ১ মাস ০৮ দিনের মাথায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি যুদ্ধাপরাধ বিষয়ক একটি আদেশ জারি করেন। এর শিরােনাম ছিল, বাংলাদেশ কলাবরেটস (স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল) অর্ডার, ১৯৭২। এটি জারী হয় ২৪ জানুয়ারি ১৯৭২। অতঃপর শান্তি কমিটি, রাজাকার, আল-বদর, আল-শামসের মােট ৩৭৪৭১ জনকে গ্রেফতার করা হয়, তবে যেসব ব্যক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের সুনির্দিষ্ট অভিযােগ নেই তাদের জন্য বাংলাদেশ সরকার সাধারণ ক্ষমা ঘােষণা করেন। এই ঘােষণায় স্পষ্ট করে বলা হয় যে, রাষ্ট্রদ্রোহিতা, ধর্ষণ, খুনের চেষ্টা, অগ্নিসংযােগ, অপহরণ প্রভৃতি ১৮ ধরনের অপরাধের দায়ে দণ্ডিত ও অভিযুক্তদের ক্ষমা প্রদর্শন করা হবে না। সাধারণ ক্ষমা ঘােষণার পর আটক ৩৭৪৭১ ব্যক্তির মধ্যে প্রায় ২৬,০০০ ছাড়া পায়। বাকি ১১ হাজারেরও বেশি ব্যক্তি কারগারে আটক ছিল এবং তাদের বিচার কার্যক্রম চলমান ছিল। ট্রাইব্যুনালে মৃত্যুদণ্ডসহ বিভিন্ন মেয়াদে দণ্ড প্রদান করা হয়। পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধী ও তাদের সহযােগীদের বিচারের জন্য ১৯৭৩ সালের ২০ জুলাই আন্ত র্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন পাশ করা হয়।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বাংলাদেশের জঘন্যতম হত্যাযজ্ঞ সংঘটিত হয়। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর। রহমানকে স্বপরিবারে হত্যা করা হয়। অতঃপর ১৯৭৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর বাংলাদেশের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ও সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে বাংলাদেশ কলাবরেটরস (স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল) রিপিল অর্ডিন্যান্স, ১৯৭৫ জারি করেন। ফলে ট্রাইব্যুনাল ও আদালতে যত মামলা বিচারাধীন ছিল, মামলার পুলিশি তদন্ত ও অন্যান্য কার্যক্রম সব কিছুই নিস্ক্রিয় ও বাতিল হয়ে যায়। সেনাশাসক জিয়াউর রহমান ক্ষমতা দখলের পর অবৈধভাবে দালাল আইন বাতিল করেন এবং গােলাম আযমসহ আরাে অনেককে পাকিস্তানি পাসপাের্ট নিয়ে বাংলাদেশে এসে রাজনীতি করার অনুমতি ও সুযোগ দিয়েছিলাে। সাম্প্রদায়িক ও ধর্মভিত্তিক রাজনীতির উপর। যে নিষেধাজ্ঞা ছিল, জিয়াউর রহমান তা বাতিল করার ফলে জামায়াত তথা যুদ্ধাপরাধী ঘাতক দলটি আবার রাজনীতি করার সুযােগ পায়। ধর্মভিত্তিক রাজনীতি করার বিষবৃক্ষটি রােপন করেন জিয়াউর রহমান। শুধু রােপন করেই ক্ষান্ত হন নি।
নিয়মিত সার দিয়ে, পানি দিয়ে, আলাে দিয়ে, ছায়া দিয়ে এটিকে পরিপুষ্ট করে। তােলেন । জিয়াউর রহমানের স্ত্রী, সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াও একই। ভাবে ক্ষমতায় এসে সেই যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরােধী অপরাধীদেরকে মন্ত্রী বানিয়ে তাদের গাড়িতে পতাকা তুলে দিয়ে একেবারে ষােলােআনার উপরে আঠারাে আনা পূর্ণ করেন। ইতিমধ্যে বেশ কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় মানবতাবিরােধী অপরাধীর বিরুদ্ধে রায় । ঘােষিত হয়েছে। অন্যদের বিচার চলছে। আপীলেট ডিভিশনে কিছু মামলা শুনানি নর অপেক্ষায় আছে। তবে সবচেয়ে আশা ও প্রাপ্তি এবং অর্জন হলাে, ইতিমধ্যে একজনের ফাসির রায় কার্যকর হয়েছে। এর মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশ আইনের শাসন ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় এক অনন্য উচ্চতায় উপনীত হয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশে মানবতাবিরােধী অপরাধের যে বিচার চলছে পৃথিবীতে যত । যুদ্ধপরাধীর ট্রায়াল হয়েছে সবগুলাের থেকে অনেক বেশি আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন এবং স্বচ্ছ। এই বিচার শুরু হওয়ার পর বিদেশ থেকে পর্যবেক্ষকরা বাংলাদেশ। এসে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এক্ট ও রুলস সম্পর্কে সন্তোষ প্রকাশ। করেছেন। একমাত্র আমাদের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এক্টেই আপীলের বিধান আছে। এছাড়া বিচার প্রকাশ্য আদালতে হচ্ছে গণমাধ্যম তা অবাধে প্রত্যক্ষ করছে, আসামিরা তাদের পছন্দমতাে আইনজীবী নিয়ােগ করে সকল আইনি সুবিধা পাচ্ছেন। অতত্রব স্বচ্ছতা ও মানের দিক দিয়ে এই বিচার অবশ্যই আন্তর্জাতিক মানের। কথা উঠেছে, তকালীন বাংলাদেশ সরকার ১৯৫ জন পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধীকে বিচার না করে পাকিস্তানে ফেরত পাঠানাে প্রসঙ্গে। এটা নিয়েও ঘােলা পানিতে মাছ শিকারে কম চেষ্টা হয়নি। ঐ সময়ে প্রায় চার লক্ষ বাঙালি পাকিস্তানে বন্দি অবস্থায় ছিল। তাদের পরিবারের সদস্য ও আত্মীয়-স্বজনরা সেই বাঙালিদের। ফিরিয়ে আনার জন্য বঙ্গবন্ধুর কাছে গিয়েছিল, কান্নাকাটি করেছিল, রাস্তায়ও নেমেছিল। ১৯৭৪ সালের ৯ এপ্রিল নয়াদিল্লিতে বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে একটি ত্রিপক্ষীয় চুক্তি হয়েছিল।
এই চুক্তির অধীনে বাংলাদেশ সরকার ১৯৫ জন যুদ্ধবন্দীকে বিচার না করে পাকিস্তানে ফেরত পাঠাতে সম্মত হয়। তখনকার পাকিস্তান সরকার বলেছিল যে, তারা ঐ ১৯৫জন যুদ্ধবন্দীর বিচার তাদের দেশে নিয়ে গিয়ে করবে। যদিও আজো সেই বিচার করেনি, ১৯৭৪ সালের ত্রিপক্ষীয় চুক্তিটি বাংলাদেশের জন্য একটি আন্তর্জাতিক চুক্তি। বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী কোনাে আন্তর্জাতিক চুক্তির বৈধতা প্রশ্নে সংসদের সম্মতি গ্রহণ করা আবশ্যক নয়, তবে যদি কোনাে আন্তর্জাতিক চুক্তির অধীনে প্রতিষ্ঠিত দায়বদ্ধতা বাংলাদেশের প্রচলিত আইনের পরিপন্থী হয়, তবে সেই আন্তর্জাতিক চুক্তিকে অবশ্যই সংসদে আইন হিসেবে পাশ করিয়ে নিতে হবে। ১৯৭৪-এর ত্রিপক্ষীয় চুক্তি বাংলাদেশের সংসদে কখনই আলােচিত হয় নি, তাছাড়া এই চুক্তিটি বাংলাদেশের প্রচলিত আইন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালস) আইন ১৯৭৩-এর পরিপন্থী। সঙ্গত কারণেই বাংলাদেশের কোনাে আদালত ১৯৭৪ সালের ত্রিপক্ষীয় চুক্তিটি প্রয়ােগে বাধ্য নয়। ফলে বর্ণিত ১৯৫জন পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দীর বিচার আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন, ১৯৭৩-এর অধীনে করা সম্ভব। সেদিন হয়তাে বেশি দূরে নয়, যখন আমরা দেখবো যে, ১৯৫জন পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দীর বিচারও এই বাংলার মাটিতে শুরু হবে। সেদিনের প্রত্যাশায় রইলাম।

সূত্র : ফিরে-দেখা-৭১-যুদ্ধাপরাধীদের-বিচার-সুজন-হালদার