You dont have javascript enabled! Please enable it!

মুক্তিযুদ্ধে গাজীপুর সদর উপজেলা

গাজীপুর সদর উপজেলা ১৯৭১ সালের উত্তাল মার্চে দেশের অপরাপর এলাকার মতো গাজীপুর সদরও অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে। ১লা মার্চ জাতীয় সংসদের অধিবেশন স্থগিতের ঘোষণা শুনে গাজীপুরবাসী বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। এলাকার লোকজন বিক্ষুব্ধ হয়ে রাস্তায় নেমে আসে। এখানকার তিনটি বৃহৎ শিল্প প্রতিষ্ঠান যথা সমরাস্ত্র কারখানা, মেশিন টুলস ফ্যাক্টরি ও ডিজেল প্ল্যান্টের হাজার-হাজার শ্রমিক- কর্মচারী তাদের সঙ্গে যোগ দেয়। আন্দোলন-সংগ্রামকে বেগবান করতে ২রা মার্চ পশুপালন কর্মকর্তা ডা. আহমেদ ফজলুর রহমানের বাসায় এলাকার বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ এক সভায় মিলিত হন। সেখানে মো. শামসুল হক মিয়া এমপিএ-কে উপদেষ্টা করে সর্বদলীয় মুক্তি সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। সংগ্রাম পরিষদের দুটি শাখা ছিল— একটি হাইকমান্ড, অপরটি একশন কমিটি। হাইকমান্ডে ছিলেন মো. হাবিবুল্লাহ (আওয়ামী লীগ নেতা), ডা. মণীন্দ্রনাথ গোস্বামী (ন্যাপ নেতা), এম এ মোতালিব (শ্রমিক নেতা) প্রমুখ। একশন কমিটিতে ছিলেন আ ক ম মোজাম্মেল হক (আহ্বায়ক), নজরুল ইসলাম খান (কোষাধ্যক্ষ), মো. শহীদুল্লাহ বাচ্চু (ছাত্ৰনেতা), মো. আয়েশউদ্দিন, মো. আবদুস সাত্তার মিয়া, মো. শহীদুল্লাহ পাঠান জিন্নাহ (ছাত্রনেতা), মো. হারুন-অর-রশীদ ভূঁইয়া, মো. নূরুল ইসলাম, শেখ আবুল হোসাইন, মো. হযরত আলী, ছাইয়েদ বক্স ভূঁইয়া প্রমুখ। এছাড়াও সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে মো. হাবিবুল্লাহ এবং আ ক ম মোজাম্মেল হকের উদ্যোগে শিল্পাঞ্চলে আরেকটি মুক্তি সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়, যার আহ্বায়ক ছিলেন মো. শহীদুল্লাহ বাচ্চু এবং যুগ্ম-আহ্বায়ক ছিলেন সমরাস্ত্র কারখানার আবদুস সালাম ও সেকান্দার। সংগ্রাম পরিষদ গঠন করার পরপরই জয়দেবপুর (বর্তমান গাজীপুর)-কে ঘিরে এর চারপাশ এবং গ্রামাঞ্চলের হাটগুলোতে সভা- সমাবেশ শুরু হয়। কর্মসূচি চালিয়ে নেয়ার জন্য একটি ফান্ড গঠন করা হয়, যেখানে এলাকার লোকজন স্বতঃস্ফূর্তভাবে টাকা-পয়সা দান করত। ৪ঠা মার্চ সারা দেশের মতো গাজীপুরেও সকাল ৬টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়। এদিন বিকেলে বাজারের পূর্বপাশে রেলগেটের কাছে এক জনসভায় ইয়াহিয়া ও ভুট্টোর কুশপুত্তলিকা দাহ করা হয়। ৫ই মার্চ টঙ্গীতে পাকহানাদারদের অনুগত ইপিআর বাহিনীর গুলিতে মেঘনা টেক্সটাইল মিলস-এর মোতালেব, রইচউদ্দিন, ইস্রাফিলসহ চারজন শ্রমিক শহীদ হন, যা ছিল পাকবাহিনী কর্তৃক এ অঞ্চলে প্রথম হত্যাকাণ্ড। একই দিন হরতাল শেষে জকী স্মৃতি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সম্মুখের বটতলায় এক জনসভায় পাকিস্তানি পতাকায় অগ্নিসংযোগ করা হয়। ৭ই মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শোনার জন্য গাজীপুর থেকে কয়েক হাজার মানুষ বাস- ট্রাকযোগে ঢাকা আসে।
বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ-এর পর সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরি ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের শ্রমিকদের সংগঠিত করে গোপনে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু করেন। জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক কাজী মোজাম্মেল হকের নেতৃত্বে হাসান উদ্দিন সরকার, সাহাবুদ্দিন, সরদার আলী মাস্টার, আবদুল হাকিম মাস্টার ও মুখলেস কমিশনার টঙ্গী এলাকার লাইসেন্সকৃত বন্দুকগুলো সংগ্রহ করেন এবং সেগুলো দিয়ে এলাকার যুবকদের প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করেন। ২৫শে মার্চ পাকবাহিনীর নৃশংসতার পর জয়দেবপুরের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মী, ছাত্র-যুবক ও কৃষক-শ্রমিক মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের জন্য ভারতে যাওয়ার প্রস্তুতি গ্রহণ করে। এপ্রিল মাস থেকেই এসব মানুষ ত্রিপুরার আগরতলায় গমন করে। তারা ত্রিপুরা ও আসামের বিভিন্ন ক্যাম্পে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে বিভন্ন গ্রুপে বিভক্ত হয়ে জুন ও জুলাই মাসে জয়দেবপুরের পার্শ্ববর্তী এলাকায় অবস্থান নেন। রাহাপাড়া গ্রামে আবদুল বারিক মিয়া ও মো. আবদুর রাজ্জাকের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা একটি বড় ক্যাম্প স্থাপন করেন। এ ক্যাম্পে অন্যান্যদের মধ্যে ছিলেন ডা. মো. ছায়েদ আলী, মো. এখলাস উদ্দিন, শেখ আবুল হোসাইন, আবদুল হালিম, ওমর আলী, আবদুস সালাম, আবদুল গফুর প্রমুখ। মুক্তিযোদ্ধা মো. হাতেম আলী ভারত থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে মেজর কে এম সফিউল্লাহ, বীর উত্তম-এর নির্দেশে ২১ জন সঙ্গীসহ জয়দেবপুরের কাছাকাছি অবস্থান নেন। গ্রুপ কমান্ডার মো. আব্দুল বাতেনের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের অপর একটি গ্রুপ কামারিয়া গ্রামে ক্যাম্প স্থাপন করে। এছাড়াও মো. শহীদুল্লাহ বাচ্চু, মো. হারুন-অর-রশীদ, মো. শহীদুল ইসলাম পাঠান জিন্নাহ, শেখ আবুল হোসেন, আবদুর রউফ নয়ন ও রমিজউদ্দিন মাস্টারের নেতৃত্বে আরেকটি গ্রুপ জয়দেবপুরের কাছাকাছি অবস্থান নিয়ে বেশ কয়েকটি অপারেশন পরিচালনা করে।
সর্বাত্মক প্রতিরোধযুদ্ধ এবং মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত করার ক্ষেত্রে সর্বদলীয় মুক্তি সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দ ছাড়াও মো. ময়েজ উদ্দিন এমপিএ, কাজী মোজাম্মেল হক (টঙ্গী), ডা. সাইদ বক্স ভূঁইয়া, আবদুল বারিক, গিয়াস চৌধুরী, নূরুল আনোয়ার, জামাল হায়দার মুকুল, হাবিবুর রহমান, মো. শহীদুল্লাহ, খুরশিদ হোসেন নয়ন, ইয়াকুব আলী সরকার, কাজী আজিমুদ্দিন, রফিকুর রহমান, আবদুল হাকিম মাস্টার (টঙ্গী) প্রমুখ বিশিষ্ট ভূমিকা পালন করেন। এছাড়া বাটা সু কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক উইলহিলমাস এ এস ঔডারল্যান্ড, বীর প্রতীক- (খেতাবপ্রাপ্ত একমাত্র বিদেশী) মুক্তিযুদ্ধে অসাধারণ ভূমিকা রাখেন। এ উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধের গ্রুপ কমান্ডার ছিলেন আবদুর রশিদ ও শেখ আবুল হোসেন।
১১ই মার্চ ঢাকা সেনানীবাসের জিওসি মেজর জেনারেল সাহেবজাদা ইয়াকুব খানের জয়দেবপুর সেনানীবাস পরিদর্শনে আসাকে এলাকার সাধারণ মানুষ প্রতিহত করে। দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালি সৈনিকদের কৌশলে নিরস্ত্র করার উদ্দেশ্যে পাকিস্তানি সেনা কর্তৃপক্ষ ১৫ই মার্চের মধ্যে তাঁদের অস্ত্র জমাদানের নির্দেশ জারি করে। এ খবর দ্রুত ছড়িয়ে পড়লে বিক্ষুব্ধ জনতা টঙ্গী থেকে শুরু করে ঢাকা-জয়দেবপুর সড়ক, চৌরাস্তা ও তৎসংলগ্ন সড়কগুলোতে ইট, গাছের গুঁড়ি, ঠেলাগাড়ি ইত্যাদি দিয়ে অসংখ্য ব্যারিকেড তৈরি করে। সাধারণ লোকজন দেশীয় অস্ত্র নিয়ে রাস্তায় নেমে আসে। এমন এক পরিস্থিতিতে ১৯শে মার্চ ঢাকাস্থ ৫৭ পদাতিক ব্রিগেডের কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জাহানজেব আরবাব খান ভারী অস্ত্রে সজ্জিত ৭० জন সেনাসদস্যকে সঙ্গে নিয়ে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালি সৈন্যদের নিরস্ত্র করতে এলে স্থানীয় জনতা তাদের প্রতিরোধ করে। ব্যারিকেড সরিয়ে ব্রিগেডিয়ার জাহানজেব পৌঁছতে সক্ষম হলেও তাঁর ফেরার পূর্বে বিক্ষুব্ধ জনতা রেলের বগি দিয়ে রেলক্রসিংয়ে ব্যারিকেড দেয়। পথের অন্যত্রও ব্যারিকেড সৃষ্টি করা হয়। ব্রিগেডিয়ার জাহানজেব সেকেন্ড বেঙ্গল ব্যাটালিয়নের বাঙালি কমান্ডার লে. কর্নেল মাসুদুল হোসেন খানকে প্রতিরোধকারী জনতার ওপর গুলি করার নির্দেশ দেন। এমনি অবস্থায় হঠাৎ শত্রুপক্ষের গুলিতে ফুটবল খেলোয়াড় হুরমতসহ বেশ কয়েকজন হতাহত হন। এটি জয়দেবপুর প্রতিরোধযুদ্ধ – নামে পরিচিত। জয়দেবপুরবাসীর এই সশস্ত্র প্রতিরোধের পর সমগ্র বাংলাদেশে স্লোগান ওঠে ‘জয়দেবপুরের পথ ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর’। ২৫শে মার্চ গণহত্যার পর পাকবাহিনীর গাজীপুরে প্রবেশ ঠেকাতে এলাকাবাসী টঙ্গীতে ব্যাড়িকেড দেয়, তুরাগ নদীর কাঠের ব্রিজ পুড়িয়ে দেয় এবং কংক্রিটের ব্রিজ ভেঙ্গে ফেলার চেষ্টা করে।
২৭শে মার্চ পাকবাহিনী প্রথমে টঙ্গী দখল করে টেলিফোন শিল্প সংস্থায় ঢাকা উত্তর জোনের হেডকোয়ার্টার্স স্থাপন করে। তাদের অধিনায়ক ছিল মেজর আরিফ। প্রাথমিক পর্যায়ে তারা এখান থেকে ঢাকা, জয়দেবপুর, টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ প্রভৃতি এলাকায় তাদের অপারেশন চালাত। ২৮শে মার্চ ২য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালি সৈন্যরা মেজর সফিউল্লাহ, মেজর মইনুল হোসেন চৌধুরী ও ক্যাপ্টেন আজিজুর রহমানের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে টাঙ্গাইল হয়ে ময়মনসিংহ চলে গেলে পাকবাহিনী জয়দেপুর রাজবাড়িতে বিমান হামলা চালায় এবং সড়কপথে উপজেলা সদর জয়দেবপুরে প্রবেশ করে। পর্যায়ক্রমে তারা সমরাস্ত্র কারখানা, মেশিন টুলস ফ্যাক্টরি এবং অর্ডন্যান্স ডিপো দখল করে নেয়। মুক্তিযুদ্ধের শেষদিন পর্যন্ত টঙ্গী, জয়দেবপুর, সমরাস্ত্র কারখানা ও অর্ডন্যান্স ডিপোতে পাকবাহিনীর শক্ত ঘাঁটি ছিল।
গাজীপুর সদর উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিরা হলো- আলাউদ্দিন (টঙ্গী), আওয়াল (জয়দেবপুর), নওয়াব আলী (জয়দেবপুর), হাকিমউদ্দিন (জয়দেবপুর), আহাদ আলী (ঐ), মনু (ঐ) প্রমুখ।
জয়দেবপুর দখলের পর পাকবাহিনী আশপাশের গ্রামগুলোতে হানা দিয়ে হত্যা, নারীনির্যাতন, অগ্নিসংযোগ ও লুটতরাজ চালাতে থাকে। এ-কাজে এগিয়ে আসে স্থানীয় মুসলিম লীগ ও নেজামে ইসলামী সহ পাকিস্তানপন্থী বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরা। জয়দেবপুরের মস্তান খান, নওয়াব আলী, আবদুল আউয়াল, আইনউদ্দিন সরকার (বাসন ইউনিয়ন), শফিউদ্দিন প্রমুখের নেতৃত্বে গঠিত হয় শান্তি কমিটি। টঙ্গী এলাকায় শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান ছিল মজিদ সরকার। শান্তি কমিটির সহায়তায় পাকবাহিনী রাজাকার, আলবদর ও আলশামস বাহিনী গঠন করে। এসব বাহিনীর সদস্যরা বিভিন্ন অভিযানে পাকসেনাদের পথ দেখানো, মুক্তিযোদ্ধাদের ঘরবাড়ি চিনিয়ে দেয়া এবং হত্যা, নারীনির্যাতন, অগ্নিসংযোগ ও লুটতরাজে সহায়তা করে।
৫ই মার্চ অসহযোগ আন্দোলন চলাকালেই টঙ্গীর মেঘনা টেক্সটাইল মিলসে পাকবাহিনীর দোসরদের দ্বারা গণহত্যা সংঘটিত হয়। এরপর ২৫শে মার্চ থেকে শুরু করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী টঙ্গীর বিসিক শিল্প এলাকার পেসোসকার ফ্যাক্টরি, টেলিফোন শিল্প সংস্থা, বাংলাদেশ ফার্মাসিউটিক্যালস ইন্ডাস্ট্রিজ, টঙ্গী বাজার, আবদুল্লাহপুর, আরিচপুর, পিপলস্ সিরামিকস ইত্যাদি স্থানে গণহত্যা চালায়, যা টঙ্গী গণহত্যা নামে পরিচিত।
২৮শে মার্চ থেকে ৩রা এপ্রিল পর্যন্ত জয়দেবপুর সমরাস্ত্র কারখানায় একাধিক হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়, যা জয়দেবপুর সমরাস্ত্র কারখানা গণহত্যা- নামে পরিচিত। শুধু ৩রা এপ্রিল সমরাস্ত্র কারখানায় রাজাকার আবদুল কুদ্দুস (হেডমাস্টার)- এর সহায়তায় পাকবাহিনী ওয়ার্কস ম্যানেজার এ কে মাহবুব চৌধুরী, ডা. মেজর নঈমুল ইসলাম, ওয়েলফেয়ার অফিসার মাহবুব রহমানসহ ৬ জন অফিসারকে নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করে। ২৫শে এপ্রিল টঙ্গী জুট মিলস-এর চিকিৎসক ডা. সুলেমান খানকে স্থানীয় মুসলিম লীগের ভাড়াটে বাহিনী চাঁদপুরে তাঁর নিজবাড়িতে নির্মমভাবে হত্যা করে। ১৪ই মে পাকবাহিনী স্থানীয় রাজাকার আবদুল আউয়াল ও আহাদ আলীর সহায়তায় হিন্দুপ্রধান বাড়িয়া গ্রামে নির্বিচারে গণহত্যা, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট ও নারীনির্যাতন করে। ২৬শে সেপ্টেম্বর রাজাকারদের সহায়তায় পাকবাহিনী পিপলস সিরামিকসের চিকিৎসক ডা. আতিকুর রহমানকে নির্মমভাবে হত্যা করে। ১৪ই মে বাড়িয়া হত্যাকাণ্ডের সময় পাকবাহিনীর হাতে ধর্ষণের শিকার হন শৈলবালা। কামারিয়া গ্রামেও ধর্ষণের ঘটনা ঘটে।
টঙ্গীর টেলিফোন শিল্প সংস্থা ছিল পাকবাহিনীর ঢাকা উত্তর জোনের হেডকোয়ার্টার্স, যা পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে। দীর্ঘ নয়মাস এটি ছিল পাকবাহিনীর একটি স্থায়ী নির্যাতনকেন্দ্র ও বন্দিশিবির। এ নয়মাসে তারা অসংখ্য বাঙালিকে এখানে ধরে এনে নির্যাতনের পর হত্যা করে। ২৭শে মার্চ টঙ্গী দখলের সময় পাকবাহিনী বিসিকের একটি নির্মাণাধীন পেসোসকার ফ্যাক্টরিতে আশ্রয় নেয়া ২০ জন বাঙালিকে গুলি করে হত্যা করে, যা পেসোসকার ফ্যাক্টরি গণহত্যা নামে পরিচিত। নিহতদের বিসিক কবরস্থানে দাফন করা হয়। দাফনের স্থানটি গাজীপুর বিসিক গণকবর নামে পরিচিত। ২৯শে মার্চ জয়দেবপুর দখলের পর পাকবাহিনী জয়দেবপুর বাজারে অগ্নিসংযোগ করে। পরদিন তারা শ্মশানঘাট হয়ে ভুরুলিয়া গ্রাম আক্রমণ করে। সেখানে তাদের গুলিতে মান্নান ও বেনু নামে দুজন গ্রামবাসী শহীদ হন।
জয়দেবপুর রাজবাড়ি সেনানিবাসও ছিল পাকবাহিনীর একটি স্থায়ী নির্যাতনকেন্দ্র ও বন্দিশিবির। রাজবাড়ির পূর্বপাশের কোয়ার্টার্স ছিল মূল বন্দিশিবির। ৯ই এপ্রিল শুক্রবার দুপুরে পাকবাহিনী ১০ম বেঙ্গল রেজিমেন্টের ন্যাশনাল গার্ডের দেড়শ সদস্যকে ঢাকা থেকে তিনটি ট্রাকযোগে এখানে নিয়ে আসে। পূর্ব থেকে ধরে আনা অন্য বন্দিদেরও একত্রিত করে কয়েকজন নারীসহ প্রায় ৩০০ বাঙালিকে এখানে ব্রাশ ফায়ার ও গ্রেনেড চার্জ করে হত্যা করা হয়। এ ঘটনা জয়দেবপুর রাজবাড়ি গণকবর- এবং দিনটি ‘জয়দেবপুর শহীদ দিবস’ হিসেবে পরিগণিত। যুদ্ধের পরবর্তী বছর থেকেই এ দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। এছাড়া সমরাস্ত্র কারখানা এবং অর্ডন্যান্স ডিপোতেও পাকবাহিনীর নির্যাতনকেন্দ্র ও বন্দিশিবির ছিল।
১৭ই এপ্রিল টঙ্গীর আরিচপুরে একটি ভয়াবহ গণহত্যার ঘটনা ঘটে। এদিন টঙ্গীতে অবস্থানরত পাকসেনারা এলাকার নিরীহ লোকদের গুলি ও বেয়োনেট চার্জ করে হত্যা করে। -আরিচপুর গণহত্যা-য় ৩০ জন মানুষ শহীদ হন। ১৪ই মে হিন্দু অধ্যুষিত বাড়িয়া ও কামারিয়া গ্রামে পাকবাহিনী ও তাদের দোসররা গণহত্যা, অগ্নিসংযোগ ও নির্যাতন চালায়। এ বাড়িয়া- কামারিয়া গণহত্যায় কয়েকশ গ্রামবাসী শহীদ হন। গাছা ইউনিয়নের দুর্গম ও হিন্দুপ্রধান ইছরখালী গ্রামে পার্শ্ববর্তী এলাকার অনেক লোকজন আশ্রয় নিয়েছিল। জুন মাসের শেষদিকে পাকবাহিনী স্থানীয় রাজাকার ও শান্তি কমিটির সহায়তায় রাতের অন্ধকারে গ্রামটিতে হত্যাকাণ্ড চালায়, যা ইছরখালী গণহত্যা- নামে পরিচিত। এখানে নারী, পুরুষ ও শিশুসহ শতাধিক লোক শহীদ হন। নিহতদের গাছা স্কুল প্রাঙ্গণে মাটিচাপা দেয়া হয়। এ কারণে উক্ত স্থানটি গাছা স্কুল গণকবর নামে পরিচিত।
সমরাস্ত্র কারখানা দখলের পর পাকবাহিনী কারখানার আঞ্চলিক সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি ও সম্পাদককে গুলি করে হত্যা করে এবং বাঙালি কোয়ার্টার্সে যারা ছিল তাদেরসহ আশপাশের বাড়িঘরে হামলা ও নির্যাতন চালায়।
টঙ্গীর শহীদ স্মৃতি স্কুল প্রাঙ্গণের তালতলায় এপ্রিল থেকে মে মাস পর্যন্ত কমপক্ষে ২৫ জন বাঙালিকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। হত্যার স্থানটি টঙ্গী শহীদ স্মৃতি স্কুল বধ্যভূমি নামে পরিচিত। ৪ঠা ডিসেম্বর বাটা সু কোম্পানিতে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে গিয়ে গোলাম কিবরিয়া ও আবদুস সোবহান শহীদ হন।
গাজীপুর সদর উপজেলা তথা সমগ্র গাজীপুরে সবচেয়ে বড় বধ্যভূমি ও গণকবর হলো রাজবাড়ি বধ্যভূমি। টঙ্গীর বিসিক এলাকাও বধ্যভূমি ও গণকবর হিসেবে পরিচিত।
মুক্তিযুদ্ধের প্রথম দিকে মুক্তিযোদ্ধাদের লক্ষ্য ছিল পাকবাহিনীর বিভিন্ন ক্যাম্প ও স্থাপনা আক্রমণ, বৈদ্যুতিক খুঁটি ও ব্রিজ ধ্বংস এবং এর মাধ্যমে পাকবাহিনীকে ভীত- সন্ত্রস্ত করে রাখা। ২৮শে মার্চ ২য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈনিকরা বিদ্রোহ করে জয়দেবপুর ত্যাগ করার প্রাক্কালে তাদের হাতে সৈনিকদের মেসের বাইরে এবং রাজবাড়ির বিভিন্ন স্থানে প্রায় ৩০ জন পাকিস্তানি সৈন্য নিহত হয়। ২৬শে মে রাতে মুক্তিযোদ্ধারা মাইন বিস্ফোরণ ঘটিয়ে একটি বৈদ্যুতিক খুঁটি উপরে ফেলেন। মুক্তিযোদ্ধা হাতেম আলী ও তাঁর দল ১৩ই আগস্ট চান্দনা চৌরাস্তার নিকট ঢাকা-জয়দেবপুর সড়কের পাশে বিস্ফোরক দিয়ে অপর একটি বৈদ্যুতিক খুঁটি উপরে ফেলেন। ফলে পাঁচদিন জয়দেবপুর চৌরাস্তাসহ আশপাশের এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ থাকে। গ্রুপ কমান্ডার আবদুর রশিদের গ্রুপ আগস্টের শেষদিকে পূবাইল রেলসেতু পাহারারত রাজাকারদের ওপর আক্রমণ চালায়। এ গ্রুপটি বোর্ডবাজারের কাছে রেডিও পাকিস্তানের ট্রান্সমিশন অফিসে পাহারারত রাজাকার ও বিহারিদের ওপর আক্রমণ করলে দুজন বিহারি নিহত হয়। ১৪ই আগস্ট পাকবাহিনী পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবস উদযাপনের উদ্যোগ নিলে মুক্তিযোদ্ধারা সার্কেল অফিসারের বাসভবনে গ্রেনেড চার্জ করে তা ভুণ্ডল করে দেন ৷ আগস্টের শেষদিকে ধীরাশ্রম রেল স্টেশনের উত্তরে একটি ব্রিজে পাহারারত পাকসেনাদের ওপর আক্রমণ করার সময় শরাফত আলী নামে একজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।
১৭ই সেপ্টেম্বর টঙ্গীর মাঝুখান রেলব্রিজে আবদুস সালাম (আদাবৈ) ও আবদুল গফুরের (নীলেরপাড়) নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে পাকসেনা ও রাজাকারদের সংঘর্ষ হয়। সেপ্টেম্বরের শেষদিকে রাহাপাড়ার পূর্বপাশে কাউছার বাইদে গ্রেনেড চার্জ করলে কয়েকজন পাকসেনা হতাহত হয়। ১০ই অক্টোবর জয়দেবপুর থানার পুলিশ ও রাজাকারদের সহায়তায় পাকবাহিনী মুক্তিবাহিনীর রাহাপাড়া ক্যাম্প আক্রমণ করতে অগ্রসর হলে কাউছার বাইদে ও রূপলাল তাদের ওপর গ্রেনেড নিক্ষেপ করেন। এ-সময় রূপলালসহ কয়েকজন আহত হন এবং পাতলা খান নামে এক পাকদোসর নিহত হয়। ১১ই অক্টোবর মুক্তিযোদ্ধারা ধীরাশ্রম থেকে কয়েকজন পাকসেনাকে ধরে এনে রাহাপাড়া ক্যাম্পে বন্দি করে রাখেন। ১৪ই অক্টোবর রাতে মুক্তিযোদ্ধারা ধীরাশ্রমের কাছে প্রায় এক মাইল রেলপথ উপরে ফেলেন এবং জয়দেবপুর রেল স্টেশনের দক্ষিণে সিগন্যাল সংলগ্ন রেলসেতুটি মাইন বিস্ফোরণে উড়িয়ে দেন। এ অভিযানে গ্রুপ কমান্ডার শেখ আবুল হোসেন আহত হন।
নভেম্বরে গাজীপুর রেল স্টেশনে একটি ট্রেনে হামলা কালে মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল মাজেদ (মেঘডুবি) শহীদ হন। ২৯শে নভেম্বর তিতারকুলে পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের ভীষণ যুদ্ধ হয়, যা তিতারকুল যুদ্ধ নামে পরিচিত। এ- যুদ্ধে পাকবাহিনীর ২ জন সৈন্য নিহত ও কয়েকজন রাজাকার ধরা পড়ে। ৮ই ডিসেম্বর একদল মুক্তিযোদ্ধা গাজীপুর রেল স্টেশনে অস্ত্র ও গোলাবারুদ বহনকারী ঢাকাগামী একটি ট্রেনের কয়েকটি বগি মাইন বিস্ফোরণে ধ্বংস করে দেন। এতে কয়েকজন পাকসেনা নিহত হয়। অন্যরা গ্রামের দিকে পালিয়ে গেলে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে গোলাগুলিতে আরো কয়েকজন পাকসেনা নিহত হয় এবং তিনজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। এ ঘটনা গাজীপুর রেল স্টেশন অপারেশন নামে পরিচিত।
মুক্তিযোদ্ধা মো. শহীদুল্লাহর গ্রুপ ডিসেম্বরের প্রথম দিকে জকী স্মৃতি স্কুলের দক্ষিণ দিক থেকে এবং জয়দেবপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নিকট থেকে রাজবাড়ি সেনা ছাউনি, জয়দেবপুর রেল স্টেশন ও বাজারে আক্রমণ চালায়। ১০ই ডিসেম্বর ভাওয়াল কলেজের পাশে ও উলুখোলায় দুটি পাকিস্তানি বিমান বিধ্বস্ত হয়। এতে উভয় বিমানের পাইলট নিহত হয়। ১৩ই ডিসেম্বর পূর্ব রণাঙ্গনে পিছুহটা পাকসেনাদের ট্রেনে মুক্তিযোদ্ধারা মাইন বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ট্রেনের কয়েকটি বগি ধ্বংস করলে অনেক পাকসেনা হতাহত হয়। একই দিন পূবাইল রেল স্টেশনের দক্ষিণ পাশের একটি বাড়িতে পাকসেনাদের আক্রমণে সেলিম রেজা, নাসিরউদ্দিন আহমেদ ও আজমল হোসেন নামে তিন ভাই শহীদ হন। ১৪ই ডিসেম্বর জয়দেবপুর রেল স্টেশনের পূর্বপাশে গোলাগুলির সময় মুক্তিযোদ্ধা বদরুজ্জামান ভূঁইয়া খোকন শহীদ হন। ১৫ই ডিসেম্বর রাজেন্দ্রপুর ও জয়দেবপুর থেকে পায়ে হেটে এক দল পাকসেনা ঢাকার পথে পলায়নকালে কাউছার বাইদে ও আসলামের নেতৃত্বে একদল মুক্তিযোদ্ধা পূর্ব ভারারুলে তাদের ওপর আক্রমণ চালান। এ সময় ভারারুল চৌরাস্তার চাঁন মিয়া ধানকাটা কাস্তে নিয়ে পাকসেনাদের ধাওয়া করলে তাদের গুলিতে তিনি শহীদ হন। একই দিন মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় মিত্রবাহিনীর সঙ্গে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ছয়দানা নামক স্থানে একটি যুদ্ধ হয়। ছয়দানার যুদ্ধ-এ মাধ্যমেই জয়দেবপুর সদর উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়। এ-যুদ্ধ ছিল বাংলাদেশে পাকবাহিনীর পতন ও আত্মসমর্পণের পূর্বে ঢাকার সন্নিকটে বড় ধরনের যুদ্ধ।
উপজেলার খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা হলেন- মো. আফজাল মিয়া, বীর উত্তম- (পিতা জমির উদ্দিন, জয়দেবপুর), নিজাম উদ্দিন, বীর বিক্রম- (পিতা সাইফুদ্দিন খান, মৌচাক) ও আব্দুল মজিদ, বীর প্রতীক- (পিতা জনাব আলী, কলমেশ্বর, বোর্ড বাজার)।
গাজীপুর সদর উপজেলার শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- নিজাম উদ্দিন, বীর বিক্রম (পোড়াগ্রাম যুদ্ধে শহীদ), ফরহাদ হোসেন (পিতা মমিন নেওয়াজ খান, জরুন), নিয়ামত আলী (পিতা কাশেম আলী, পশ্চিম জয়দেবপুর), বদরুজ্জামান ভূঁইয়া খোকন (পিতা নুরুজ্জামান ভূঁইয়া, কানাইয়া), মজিবুর রহমান (পিতা মহিবুর রহমান, চান্দপাড়া), হুরমত আলী (পিতা ছাবেদ আলী মুন্সী, ভোগড়া), মো. নুরুল ইসলাম (পিতা লাল মিয়া, বাহবাড়ি), লাবিবউদ্দিন (পিতা ওসমান মৃধা, বারেন্দা), শরাফত আলী (পিতা মো. আমিন উদ্দিন, ধীরাশ্রম), আবদুল বাছেত মোল্লা (পিতা আবদুল গফুর মোল্লা, বহুরিয়া), মেঘলাল বর্মণ (পিতা মাঠুরাম বর্মণ, বাউপাড়া), রুহুল আমিন (পিতা দেলাতুল্লাহ, পাকুরিয়া), নিজামউদ্দিন (পিতা খালেদ মোল্লা, ভুরুলিয়া), সিপাহি মো. রওশন আলী (পিতা আবদুল আলী, চান্দনা), সিপাহি তকদির হোসেন (পিতা লোফাত আলী চৌধুরী, নলজানী), নায়েক মোফাজ্জেল হোসেন দেওয়ান (পিতা মোবারক আলী সরকার, হাতিমারা), মোহাম্মদ আলী (পিতা মো. আবদুল গফুর, দত্তপাড়া), আজিজুল হক (পিতা আবদুল খালেক, দক্ষিণ আরিচপুর, টঙ্গী), সিপাহি সিদ্দিক মিয়া (পিতা মনিরুদ্দিন, খাইলকুর/কেবিবাজার, টঙ্গী), নায়েক, আবু তাহের (পিতা আবু হাসেম খান, আরিচপুর পূর্বপাড়া, টঙ্গী), ল্যান্স নায়েক জাফর আলী (পিতা সৈয়দ আলী পাটোয়ারী, ময়নাকুঞ্জ, টঙ্গী), তাজুল ইসলাম (পিতা মো. আবদুল মজিদ, মুন্নুনগর, টঙ্গী; পুলিশ সদস্য), আব্দুল মাজেদ (মেঘডুবি), আব্দুল সাজেদ মিয়া, মো. জসিমউদ্দিন, রবিচন্দ্র ঘোষ, মো. নিজামউদ্দিন এবং মো. মহিউদ্দিন।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রথম স্মারক ভাস্কর্য হলো গাজীপুরের জাগ্রত চৌরঙ্গী। চান্দনা চৌরাস্তায় ১৯শে মার্চ পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিরোধে শহীদ হুরমত আলীসহ বীর শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধার নিদর্শনস্বরূপ এটি নির্মিত হয়। একই সময়ে প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধযুদ্ধের স্মারক হিসেবে ভাওয়াল রাজবাড়ি (বর্তমান জেলা প্রশাসকের কার্যালয়)-র সম্মুখে স্থাপন করা হয় ভাস্কর্য ‘জাগ্রত উনিশে’। ১৯শে মার্চকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য গাজীপুর বাজার-সংলগ্ন গণমঞ্চটির নাম ‘উনিশে মঞ্চ’ এবং তৎসংলগ্ন চত্বরটির নাম ‘উনিশে চত্বর’ রাখা হয়। গাজীপুর সার্কিট হাউসের সামনে নির্মিত হয়েছে ভাস্কর্য ‘অণুপ্রেরণা-১৯’। শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে প্রথম ‘সামরিক মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর’ নির্মাণ করা হয় ভাওয়াল রাজবাড়িতে। এখানে বিশেষভাবে স্থান পেয়েছিল শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যবহৃত জিনিসপত্র, পোশাকাদি, সনদ প্রভৃতি। পরবর্তীতে রাজবাড়ি থেকে সেনাছাউনি উঠে গেলে জাদুঘরটি বিলুপ্ত হয়। টঙ্গী শিল্প এলাকায় স্কুইব ফার্মাসিউটিক্যালস-এর সম্মুখে বাংলাদেশের অভ্যুদয়কে নবজাতকের সঙ্গে তুলনা করে নির্মিত হয়েছে ভাস্কর্য ‘ওম্’। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে নির্মিত হয়েছে ‘স্মৃতির মিনার’ ও ম্যুরাল চিত্র স্বাধীনতা। এছাড়া প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ‘মুক্তিযুদ্ধ বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ গবেষণা ইনস্টিটিউট’ (বর্তমানে এটি ঢাকার ধানমন্ডি-তে অবস্থিত)। বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে নির্মিত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি সংরক্ষণাগার ‘মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিকর্ণার’। রাজেন্দ্রপুর সেনানিবাসে মুক্তিযুদ্ধের স্মারক ভাস্কর্য হিসেবে নির্মিত হয়েছে রক্তসোপান। এতে সেনা অর্ডন্যান্স কোরের ৪৫ জন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার পরিচয় ও অবদান তুলে ধরা হয়েছে। অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরিতে নির্মিত হয়েছে ২১ জন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার নামাঙ্কিত অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরি স্মৃতিফলক। মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের স্মরণে গাজীপুর চৌরাস্তার নিকট নির্মিত হয়েছে ‘গাজীপুর পৌরতোরণ’। টঙ্গীর শিল্পনগরীতে মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের স্মরণে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে ‘শহীদ স্মৃতি উচ্চ বিদ্যালয়’। ভাওয়াল রাজবাড়ির মাঠে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের পাশে স্থাপন করা হয়েছে কতিপয় শহীদের নামসম্বলিত ‘শহীদ স্মারক কালো পাথর’। শহীদ মুক্তিযোদ্ধা নিয়ামতের নামে মেশিন টুলস ফ্যাক্টরি সড়কের একটি শাখা- সড়কের নামকরণ করা হয়েছে ‘শহীদ নিয়ামত সড়ক’। শহরের জোড়পুকুর পাড় থেকে শ্মশান পর্যন্ত সড়কটির নামকরণ করা হয়েছে শহীদ মুক্তিযোদ্ধা খররুমের নামানুসারে ‘শহীদ খররুম সড়ক’। শ্মশানঘাট থেকে রাজবাড়ি পানির ট্যাংক পর্যন্ত এক কিলোমিটার দীর্ঘ সড়কটির নামকরণ করা হয়েছে শহীদ বদরুদ্দোজা ভূঁইয়ার নামে। রাজবাড়ির পশ্চিম পাশের দিঘিটির নামকরণ করা হয়েছে ‘শহীদ শাহ আলম লেক’। রাজবাড়ির মাঠের নামকরণ করা হয়েছে ‘শহীদ বসির উদ্দিন ফুটবল গ্রাউন্ড’। এ উপজেলার পুলিশ সদস্য তাজুল ইসলাম ময়মনসিংহে কর্মরত অবস্থায় পাকবাহিনীর হাতে শহীদ হন। তাঁর নামানুসারে ময়মনসিংহ শহরে ‘শহীদ তাজুল সড়ক’ নামে একটি সড়কের নামকরণ করা হয়েছে। গাজীপুর জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে স্থাপন করা হয়েছে বঙ্গবন্ধু ও তাজউদ্দীন আহমদ-এর ছবি সম্বলিত ম্যুরাল। এছাড়া সালনায় ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়’ এবং শহরে ‘শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল’ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। [মনিরুজ্জামান শাহীন]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৩য় খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!