গরুচৌকা খাল যুদ্ধ (তজুমদ্দিন, ভোলা)
গরুচৌকা খাল যুদ্ধ (তজুমদ্দিন, ভোলা) সংঘটিত হয় নভেম্বর মাসের শেষদিকে। ভোলা জেলার মুক্তিযুদ্ধে এটি একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। এ-যুদ্ধে ১৮ জন পাকিস্তানি সেনা ও ১৩ জন রাজাকার- মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে আত্মসমর্পণ করে।
নভেম্বর মাসের শুরুতে ভারতীয় সেনাদের নিয়ে মিত্রবাহিনী গঠিত হলে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের গতি বহুগুণ বেড়ে যায়। দেশে প্রায় সব স্থানে মুক্তিবাহিনীর কাছে পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের সহযোগীদের পরাজয়ের সংবাদ আসতে শুরু করে। এমন প্রেক্ষাপটে ২১শে নভেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীর একটি দল তাদের সহযোগী রাজাকারদের নিয়ে নোয়াখালী জেলার মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে তিনটি নৌকাযোগে ভোলা জেলার তজুমদ্দিনের দিকে রওয়ানা দেয়। নোয়াখালীর স্থানীয় লোকেরা দ্রুত এ খবর ভোলার মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পৌঁছে দেয়। এ- সময় বোরহানগঞ্জে কমল মিত্রের বাড়িতে প্রায় ৪০ জন এবং বোরহানউদ্দিনের হাওলাদার বাড়ি ক্যাম্পে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল অবস্থান করছিল। মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে এ সংবাদ পৌঁছলে তাঁদের একটি দল দৌলতখান শহর রক্ষা বাঁধের দিকে, অপর একটি দল নৌকাযোগে মির্জাকালু বাজারের উত্তর-পূর্ব দিকে ব্যাপারী বাড়ি পর্যন্ত গিয়ে বাঁধের ওপর পৌঁছে। দলটি গরু চৌকা খালের কাছে এলে পাকিস্তানি বাহিনী নৌকা থেকে গুলি ছোড়ে। মুক্তিযোদ্ধারাও বাঁধের আড়ালে অবস্থান নিয়ে তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে বাঁধের উত্তর, দক্ষিণ ও মধ্যভাগ থেকে আক্রমণ চালাতে থাকেন। এভাবে দীর্ঘ সময় গোলাগুলি চলতে থাকলে সন্ধ্যা নেমে আসে। এরই মধ্যে চারদিক থেকে স্থানীয় জনতা মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানের চারদিকে জড়ো হতে থাকে। শিশু-কিশোররা গাছের ডালে উঠে পাকিস্তানিদের অবস্থান লক্ষ করে মুক্তিযোদ্ধাদের জানাতে থাকে। মুক্তিযোদ্ধাদের সীমিত গোলা-বারুদ ফুরিয়ে এলে তাঁরা গুলি বর্ষণের গতি কমিয়ে দিয়ে পাকিস্তানি সেনাদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করতে থাকেন।
কৌশল পরিবর্তন করে মুক্তিযোদ্ধারা তাঁদের মধ্য থেকে দক্ষ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাকে বরিশালের গৌরনদীর ক্ষিরোদ চন্দ্র ও ল্যান্স নায়েক মো. হানিফকে ২টি গ্রেনেড দিয়ে পাকিস্তানিদের নৌকাগুলো ধ্বংস করতে পাঠান। মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানিদের নৌকার কাছাকাছি পৌঁছলে পাকিস্তানি বাহিনীর দলনেতা সুবেদার আবদুল মালেক আত্মসমর্পণের ঘোষণা দেয়। যুদ্ধের রীতি অনুসারে মুক্তিযোদ্ধারা তার প্রস্তাবে সাড়া দেন। আলাপ-আলোচনার পর সুবেদার আবদুল মালেক তার অস্ত্রটি প্রথমে মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মো. ওবায়েদ মিয়ার কাছে প্রদানের মাধ্যমে আত্মসমর্পণ করে। এরপর একে-একে ১৮ জন পাকিস্তানি সেনাসদস্য ও সন্দ্বীপ থেকে আগত ১৩ জন রাজাকার মুক্তিবাহিনীর নিকট আত্মসমর্পণ করে। পরবর্তীতে ৯নং সেক্টর কমান্ডার মেজর এম এ জলিলের নির্দেশে তাদের বরিশালে পাঠিয়ে দেয়া হয়। কমান্ডার মো. ওবায়েদ মিয়ার নেতৃত্বে এ-যুদ্ধে মাহফুজুর রহমান, আলী আকবর হোসেন, চৌধুরী মিন্টু মিয়া, সুবেদার এম এ রশিদ প্রমুখ মুক্তিযোদ্ধা অংশগ্রহণ করেন। এ-যুদ্ধে জয়ের ফলে তজুমদ্দিন উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়। গরু চৌকা খালের পাড়ে সংঘটিত হওয়ায় এটি গরু চৌকা খাল যুদ্ধ নামে পরিচিত। [রেহানা পারভীন]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৩য় খণ্ড