গল্লামারী বধ্যভূমি (খুলনা শহর)
গল্লামারী বধ্যভূমি (খুলনা শহর) খুলনা শহরে অবস্থিত। মুক্তিযুদ্ধের সময় এখানে বহু লোককে হত্যা করা হয়।
বাংলাদেশের বৃহৎ বধ্যভূমিসমূহের অন্যতম খুলনার গল্লামারী বধ্যভূমি। মুক্তিযুদ্ধের সময় গল্লামারী ছিল খুলনা শহরের পশ্চিমে নির্জন একটি এলাকা। বর্তমানে এটি জনবহুল এলাকা। সে-সময় গল্লামারী নদীর ওপর পাকা সেতু ছিল না, ছিল কাঠের পুল। খুলনা-সাতক্ষীরা সড়কও ছিল না। যান চলাচলের রাস্তা না থাকায় খুলনা শহরের সঙ্গে বটিয়াঘাটা ও দাকোপ উপজেলার যোগাযোগ ছিল নদীপথে। বর্তমান খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরনো দোতলা প্রশাসনিক ভবনটি তখন ছিল একতলা। এ ভবনটিতে ছিল খুলনা রেডিও স্টেশন। এখান থেকে বেতার কার্যক্রম সম্প্রচার করা হতো। রেডিও স্টেশন নিয়ন্ত্রণের জন্য মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই পাকিস্তানি সেনারা এ ভবনের দখল নেয় এবং এর চারপাশের নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করে। পাকসেনাদের ভয়ে এ ভবনের আশপাশে তেমন কেউ যেত না। ভবনটি নির্জন এলাকায় হওয়ায় এটি নির্যাতনকেন্দ্র এবং এর পাশের গল্লামারী বিল এবং নদীর আশপাশের এলাকা হয়ে ওঠে বধ্যভূমি। বেতার ভবনের পেছনে একটি দোচালা ঘর ছিল। এর সামনের চত্বর নির্যাতনকেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হতো। এখানে মুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিযুদ্ধের সমর্থকদের ঘরের কাঠের সঙ্গে পা ওপরের দিকে বেঁধে ঝুলিয়ে নির্মমভাবে শারীরিক নির্যাতন করা হতো। এছাড়া ঘরের সামনে গাছের ডালে ঝুলিয়েও নির্যাতন করা হতো। নির্যাতনে কারো কারো মৃত্যু হতো, কাউকে গুলি করে অথবা বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে-খুঁচিয়ে আবার কাউকে জবাই করে হত্যা করা হতো।
খুলনা শহর ও এর আশপাশের এলাকা থেকে প্রতিদিন শতশত মানুষকে ধরে এনে জেলখানা, হেলিপ্যাড ও ইউএফটি ক্লাবে রাখা হতো এবং তাদের ওপর অকথ্য নির্যাতন চালানো হতো। এরপর মধ্যরাতে তাদের হাত, পা ও চোখ বেঁধে ট্রাকে করে গল্লামারী এনে নদীর তীরে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করে নদীতে ফেলে দেয়া হতো। সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করানো মৃত্যুপথযাত্রী মানুষগুলোর গগনবিদারী আর্তচিৎকারে গভীর রাতে গল্লামারীর কাছাকাছি এলাকার লোকজনের ঘুম ভেঙ্গে যেত। পাকহানাদাররা গল্লামারীতে ধরে আনা শতশত মানুষকে প্রথমদিকে গুলি করে এবং পরে গুলির পরিবর্তে জবাই করে হত্যা করা শুরু করে। জবাই করার কাজে নিয়োজিত ছিল অবাঙালি বিহারিরা। বাঙালি নিধনে তারা খুবই উৎসাহী ছিল। গল্লামারীতে লঞ্চ, বাস, ট্রেনসহ বিভিন্ন পরিবহনের যাত্রীদের ধরে এনে হত্যা করা হতো। যুদ্ধপরবর্তীতে এখানে শতশত মানুষের লাশ, কঙ্কাল, হাড়-গোড় ও মাথার খুলি পাওয়া যায়। গল্লামারী বধ্যভূমিতে নিহত অসংখ্য মানুষের মধ্যে যাদের নাম- পরিচয় পাওয়া গেছে, তারা হলেন— মাহাতাব বিশ্বাস (গড়খালি, দাকোপ), শান্তিলতা সাহা (পিতা অভিলাষ সাহা, দামোদর সাহাপাড়া, ফুলতলা), বেজে মল্লিক (পিতা কান্তারাম মল্লিক, টোলনা, ডুমুরিয়া), আবুবকর ফকির (পিতা ইউছুফ ফকির, টোলনা, ডুমুরিয়া), ইদ্রিস মোল্লা (পিতা হারেজ মোল্লা, টোলনা, ডুমুরিয়া), সোফাল মণ্ডল (পিতা পাচো মণ্ডল, টোলনা, ডুমুরিয়া), রমজান বিশ্বাস (পিতা আরামদি বিশ্বাস, টোলনা, ডুমুরিয়া), হামান বিশ্বাস (পিতা নয়েজ আলী বিশ্বাস, টোলনা, ডুমুরিয়া), মতলেব সরদার (পিতা বন্দে আলী সরদার, পিপরাইল, ফুলতলা), হালিম শেখ (পিতা হারেজ আলী শেখ, পিপরাইল, ফুলতলা), হোছেন কারিকর (পিতা জোবান কারিকর, জামিরা, ফুলতলা), দলিল আকুঞ্জি (পিতা হানিফ আকুঞ্জি, জামিরা, ফুলতলা), রুহিদাস (দত্তগাতি, ফুলতলা), মো. রওশন আলী (রেলওয়ে ফুয়েল ইন্সপেক্টর, খুলনা), মো. আশরাফুজ্জামান (পিতা মো. রওশন আলী), গোলাম মাহবুব (পিতা মো. রওশন আলী) ও শামছুদ্দিন (রেলওয়ে কর্মকর্তা, খুলনা)। [শংকর কুমার মল্লিক]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৩য় খণ্ড