গরিবপাড়া যুদ্ধ (নবাবগঞ্জ, দিনাজপুর)
গরিবপাড়া যুদ্ধ (নবাবগঞ্জ, দিনাজপুর) সংঘটিত হয় জুলাই মাসের ৩ তারিখ। এতে ৬ জন রাজাকার নিহত হয়। বিরামপুর থেকে ৬ কিলোমিটার পূর্বদিকে এবং নবাবগঞ্জ থেকে ৪ কিলোমিটার পশ্চিমদিকে ডিবি রাস্তার দুপাশে একটি ছোট্ট পাড়া গড়ে উঠেছিল। দিনমজুর, কৃষিশ্রমিক এই শ্রেণির মানুষদের বসবাস ছিল সেখানে। গরিব মানুষের বসবাস ছিল বলে পাড়াটির নাম হয় গরিবপাড়া। বিরামপুরের ও নবাবগঞ্জ পাকসেনা ক্যাম্পের মধ্যে যোগাযোগে এই ডিবি রাস্তাটি ব্যবহৃত হতো। এ-রাস্তা ধরে পাকটহলদার বাহিনী প্রায়ই পায়ে হেঁটে যাতায়াত করত। এপ্রিল মাসের প্রথম দিক থেকেই তাদের যাতায়াত শুরু হয়। সেই সময় রাস্তার দুপাশের গ্রামগুলোতে নারীনির্যাতন ও লুটপাট ছিল পাকসেনাদের নিত্যদিনের কাজ। এতে গ্রামবাসীদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। সেই অবস্থা থেকে তাদের মুক্ত করার জন্য তৎকালীন আওয়ামী লীগ-এর ইউনিয়ন সভাপতি ডা. মো. মোছফার রহমান এগিয়ে আসেন। জুন মাসের শেষদিকে তিনি ভারত থেকে ট্রেনিংপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের বিষয়টি অবগত করেন। তাঁরা একটি গেরিলা যুদ্ধের পরিকল্পনা করেন। মুক্তিযোদ্ধারা ৫-৭ দিন গরিবপাড়াটি রেকি করেন।
জুলাই মাসের ৩ তারিখ খুব ভোরে মুক্তিযোদ্ধারা গরিবপাড়ায় এসে অবস্থান নেন। পাড়া থেকে লোকজনকে সরিয়ে দেন। পাড়ার পূর্বপাশে একটি জঙ্গলে তাঁদের একটি সুসজ্জিত দলকে লুকিয়ে রাখেন। তারপর এমন একটি ফাঁদ তৈরি করেন, যাতে হানাদার বাহিনীর সদস্যরা পালিয়ে সেই জঙ্গলে আশ্রয় নেয়। গেরিলাদের বেশকিছু সদস্য পাকহানাদার বাহিনীর ওপর আক্রমণ পরিচালনা করতে গরিবপাড়ার দুই পাশের ঘরবাড়িগুলোতে আশ্রয় নেন। এভাবে পরিকল্পনা করে তাঁরা সকাল ৭টা থেকেই ডিফেন্স নেন। প্ৰায় দুই ঘণ্টা অপেক্ষা করার পর হানাদার বাহিনীর ৬ জন সদস্য ও ৮জন রাজাকার- পায়ে হেঁটে গরিবপাড়ার বটগাছের কাছাকাছি চলে আসে। গেরিলারা সিগন্যাল দিতেই হানাদার বাহিনীর ৫ সদস্য উল্টো দিকে দৌড় শুরু করে একটা নিরাপদ জায়গায় গিয়ে ডিফেন্স নেয়। গরিবপাড়ার গেরিলারা তখন রাস্তায় উঠে তাদের দিকে গুলি ছুড়তে থাকেন। এ অবস্থায় একজন পাকসেনা ও কয়েকজন রাজাকার বটগাছের পাশের জঙ্গলের দিকে ছুটে যায়। তখন জঙ্গল থেকে লুকিয়ে থাকা গেরিলারা বেরিয়ে এসে তাদের ঘিরে ফেলেন এবং গুলি চালান। এতে ৬ রাজাকার নিহত হয় এবং পাকসেনাটি পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। অন্যদিকে ডিফেন্স নেয়া হানাদার বাহিনীর সঙ্গে গুলি বিনিময় চলে। শত্রুপক্ষ পেছনের দিকে পালাতে থাকে। প্রায় ১ ঘণ্টা গোলাগুলির পর পেছন থেকে শত্রুপক্ষের অনুকূলে টহলগাড়ি এলে হানাদাররা দ্রুত পালিয়ে যায়। তবে আব্দুল গফুর ও এন্তাজ আলী নামে দুজন রাজাকার আত্মসমর্পণ করে।
এই গেরিলা যুদ্ধে ৩০ জন মুক্তিযোদ্ধা অংশ নিয়েছিলেন। তাঁদের মধ্যে রেজানুল হক, সামসুল আরেফিন ডাগু, প্লাটুন কমান্ডার মোফাজ্জল হোসেন, সেকেন্দার আলী, ওয়াজেদ আলী, ছামসুল হক, ডা. মমতাজুর রহমান প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। এ-যুদ্ধের পর থেকে পাকসেনা ও রাজাকার বাহিনী গ্রামগুলোতে যখন-তখন ঢোকার আর সাহস দেখায়নি। পাকসেনারা গাড়ি বহরের মাধ্যমে চলাফেরা করত। [মাসুদুল হক]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৩য় খণ্ড