You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে গণহত্যা

গণহত্যা ১৯৪৮ সালের ৯ই ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ কর্তৃক গৃহীত রেজুলেশন ২৬০(৩) অনুচ্ছেদ-২ অনুযায়ী ‘জেনোসাইড’ কথাটির সার্বিক অর্থ বিশেষ জাতি, গোষ্ঠী, ধর্মীয়, নৃতাত্ত্বিক বা এথনিক গ্রুপের সমষ্টিগত বিনাশ অথবা হত্যার প্রয়াস। পরিকল্পিত এ হত্যাকাণ্ড কেবল একটি জাতি বা গোষ্ঠীর জীবনের অধিকার অস্বীকার করাই নয়, এটি আপন মর্যাদা, বিশ্বাস ও সংস্কৃতি নিয়ে বেঁচে থাকার অধিকার বিলোপনও বটে।
যুদ্ধে, সংঘাতে অথবা বাহ্যত শান্তিকালীন সময়ে উস্কানিমূলক প্ররোচনার কারণে ব্যক্তি, সমষ্টি বা রাষ্ট্র কর্তৃক গণহত্যা সংঘটিত হয়। গণহত্যা সংঘটনের পেছনে প্রধানত যে নষ্ট- ইচ্ছা বা মনোজাগতিক বোধ কাজ করে, তা হলো ভয়াবহ ঘৃণা এবং বিদ্বেষপ্রসূত অসহিষ্ণুতা। অনেক ক্ষেত্রে জাতিগত অহঙ্কার, বিদ্বেষ, ঘৃণা, ধর্মভিত্তিক উন্মাদনা, ভারসাম্যহীন চিন্তা-চেতনা, নষ্ট দর্শন, অশুভ চিন্তা বা ভুল পথে পরিচালিত চিন্তা এবং সামগ্রিকভাবে আত্মপরিচয়ের সংকট এমন এক অসহিষ্ণুতা সৃষ্টি করে যা মানুষের মূল্যবোধ এবং মানবিক অনুভূতিকে রহিত করে গণহত্যার মতো ঘৃণ্যকর্মে ঠেলে দেয়। এ অসহিষ্ণুতাকে ব্যক্তিগত রোগ বা ব্যর্থতা না বলে সমষ্টিগত বোধবুদ্ধির অভাব এবং সংঘবদ্ধভাবে নষ্টকর্মে সম্পৃক্তি বলা যেতে পারে।
অতএব, জাতিগত-গোষ্ঠীগত বা ধর্মগত নিধনের উদ্দেশ্যে যদি একটি লোককেও হত্যা করা হয় সেটাও গণহত্যা। যদি কোনো জাতি, গোষ্ঠী বা বিশেষ ধর্মের মানুষের জন্ম রুদ্ধ করার প্রয়াস নেয়া হয় বা পরিকল্পিতভাবে বিশেষ জাতি ও গোষ্ঠীভুক্ত নারীর গর্ভে একটি ভিন্ন জাতির জন্ম দেবার চেষ্টা করা হয়, সেটাও গণহত্যা। তবে, শেষের বিষয়টিকে ‘জেনোসাইডাল রেপ’ (Genocidal Rape) বলা হয়। নানা যুদ্ধে নারী ধর্ষণকে অনেক সময় একটি অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এ অস্ত্রটি প্রতিপক্ষের মনোবল এবং অহংকারকে গুঁড়িয়ে দেবার জন্য প্রয়োগ করা হয়। অনুরূপভাবে নারী, শিশুসহ একটি সম্প্রদায়ের সকল সদস্য এবং গর্ভবতী নারীকে যদি হত্যা করা হয়, সেটি হবে একই সঙ্গে যেমন Ethnic Cleansing, তেমনি ‘জেনোসাইড’। শত্রুপক্ষের হাতে অবরুদ্ধ নারীর নানা প্রক্রিয়ায় গর্ভপাত ঘটানোও জেনোসাইডের অংশ।
পৃথিবীর ভয়াবহ গণহত্যাগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো— আসিরিয়ান গণহত্যা, গ্রিক গণহত্যা, মঙ্গোলীয় গণহত্যা, ভারতের পূর্বাঞ্চল ও দক্ষিণ অঞ্চলে আর্যগোষ্ঠী পরিচালিত গণহত্যা, আমেরিকা অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীদের ওপর পরিচালিত গণহত্যা, গুয়াতেমালা ও ল্যাটিন আমেরিকান গণহত্যা, কম্বোডিয়া, রুয়ান্ডা, সুদানের দার্ফু, বসনিয়া ও বাংলাদেশের গণহত্যা।
বিভিন্ন সময়ে পৃথিবীর নানা দেশে গণহত্যায় নিহত ৫০ মিলিয়ন মানুষের মধ্যে ৩ মিলিয়ন মানুষই বাংলাদেশের মাটিতে ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে প্রাণ হারায়। একই কারণে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ হওয়া ৫০ মিলিয়ন উদ্বাস্তুর মধ্যে ১০ মিলিয়ন মানুষ ৭১ সালে বাংলাদেশ থেকে শরণার্থী হিসেবে ভারতের মাটিতে আশ্রয় নেয়, যা ছিল সে-সময়ে পূর্ব বাংলার মোট জনসংখ্যার এক-সপ্তমাংশ।
১৯৭১-এর গণহত্যার প্রেক্ষাপট: ৭১-এর ২২শে ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান তার সহযোগী জেনারেল হামিদ, জেনারেল মিঠা, জেনারেল ইফতেখার জানজুয়া, পীরজাদা, গুল হাসান এরা সবাই মিলে আওয়ামী লীগ, তার সমর্থক ও পূর্ব বাংলার প্রগতিশীল জনগোষ্ঠীকে ধ্বংস করতে ব্যাপক গণহত্যার পরিকল্পনা করে।
তবে এ গণহত্যার পেছনে থাকা বহুমুখী প্রেক্ষাপট পূর্ব বাংলার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড বিশ্লেষণের মাধ্যমে যেমন স্পষ্ট হয়, তেমনি তা অকাট্য হয়ে ওঠে নানা দেশের গোয়েন্দা রিপোর্টেও। এ পরিকল্পিত অপরাধ কর্মটি দৃশ্যমান হয় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অপতৎপরতার মধ্য দিয়ে। শুরুতে এ পরিকল্পনা কিছুটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে ৬৯-এর ফেব্রুয়ারি থেকে ৭০-এর নির্বাচনের সময়টাতে। আরো স্পষ্ট হয় ৭০- এর নির্বাচনের পর থেকে মার্চের উত্তাল দিনগুলোতে। প্রতিটি গণহত্যার পেছনে যেমন একটি পূর্ব পরিকল্পনা থাকে, তেমনি থাকে নষ্ট দর্শনে উদ্বুদ্ধ কিছু পরিকল্পক বা prime perpetrators। পুনরায় প্রতিটি গণহত্যার পেছনে যেমন একটি সুতীব্র ঘৃণা ও রোষ কাজ করে, তেমনি একটি নষ্ট আত্মপরিচয় ক্রীয়াশীল থাকে। প্রায় শতভাগ ক্ষেত্রেই গণহত্যার পেছনে Racism, Racial Discrimination, Xenophobia, Discrimination ও অসহিষ্ণুতা কাজ করে। এর পেছনে থাকে ভয়াবহ লোভ, দ্বেষ ও ঘৃণা। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী মনস্তাত্ত্বিকভাবে এমন নেতিবাচক বৃত্তেই আবদ্ধ ছিল। আবার প্রতিটি গণহত্যার পেছনে যেমন কিছু লক্ষ্য থাকে, তেমনি ৭১-এ বাংলাদেশে সংঘটিত গণহত্যার পেছনেও একটি ভয়াবহ লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল। এ উদ্দেশ্যপরিচালিত ভাবনায় আবিষ্ট হয়ে পাকিস্তানি শাসকচক্র বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীকে নিচু জাতি বা মানবেতর প্রাণী মনে করে এবং ব্যাপক জনগোষ্ঠীকে মনে করত কেবল কতগুলো প্রাণীর সমষ্টি, ভিন্ন কিছু নয়। এ কারণে মানবিক মূল্যবোধকে বিসর্জন দিয়ে বাংলার মাটিতে dehumanization প্রক্রিয়াটি কার্যকর করতে তাদের মানবিক বোধ ও চেতনা কাজ করেনি এতটুকু। বাঙালির অসাম্প্রদায়িক বা সংশ্লেষণাত্মক (Syncretistic) সংস্কৃতিকে তারা দেখেছে হিন্দু সংস্কৃতি হিসেবে। তাই তাদের মূল লক্ষ্য ছিল সমূলে হিন্দু এবং বাঙালি সংস্কৃতির ধারক ও বাহক বাঙালি জনগোষ্ঠীকে নির্মূল ও অবদমন করা। এ নষ্ট কার্যে তারা সুপরিকল্পিতভাবে ব্যবহার করেছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনীসহ পূর্ব পাকিস্তানে আশ্রয় নেয়া অবাঙালি (বিহারি) এবং সুবিধাভোগী এদেশীয় দালাল তথা ধর্মান্ধ গোষ্ঠীকে।
৭১-এর গণহত্যার পরিকল্পনা: পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এ ধ্বংসাত্মক পরিকল্পনার পেছনে ছিল পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টোসহ একশ্রেণির রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, শিল্পপতি ও সামরিক-বেসামরিক এলিটরা। এ ব্যাপারে ৭১-এর ফেব্রুয়ারিতে ইয়াহিয়া ও ভুট্টোর মধ্যে সমঝোতা হয়। এমনকি ভুট্টো দেশে সাধারণ নির্বাচন না দিয়ে জেনারেল ইয়াহিয়ার সঙ্গে ক্ষমতা ভাগাভাগি করে দেশ শাসনের পক্ষে ছিল। ১৯৭০ সালের নির্বাচনের কয়েক মাস পূর্বে ভুট্টো ইয়াহিয়াকে বলেছিল, ‘East Pakistan is no problem. We will have to kill some 20,000 people there and all will be well’ (Asghar Khan, We’ve Learnt Nothing from History)|
এ প্রেক্ষাপটে ৭০-এর নির্বাচনের পর থেকেই গোপনে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তানে সমরাস্ত্রসহ পাকিস্তানি সেনাসদস্যদের আনা হয়। এর মধ্যে নিধনযজ্ঞে উৎসাহী এবং প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কমান্ডোও ছিল। গণহত্যা সংক্রান্ত প্রাথমিক পদক্ষেপ অপারেশন সার্চলাইট-এর পরিকল্পনা একাত্তরের ফেব্রুয়ারি থেকেই অনেক পাকিস্তানি জেনারেলের মাথায় ছিল। তখন এ সংক্রান্ত কিছু চিঠি চালাচালিও হয়েছিল গোপনে। তবে চূড়ান্ত আঘাতের খসড়া পরিকল্পনাটি তৈরি করে জেনারেল খাদিম হোসেন রাজা (জিওসি) ও জেনারেল রাও ফরমান আলী খান। তারা ঢাকায় জিওসি-র অফিসে বসে এটি প্রণয়ন করে। মূল অপারেশন পরিকল্পনাটি তৈরি করে জেনারেল রাও ফরমান আলী খান। তার হাতেই তৈরি হয় পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম গণহত্যার চূড়ান্ত পরিকল্পনা। এ সবই হচ্ছিল পর্দার অন্তরালে। রাজনীতিবিদরা যখন গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় আলোচনার টেবিলে ন্যায্য সমাধানের পথ খুঁজছিলেন এবং জনগণও যখন একটি শান্তিপূর্ণ সমাধান প্রত্যাশা করছিল, ঠিক তখন ভয়ঙ্কর এক শঠতার আশ্রয় গ্রহণ করে পাকিস্তানি সামরিক শাসকচক্র। এটা কোনো তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত ছিল না। অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে তারা এদেশের রাজনীতিবিদ, প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবী এবং ছাত্র, কৃষকসহ যুব শক্তিকে নিশ্চিহ্ন করে সমগ্র জাতিকে পদানত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে ঠাণ্ডা মাথায়। এ গণহত্যা চলমান ছিল ৭১-এর নয় মাস ধরে।
গণহত্যার লক্ষ্য ও অপরাধের মাত্রা বা পরিধি: ৭১-এর ২৫শে মার্চ রাতে নিরীহ, নিরপরাধ ঘুমন্ত জনগণের ওপর অতর্কিতে হামলা চালিয়ে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী শুরু করে তাদের ঘৃণ্য অপারেশন সার্চলাইট। স্কুল, কলেজ, ছাত্রাবাস, শিক্ষকদের আবাসস্থল, ইপিআর, পুলিশ ও বাঙালি সৈনিকদের ওপর তারা চড়াও হয়। ট্যাংক ও কামানের গোলায় পাকিস্তানি বাহিনী ধ্বংস করে শিক্ষকদের আবাসস্থল, সাধারণ জনগণের ঘরবাড়ি ও বিস্তৃত জনপদ। হালকা ও ভারী মেশিনগানে ছিন্নভিন্ন করে বহুসংখ্যক বাঙালি বুদ্ধিজীবী, পেশাজীবী, ছাত্র ও অগণিত জনতাকে। বিশ্লেষণে দেখা যায়, গণহত্যার প্রধান লক্ষ্য ছিল- ক. বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের ছাত্র-শিক্ষক ও বুদ্ধিজীবী, খ. সেনাবাহিনী, পুলিশ, ইপিআর ও আনসারের বাঙালি সদস্য, গ. আওয়ামী লীগ, এর সমর্থক-স্বেচ্ছাসেবক ও কল- কারখানায় স্বাধীনতার পক্ষের শ্রমিক নেতৃবৃন্দ, ঘ. হিন্দু সম্প্রদায়, ঙ. যুব সম্প্রদায়, চ. পেশাজীবী, এবং ছ. মুক্তিযুদ্ধের সমর্থক হিসেবে পরিচিত লোকজন।
২৫শে মার্চ ১৯৭১ নির্বিচার গণহত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, লুটতরাজ এবং তীব্র জাতিগত বিদ্বেষ ও ঘৃণার মধ্য দিয়ে যে অপারেশন সার্চলাইট-এর সূচনা হয়, তা অচিরেই সমগ্র দেশকে গ্রাস করে। বাঙালি বনাম পাকিস্তানিদের মধ্যকার ৭১-এর যুদ্ধ কোনো সিভিল ওয়ার ছিল না। পাকিস্তানিদের পক্ষে এটি ছিল একটি সুপরিকল্পিত গণহত্যা ও জাতিগত ধ্বংসযজ্ঞ, আর বাঙালিদের জন্য ছিল মুক্তিযুদ্ধ। পাকহানাদার বাহিনীর বর্বরতা, গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞের তুলনা চলে শুধু ইহুদি ও রাশিয়ার যুদ্ধবন্দিদের প্রতি নাৎসি আচরণের সঙ্গে।
বাংলাদেশের জনগণের ওপর পাকিস্তানি হানাদারদের আগ্রাসন ও হত্যাযজ্ঞ কতটা পরিকল্পিত ছিল তার প্রমাণ পাওয়া যায় ঐ সময়ে চট্টগ্রামের রেজিমেন্টাল সেক্টর কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এম আর মজুমদারের সাম্প্রতিক বক্তব্যে। তিনি ১৬ই জুন ২০০৩ ‘ওয়ার ক্রাইম্‌স ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটি’কে দেয়া বিশেষ সাক্ষাৎকারে বলেন যে, ৭০- এর ডিসেম্বরের শেষে বা ১৯৭১ সালের জানুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে তিনি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নিকট থেকে একটি চিঠি পেয়েছিলেন। ঐ চিঠিতে কর্তৃপক্ষ জানান যে, শেখ মুজিবের ৬-দফা বাস্তবায়িত হলে পাকিস্তান আর্মিতে পশ্চিম পাকিস্তানের আধিপত্য ক্ষুণ্ন হবে এবং তাদের সামরিক স্বার্থ ব্যাপকভাবে লঙ্ঘিত হবে। চিঠির শেষ অংশে লেখা ছিল— ‘Therefore the Army cannot allow Sheikh Mujib to become the Prime Minister of Pakistan.’ ঐ চিঠিতে Director Military Operations (DMO)/Director Military Intelligence-এর স্বাক্ষর ছিল।
পরবর্তীতে পাকিস্তানি শ্বেতপত্রে চট্টগ্রামের পাহাড়তলী এলাকায় বাঙালি-বিহারি দাঙ্গার যে প্রসঙ্গ উল্লেখ করা হয়, তা ছিল বস্তুত পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের কমান্ডো দ্বারা পরিকল্পিত। ঐ দাঙ্গায় রেলওয়ে কলোনি এলাকায় নিহতদের মধ্যে বাঙালির সংখ্যাই ছিল বেশি এবং তাদের ঘরবাড়িই বেশি পোড়ানো হয়েছিল। দাঙ্গায় নেতৃত্বদানকারীদের মধ্যে একজন ছিল সেনাবাহিনীর পাঞ্জাবি ক্যাপ্টেন।
৭১-এ বাঙালি জাতিকে চিরতরে নির্মূলের লক্ষ্যে উর্ধ্বতন পাকিস্তানি সমরনায়ক এবং তাদের অধঃস্তন সেনারা মানবতাবিরোধী যে অপরাধসমূহ সংঘটিত করে, তা হলো-
১. ২৫শে মার্চ থেকে শুরু করে ডিসেম্বর পর্যন্ত ঢাকা শহরসহ দেশের সর্বত্র নির্বিচার হত্যা, ধর্ষণ, লুটপাটসহ ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ ও গণহত্যা;
২. সামরিক পদক্ষেপ শুরুর পর গ্রামাঞ্চলগুলোতে তথাকথিত দুষ্কৃতিকারী দমনের নামে নির্বিচার হত্যা, অগ্নিসংযোগ ও সাধারণের সম্পত্তি ধ্বংস;
শুধু সামরিক অভিযানের প্রথম দিকেই নয়, একাত্তরের ডিসেম্বরে যুদ্ধের চূড়ান্ত পর্যায়ে বুদ্ধিজীবী, ডাক্তার, প্রকৌশলী প্রভৃতি পেশাজীবীদের পরিকল্পিতভাবে হত্যা:
৪. ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অফিসার ও সৈন্যদের এবং ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস ও পূর্ব পাকিস্তান পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের নিরস্ত্র করার সময় বা বিদ্রোহ দমনের অজুহাতে তাঁদের শঠতামূলকভাবে হত্যা;
৫. পাকিস্তানি আর্মি অফিসার ও সৈন্যদের দ্বারা প্রতিশোধ, প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার জন্য এবং জাতির অহংকারকে ধ্বংস করার জন্য সাড়ে চার লাখের বেশি বাঙালি নারীকে নির্যাতন ও ধর্ষণ এবং বহুসংখ্যক নারীকে হত্যা:
৬. যুদ্ধ চলাকালে ও যুদ্ধ শেষে অন্তত সাড়ে সাতশ বাঙালি নারীকে ভোগের জন্য বন্দি করে পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া এবং পতিতালয়ে
আটকে রাখা:
৭. নির্দোষ বেসামরিক ব্যক্তিবর্গ ও প্রতিষ্ঠানকে সামরিক লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করা এবং ব্যাপক গণহত্যা;
৮. অনেক নিরপরাধ নারী-পুরুষকে আইনবহির্ভূতভাবে বন্দি করে নির্যাতন ও গুম করা; এবং সংখ্যালঘু হিন্দুদের পরিকল্পিতভাবে হত্যা, নির্যাতন, জাতিগত নিধন ও শুদ্ধি অভিযান।

উল্লিখিত মানবতাবিরোধী অপরাধ, যুদ্ধাপরাধ ও নারীনির্যাতন সংঘটনের দায়িত্ব এককভাবে পাকিস্তানি সেনাদের। পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর লে. জেনারেল টিক্কা খান এবং ঢাকা ৫৭তম ব্রিগেডের কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জাহানজেব আরবাব তাদের নিষ্ঠুরতার জন্য ‘পূর্ব পাকিস্তানের কসাই’ হিসেবে কুখ্যাত। বিচারপতি হামুদুর রহমান কমিশনের রিপোর্টসহ প্রকাশিত বিভিন্ন লেখা ও অনেকের সাক্ষাৎকারে এসব অপরাধের প্রমাণ মেলে।
ঘৃণা বা Apartheid : ৭১-এ বাঙালি নিধন ও গণহত্যার পেছনে পাকিস্তানি শাসক চক্রের চরম ঘৃণা এবং অবদমন ইচ্ছা প্রকাশ পেয়েছিল তাদের নানা বক্তব্যে, যেমন ইয়াহিয়া খান একবার এ উক্তিটি করে, ‘Kill three million of them, and the rest will eat out of our hands’ (Robrt Payne, Massacre)।এ উক্তির মধ্য দিয়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও সরকারের গণহত্যার প্রস্তুতি ও পরিকল্পনা সম্বন্ধে ধারণা পাওয়া যায়।
কুখ্যাত সামরিক শাসক আইয়ুব খান মনে করত, ‘Bengalees are lower class race, unfit to enjoy any kind of freedom, Pakistanis had every right to rule over the defeated nation- Bengalees’ (Robert Payne, Massacre; also Ayub Khan, Friends Not Master)| গণহত্যার প্রধান পরিকল্পনাকারীদের মনোভাব অনুধাবনের জন্য নিয়াজির একটি বক্তব্য উল্লেখযোগ্য, ‘Bengalees were often compared with monkeys and chickens.’ It was a low lying land of low lying people. The Hindus among the Bengalees were as Jews to the Nazis, scum and vermin that should best be exterminated.
As to the Muslim Bengalees, they are to live on the sufferances of the soldiers, any infraction, any suspicion cast on them, any need for reprisals could mean their death. And the soldiers were free to kill at will.’ (R.J Rummel, Death by Government.)
Journalist Dan Coggin, quoted one Punjabi Captain as telling him ‘we can kill any one for anything, we are accountable to none. This is arrogance of power’ (R.J Rummel, Death by Government.)
পাকিস্তানিদের লিঙ্গভিত্তিক নির্যাতনের একটি উল্লেখযোগ্য দিক ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ব্রাউমিলার তাঁর গ্রন্থে লিখেছেন, ‘Rape in Bangladesh had hardly been restricted to beauty, girls of 8 and grandmother of 75 had been sexually assaulted. Pakistani Soldiers had not only violated Bengalee women on the spot, they abducted tens of hundred and held them by force in their military barracks for nightly use. Some women have been raped as many as 80 times in a night . ‘ (Susan Browmiller, Against Our Will)
হত্যাকাণ্ডে পাকিস্তানি বাহিনীর শারীরিক নির্যাতনের ধরন: ওয়ার ক্রাইম্স ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটির গবেষণায় দেখা গিয়েছে, পাকসেনারা যে প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় মানুষের ওপর হত্যাকাণ্ড এবং হত্যাপূর্ব শারীরিক নির্যাতন চালায়, তার ধরনগুলো ছিল নিম্নরূপ-
১. সন্দেহজনক ব্যক্তিকে দেখামাত্র গুলি করা;
২. শক্ত-সমর্থ, তরুণ ও যুবকদের রাস্তা কিংবা বাড়িঘর থেকে বন্দি করে এনে চোখ বেঁধে সমষ্টিগতভাবে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে গিয়ে কিছু জিজ্ঞাসাবাদের পর শারীরিক নির্যাতন করা এবং পরিশেষে পেছনে হাত বেঁধে কখনো এককভাবে কখনো কয়েকজনকে এক সঙ্গে বেঁধে গুলি করে নদী, জলাশয় বা গর্তে ফেলে দেয়া;
৩. কখনো সবাইকে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে ব্রাশ ফায়ারে হত্যা করা;
৪.কখনো নিকটজনের সামনেই বন্দিদের এক-এক করে জবাই করা এবং দেহ টুকরো-টুকরো করা;
৫. সকলের সামনে বিভিন্ন অঙ্গচ্ছেদ করা অথবা বিভিন্ন অঙ্গে গুলি করে হত্যা করা;
৬. চোখ উপড়ে ফেলা;
৭. উলঙ্গ অবস্থায় উল্টো করে ঝুলিয়ে রেখে পা থেকে মাথা পর্যন্ত চামড়া ছিলে ফেলা;
৮. ভোঁতা অস্ত্র দিয়ে মাথায় আঘাত করে মাথা চূর্ণবিচূর্ণ করা এবং মুখ থেঁতলে মেরে ফেলা;
৯. বস্তায় ঢুকিয়ে বস্তার মুখ বেঁধে পিটিয়ে হত্যা করা অথবা বস্তাবন্দি অবস্থায় নদীতে ফেলে দেয়া;
১০. দড়ি দিয়ে বেঁধে লাথি, ঘুষি ও অন্যান্য আঘাতের দ্বারা থেঁতলে মেরে ফেলা;
১১. বাঁশ এবং রোলারের মধ্যে শরীর ও বিভিন্ন অঙ্গ চেপে ধরে মেরে ফেলা;
১২. বেয়নেট ও ধারালো অস্ত্র দিয়ে পেট এফোঁড়-ওফোঁড় করা, কখনো পেটের সমস্ত নাড়িভুঁড়ি বের করে কিংবা বুক চিরে হৃৎপিণ্ড উপড়ে ফেলা;
১৩. হাত-পা বেঁধে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করা;
১৪. পানি, অগ্নিকুণ্ড কিংবা বয়লারে নিক্ষেপ করে হত্যা করা ইত্যাদি।

৭১-এর হত্যাযজ্ঞ যে কতটা ব্যাপক, ভয়ঙ্কর ও পরিকল্পিত ছিল, তার প্রমাণ পাওয়া যাবে পাকিস্তানি বাহিনীর অসংখ্য গণহত্যা স্পটের কয়েকটি চিত্র দেখলেই। যেমন-
বাড়িয়া (গাজীপুর) গণহত্যায় একই দিনে পাকিস্তানি আর্মি হত্যা করে ২০০ জন নিরীহ গ্রামবাসীকে, যাদের মধ্যে ৪৫ জন ছিলেন নারী। একইভাবে তারা ছাব্বিশা (ভূঞাপুর, টাঙ্গাইল)-য় ৭ জন নারীসহ ৪০ জন, গোলাহাট (নীলফামারী)-এ ১০০ জন নারীসহ ৪১৩ জন, বানিয়াচং থানা (হবিগঞ্জ)-র জিলুয়া-মাকালকান্দিতে ২৬ জন নারীসহ ১০০ জন, কড়াইকাদিপুর (জয়পুরহাট)-এ ৬০ জন নারীসহ ৩৬১ জন, হাতিয়া-দাগারকুঠি (কুড়িগ্রাম)-তে ৪০ জন নারীসহ ৩০০ জন, সিলেটের বুরুঙ্গাতে হিন্দু সম্প্রদায়ের ১০০ জন, শ্রীমঙ্গলের ভাড়াউড়া চা বাগানে ৫০ জন নিরীহ মানুষকে হত্যা করে। এছাড়া খুলনার চুকনগর, বরিশালের আগৈলঝাড়া, মাদারীপুরের হাওলাদার জুট মিলস, বরগুনা জেলখানা, জয়পুরহাটের পাগলা দেওয়ানসহ দেশব্যাপী অসংখ্য গণহত্যা স্পটের বিবরণ ও সাক্ষ্য-প্রমাণ সন্নিবেশিত হয়েছে ‘যুদ্ধাপরাধ গণহত্যা ও বিচারের অন্বেষণ’ এবং ‘যুদ্ধ ও নারী ‘গ্রন্থে।

নিহতের সংখ্যার দিক থেকে গণহত্যাগুলোর মধ্যে শীর্ষে অবস্থান খুলনার চুকনগর ও চট্টগ্রামের পাহাড়তলী গণহত্যার। এছাড়াও নৃশংসতা ও নিষ্ঠুরতা বিচারে চট্টগ্রামের ফয়’স লেক গণহত্যা, শেরপুরের সোহাগপুর (বিধবাপল্লী) গণহত্যা, কিশোরগঞ্জের বরইতলা গণহত্যা, সৈয়দপুরের গোলাহাট গণহত্যা, সিলেটের বালাগঞ্জ উপজেলা (বর্তমান ওসমানী নগর)-এর বুরুঙ্গা গণহত্যা এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বুদ্ধিজীবী হত্যা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ৭১-এর ২০শে মে খুলনা জেলার ডুমুরিয়া থানার অন্তর্গত চুকনগর বাজার এলাকায় স্বাধীনতা যুদ্ধকালে স্বল্প সময়ের ব্যবধানে সবচেয়ে বড় গণহত্যাটি সংঘটিত হয়। ঐদিন চুকনগর বাজার ও তার আশপাশে এখানকার নিম্ন অঞ্চল থেকে প্রায় ১০ হাজার শরণার্থী ভারতে যাবার জন্য এসে জড়ো হয়। তারা এদিন রাতে সাতক্ষীরা ও কলারোয়া সীমান্ত দিয়ে ভারতে যাবার পরিকল্পনা নিয়েছিল। কিন্তু হঠাৎ করে সকাল ৯টায় সাতক্ষীরার দিক থেকে ৩-৪টি পাকিস্তানি আর্মির কনভয় এসে তাদের এলোপাতাড়ি গুলি করে। ১০ হাজার শরণার্থীর প্রায় সবাই তাদের গুলিতে নিহত হয়। তাদের মধ্যে ৭ জন ছিল স্থানীয়, বাকিরা সবাই বহিরাগত (দ্রষ্টব্য – চুকনগর গণহত্যা)।
চুকনগরের এরশাদ আলী মোড়ল ১৯৯৯ সালে ওয়ার ক্রাইমস্ ফ্যাক্টস্ ফাইন্ডিং কমিটিকে এক সাক্ষাৎকারে বলেন- চুকনগর বাজার থেকে এক কিলোমিটার দূরে একটি রাস্তা আছে যেখান থেকে মালথিয়া গ্রামে যাওয়া যায়। ঐ গ্রামে আমার বাড়ি। ১৯৭১ সালের ২০শে মে বৃহস্পতিবার ৯-৩০ মিনিটের সময় একটা মিলিটারির গাড়ি সাতক্ষীরার দিক থেকে চুকনগর আসে। ঐ গাড়িতে খান সেনা ও কিছু বাঙালি ছিল। আমি, আমার বাবা ও বড় ভাই একসাথে ঐ রাস্তার পাশের জমিতে হালচাষ করছিলাম। তখন মিলিটারির গাড়ি দেখে আমার বাবা আমার নাম ধরে বললেন, ‘এরশাদ, মিলিটারির গাড়ি আসছে, তাড়াতাড়ি পালিয়ে যা।’ এই কথা বলার সাথে-সাথে আমরা দৌড়ে দু’শ হাত দূরে আমাদের বাড়িতে চলে যাই। আমরা দূর থেকে দেখতে পেলাম খান সেনারা গাড়ি থেকে নেমে আমার বাবাকে কিছু জিজ্ঞেস করছে। কিন্তু কী জিজ্ঞেস করছিল তা আমরা জানতে পারিনি। এরপর আমরা দেখলাম বাবা মিলিটারিদের মাথার ওপর কাঁচি দিয়ে মারতে যাচ্ছেন। এ সময় তারা বাবাকে গুলি করে। গুলি করার আগে বাবা চিৎকার করে বলে ওঠেন, ‘তোরা পালা।’ তখন আমরা নিজেদের বাড়ি থেকে আরো দূরে সরে যাই। এরপর মিলিটারিরা রাস্তার অপর সাইডে চলে গেল এবং বটিয়া ঘাটা, দাকোপ, ছিয়ানব্বই গ্রাম ইত্যাদি এলাকা থেকে আগত হাজার-হাজার শরণার্থীর ওপর নির্বিচারে গুলি করতে লাগল। মিলিটারিরা প্রথমে মালথিয়া গ্রামে এসে আমার বাবাকে গুলি করে হত্যা করে তাদের হত্যাযজ্ঞের সূচনা করে। আমরা দেখতে পেলাম, মেশিন গানের ব্রাশ ফায়ারে হাজার-হাজার মানুষ পাখির মতো পড়ে যেতে লাগল। বৃদ্ধ-মহিলা-পুরুষসহ আনুমানিক ২ থেকে ৩ হাজার মানুষকে সেখানে তারা হত্যা করে। এরপর মিলিটারিরা ওখানকার একটি রাস্তা দিয়ে পূর্বদিকে যায় এবং সেখান থেকে চুকনগর বাজারে যেয়ে গুলি করে। বাজারে তাদের গুলিতে হাজার-হাজার মানুষ নিহত হয়। চুকনগর সরদার বাড়ি ও অন্যান্য এলাকায় প্রায় ৪ হাজার মানুষকে গুলি করে হত্যা করে পাকিস্তানি আর্মিরা। সকাল সাড়ে ৯টা থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত তারা অবিরাম গুলি চালিয়ে হাজার- হাজার মানুষকে হত্যা করে। সাতক্ষীরা থেকে প্রথমে এক গাড়ি পাকিস্তানি আর্মি আসে, পরে আরো দু’গাড়ি আর্মি এসে তাদের সাথে যোগ দেয়। এরপর হত্যাযজ্ঞ শেষ করে তারা গাড়িসহ সাড়ে ৩টায় সাতক্ষীরার দিকে চলে যায়।
এরমধ্যে আমার বাবাকে যখন আমরা কবর দিচ্ছিলাম তখন পাকিস্তানি আর্মিরা পুনরায় আমাদের বাড়িতে আসে। এ সময় বাবাকে কবরের পাশে ফেলে রেখে আমরা আবার দূরে চলে যাই। বাড়িতে কেবল আমার মা ছিলেন। এরপর আমরা নিহত আত্মীয়র পাশে দৈবক্রমে বেঁচে যাওয়া দু’এক জনকে বসে থাকতে দেখি। হঠাৎ দেখলাম একটা মেয়েশিশু তার মৃত মায়ের দুধ খেয়ে যাচ্ছে। সেখানে অন্য কোনো লোক ছিল না। মরা মানুষের দুধ খেতে দেখে আমি চিৎকার করে বলে উঠলাম, ‘তোরা কে কোথায় আছিস, মেয়েটা কার, নিয়ে যা।’ কিন্তু কোনো লোক পাশে ছিল না। তখন একজনকে চুকনগরের দিকের এ মাঠ দিয়ে দৌড়ে যেতে দেখে ভাবলাম ঐ লোকটা হয়ত মেয়েটার কেউ হবে। পরে দেখলাম লোকটা মরা লাশ সরিয়ে কাকে যেন খুঁজছে। তখন আমি তাকে বললাম, “কি ব্যাপার তুমি কাকে খুঁজছো?’ তখন সে বলল, “আমার বাড়ি মঙ্গল কোট, আমার একটা ভাইপো বাড়ি থেকে এসেছে, কিন্তু তাকে খুঁজে পাচ্ছিনা। তাই লাশের মধ্যে তাকে খুঁজছি।’ আমি তাকে বললাম, ‘এত লাশের মধ্যে তাকে খুঁজে পাবেনা। তুমি ভাই কি জাত?’ তখন সে বলল যে, সে হিন্দু এবং তার পদবী দাস। তখন আমি বললাম, ‘দেখ ভাই, হিন্দু সম্প্রদায়ের এই মেয়েটার মা-বাবা মারা গেছে, মরা মায়ের দুধ খাচ্ছে। তুমি একই ধর্মের মানুষ, তুমি একে নিয়ে যাও। পরে তত্ত্বাবধান যা করতে হয় আমি করব।’ এরপর সে মেয়েটাকে নিয়ে গেল। আমি তার কাছ থেকে ঠিকানা নিলাম ও পরে তার বাড়ি গিয়ে দেখলাম তার কোন সন্তান নেই। পরে ঐ মেয়েটাকে সে লালন পালন করে এবং আমিও তার তত্ত্বাবধান করি। আমরা মালথিয়া গ্রামের বাবু দাসের সাথে পরে তার বিয়ে দেই। তার দুটো সন্তান রয়েছে, তবে গরীবের ঘর তাই খুব সুখে শান্তিতে নেই।
২০/২৫টা করে লাশ প্রতিদিন ঘ্যাংরাইল নদীতে আমরা টেনেটেনে ফেলেছি। চার পাঁচদিন যাবত আমরা এ কাজ করি। আর চুকনগরে যে লাশ পড়েছিল তা সব ভদ্রা নদীতে ফেলা হয়। তৎকালীন চেয়ারম্যান ওহাব সাহেব আমাদেরকে বলেন, ‘এত কষ্ট করে লাশ ফেলেছ, তোমরা কিছু খরচ নাও।’ কিন্তু এখানকার কেউই কোনো পয়সা নেয়নি। কারণ যেসব মানুষের করুণ মৃত্যু হয়েছে তাদের লাশের বিনিময়ে আমরা পয়সা নিতে পারিনা। এরপর আমরা যারা ছিলাম তারা বেঁচে যাওয়া শরণার্থী ও স্থানীয় হিন্দুদের যাতে আর কোনো ক্ষয়ক্ষতি না হয় সে ব্যাপারে সাধ্যমত চেষ্টা করি।
চট্টগামের পাহাড়তলীতে মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস ভয়াবহ গণহত্যা সংঘটিত হয়। ১১ হাজারেরও বেশি লোক এ হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়। এ গণহত্যার শিকার লোকজনের মধ্যে একটি বড় অংশ ছিল চট্টগ্রাম রেলওয়ের চাকরিজীবী। এছাড়া পাহাড়তলী স্টেশনে ট্রেন থামিয়ে এখানে বহুলোককে হত্যা করা হয়। শুধু ১০ই নভেম্বর একদিনে ৪০০ জনের মতো লোক হত্যার শিকার হয়। পাহাড়তলী রেল স্টেশনটি জল্লাদখানা হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। এখানে পাহাড়ের ওপরে ছিল ব্রিটিশ আমলের একটি দোতলা ভবন। পাকিস্তানি পানাদার বাহিনী এ ভবনটিকে নির্যাতনকেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করত। এখানে যুবতি নারীদের আটকে রেখে হানাদাররা নিয়মিত পাশবিক নির্যাতন চালাত। এখানকার হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হতো রাতের বেলায়। হত্যাকাণ্ডের মূল হোতা ছিল স্থানীয় অবাঙালি বিহারিরা। হত্যার ধরনও ছিল অত্যন্ত পৈশাচিক। এখানে দুটি পাথর খণ্ড ছিল, যা ছুরি ও রামদা ধার দেয়ার জন্য ব্যবহৃত হতো। লোকজন ধরে এনে প্রথমে পুরো দেহ চিড়ে লবন-মরিচ মেখে লোহার পাতের সঙ্গে হাত-পা-মাথা শক্ত করে বেঁধে রাখা হতো। এরপর একটি বড় পাথরের ওপর শুইয়ে পশুর মতো জবাই করে মাথা আলাদা করে দেহ গর্তের ভেতর ফেলে দেয়া হতো। প্রায় প্রতিদিনই সে গর্তে এক ধরনের কেমিক্যাল ছিটিয়ে দিত। ১৬ই ডিসেম্বর দেশ হানাদারমুক্ত হওয়ার পর এখান থেকে অসংখ্য মানুষের মাথার খুলি উদ্ধার করা হয়। পাহাড়ের চূড়ায় মহিলাদের শাড়ি, ব্লাউজ ও পেটিকোট পড়ে থাকতে দেখা যায় (দ্রষ্টব্য পাহাড়তলী বধ্যভূমি)।
মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী চট্টগ্রামের ফয়’স লেক বধ্যভূমি হিসেবে ব্যবহার করত। তারা নারী-পুরুষ নির্বিশেষে বাঙালিদের ধরে এনে এখানে নির্মমভাবে হত্যা করত। হত্যাকাণ্ডের জন্য তারা পাথর, ছুরি ও দুটি গাছ দিয়ে একটি মৃত্যু ফাঁদ তৈরি করেছিল। গাছদুটির সঙ্গে হুকে বাঁধা থাকত কয়েকটি রশি এবং প্রতিটি রশির মাথায় লাগানো হুক মাটিতে পোঁতা হুকের সঙ্গে লাগিয়ে রাখা হতো। বাঙালিদের ধরে এনে প্রথমে পাথরে শুইয়ে দিয়ে হুকওয়ালা রশি দিয়ে দেহের বিভিন্ন অংশ বেঁধে দিত। এরপর খুনিরা ছুরি দিয়ে পেট চিরে দিত, তারপর বড় ছুরি দিয়ে তাদের জবাই করত। নিহতদের রক্তাক্ত লাশ লেকে ভাসিয়ে দিত। ফলে লেকের নীল জল রক্তে লাল হয়ে যায়। হানাদাররা তাদের ক্যাম্পে পাশবিক নির্যাতনে গর্ভবতী বহু নারীকে ১৬ই ডিসেম্বরের পূর্বে পেট চিরে হত্যা করে এ লেকে ফেলে দেয় এবং দেশ হানাদারমুক্ত হওয়ার পর তাদের বহুজনের ভাসমান লাশ দেখতে পাওয়া যায় (দ্রষ্টব্য ফয়’স লেক অপারেশন, নারী নির্যাতন)।
সোহাগপুর শেরপুর জেলার নালিতাবাড়ি উপজেলায় অবস্থিত। ২৫শে জুলাই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আলবদর কমান্ডার ও ইসলামী ছাত্র সংঘ-এর নেতা কামারুজ্জামান (যুদ্ধাপরাধের দায়ে বিচারে ২০১৫ সালের ২১শে এপ্রিল মৃত্যুদণ্ড কার্যকর)-এর প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণে এক নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করে। গ্রামটির একটি পাড়ার সকল পুরুষ সদস্য (১৮৭ জন)-কে হত্যা করা হয়। নারীদের ওপর চালানো পৈশাচিক নির্যাতন। পুরুষশূন্য হওয়ায় এ গ্রামটি পরবর্তীতে ‘বিধবাপল্লী’ নামে দেশব্যাপী পরিচিতি পায় (দ্রষ্টব্য সোহাগপুর গণহত্যা)।
৭১ সালে কিশোরগঞ্জের বরইতলা গণহত্যার নৃশংসতার কোনো তুলনা খুঁজে পাওয়া দায়। বর্বরোচিত এ হত্যাকাণ্ডের নির্মম শিকার হন ৩৬৬ জন গ্রামবাসী, মারাত্মক আহত হন আরো ১৩৪ জন।
এক সকালে পাকিস্তানি হানাদারবাহিনীর সহযোগী দালালরা প্রায় ১৫০০ পুরুষকে বরইতলা গ্রামের রেল লাইনের পাশে জড়ো করে মিটিংয়ের নাম করে। এদের মধ্যে প্রায় অর্ধেককে উপস্থিত দালালরা আত্মীয়, বন্ধু, পরিচিত জন ইত্যাদি বলে পাকিস্তানি আর্মির কাছ থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়। অবশিষ্ট লোকদের একজনের বাহু অন্যের সঙ্গে বেঁধে রেল লাইনের ওপর বসিয়ে দেয়া হয় এবং ত্রিশ কেজি ওজনের বিশেষ ধরনের শাবলের আঘাতে একেএকে চূর্ণবিচূর্ণ করে ফেলা হয় প্রত্যেকের মাথা। এরপর মৃতদের ওপর ব্রাশ ফায়ার করা হয়। এত কিছুর পরও যাঁদের দেহ একটু আধটু নড়াচড়া করছিল তাঁদের ওপর বেয়নেট চার্জ করা হয়। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসররা অপর একটি বর্বরোচিত এবং নৃশংস গণহত্যা চালায় সৈয়দপুর শহরের কাছে গোলাহাটে।

১৩ই জুন পাকিস্তানি আর্মি সৈয়দপুর ও এর আশপাশের এলাকা থেকে ৪ শতাধিক মানুষকে ধরে ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যায়। এরপর তাদেরকে ভারতে পৌঁছে দেয়ার নাম করে স্থানীয় রেলওয়ে স্টেশনে নেয়া হয়। কৌশলে বন্দিদের পরিবারের বাকি সদস্যদেরকেও স্টেশনে আনা হয়। এই ফাঁকে চালানো হয় নির্বিচার লুটপাট।
ট্রেনের চারটি বগির পেছনের দুটোতে উঠানো হয় নারী ও শিশুদের এবং বাকি দুটোতে পুরুষদের। দু’কিলোমিটার যাবার পর রেলওয়ে ওয়ার্কশপের একটি কালভার্টে এসে ট্রেনটি থামে। তারপরই শুরু হয় বীভৎস হত্যাযজ্ঞ। একজন একজন করে নামানো হয় আর খোলা তলোয়ারের কোপে দু’খণ্ড করে ফেলা হয় তাদের দেহ। জানালা ভেঙে যারা পালাতে চেষ্টা করেছিল তাদেরকে ব্রাশ ফায়ার করে হত্যা করা হয়। গোলাহাটে পাকিস্তানিদের এই হত্যাকাণ্ড থেকে সেদিন ২৩ জন পুরুষ পালাতে সক্ষম হলেও নারী ও শিশুদের কেউ পালাতে পারেনি। উপর্যুপরি ধর্ষণ শেষে নারীদেরকে হত্যা করা হয়। ঐদিন গোলাহাটে পাকিস্তানি বাহিনী ৪৫০ জনকে হত্যা করে।

সেদিন গোলাহাটের গণহত্যা থেকে অলৌকিকভাবে বেঁচে ফিরেছিলেন তপন কুমার দাস (পিতা হরিপদ দাস)। তিনি ৭১-এ সৈয়দপুর এয়ারপোর্টে অবস্থিত কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের কথা বলেছেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইহুদিদের যেমন নির্যাতন করে জোরপূর্বক কাজ করিয়ে নেয়া হতো, সে-রকম কাহিনির কথা তিনি বলেছেন। যুদ্ধাপরাধ বলতে যে ধারাগুলোকে বোঝায়, যেমন- Crime of torture, Forced labour Slavery, Outrages upon personal dignity, এর সবটাই প্রযোজ্য হয় ঐ ক্ষেত্রে। তিনি এক সাক্ষাৎকারে বলেন- একদিন শোনা গেল পাকিস্তান এয়ারফোর্সের ঘাঁটি স্থাপনের জন্য সৈয়দপুরে একটি এয়ারপোর্ট নির্মাণ করা হবে। সেখানে কাজ করার জন্য একদিন আমাদের সবাইকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। তখন আমার বয়স একুশ-বাইশ বছর। আমার মতো এ এলাকার প্রায় প্রত্যেক যুবককেই তখন ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। তারা সৈয়দপুর হাইস্কুল ও দারুল উলুম মাদ্রাসা ছাড়াও আরো দু’একটা জায়গায় ক্যাম্প করে এবং সেখানে আমাদের ধরে নিয়ে যায়। বলা হয়, বিহারিরা যাতে আমাদের ওপর অত্যাচার করতে না পারে সেজন্য ক্যাম্পে নেয়া হচ্ছে। কিন্তু সেটা ছিল একটা প্রতারণা। আমরা যারা এই ক্যাম্পে পাকিস্তানি সেনাদের পাহারায় ছিলাম তাদের প্রত্যেককেই প্রতিদিন সকাল ৬ টায় সৈয়দপুর এয়ারপোর্টে হাজিরা দিতে হতো। আমাদের দিয়ে সেখানে পুরো ৩ মাস শ্রমিকের কাজ করানো হয়। আমরা ইট টেনেছি, পাথর টেনেছি, ইট বিছিয়ে ‘সোলিংও’ করেছি। সকাল ৬টা থেকে সন্ধ্যে ৬টা পর্যন্ত বিরামহীনভাবে তারা আমাদের দিয়ে কাজ করিয়েছে, কিন্তু এর মধ্যে এক গ্লাস পানি পর্যন্ত খেতে দেয়নি। এভাবে কাজ করতে করতে আমাদের মনে হচ্ছিল এর থেকে মরে যাওয়াই ভালো। কাজের মধ্যেই আমাদেরকে প্রচণ্ড মারপিট করা হতো ও মানসিক যন্ত্রণা দেয়া হতো। পেয়ারা নামে আমার এক বন্ধুকে একদিন ইলেকট্রিক চাবুক দিয়ে এমনভাবে মারল যে, তার প্রায় মরে যাওয়ার অবস্থা।
২৬শে মে সিলেট জেলার বালাগঞ্জ উপজেলা (বর্তমানে ওসমানী নগর)-র বুরুঙ্গাতে সংঘটিত হয় আরো একটি নারকীয় গণহত্যা। শেরপুর থেকে ক্যাপ্টেন দাউদ খানের নেতৃত্বে পাকিস্তানি আর্মি এখানে আসে। তারা মিটিংয়ের নাম করে প্রায় এক হাজার গ্রামবাসীকে স্থানীয় স্কুল মাঠে জড়ো করে। তাদের মধ্যে বুরুঙ্গা উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক শ্রীনিবাস চক্রবর্তী, তাঁর ছোট ভাই এবং বাবা ছিলেন।

পাকিস্তানি হানাদারদের হাত থেকে বেঁচে যাওয়া শ্রীনিবাস চক্রবর্তী জানান— ধৃত গ্রামবাসীর মধ্য থেকে বেছে নেয়া হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রায় ১০০ জন নিরীহ লোককে লাইনে দাঁড় করিয়ে প্রথমে ব্রাশ ফায়ার করে পাকিস্তানি সেনারা। চোখের পলকেই মানুষের মাথা, দেহ, হাত-পা সব ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। আমার হাতে গুলি লাগে। এর মধ্যে মরার মতো পড়ে থেকে আমি অলৌকিকভাবে রক্ষা পাই। এরপর কেরোসিন ঢেলে মৃতবৎ সবার শরীরে আগুন লাগিয়ে দেয়া হলে যারা তখনও বেঁচে ছিল তারা আগুনের তাপে চিৎকার করে ওঠে। আর্মি তখনও মাঠ পেরিয়ে বড় রাস্তায় উঠতে পারেনি। চিৎকারের শব্দ শুনে তারা ফিরে আসে এবং গুলি চালায়।

এতসব কিছুর পর আর্মিরা কিছুদূর চলে গেলে মানুষ পানিপানি বলে চিৎকার করে ওঠে। তাতে পাকিস্তানি সেনারা ফিরে এসে আবার গুলি চালায়। ঐ সময় একটা গুলি এসে লাগে আমার পিঠে। তারপরও আমি গণহত্যা স্পট থেকে সরে যেতে সক্ষম হই। শুধু হিন্দু বলেই অনেককে গণহত্যার শিকার হতে হয়েছে।
বুদ্ধিজীবী হত্যার খণ্ডচিত্র ফুটে ওঠেছে অধ্যাপক ফরিদা বানুর বক্তব্যে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের শহীদ অধ্যাপক গিয়াসউদ্দিন আহমেদের বোন অধ্যাপক ফরিদা বানু (গণিত বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়) এক সাক্ষাৎকারে বলেন- ১৪ই ডিসেম্বর এক ফোঁটা পানি ছিল না কোয়ার্টার্সের ট্যাপে। মহসিন হলের হাউজ টিউটর ছিলেন শহীদ গিয়াসউদ্দিন। হলের হাউস টিউটর কোয়ার্টার্সে থাকতেন। পানি না পেয়ে পানির পাম্পের মিস্ত্রি খুঁজতে বাসা থেকে নিচে নেমে গেলেন। আগের দিন ডিএসপি পরিচয়ধারী এক ব্যক্তির আচমকা টেলিফোনের কথাটি তখন তাঁর মাথায়। পুলিশের এক অফিসার ১৩ই ডিসেম্বর তাঁকে টেলিফোন করে জানিয়েছিল ৭১ ও ৭২ নম্বর ফ্ল্যাট দুটো খালি করে দিতে হবে পাকিস্তানি মিলিটারিদের জন্য। এসব কথা ভাবতে ভাবতে লুঙ্গি পরেই তিনি এখানে ওখানে ছুটছিলেন মিস্ত্রির জন্য। সে-সময় ফরিদা বানু তার স্বামীকে নিয়ে ফ্ল্যাটের ব্যালকনিতে দাঁড়ানো ছিলেন। সময় সকাল ৮টা হবে। ঠিক সে সময় কাদামাখা ইপিআরটিসি-র মাইক্রোবাস বাসার সামনে এসে দাঁড়াল। খাকি শার্ট পরা চার-পাঁচ জন লোক ঐ বাস থেকে নেমে এল। ওদের দুজনের হাতে রাইফেল। একজনের গায়ে কালো সোয়েটার। সে-সময় তাঁরা দেখলেন যে, তাদের একজন প্রভোস্ট অফিসের সামনে টেলিফোনের লাইন কাটছে। এর চার/পাঁচ মিনিট পর তারা দরজায় নক করল। তাঁদের ভাই গোলাম কিবরিয়া দরজা খুলে দিলে মাইক্রোবাসে আসা দুজন আগন্তুক ঘরে প্রবেশ করল। একজনের হাতে রাইফেল। এসে খোঁজ করল গিয়াসউদ্দিনকে। তিনি বাসায় না থাকায় তারা প্রথমে চলে গিয়ে আট/দশ মিনিট পর আবার ফেরত এল। সারা ঘরময় গিয়াসউদ্দিনকে তন্নতন্ন করে খুঁজে তাঁকে না পেয়ে গোলাম কিবরিয়াকে ওরা চেপে ধরল। তারা জিজ্ঞাসা করল, গিয়াসউদ্দিন কোথায়? গিয়াসউদ্দিনকে খুঁজে পাবার জন্য তারা তখন তাকে ধরে নিয়ে গেল। যেখানটায় পানির পাম্প ছিল সেখানটায় নিয়ে গেল। এরমধ্যে মাইক্রোবাসটি প্রভোস্ট অফিসের সামনে এসে দাঁড়াল, গিয়াসউদ্দিনও ওখানেই ছিলেন। তাঁকে হলের গার্ড আব্দুর রহিমের গামছা দিয়ে দুচোখ বেঁধে ফেলে ঐ দস্যুরা। এরপর তাঁকে মাইক্রোবাসে উঠিয়ে নিয়ে যায়। এসময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কিছু প্রগতিশীল অধ্যাপককেও এমনভাবে গুম করে ফেলা হয়েছিল। তাঁদের মধ্যে ছিলেন অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী (বাংলা), অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী (বাংলা), অধ্যাপক আনোয়ার পাশা (বাংলা), ড. আবুল খায়ের (ইতিহাস), অধ্যাপক রাশীদুল হাসান (ইংরেজি), অধ্যাপক গিয়াসউদ্দিন আহমেদ (ইতিহাস), ড. ফয়জুল মহী (আইইআর), ড. সন্তোষ ভট্টাচার্য (ইতিহাস), ড. সিরাজুল হক (আইইআর) ও ডা. মোর্তজা (বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান চিকিৎসক)। ৪ঠা জানুয়ারি ১৯৭২ এঁদের ক্ষতবিক্ষত মরদেহ পাওয়া যায় মিরপুর গোরস্থানে। নৃশংস অত্যাচারের পর গুলি করে হত্যা করে আশরাফুজ্জামান নামক আলবদরের এক ঘাতক। এ বিষয়টি ৯ই জানুয়ারি, ১৯৭২ দৈনিক পূর্বদেশ-এ প্রকাশিত রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়। আশরাফুজ্জামানের উদ্ধারকৃত ডায়েরির পাতা থেকে ঐ রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। যে গাড়িতে করে শিক্ষকদের নিয়ে যাওয়া হয় তার চালক মফীজউদ্দীন পরবর্তীতে পুলিশের কাছে স্বীকারোক্তিতে এ তথ্য জানায়। আলবদর, ইপিসিএএফ এবং অবাঙালি আলমুজাহিদ বাহিনীর সমন্বিত অপরাধের কুখ্যাত দৃষ্টান্ত এটি।
ঢাকার বাইরে বুদ্ধিজীবী হত্যার না-বলা কাহিনিগুলো উঠে এসেছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মাসতুরা খানমের বক্তব্যে। তাঁর বক্তব্যে বিশেষ করে উঠে আসে কতিপয় ঘাতকের কথা। পাকিস্তানি ব্রিগেডিয়ার আসলাম, লে. কর্নেল তাজ, ক্যাপ্টেন ইলিয়াস, ক্যাপ্টেন তাহির এসকল কুখ্যাত ব্যক্তি কীভাবে বুদ্ধিজীবী হত্যায় সম্পৃক্ত হয়েছিল, তা ভুক্তভোগীদের পরিবারের সদস্যদের জবানবন্দি থেকে সবিস্তার জানা যায়।
৭১-এ পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধী এবং তাদের এদেশীয় দোসররা এদেশের মাটিতে প্রায় ৫৩ ধরনের অপরাধ সংঘটিত করে। মোটাদাগে তারা ১৭ ধরনের যুদ্ধাপরাধ, ১৩ ধরনের মানবতাবিরোধী অপরাধ এবং ৪ ধরনের গণহত্যাসংক্রান্ত অপরাধ ঘটায়।
গণহত্যার বিচার: জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ কর্তৃক গৃহীত (৯ই ডিসেম্বর ১৯৪৮) জেনোসাইড কনভেনশনের আর্টিকেল-১-এ বলা হয়েছে— The Contracting Parties confirm that genocide, whether committed in time of peace or in time of war, is a crime under international law which they undertake to prevent and to punish. একই কনভেনশনের আর্টিকেল-৩-এর অধীনে যেসব অপরাধ বিচারযোগ্য বিবেচিত হবে, তা হলো—
(a) Conspiracy to commit genocide;
(b) Direct and public incitement to commit genocide;
(c) Attempt to commit genocide;
(d) Complicity in genocide.

আর্টিকেল-৪-এ বলা হয়েছে- Persons committing genocide or any of the other acts enumerated in Article 3 shall be punished, whether they are constitutionally responsible rulers, public officials or private individuals.
সামগ্রিকভাবে গণহত্যার অপরাধের কোনো ব্যাখ্যাই একে বৈধতা দিতে পারে না। এ ঘৃণ্য ও মানবতাবিরোধী কার্যে যারা সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে বা এর জন্য সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টি করে অথবা নিভৃতে কিংবা প্রকাশ্যে প্রণোদনা দেয় তারা, সকলেই এ কার্যের হুকুমদাতার মতোই সমপরিমাণ অপরাধে অপরাধী। গণহত্যার সংগঠক হতে পারে দেশের সরকার প্রধান বা সেনাপ্রধান বা তাদের অধঃস্তন কোনো কর্মচারী বা ভিন্ন সহযোগী। এ অপরাধ বৈশ্বিক জীবন ও সমগ্র মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ। এ অপরাধের কোনো ক্ষমা নেই। (জেনোসাইড কনভেনশন, আর্টিকেল-৩)।
বিশ্বব্যাপী গণহত্যার মতো অপরাধ প্রতিহত করার জন্য গৃহীত হয়েছে বিভিন্ন কনভেনশন, প্রটোকল ও ডিক্লারেশন।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি দখলদার বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসরদের মানবজাতির ইতিহাসের নির্মম-নিষ্ঠুর গণহত্যা, অন্যান্য হত্যাকাণ্ড, নারীর ওপর পাশবিক নির্যাতন, ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ এবং বহুসংখ্যক মানুষকে দেশত্যাগ করে পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র ভারতে উদ্বাস্তু হিসেবে আশ্রয় গ্রহণে বাধ্য করা ইত্যাদি যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর সরকার ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ জাতীয় সংসদে International Crimes (Tribunals) Act পাস করে। ৭১-এর গণহত্যার জন্য চিহ্নিত ১৯৫ জন পাকিস্তানি সেনাদের বিচারের আওতায় নিয়ে আসার সরকারি অঙ্গীকার সত্ত্বেও আন্তর্জাতিক রাজনীতির কারণে তা সম্ভব হয়নি। অন্যদিকে, ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর ক্ষমতাসীনদের কর্তৃক পাকিস্তানি সেনাদের ঐ গণহত্যায় এদেশীয় দোসরদের দীর্ঘদিন ধরে বিচারের সম্মুখীন করার কোনো উদ্যোগই রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে নেয়া হয়নি। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, ৭১-এ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বাঙালিদের ওপর বর্বরোচিত গণহত্যায় এদেশীয় দোসরদের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীর আমীর গোলাম আযম ছিল শীর্ষ স্থানীয় ও মাস্টারমাইন্ড। চরম হিন্দু ও ভারতবিদ্বেষ, অন্ধ ধর্মীয় বিশ্বাস ও পাকিস্তানের অখণ্ডত্ব রক্ষা ইত্যাদি কারণে সে ঐ ভূমিকা নেয়। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ছত্রছায়ায় এবং তার পরামর্শ ও নির্দেশনায় জামায়াতে ইসলামী ও এর ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘের ক্যাডারদের নিয়ে আলবদর, আলশামস ইত্যাদি নামে ঘাতক বাহিনী গড়ে তোলা হয়। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গণহত্যায় প্রত্যক্ষ সহযোগিতা ছাড়াও এসব বাহিনী এ দেশের শ্রেষ্ঠ বুদ্ধিজীবীদের তালিকা ধরে অত্যন্ত নির্মম-নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে। ১৬ই ডিসেম্বর পাকহানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণ ও মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের প্রাক্কালে গোলাম আযম পাকিস্তানে পালিয়ে যায় এবং দীর্ঘদিন সেদেশে বসবাস করে। জেনারেল জিয়াউর রহমানের শাসনামলে ১৯৭৮ সালে পাকিস্তানি পাসপোর্টে সে বাংলাদেশে ফিরে আসে এবং এদেশে অবস্থান ও রাজনীতি করার অধিকার পায়। একই শাসন আমলে বিচারের পরিবর্তে পাকিস্তানি হানাদারদের সহযোগী ও যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে বঙ্গবন্ধু সরকারের সময় গ্রেপ্তারকৃত ৩৭ হাজার ৪শ বন্দিকে ছেড়ে দেয়া হয়।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে তাঁর কন্যা ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠনের সুযোগ পেলে অবস্থার লক্ষণীয় পরিবর্তন ঘটতে শুরু করে। ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে জয়ী হয়ে দ্বিতীয়বার সরকার গঠনের সুযোগ লাভ করে ২০১০ সালে তিনি ৭১-এর মানবতাবিরোধী ও যুদ্ধাপরাধী এদেশীয় পাকিস্তানি দোসরদের বিচারের লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করেন। দীর্ঘ বিচারিক প্রক্রিয়া শেষে ঐ ট্রাইব্যুনালের রায় অনুযায়ী মিরপুরের কসাই খ্যাত আব্দুল কাদের মোল্লা (জামায়াতে ইসলামী), মতিউর রহমান নিজামী (জামায়াতে ইসলামী), আলী আহসান মোহাম্মদ মোজাহীদ (জামায়াতে ইসলামী), কামারুজ্জামান (জামায়াতে ইসলামী ও আলবদর কমান্ডার), মীর কাশেম আলী (জামায়াতে ইসলামী ও আলবদর কমান্ডার), সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী (বিএনপি) প্রমুখ যুদ্ধাপরাধীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। এছাড়া কুখ্যাত শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযম (জামায়াতে ইসলামী), আব্দুল আলীম (বিএনপি), মওলানা দেলোয়ার হোসেন সাঈদী (জামায়াতে ইসলামী)-র বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনাল আজীবন কারাদণ্ডের রায় ঘোষণা করে এবং বন্দি অবস্থায় এদের প্রথম দুজনের ইতোমধ্যে মৃত্যু ঘটে। উল্লেখ্য, মৃত্যুদণ্ডাদেশ প্রাপ্য হলেও বয়স ও শারীরিক অবস্থা বিবেচনায় গোলাম আযমকে ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক আজীবন কারাদণ্ডাদেশ দেয়া হয়। ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম এখনো চলমান। গণহত্যা বা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ যে কখনো তামাদি হয়না এবং এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অপরাধীদের যে বিচারের কাঠগড়ায় কোনো-না-কোনো সময় দাঁড়াতেই হয়, স্বাধীনতার চার দশকেরও অধিক সময় পরে হলেও এসব জঘন্য অপরাধীর বিচার অনুষ্ঠান সেটিই প্রমাণ করে [এম এ হাসান ও হারুন-অর-রশিদ]

তথ্যসূত্র: ওয়ার ক্রাইমস্ ফ্যাক্টস্ ফাইন্ডিং কমিটির গবেষণা তথ্য; জেনোসাইড আর্কাইভ এন্ড হিউম্যান স্টাডিজ সেন্টারে সংরক্ষিত তথ্য; ডা. এম এ হাসান, যুদ্ধাপরাধ গণহত্যা ও বিচারের অন্বেষণ, ঢাকা ২০০১; ডা. এম এ হাসান, যুদ্ধ ও নারী, ঢাকা ২০০২; ১৯৭২-এর দৈনিক পত্র-পত্রিকা; Robert Payne, Massacre, Macmillan 1973; RJ Rummel, Death By government, Routledge 2017; Susan Browmiller, Against Our Will, USA, Simon & Schuster 1975; Mohammad Ayub Khan, Friends Not Masters: A Political Autobiography, Dhaka, The University Press Limited 2008; M Asghar Khan, We’ve Learnt Nothing from History, Pakistan: Politics and Military Power, Karachi, Oxford University Press 2005

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৩য় খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!