গয়েশপুর গণহত্যা (বদলগাছী, নওগাঁ)
গয়েশপুর গণহত্যা (বদলগাছী, নওগাঁ) সংঘটিত হয় ১৪ই অক্টোবর। এতে শিশু, নারী, শিক্ষক, আইনজীবী, কৃষকসহ অনেক মানুষ নিহত হয়। পাকসেনারা এদিন গয়েশপুর গ্রামে ব্যাপক লুণ্ঠন ও অগ্নিকাণ্ড ঘটায়।
নওগাঁ শহর থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরে গয়েশপুর গ্রাম। গয়েশপুর গ্রাম সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও রাজনীতি সচেতনতার জন্য বিশেষভাবে খ্যাত ছিল। শুরু থেকে মুক্তিযুদ্ধে এ গ্রামের বিশেষ ভূমিকা ছিল। ২৬শে মার্চ বলদগাছী থানায় ও গয়েশপুর গ্রামে এক সঙ্গে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলিত হয়। ২৫শে এপ্রিল পাকবাহিনী কর্তৃক বদলগাছী থানা অধিকৃত হলেও গয়েশপুরে স্বাধীন বাংলার পতাকা উড্ডীয়মান ছিল। এ গ্রামে নওগাঁ, রাজশাহী, পাবনা, নাটোর বগুড়া থেকে ভারতে যাওয়ার পথে হাজার-হাজার শরণার্থী আশ্রয় গ্রহণ করে।
এ গ্রামে মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রানজিট ক্যাম্প ছিল। এজন্য পাকহানাদারদের আক্রমণের লক্ষ্য ছিল এ গ্রাম। আক্রমণের পূর্বে পাকসেনারা গ্রামের লোকদের একটি তালিকা তৈরি করে। ১৪ই অক্টোবর সকালে পাকসেনারা গয়েশপুরে আক্রমণ করে। জয়পুরহাট থেকে মঙ্গলবাড়ি ও ইসবপুর হয়ে আসা হানাদার বাহিনীর একটি দল ধূলাউড়িতে গাড়ি রেখে এ গ্রামে ঢোকে। তাদের সঙ্গে মহাদেবপুর ও পত্নীতলা থেকে আগত পাকসেনাদের আরো দুটি দল যোগ দেয়। গ্রামে ঢুকেই হানাদাররা চতুর্দিকে নির্বিচারে গুলিবর্ষণ শুরু করে। এক সময় পাকসেনারা ঘরে- ঘরে তল্লাশি শুরু করে এবং যাকে যেখানে পায় সেখানেই গুলি করে। এভাবে গ্রামের অনেকে প্রাণ হারান। বিভিন্ন বাড়ি থেকে তারা অনেককে আটক করে বেদম প্রহারের পর সারিবদ্ধভাবে বেঁধে দাঁড় করিয়ে গুলি করে। হানাদারদের গুলিতে সখিনা বিবি (স্বামী হোসেন সোনার), কিশোরী রশিদা বেগম (পিতা আকালু মণ্ডল), ইসমাইল হোসেন চৌধুরীর দুই পুত্র আফজাল হোসেন চৌধুরী (পোস্টমাস্টার) ও মখলেছার রহমান চৌধুরী (গয়েশপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক) নিহত হন। মখলেছার রহমান চৌধুরী একজন নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষক ও সংস্কৃতিকর্মী ছিলেন। গয়েশপুর গ্রামে ঢুকে পাকবাহিনীর একটি দল মখলেছার রহমান চৌধুরীর বাড়িতে হানা দেয়। তাঁকে ও তাঁর বড় ভাই আফজাল হোসেনকে টেনে-হিঁচড়ে ঘর থেকে বের করে। তখন তাদের মা আলিয়া খাতুন দুই ছেলেকে জড়িয়ে ধরেন। নিজে মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও মখলেছার রহমান শত্রুসেনার কাছে তার বড় ভাইয়ের জীবন ভিক্ষা চান। এদিকে বড় ভাই আফজাল হোসেন চৌধুরী পাকবাহিনীর কাছে অসুস্থ ছোটো ভাইকে না মারার জন্য মিনতি জানান। কিন্তু এসব মিনতি ও আবেদন-নিবেদনে সাড়া না দিয়ে হানাদাররা প্রথমে আফজাল হোসেন চৌধুরীকে তাঁর মায়ের শরীরে জড়িয়ে থাকা অবস্থায় গুলি করে। সঙ্গে-সঙ্গে তিনি মত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। তাঁর তাজা রক্তে মায়ের শরীর রঞ্জিত হয়। এরপর পাকহানাদাররা মখলেছার রহমান চৌধুরী, পাশের বাড়ির এনামুল হক চৌধুরী (পিতা ইসাহাক আলী চৌধুরী) ও তাঁর পুত্র আমিনুল হক চৌধুরীকে নিয়ে তাদের বাড়ির পশ্চিম দিকে যায়। সেখানে ইতোমধ্যে মখলেছার রহমান চৌধুরীর পরিবারের পাটের গুদামে অগ্নিসংযোগের ফলে কয়েকশ মন পাট দাউ-দাউ করে জ্বলছিল। পাশে আব্দুল বারী চৌধুরীর গোয়াল ঘরে ৩টি গরু এবং ২টি মহিষকে শেকল দিয়ে আটকিয়ে আগুন দেয় পাক নরপশুরা। এতে নিরীহ প্রাণীগুলো পুড়ে ছাই হয়ে যায়। হানাদাররা মখলেছার রহমান চৌধুরী, এনামুল হক চৌধুরী ও আমিনুল হক চৌধুরীকে পাট গুদামের আগুনের লেলিহান শিখার মধ্যে নিক্ষেপ করতে চায়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মত পরিবর্তন করে তাঁদের পাশাপাশি বেঁধে গুলি করে হত্যা করে। হানাদার বাহিনীর গুলিতে গ্রামের আরো অনেকে নিহত হয়।
পাকসেনারা আব্দুল ওয়াহেদ চৌধুরীর ঘরে ঢুকে তাঁর স্ত্রী তহুরুন নেছাকে কোরআন পাঠরত অবস্থায় গুলি করে হত্যা করে। তারা এ গ্রামে বেড়াতে আসা মহাদেবপুর উপজেলার জোয়ানপুরের নূর মোহাম্মদ সর্দারের ওপর আমানবিক শারীরিক নির্যাতন করে। পরদিন তিনি মারা যান। হানাদারদের দেখে গ্রামের শামসুল হক চৌধুরীর মেয়ে সামসাদ বেগম রাবেয়া পালানোর চেষ্টা করে। তাকে ধরে পাকসেনারা গুলি করলে সে আহত হয়। এ গ্রামের আবু ফারুক চৌধুরী (পিতা ওয়ারেশ আলী চৌধুরী) পেশায় আইনজীবী ছিলেন। ১৯৬০ সালে তিনি বগুড়া আজিজুল হক কলেজ থেকে আইএ, ১৯৬২ সালে রাজশাহী কলেজ থেকে বিএ এবং ১৯৬৬ সালে রাজশাহী আইন কলেজ থেকে বিএল ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি ছিলেন নওগাঁর আরেক শহীদ আইনজীবী আব্দুল জব্বারের সহপাঠী। তিনি কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত না থাকলেও সমাজতন্ত্র ও প্রগতিশীলতার সমর্থক ছিলেন। নওগাঁ শহর হানাদার বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে চলে গেলে তিনি গয়েশপুরে চলে আসেন। কিন্তু গয়েশপুরে সেদিন এ বিশিষ্ট আইনজীবী ও তাঁর ভাই শামসুল হক চৌধুরী পাকবাহিনীর হাতে ধরা পড়েন। একটি নারকেল গাছের সঙ্গে দুই ভাইকে বেঁধে হানাদাররা গুলি করে নৃশংসভাবে হত্যা করে। পাকসেনারা এ গ্রামের শতাধিক বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ করে। ফলে এ সকল বাড়িঘর সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে যায়।
গয়েশপুর গণহত্যায় নিহতদের স্মৃতি রক্ষার জন্য ১৯৯৭ সালের ২রা ডিসেম্বর আওয়ামী লীগ-এর প্রেসিডিয়াম সদস্য আব্দুল জলিল শহীদদের নাম সম্বলিত একটি স্মৃতিস্তম্ভ উন্মোচন করেন। [চিত্তরঞ্জন মিশ্র]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৩য় খণ্ড