You dont have javascript enabled! Please enable it!

গাভা-নরেরকাঠি গণহত্যা (বানারীপাড়া, বরিশাল)

গাভা-নরেরকাঠি গণহত্যা (বানারীপাড়া, বরিশাল) ২রা মে সংঘটিত হয়। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর এ নৃশংস গণহত্যায় শতাধিক মানুষ শহীদ হন।
গাভা ও নরেরকাঠি গ্রামদুটি বরিশাল জেলার বানারীপাড়া উপজেলার ৭নং বানারীপাড়া ইউনিয়নে অবস্থিত। ২রা মে রবিবার দুপুর ২.৩০ মিনিটে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী গাভা ও নরেরকাঠির নিরীহ মানুষদের ওপর এক নির্মম হত্যাযজ্ঞ চালায়। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর একদল ঝালকাঠি- পিরোজপুর থেকে এবং অন্যদল বরিশাল থেকে বানারীপাড়া থানা হয়ে গাভা গ্রামে প্রবেশ করে। এ-সময় নিরাপদ স্থান মনে করে গাভায় বহু দূরের মানুষও আশ্রয় নিয়েছিল। হিন্দু প্রধান এ অঞ্চলে তখনো মুক্তিযোদ্ধাদের তৎপরতা শুরু হয়নি। পাকিস্তানি বাহিনীর হিন্দু নিধনের পরিকল্পনা থেকেই গাভা-নরেরকাঠি গণহত্যা সংঘটিত হয়। শান্তি কমিটি র নেতা গাভা-রামচন্দ্রপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ফজলে আলী সিকদারের সহযোগিতায় পাকিস্তানি বাহিনী হিন্দু প্রধান গাভা ও নরেরকাঠি এলাকায় গণহত্যার ছক করছিল। এক সভার মাধ্যমে শান্তি কমিটি গঠন করা হবে বলে পাকিস্তানি বাহিনী গ্রাম থেকে বেছে-বেছে মানুষজনকে নরেরকাঠি সরকার বাড়ির নিকট খালের পাড়ে নিয়ে আসে। যুদ্ধের বিভীষিকার মধ্যে শান্তির কথা শুনে গাভা ও নরেরকাঠি গ্রামের অনেকেই পাকিস্তানি বাহিনীর সামনে আসে। এরপর পাকিস্তানি বাহিনী সকলকে লাইনে দাঁড় করিয়ে ২৫ মিনিট ধরে গুলি বর্ষণ করে এ হত্যাকাণ্ড চালায়। নরেরকাঠি গ্রামের কমলা রাণী রায় চৌধুরীর বাড়িতে বিভিন্ন স্থান থেকে মানুষ এসে আশ্রয় নিয়েছিল। তাদেরও পাকিস্তানি বাহিনী ধরে এনে হত্যা করে। এ গণহত্যার প্রত্যক্ষদর্শী সুখরঞ্জন সরকার (গাভা হাইস্কুলের সিনিয়র শিক্ষক)। এক সপ্তাহ ধরে লাশগুলো পানিতে ভাসতে থাকলেও কেউ সামনে যেতে সাহস করেনি। পরবর্তীতে গন্ধে টিকতে না পেরে স্থানীয় যাদব, গেরদে আলী সিকদার, প্রহ্লাদ সমাদ্দার ও সুধীর রায়সহ অনেকে মিলে আটকে থাকা লাশগুলো মাটিচাপা দেয়।
পাকিস্তানি বাহিনী গাভা-নরেরকাঠিতে শতাধিক গ্রামবাসীকে হত্যা করে। নিহতদের অনেকেই দূর-দূরান্ত থেকে এসে এ গ্রামে আশ্রয় নিয়েছিল বলে অনেকেরই নাম-পরিচয় জানা যায়নি। গণহত্যায় শহীদ ৫৮ জনের পরিচয় জানা গেছে। তারা হলেন— লোকনাথ সরকার (৪৫) (পিতা কার্তিক চন্দ্ৰ সরকার, নরেরকাঠি), বিনোদ বিহারী মণ্ডল (৫৫) (পিতা ছুডু মণ্ডল, নরেরকাঠি), সুনিল মিস্ত্রী (২২) (পিতা সখানাথ মিস্ত্রী, নরেরকাঠি), রাধেশ্যাম মণ্ডল (১৮) (পিতা নীলকান্ত মণ্ডল, নরেরকাঠি), উপেন্দ্রনাথ হাওলাদার (৬০) (পিতা পূর্ণচন্দ্ৰ হাওলাদার, গাভা), মনোরঞ্জন হাওলাদার (২৫) (পিতা উপেন্দ্রনাথ হাওলাদার, গাভা), অক্ষয় চন্দ্র হাওলাদার (২৫) (পিতা লক্ষ্মীকান্ত হাওলাদার, গাভা), শরৎচন্দ্র সমদ্দার (৫৮) (পিতা কালীচরণ সমদ্দার, গাভা), রাজেন বেপারী (২৫) (পিতা রাম বেপারী, গাভা), হরলাল বণিক (২০) (পিতা রাজেন্দ্র নাথ বণিক, গাভা), নকুল চন্দ্ৰ বণিক (৭০) (পিতা অম্বিকা চরণ বণিক, গাভা), রঙ্গলাল বণিক (২২) (পিতা রাজেন্দ্র নাথ বণিক, গাভা), কার্তিক চন্দ্ৰ ঋষি (৪৮) (পিতা লেদু ঋষি, গাভা), কমল চন্দ্র বণিক (২০) (পিতা নারায়ণ চন্দ্র বণিক, গাভা), রমেশ চন্দ্র কর্মকার (৬৮) (গাভা), অবিনাশ চন্দ্র বাড়ৈ (২৫) (পিতা জ্ঞানেন্দ্রনাথ বাড়ৈ, গাভা), হরেকৃষ্ণ রাজ (পিতা হেমন্ত কুমার রাজ, গাভা), গোপাল রায় (৬০) (পিতা গঙ্গাচরণ রায়, গাভা), শ্যাম বড়াল (২৪) (পিতা রাখাল চন্দ্র বড়াল, গাভা), গোপীনাথ বাড়ৈ (৩০) (পিতা বেচারাম বাড়ৈ, চাউলাকাঠি), রবিন মুড়ি (৪০) (পিতা দেবেন মুড়ি, গাভা), হরি ঘরামি (৩৫) (পিতা লালু ঘরামি, গাভা), সবিতা রানী বাড়ৈ (৮) (পিতা সুধীর বাড়ৈ, গাভা), গুনমনি হাওলাদার (৭০) (স্বামী রসিক চন্দ্র হাওলাদার, গাভা), মনি রানী হাওলাদার (৫২) (স্বামী উপেন্দ্রনাথ হাওলাদার, গাভা), দেবেন দেউড়ী (৪০) (পিতা নিশীকান্ত দেউড়ী, গাভা), কালাচাঁদ সাহা (৪৫) (পিতা বসন্ত কুমার সাহা, গাভা), ফুল সোনা দেউড়ী (৪০)(স্বামী কুঞ্জ বিহারী দেউড়ী, গাভা), দিলীপ কুমার সমদ্দার (২৫) (পিতা জিতেন্দ্ৰ নাথ সমদ্দার, গাভা), শশী কুমার দাস (৪৭) (পিতা গঙ্গা চরণ দাস, গাভা), উপেন দাস (৪২) (পিতা নসাই দাস, গাভা), সুশীল দাস (৪৫) (পিতা শরৎ . দাস, গাভা), আব্দুর রব তালুকদার (৬২) (পিতা করিমুদ্দিন তালুকদার, গাভা), আশ্রাব আলী হাওলাদার (৪০) (পিতা জবেদ আলী হাওলাদার, গাভা), মুনসুর হাওলাদার (৪০) (পিতা হুজ্জত আলী হাওলাদার, গাভা), আহম্মদ আলী মৃধা (২২) (পিতা আসিক মৃধা, গাভা), সেকেন্দার প্যাদা (৪৫) (পিতা বুলু প্যাদা, গাভা), নিরঞ্জন সাধক (২৫) (পিতা বসন্ত কুমার সাধক), নারায়ণ চন্দ্র বাড়ৈ (৪২) (পিতা অশ্বিনী বাড়ৈ, গাভা), সারদা ঘরামী (৫৫) (স্বামী ললিত ঘরামী, গাভা), মধু ঘরামী (৪৮) (গাভা), প্রফুল্ল বালা দাস (৬২) (স্বামী ভোলানাথ দাস, গাভা), ক্ষিরোদা বাড়ৈ (৬০) (স্বামী অশ্বিনী কুমার বাড়ৈ, গাভা), গোলাপ বাড়ৈ (৫৮) (স্বামী কেদার বাড়ৈ, গাভা), নিশীকান্ত বাড়ৈ (৬৫) (গাভা), যজ্ঞেস্বর ঘরামী (৫৫) (পিতা লালু ঘরামী, গাভা), ফণীমোহন ঘোষ (৭২) (পিতা রসিক চন্দ্র ঘোষ, গাভা), সরজনী বাড়ৈ (৬০) (স্বামী অশ্বিনী কুমার বাড়ৈ, গাভা), বিল্ববাসিনী মিস্ত্রী (৩০) (স্বামী গৌরাঙ্গ মিস্ত্রী, গোয়ালকান্দা), শুকলাল মণ্ডল (২৪) (পিতা মহেন্দ্ৰ নাথ মণ্ডল, আটঘর), মহাদেব মল্লিক (৩৫) (পিতা হরনাথ মল্লিক, সুলতানপুর, পিরোজপুর), আকিমোন্নেছা (৪০) (স্বামী সেকেন্দার প্যাদা, গাভা), সামছুন্নাহার (৪৫) (স্বামী আব্দুল মজিদ, গাভা), মোহাম্মদ আলী ফকির (৬৫) (পিতা সোনামদ্দিন ফকির, বেরমহল, ঝালকাঠী), মোহাম্মদ আলী রাঢ়ী (২৭) (পিতা আমিন উদ্দিন রাঢ়ী, বেরমহল, ঝালকাঠী), প্রফুল্ল কুমার নাথ (৩৫) (পিতা অনন্ত কুমার নাথ, গাভা), কামিনী বাড়ৈ (৭৫) (পিতা ভোলানাথ বাড়ৈ, নরেরকাঠি)। [মনিরুজ্জামান শাহীন]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৩য় খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!