বীর প্রতীক গাজী আব্দুস সালাম ভূঁইয়া
গাজী আব্দুস সালাম ভূঁইয়া, বীর প্রতীক (জন্ম ১৯৪১) ১১নং সেক্টরের বীর মুক্তিযোদ্ধা, সামরিক পেশাজীবনে নৌসেনা ও মুক্তিযুদ্ধকালে কোম্পানি কমান্ডার। তিনি ১৯৪১ সালে ময়মনসিংহ জেলার নান্দাইল উপজেলার নান্দাইল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম শহীদ শাহনেওয়াজ ভূঁইয়া এবং মাতার নাম হালিমা খাতুন। পিতা শাহনেওয়াজ ভূঁইয়া মহান মুক্তিযুদ্ধে রাজাকার- আলবদরদের হাতে শহীদ হন।
গাজী আব্দুস সালাম ভূঁইয়া পাকিস্তান নৌবাহিনীতে চাকরি করতেন। ১৯৭১ সালে তিনি পশ্চিম পাকিস্তানে যুদ্ধজাহাজ পিএনএস মুন্সীফে কর্মরত ছিলেন। চাকরিকালীন সময়ে তিনি পাকিস্তানি সামরিক জান্তার বৈষম্যনীতি প্রত্যক্ষ করেন। মার্চের প্রথম দিকে পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশে ব্যাপক হারে সৈন্য এবং অস্ত্রশস্ত্র পাঠাতে দেখে তিনি উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। ২৫শে মার্চ কোনোভাবে ছুটি অনুমোদন করিয়ে তিনি বিমানযোগে ঢাকায় ফিরে আসেন। এদিন রাতেই পাকিস্তানি সৈন্যরা বাঙালিদের ওপর গণহত্যা শুরু করে। ২৬শে মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার পর তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেন। ঢাকায় ২-৩ দিন অবস্থান করে তিনি বিক্রমপুর-নারায়ণগঞ্জ-নরসিংদী-কিশোরগঞ্জ হয়ে নিজ বাড়িতে পৌঁছান। এলাকায় এসে তিনি ছাত্র-যুবকদের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য সংগঠিত করতে থাকেন। তাদের নিয়ে তিনি ভারতের তুরায় যান এবং তুরা ও কালাইপাড়ায় মুক্তিযুদ্ধ ক্যাম্পে প্রশিক্ষণের দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তী সময়ে তিনি ১১ নম্বর সেক্টরে অন্তর্ভুক্ত হয়ে যুদ্ধ করেন। এ- সময় তিনি একটি কোম্পানির কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ভারতের সীমান্ত এলাকা শেরপুরের কামালপুর, বকশিগঞ্জ, শ্রীবরদী প্রভৃতি এলাকায় অনেকগুলো যুদ্ধে সাহসিকতার পরিচয় দেন।
গাজী আব্দুস সালাম ভূঁইয়া ১৫ই নভেম্বর কামালপুর যুদ্ধে ১১ নম্বর সেক্টরের অধিনায়ক মেজর আবু তাহের মারাত্মকভাবে আহত হলে তাঁকে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। ৪ঠা ডিসেম্বর কামালপুর যুদ্ধের পর তাঁরা শেরপুর দখলের সিদ্ধান্ত নেন। হানাদার বাহিনীর শক্ত ঘাঁটি শেরপুর দখলের জন্য মুক্তিযোদ্ধারা ২ ভাগে বিভক্ত হন। তাঁদের একটি দল শ্রীবর্দী থেকে মগড়ার চরে কাঁচা রাস্তা, অপর দলটি গাজী আব্দুস সালাম ভূঁইয়ার নেতৃত্বে শ্রীবর্দী-শেরপুর পাকা রাস্তা ধরে সামনের দিকে এগুতে থাকেন। শেরপুরের উপকণ্ঠে পৌঁছে তাঁরা আক্রমণের প্রস্তুতি নিতে থাকেন। কিন্তু আক্রমণ শুরুর পূর্বেই পাকিস্তানি সৈন্যরা শেরপুর থেকে পলায়ন করতে থাকে। সহযোদ্ধাদের নিয়ে তিনি পলায়নরত পাকসেনাদের ওপর আক্রমণ করেন। উভয় পক্ষের মধ্যে প্রচণ্ড যুদ্ধের এক পর্যায়ে হানাদার বাহিনী রণে ভঙ্গ দিয়ে পালিয়ে যায়। যুদ্ধে কয়েকজন পাকিস্তানি সৈন্য হতাহত হয়।
মহান মুক্তিযুদ্ধে সাহসিকতাপূর্ণ অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার গাজী আব্দুস সালাম ভূঁইয়াকে ‘বীর প্রতীক’ খেতাবে ভূষিত করে। তাঁর স্ত্রীর নাম মেহেরুননেছা। এ দম্পতি ১ পুত্র ও ২ কন্যা সন্তানের জনক-জননী। স্বাধীনতাপরবর্তী সময়ে গাজী আব্দুস সালাম ভূঁইয়া ময়মনসিংহের নান্দাইলে নিজ বাড়িতে বসবাস করেন। তিনি বিভিন্ন সামাজিক- সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে নিজকে যুক্ত করেন। [মনিরুজ্জামান শাহীন]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৩য় খণ্ড