You dont have javascript enabled! Please enable it! গণহত্যা-নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘর (খুলনা শহর) - সংগ্রামের নোটবুক

গণহত্যা-নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘর (খুলনা শহর)

গণহত্যা-নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘর (খুলনা শহর) বাঙালিদের ওপর পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যা এবং নির্যাতনই ছিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালে প্রধান ঘটনা। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের যত মানুষ গণহত্যার শিকার হয়েছে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আর কোথাও এক সঙ্গে এত মানুষ নিহত হয়নি। বাংলাদেশ ইতিহাস সম্মিলনী-র সভাপতি ইতিহাসবিদ ড. মুনতাসীর মামুনের প্রস্তাব ও ইতিহাস সম্মিলনীর উদ্যোগে ২০১৪ সালের ১৭ই মে খুলনা সদরে গণহত্যা-নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘর প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি কেবলমাত্র বাংলাদেশেই নয়, দক্ষিণ এশিয়ায় প্রথম গণহত্যা বিষয়ক জাদুঘর। ১৯৮১ সালের ১৭ই মে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা (বর্তমান প্রধানমন্ত্রী) নির্বাসিত জীবন ছেড়ে বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করেন। তাঁর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের মধ্য দিয়ে সূচিত হয় ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে ক্ষমতা দখলকারীদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয় পাকিস্তানি ধারার সাম্প্রদায়িক রাজনীতি। শেখ হাসিনা স্বদেশে ফিরে ঘোষণা দিয়েছিলেন তিনি ফিরিয়ে আনবেন মুক্তিযুদ্ধের ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ। দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রাম শেষে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী (৩রা জুলাই ২০১১)-র মাধ্যমে তিনি ফিরিয়ে এনেছেন বঙ্গবন্ধুর ১৯৭২ সালের সংবিধানের চার মূলনীতি- বাঙালি জাতিয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। তাঁর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের বিশেষ দিনটি স্মরণে রেখে মে মাসের একই তারিখে জাদুঘরটি প্রতিষ্ঠা করা হয়।
জাদুঘরটি একটি ট্রাস্ট দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে। ড. মুনতাসীর মামুন ট্রাস্টি বোর্ডের সভাপতি। তাঁর চেষ্টায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা খুলনার সাউথ সেন্ট্রাল রোডে ১৮ শতাংশ জমি (দুটি পরিত্যক্ত পুরাতন বাড়িসহ) জাদুঘরকে দান করেন। উক্ত বাড়িটি সংস্কার করে জাদুঘর চালু করা হয়েছে। বর্তমানে (২০১৮) প্রতিদিন গড়ে ২০-২৫ জন দর্শক দর্শনির বিনিময়ে জাদুঘরটি পরিদর্শন করতে আসেন। জাদুঘরটি মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে:
গণহত্যার বিস্মৃত স্থানকে তুলে আনার জন্য জেলাভিত্তিক গণহত্যা- নির্যাতন, বধ্যভূমি ও গণকবর চিহ্নিতকরণ;
গণহত্যাস্থলকেন্দ্রিক প্রত্যক্ষদর্শীদের স্বাক্ষ্যভিত্তিক গ্রন্থের ভিত্তিতে গণহত্যা-নির্যাতন নির্ঘণ্ট ও শহীদ স্মৃতি গ্রন্থ প্রকাশ করা;
গণহত্যা-নির্যাতন নিয়ে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ও আধুনিক অনলাইন ও অফলাইন আর্কাইভ গড়ে তোলা;
গণহত্যা-নির্যাতন নিয়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সেমিনার এবং শহীদ-স্মৃতি বক্তৃতার আয়োজন করা;
সারা বাংলাদেশে হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ কোর্সের আয়োজনের মাধ্যমে স্থানীয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধের গবেষক তৈরি করা;
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সংঘটিত গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ে এডভোকেসি করা, ইত্যাদি।

জাদুঘরটি ইতোমধ্যেই একটি বিরাট সংগ্রহশালায় পরিণত হয়েছে। ১৯৭১ সালের পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নির্মমতার এক সাক্ষী খুলনার খালিশপুরের প্লাটিনাম জুটমিলস। পাকবাহিনী এ জুটমিলসের জলন্ত বয়লারে অসংখ্য মানুষকে পুড়িয়ে হত্যা করে, যা প্লাটিনাম জুটমিলস বয়লার গণহত্যা নামে পরিচিত। একাত্তরের গণহত্যা আর নির্যাতনের সাক্ষী সেই বয়লারটির অংশবিশেষ সংরক্ষণ করা হয়েছে এ জাদুঘরে। সংগ্রহশালার একটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো ‘শহীদ বুদ্ধিজীবী সংগ্রহশালা’। শিলালিপি-র সম্পাদক শহীদ সাংবাদিক সেলিনা পারভিন যে কলম দিয়ে ৭১-এ যুদ্ধ করেছেন, সেই কলম ও তাঁর পরনের শাড়ি প্রদর্শিত হয়েছে এ জাদুঘরে। চিকিৎসক ডা. আলীম চৌধুরীর ব্যবহৃত চিকিৎসা সরঞ্জাম জাদুঘরে সংরক্ষিত রয়েছে। এখানে আরো রয়েছে শহীদুল্লাহ কায়সারের ডায়েরি, শহীদ বুদ্ধিজীবী ড. মুনীর চৌধুরী ও শহীদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দিন হোসেনের পাঞ্জাবি, শহীদ সাংবাদিক নাজিমুদ্দিন আহমদের ব্যবহৃত কোটসহ শহীদ অন্যান্য বুদ্ধিজীবীদের নানা স্মারক।
মুক্তিযুদ্ধকালে গঠিত মুজিবনগর সরকার-এর প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ- মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার প্রাক্কালে স্ত্রীর জন্য ঐ সময়ের জনপ্রিয় কিং-স্ট্রোক (বক মার্কা) সিগারেটের প্যাকেটের উল্টো দিকে একখানা চিরকুট লিখে রেখে যান। তাতে লিখা ছিল, ‘জোহরা, পারলে সাড়ে সাত কোটি বাঙালির সাথে মিশে যেয়ো’। বিখ্যাত সেই চিরকুটটি এ জাদুঘরে সংগ্রহ করা হয়েছে। এখানে রয়েছে জেনারেল নিয়াজির গণহত্যার ব্লুপ্রিন্ট, কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী জেনারেল খটকের দুষ্কর্মের দলিল, বাগেরহাটের কুখ্যাত রাজাকার- রজব আলী ফকিরের স্থানীয়দের রাজাকার বাহিনীতে যোগ দিতে আহ্বান জানানোর হাতে লেখা চিঠি। আছে একাত্তরের দুঃসহ স্মৃতিময় গুলির খোসা, শহীদদের ব্যবহৃত ট্রানজিস্টরসহ নানা জিনিসপত্র। বিভিন্ন মোটিফে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে একাত্তরের কারাগার, টর্চার সেল, নির্যাতিতা নারীর অবয়ব। মুক্তিযুদ্ধের বই বিক্রির জন্য জাদুঘরে একটি বিক্রয় কেন্দ্র খোলা হয়েছে।
গণহত্যার স্মৃতি সংরক্ষণের জন্য জাদুঘরের নানামুখী পদক্ষেপের মধ্যে একটি হলো দেশের বিভিন্ন স্থানে স্মৃতিফলক নির্মাণ। অপর একটি কার্যক্রম হচ্ছে গণহত্যার নির্ঘণ্ট সিরিজ। এছাড়া গণহত্যার সংখ্যাতাত্ত্বিক বিতর্কের অবসান ঘটানো এবং শহীদদের সংখ্যা, বধ্যভূমি, গণকবর, গণহত্যা, নির্যাতনকেন্দ্র খুঁজে বের করার লক্ষ্যে সারাদেশে জেলাওয়ারি জরিপ কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে। আর্কাইভ ও জাদুঘর প্রতিষ্ঠানটি ২০১৭ সালের ৩রা এপ্রিল থেকে ‘গণহত্যা-নির্যাতন ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষণা কেন্দ্ৰ’ প্রতিষ্ঠা করে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে তরুণদের জন্য মাঠ পর্যায়ে গবেষণাসহ পোস্ট গ্রাজুয়েট ট্রেনিং কোর্স চালু করে। তাছাড়া জাদুঘরের উদ্যোগে নির্মাণ করা হয়েছে কয়েকটি ডকুমেন্টারি। বিপুল তথ্য নিয়ে গড়ে উঠেছে ডিজিটাল আর্কাইভ। সংগৃহীত হয়েছে একাত্তরের গণহত্যার দেশী- বিদেশী দলিল, পত্র-পত্রিকা, গণহত্যার দুষ্প্রাপ্য প্রায় ৬ হাজার ছবি। আয়োজন করা হচ্ছে গণহত্যা ও নির্যাতনের ওপর আন্তর্জাতিক সেমিনার। বাংলাদেশ ডাক বিভাগ গণহত্যা-নির্যাতন জাদুঘরের ওপর একটি স্মারক খাম প্রকাশ করেছে। গণহত্যার বীভৎস্য দৃশ্য এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও শক্তি তৃণমূল পর্যায়ে ছড়িয়ে দিতে কাজ করছে এ জাদুঘর। [মো. মাহবুবর রহমান ও চৌধুরী শহীদ কাদের]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৩য় খণ্ড