আন্তর্জাতিক আইন ও বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধের বিচার
শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন শিক্ষক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি উত্থাপিত হওয়ায় জামাতে ইসলামী ও তাদের প্রতি যাদের সহানুভূতি রয়েছে তাদের পক্ষ থেকে কয়েকটি প্রশ্ন উত্থাপন করা হয়েছে। এছাড়া সুশীল সমাজের মধ্যে অবস্থান নিয়ে একশ্রেণির বর্ণচোরা বুদ্ধিজীবী জনগণকে বিভ্রান্ত করছেন। তারা বলছেন – ১. বাংলাদেশে কোনাে যুদ্ধাপরাধী নেই, ২, বঙ্গবন্ধুর সাধারণ ক্ষমা ঘােষণার পর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কোনাে প্রশ্নই উঠতে পারে না ৩. মুক্তিযুদ্ধের ৪৩ বছর পর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কথা বলে জাতিকে বিভক্ত করার চেষ্টা হচ্ছে। শুধুমাত্র পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর যেসকল সদস্য গণহত্যা ধর্ষণ ও লুটতরাজের সঙ্গে জড়িত ছিল তারাই শুধু যুদ্ধাপরাধী বিষয়টি কিন্তু এমন নয়। বাংলাদেশ দালাল (বিশেষ ট্রাইব্যুনালস) আদেশ, ১৯৭২-এর ২ নম্বর ধারায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সহযােগী কারা তা সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল) আইন, ১৯৭৩-এর ৩ ধারায় গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ, শান্তি ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধকে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। এ দুটো আইনকে এক সঙ্গে পড়লে এবং শান্তি। কমিটি, রাজাকার, আল-বদর ও আল-শামস বাহিনীর সদস্য কারা ছিলাে তার সরকারি নথি দেখলেই এটা পরিষ্কার হয়ে যায় যে, জামায়াতে ইসলামীর এখনকার নেতৃত্বের অনেকেই যুদ্ধাপরাধের সঙ্গে জড়িত ছিলাে। দ্বিতীয় যে কথাটি জামাতী নেতৃবৃন্দ ও বুদ্ধিজীবীরা বঙ্গবন্ধুর উদ্ধৃতি দিয়ে বলতে চান সেটি হচ্ছে, বঙ্গবন্ধু যুদ্ধাপরাধীদের ক্ষমা করে দিয়েছিলেন। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে বঙ্গবন্ধুর সরকার পাকিস্তানি বাহিনীর এদেশীয় দোসরদের বিচারের জন্য বাংলাদেশ দালাল (বিশেষ ট্রাইব্যুনালস) আদেশ, ১৯৭২ জারি করেছিলেন। এ ব্যাপারে সাধারণ ক্ষমা ঘােষণা করলেও, যাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযােগ ছিল তাদের ক্ষমা করা হয়নি।
দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য সাবেক সেনাশাসক জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে ১৯৭৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর বাংলাদেশ দালাল (বিশেষ ট্রাইব্যুনালস) আদেশ, ১৯৭২ বাতিল করে দেন। তৃতীয় যে কথাটি জামাতীরা বলতে চান সেটি হচ্ছে, আদর্শিকভাবে মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে তারা কোনাে ভুল করেননি। মুক্তিযুদ্ধের এত বছর পর। যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে বিচারের কথা বলে জাতিকে বিভক্ত করার চেষ্টা হচ্ছে। আমরা এমন এক দুর্ভাগা জাতি যে, যে মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বিরােধিতা জামাতে ইসলামী নেতৃবৃন্দ করেছিলাে, সেই বাংলাদেশ রাষ্ট্রে বসেই তারা মুক্তিযুদ্ধ , মুক্তিযােদ্ধা ও বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বক্তব্য দিচ্ছেন। তবে মূল বিষয় হচ্ছে সময়ের দোহাই দিয়ে তারা বিচারের দায় এড়াতে চান, যদিও এ বিষয়ে আইন তাদের সহযােগিতা করবে না। কেননা দণ্ড আইনের সাধারণ নীতি হচ্ছে কোনাে ব্যক্তি অপরাধ করলে তার বিচার সময় দ্বারা তামাদি হয়ে যায় না। উপরক্ত যুদ্ধাপরাধের বিচার ও শাস্তির ব্যাপারে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক আইন আরও কঠোর । ৪০ বছর কেন, ১০০ বছর পরেও বাংলাদেশ বা বিশ্বের যে কোনাে দেশের আদালত অথবা ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্ট একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করতে পারবে। আন্তর্জাতিক আইনে এবং সকল সভ্য গণতান্ত্রিক দেশের জাতীয় আইনে গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ, শান্তি ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধকে বর্বরতম অপরাধ বলে গণ্য করা। হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সময় থেকে এ পর্যন্ত গণহত্যা, ধর্ষণ, লুটতরাজ ও যুদ্ধাপরাধের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিচারের জন্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অনেক ট্রাইব্যুনাল গঠিত হয়েছে। অনেক দেশের আদালত জাতীয় বা আন্তর্জাতিক অথবা উভয় আইন প্রয়ােগ করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করে শাস্তি দিয়েছে। বাংলাদেশেও যথাযথ আইন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই এগিয়ে চলছে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কাজ। এটি যত দ্রুত শেষ করা যাবে জাতির জন্য ততই মঙ্গল।
সূত্র : ফিরে-দেখা-৭১-যুদ্ধাপরাধীদের-বিচার-সুজন-হালদার