গাজীপুর বাজার যুদ্ধ (ফরিদগঞ্জ, চাঁদপুর)
গাজীপুর বাজার যুদ্ধ (ফরিদগঞ্জ, চাঁদপুর) সংঘটিত হয় দুবার – ২৭শে এপ্রিল ও ২৫শে সেপ্টেম্বর। প্রথমবারের যুদ্ধে ৭-৮ জন এবং দ্বিতীয়বারের যুদ্ধে ৩০-৩৫ জন পাকসেনা হতাহত হয়।
২০শে এপ্রিল মুক্তিবাহিনী ফরিদগঞ্জ গোডাউনের খাদ্যসামগ্রী লুট করার পর পাকবাহিনী এর প্রতিশোধ নিতে তৎপর হয়ে ওঠে এবং ২৩শে এপ্রিল ফরিদগঞ্জ থানা দখল করে। ২৭শে এপ্রিল সকাল ১১টার দিকে খবর আসে যে, পাকবাহিনীর একটি লঞ্চ অস্ত্র ও খাদ্যসামগ্রী নিয়ে ফরিদগঞ্জ আসছে। ইতোমধ্যে মুক্তিযোদ্ধারা কৌশলে কিছু লোককে দালাল হিসেবে পাকবাহিনীর কাজে নিয়োজিত করেন। তারাই পাইকপাড়ায় এসে এ খবর দেয়। খবর পেয়ে সুবেদার জহিরুল হক পাঠান ও বি এম কলিমউল্যা ভূঁইয়া দ্রুত গাজীপুরের ডানে-বাঁয়ে ব্যাপক এলাকায় প্রতিরক্ষাব্যূহ তৈরি করেন। পাকবাহিনীর লঞ্চ ধীরে-ধীরে মুক্তিযোদ্ধাদের ফাঁদে প্রবেশ করলে জহিরুল হক পাঠানের নির্দেশে মুক্তিযোদ্ধারা তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন। এতে ৭-৮ জন পাকসেনা নিহত হয় এবং বাকিরা নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তারা পাড়ে উঠে পাল্টা আক্রমণ চালায়। দুপুর ১২টা থেকে বেলা ২টা পর্যন্ত উভয় পক্ষে যুদ্ধ চলে। এক পর্যায়ে পাকসেনারা নিহত সহযোদ্ধাদের লাশ নিয়ে ফরিদগঞ্জ থানায় চলে যায়। তাদের বহনকারী লঞ্চটি গুলিতে ছিদ্র হয়ে নদীতে ডুবে যায়। পাকবাহিনী চলে যাওয়ার পর জনগণ লঞ্চটি তীরে টেনে উঠায়। মুক্তিবাহিনীর বিজয়ের খবর চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়লে হাজার-হাজার জনতা স্লোগানে-স্লোগানে গাজীপুর মাতিয়ে তোলে। এ-যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধারা ১টি ৩ ইঞ্চি মর্টার, ১টি রকেট লঞ্চার, ৪টি চাইনিজ এলএমজি, রাইফেল, গ্রেনেড ও প্রচুর পরিমাণ গোলা-বারুদ উদ্ধার করেন। দুদিন পর জহিরুল হক পাঠান অস্ত্রগুলো সুবেদার আলী আকবরের নেতৃত্বে ২নং সেক্টর হেডকোয়ার্টার্স ভারতের নির্ভয়পুরে পাঠান। সাব- সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন মাহাবুব অত্যন্ত খুশি হয়ে পাঠান গ্রুপকে ৬টি ব্রিটিশ এলএমজি, ৪টি ২ ইঞ্চি মর্টার ও প্রচুর গোলা-বারুদ বরাদ্দ দেন।
গাজীপুরের দ্বিতীয় যুদ্ধের আগের দিন (২৪শে সেপ্টেম্বর) সুবেদার জহিরুল হক পাঠান রাত ১০টার দিকে ডল্টা বাজার (হাজীগঞ্জ)-এ এসে মুক্তিযোদ্ধাদের নির্দেশ দেন যার-যার হাতিয়ার নিয়ে নৌকায় উঠতে। নির্দেশমতো মুক্তিযোদ্ধারা নৌকায় উঠে কয়েকটি দলে ভাগ হয়ে সেই রাতেই কড়ইতলী, পাইকপাড়া ও আষ্ট্রায় চলে যান। হাবিলদার রশিদের নেতৃত্বে একটি প্লাটুন খুব ভোরে গাজীপুর পৌঁছে। এদিকে পাকবাহিনী লঞ্চে করে গাজীপুর বাজারে এসে ফাঁকা আওয়াজ করে। হাবিলদার রশিদ তাঁর সহযোদ্ধা ডা. দেলোয়ার হোসেন খান (খুরুমখালী)-কে সঙ্গে নিয়ে গাজীপুর হুতার বাড়ি (সূত্রধর বাড়ি) আসেন এবং পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করেন। সেখানে পজিশন নেয়া ছিল অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ, কারণ এখান থেকে গাজীপুরের দূরত্ব মাত্র ৩৫ গজ। এর পূর্বে তিনি ২টি এলএমজি দিয়ে এক গ্রুপকে বাঁয়ে এবং অন্য গ্রুপকে ডানে গাজীপুর পাঠান বাড়িতে ডিফেন্সে পাঠান। রশিদ নিজে তাঁর সহযোদ্ধাকে নিয়ে গাজীপুর সওদাগর বাড়ির মসজিদের পাকা দানবাক্সের আড়ালে এলএমজি নিয়ে পজিশন নেন। পাকবাহিনী গাজীপুর বাজার ও হুতার বাড়িতে আগুন লাগায়। তারা গুলি করতে-করতে প্রায় কাছে চলে আসে। তাদের অসংখ্য ৩ ইঞ্চি মর্টারের শেল মুক্তিযোদ্ধাদের আশপাশে পড়ছে। পাকবাহিনীর প্রায় ২৫ জন সেনা কাছে এগিয়ে আসে। এমন সময় শুরু হয় পাকবাহিনীর ওপর তীব্র আক্রমণ। প্রথম ফায়ারে ৭-৮ জন পাকসেনা ধানক্ষেতে লাফিয়ে পড়ে চিৎকার করতে থাকে। এর ১০ মিনিট পর মুক্তিযোদ্ধারা পাঠান বাড়ি ও হুতার বাড়ি থেকে প্রচণ্ড আক্রমণ করেন। এক পর্যায়ে তাঁরা স্থান ত্যাগ করে ধানক্ষেতের ভেতর দিয়ে তিনার বাড়ির দক্ষিণ পাশে তাল গাছের গোড়ায় পজিশন নেন। এ সময় পাকবাহিনী হুতার বাড়ি, পাঠান বাড়ি ও সওদাগর বাড়ি জ্বালিয়ে দেয়। মুক্তিযোদ্ধারা দ্বিতীয়বার তিনার বাড়ির পেছনের রাস্তায় পজিশন নেন। এখানে তাঁরা প্রায় আধঘণ্টা যুদ্ধের পর পুনরায় ধানক্ষেতের ভেতর দিয়ে মাঝি বাড়ির কাঠের ব্রিজের গোড়ায় প্রধান সড়কে পজিশন নেন। পাকবাহিনী অনবরত গুলি করছে। তারা তিনার বাড়ি ও মাঝির বাড়ি জ্বালিয়ে দেয়। মাঝির বাড়ির কাঠের ব্রিজের পজিশন ছিল অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। পাকবাহিনী চতুর্দিকে গুলি করতে-করতে এগিয়ে আসে। এ সময় রশিদ হাবিলদার ও তাঁর সহযোগীরা আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন। ১৫- ২০ মিনিট একটানা যুদ্ধের পর পাকবাহিনী পরাজিত হয়। তাদের প্রায় ৩০-৩৫ জন সৈন্য হতাহত হয়। জীবিত পাকসেনারা কভারিং ফায়ার করে হতাহতদের নিয়ে চলে যায়। কিছুক্ষণ পর শতশত জনতা দেশীয় অস্ত্র নিয়ে স্লোগান দিয়ে গাজীপুরের দিকে আসে। যুদ্ধের খবর নিতে জহিরুল হক পাঠান ও কলিমউল্যা ভূঁইয়াও ঘটনাস্থলে ছুটে আসেন। [দেলোয়ার হোসেন খান]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৩য় খণ্ড