You dont have javascript enabled! Please enable it!

গল্লামারী রেডিও স্টেশন অপারেশন (খুলনা শহর)

গল্লামারী রেডিও স্টেশন অপারেশন (খুলনা শহর) পরিচালিত হয় দুবার ৩রা এপ্রিল ও ১৫ই ডিসেম্বর। দুটি অপারেশনই ব্যর্থ হয় এবং প্রথম অপারেশনে ৩ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। ১৬ই পাকসেনারা পালিয়ে গেলে মুক্তিযোদ্ধারা রেডিও স্টেশন দখল করেন।
মুক্তিযুদ্ধের সময় খুলনা রেডিও স্টেশনটি ছিল খুলনা শহরের পশ্চিম প্রান্তে গল্লামারীতে বর্তমান খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরনো প্রশাসনিক ভবনে। সে-সময় ভবনটি ছিল একতলা, বর্তমানে এটি দ্বিতলবিশিষ্ট। এর আশপাশে তখন আজকের মতো জনবসতি ছিল না। লোকজনের চলাচলের উপযোগী তেমন কোনো রাস্তাঘাটও ছিল না। পুরো এলাকাটি ছিল নির্জন। বেতারের শিল্পী, কলাকুশলী, কর্মকর্তা-কর্মচারী ছাড়া তেমন কেউ ঐ এলাকায় যেত না। ২৫শে মার্চ ঢাকায় ব্যাপক হত্যাযজ্ঞের পর সারাদেশের মতো খুলনাতেও পাকসেনারা অতিরিক্ত নিরাপত্তার ব্যবস্থা করে। সাধারণ মানুষ এতে ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। এ-সময় খুলনার মুক্তিযোদ্ধারা রেডিও স্টেশন দখল করার সিদ্ধান্ত নেন। খুলনা রেডিও স্টেশন দখল হতে পারে মনে করে পাকবাহিনী এখানে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করে। পাকবাহিনীর ব্যাপক ধরপাকড়ের কারণে মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা খুলনা শহরে থাকতে না পেরে রূপসা নদী পার হয়ে রূপসা উপজেলার নৈহাটি স্কুলে বসে অপারেশনের পরিকল্পনা করেন। মেজর জলিল, সুবেদার মেজর জয়নুল আবেদীন, নায়েক সিদ্দিকুর রহমান এবং শেখ কামরুজ্জামান টুকু ছিলেন মূল পরিকল্পনাকারী। অপারেশন কমান্ডার মনোনীত হন সুবেদার মেজর জয়নুল আবেদীন, রেডিও স্টেশন আক্রমণের অধিনায়ক কমান্ডার নায়েক সিদ্দিকুর রহমান এবং সমন্বয়কারী শেখ কামরুজ্জামান টুকু।
পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী ৩রা এপ্রিল রাত ১২টা ১মিনিটে রেডিও স্টেশন আক্রমণের লক্ষ্যে রাত ৯টায় রূপসার নৈহাটি স্কুল থেকে শেখ কামরুজ্জামান টুকু ২৫০ জনের মতো যোদ্ধা নিয়ে রওনা হন। রাত ১০টায় সতর্কতার সঙ্গে রূপসা নদী পার হয়ে তাঁরা খুলনার এপারে আসেন। তখন পাকসেনারা খুলনা শহরে টহল দিচ্ছিল। পরিকল্পনা অনুযায়ী রেডিও স্টেশনের কাছাকাছি এসে মুক্তিযোদ্ধারা দুটি দলে বিভক্ত হয়ে যান। সুবেদার মেজর জয়নুল আবেদীন শেরে বাংলা রোডের (বর্তমান সিটি কলেজের হোস্টেলের দক্ষিণ পাশে) একটি বাড়িতে অবস্থান নিয়ে কাট অফ গ্রুপের নেতৃত্ব দেন, যাতে খুলনা সার্কিট হাউজ থেকে পাকসেনারা রেডিও স্টেশনের দিকে আসতে না পারে। অন্য দলটি এগিয়ে যায় রেডিও স্টেশনের দিকে। রেডিও স্টেশনের দক্ষিণ, পূর্ব ও পশ্চিম দিক থেকে আক্রমণের সিদ্ধান্ত হয়। দক্ষিণ পাশে রেডিও স্টেশনের মূল গেইট অবস্থিত হওয়ায় শেখ কামরুজ্জামান টুকু নায়েক সিদ্দিককে নিয়ে সেখানে অবস্থান নেন। পশ্চিম পাশে যান নায়েক জব্বার এবং তাঁর বাহিনী। সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করে রাত সাড়ে ১২টার দিকে আক্রমণ শুরু হয়। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রের বিপরীতে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে ছিল দুই শতাধিকের মতো রাইফেল ও বন্দুক এবং কিছু বোমা আর অসীম দেশপ্রেম ও মনোবল। মুক্তিবাহিনী গুলি বর্ষণ শুরু করলে রেডিও স্টেশনের ভেতর থেকে পাকবাহিনীর সদস্যরা ব্যাপক পাল্টা গুলি চালায়। পাকিস্তানি সেনাদের অব্যাহত গুলিবর্ষণের মধ্যেও মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা মূল গেইটে যেতে সক্ষম হন। কিন্তু গেইট এবং দেয়াল ভাঙ্গার উপযুক্ত ব্যবস্থা না থাকায় তাঁরা মারাত্মক সমস্যার সম্মুখীন হন। পাকসেনারা মূল গেইট রক্ষার জন্য বৃষ্টির মতো গুলি ছুড়তে থাকে। এর মধ্যেই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দাদা ম্যাচ ফ্যাক্টরির কর্মচারী মুক্তিযোদ্ধা হাবিব দেয়াল টপকাতে গিয়ে এবং মুক্তিযোদ্ধা মোসলেম মূল গেইট টপকাতে গিয়ে পাকসেনাদের গুলিতে শহীদ হন। পাকিস্তানি সেনাদের অবস্থান সুরক্ষিত ভবনের মধ্যে এবং ছাদে হওয়ায় তারা সার্চ লাইটের আলোয় দেখে-দেখে গুলি চালাতে থাকে। ভোর পর্যন্ত এ অবস্থা চলতে থাকে।
মুক্তিবাহিনী দ্বারা রেডিও স্টেশন আক্রান্ত হয়েছে এ খবর পাওয়ার পর খুলনা শহর থেকে সেনা কনভয় সেদিকে এগুতে থাকে। এদিকে খুলনা শহর থেকে বেতার কেন্দ্রের দিকে যাওয়ার একমাত্র পথ শেরে বাংলা রোডে গভীর রাতে এম্বুশে ছিল সুবেদার মেজর জয়নুল আবেদিনের নেতৃত্বাধীন মুক্তিযোদ্ধাদের দল। নিরালার মোড়ের কাছে জয়নুল আবেদিনের দলের সঙ্গে পাকসেনাদের ব্যাপক যুদ্ধ হয়। পাকসেনাদের অব্যাহত গুলি বর্ষণের এক পর্যায়ে জয়নুল আবেদিন তাঁর বাহিনীর সদস্যদের পিছু হটতে নির্দেশ দিয়ে একাই তাঁর অবস্থান থেকে গুলি চালাচ্ছিলেন। সেখানেই যুদ্ধ করতে-করতে তিনি শহীদ হন। এই প্রতিরোধ ভেঙ্গে গেলে পাকবাহিনীর কনভয় দ্রুতবেগে রেডিও স্টেশনের দিকে এগুতে থাকে। খবর পেয়ে শেখ কামরুজ্জামান টুকু অগ্রবর্তী বাহিনী ও অন্যান্য বাহিনীকে পিছু হটার নির্দেশ দেন এবং দলবল নিয়ে বটিয়াঘাটা বিল পার হয়ে রূপসায় ফিরে যান।
দ্বিতীয়বারের অপারেশন পরিচালিত হয় ১৫ই ডিসেম্বর। এদিন খুব ভোরে মুক্তিযোদ্ধারা খুলনা শহরের পশ্চিম প্রান্তের লায়ন্স স্কুল ও রেডিও স্টেশন পাকবাহিনী -রাজাকার-দের দখলমুক্ত করতে আক্রমণ করেন। এটি ছিল পরিকল্পিত ও ব্যাপক আক্রমণ। ঐ সময় গল্লামারী যাওয়ার জন্য শহরের ময়লাপোতা মোড় থেকে মাত্র একটি রাস্তা ছিল, বটিয়াঘাটা বা ডুমুরিয়ার দিকে যাওয়ার জন্য সরাসরি কোনো রাস্তা ছিল না। ময়ূর নদীর পর একটি ইটের রাস্তা চলে গিয়েছিল ধানক্ষেতের মধ্য দিয়ে। এর প্রান্তে একটি পাকা ভবন। সেটাই ছিল রেডিও স্টেশন। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই ঐ স্টেশনে পাকসেনারা অবস্থান নিয়েছিল। স্টেশনটি নির্যাতনকেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হতো। আশপাশের জলাভূমি ছিল বধ্যভূমি। অন্যদিকে গল্লামারীতে ময়ূর নদীর পূর্বপারের লায়ন্স স্কুলটি ছিল পাকবাহিনীর দোসর রাজাকারদের আস্তানা। গোটা এলাকাটি পাকবাহিনী ও রাজাকারদের নিয়ন্ত্রণে ছিল।
মুক্তিযোদ্ধারা তখন শহরের কাছাকাছি বটিয়াঘাটায়। শেখ কামরুজ্জামান টুকুর নেতৃত্বে তাঁরা রেডিও স্টেশন ও লায়ন্স স্কুল আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেন। এ অঞ্চলে চলাচলের পথ বলতে ছিল ময়ূর নদী। কিন্তু এ পথে এসে আক্রমণ করলে সহজে শত্রুপক্ষের নজরে পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা ছিল। তাই ঠিক হয় ধানক্ষেত ও গ্রামের বন-জঙ্গলের ভেতর দিয়ে এসে একটি দল গল্লামারী চর ও পাশের ইটভাটার আড়ালে এবং অন্য একটি দল গল্লামারীর পূর্বদিকে শেরে বাংলা রোডের কাছাকাছি অবস্থান নেবে। আর একটি দল থাকবে অপেক্ষাকৃত দূরে রূপসা নদীর কাছে।
পরিকল্পনা অনুযায়ী ১৫ই ডিসেম্বর ভোর রাতে মুক্তিযোদ্ধাদের দুটি দল লায়ন্স স্কুল এবং রেডিও স্টেশনের কাছাকাছি এসে অবস্থান নেয়। শতাধিক মুক্তিযোদ্ধার এ দলে নেতৃত্ব দেন স ম বাবর আলী ও শেখ আব্দুল কাইয়ুম। আক্রমণের সময়টি এমনভাবে বেছে নেওয়া হয় যখন নদীতে ভাটার সময়। আক্রমণের জন্য নদীর ভাটার এ সময়টি বেছে নেয়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে, ঐ এলাকার সবই নীচু জলাভূমি। স্থাপনা বলতে ছিল শুধু লায়ন্স স্কুল এবং রেডিও স্টেশন ময়ূর নদী এবং তদ্সংলগ্ন খালগুলো দিয়ে রূপসা নদীর জোয়ারের পানিতে নিচু ভূমি ডুবে যেত। ভাটার সময় বেশিরভাগ পানি সরে যেত। মুক্তিযোদ্ধারা এটি বিবেচনা করেই আক্রমণের পরিকল্পনা তৈরি করেন। শুরু হয় ঐ দুই স্থাপনা লক্ষ করে লেফটেন্যান্ট আরেফিনের মর্টার আক্রমণ। পাকসেনা ও রাজাকাররাও পাল্টা জবাব দিতে থাকে। দুই পক্ষের মধ্যে প্রচণ্ড গোলাগুলি চলে।
নদীতে ভাটা থাকার কারণে মুক্তিযোদ্ধারা ছিলেন সুবিধাজনক অবস্থানে। পানি ও কাদার ওপর পাকবাহিনীর গোলা-বারুদ- বিস্ফোরক পড়ে বিস্ফোরিত হচ্ছিল না। কিন্তু বেলা বাড়তে থাকায় নদীতে জোয়ার এসে পানি বেড়ে যাওয়ায় মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে সেখানে দাঁড়িয়ে আক্রমণ চালানো কঠিন হয়ে পড়ে। অন্যদিকে পাকসেনারা অপেক্ষাকৃত সুরক্ষার মধ্যে থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান দেখে পাল্টা আক্রমণ করছিল।
জলাভূমিতে নদীর জোয়ারে আসা পানিতে নিজেদের শরীর ডুবিয়ে রেখে মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধ করেন। কিন্তু সকালে দিনের আলো এবং জোয়ারের পানি তাদের বিপাকে ফেলে। নিজেদের আড়াল করে শত্রুর ওপর আক্রমণ করা কঠিন হয়ে পড়ে। অন্যদিকে শত্রুসেনারা মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান দেখে মর্টার আক্রমণ চালাতে থাকে। গোটা পরিস্থিতি মুক্তিযোদ্ধাদের বিপক্ষে যাওয়ায় তাঁরা পিছু হটতে বাধ্য হন। দ্বিতীয়বারের মতো রেডিও স্টেশন দখলের অভিযান ব্যর্থ হয়। পরের দিন ১৬ই ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধারা সংগঠিত হয়ে পুনরায় রেডিও স্টেশনের দিকে অগ্রসর হলে পাকসেনারা পালিয়ে যায় এবং মুক্তিযোদ্ধারা রেডিও স্টেশন দখল করেন। [শংকর কুমার মল্লিক ও গৌরাঙ্গ নন্দী]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৩য় খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!