গরীবউল্লাহ্ শাহ্ মাজার বধ্যভূমি ও গণকবর (চট্টগ্রাম মহানগর)
গরীবউল্লাহ্ শাহ্ মাজার বধ্যভূমি ও গণকবর (চট্টগ্রাম মহানগর) চট্টগ্রাম শহরের দামপাড়া পুলিশ ফাঁড়ি থেকে এক কিলোমিটার উত্তরে জাকির হোসেন রোডে অবস্থিত। মাজারটি সকল ধর্মের মানুষের কাছে পবিত্র স্থান হিসেবে বিবেচিত। কিন্তু পাকবাহিনী তাদের নৃশংসতার জন্য এ স্থানটিকেও রেহাই দেয়নি। তারা রাতের অন্ধকারে বাঙালিদের হত্যা করে এ কবরস্থানে পুঁতে রাখত। বুটপায়ে যখন-তখন কবরস্থানে ঢুকে পড়ত। এ নিয়ে স্থানীয় জনমনে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। এক পর্যায়ে মাজার-সংলগ্ন মসজিদের ইমাম মাওলানা আবু দাউদ মৃতদের জানাজা পড়ানোর জন্য পাকসেনাদের ওপর চাপ সৃষ্টি করেন। স্থানীয় কিছু লোকজনও তাঁকে সমর্থন করে। ফলে কবরস্থানে হত্যা ও মৃতদেহ মাটিচাপা দেয়া বন্ধ হয়। এরপর থেকে ঘাতকরা মাজারের নিকটবর্তী একটি স্থানকে বধ্যভূমি ও গণকবর হিসেবে ব্যবহার করে।
মাজারের উত্তর পাশ দিয়ে একটি সরু মাটির রাস্তা লোকালয়ের দিকে চলে গেছে। এলাকাটি পাহাড় ও জঙ্গলে ভরা, মাঝে-মধ্যে সমতল ভূমি। শহরের দরিদ্র শ্রেণির লোকেরা বস্তির মতো ঘর তুলে এখানে বসবাস করত। বিহারি যুবকরা বস্তিগুলো নিয়ন্ত্রণ করে টাকা তুলত। এলাকাটি ছিল একেবারে নির্জন। এখানে মানুষ হত্যা করে পুঁতে রাখা খুব সহজ ছিল। এ কারণে এখানে অসংখ্য বাঙালিকে ধরে এনে হত্যা করা হয়।
এখানে ঝোঁপ-জঙ্গলের মধ্যে একটি ছোট্ট ঘর ছিল। সে- ঘরে বিহারি যুকবরা এলাকার বাঙালি মেয়েদের ধরে এনে ধর্ষণ করত। পাকসেনারাও এতে অংশ নিত। এখানে মদ্যপানের ব্যবস্থা ছিল এবং লুটের টাকা-পয়সা ও স্বর্ণালংকার ভাগ করা হতো।
বিহারি যুবকরা ধরে আনা অসহায় নারীদের পাকিস্তানি সিপাহিদের কাছে বিক্রি করে দিত। তারা কিছুদিন ভোগ করে তাদের অন্যত্র চালান দিত। বিহারি যুবকরা এলাকার পুরুষদেরও ধরে এনে তাদের কাছ থেকে টাকা আদায় করত। যারা টাকা দিতে পারত না, তাদের হত্যা করে লাশ পুঁতে রাখত। বিহারি যুবকদের এসব কর্মকাণ্ডে পাকিস্তানি সৈন্যদের সরাসরি পৃষ্ঠপোষকতা ছিল। এক সময় বিহারি যুবকদের হাত থেকে এ স্থানের নিয়ন্ত্রণ চলে যায় চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে অবস্থানরত পাকসেনাদের অধীনে। সার্কিট হাউজ ও চট্টগ্রাম স্টেডিয়ামে যেসব বাঙালিকে হত্যা করা হতো, তাদের লাশ বিহারি যুবকরা এখানে এনে পুঁতে রাখত। লাশের সংখ্যা বাড়তে থাকলে বিশেষ ধরনের কেমিক্যাল দিয়ে সেগুলো পুড়ে ফেলা হতো।
শহরের বিভিন্ন এলাকা থেকে লাশ এনে এখানে ফেলা হতো। এমন তথ্যও পাওয়া গেছে যে, বাঙালিদের কাউকে ধরে এনে গুলি না করে গলায় রশি লাগিয়ে দুদিক থেকে টেনে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হতো। কোনো-কোনো বিহারি যুবক হত্যার কৌশল শেখার জন্য পাথরের ওপর বাঙালিদের মাথা চেপে ধরে জবাই করত। কেমন করে জবাই করলে দ্রুত মারা যায়, কোথায় ছুরি বসাতে হয় এসব কৌশল এখানে শেখানো হতো। এটা ছিল অনেকটা হত্যার লোমহর্ষক প্রশিক্ষণ কেন্দ্রস্বরূপ। অনেক সময় বাঙালিদের চোখ-মুখ বেঁধে পাহাড়ের গায়ে দাঁড় করানো হতো এবং নিকট দূরত্ব থেকে তাদের বুকে ধারালো ছুরি নিক্ষেপ করে হত্যার প্রশিক্ষণ নেয়া হতো। প্রায় প্রতিদিনই হত্যার এ মহড়া চলত। গুলি ব্যবহার না করে এভাবে হত্যা করার জন্য পুরস্কারেরও ব্যবস্থা ছিল।
এ বধ্যভূমিতে একটি বিশাল গাছ ছিল। সেই গাছের ডালে দড়ি বেঁধে তাতে বাঙালিদের ঝুলিয়ে ঘাতকদের কয়েকজন মিলে ‘ইয়া আলী’ বলে জোরে টান দিত এবং সেই করুণ দৃশ্য দেখে তারা উল্লাস করত। এই নৃশংসতার খবর এক সময় চলে যায় মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মৌলভী সৈয়দের নিকট। তিনি তাঁর বিশ্বস্ত কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাকে দায়িত্ব দেন এ হত্যাকাণ্ড বন্ধ করার ব্যবস্থা নিতে। একদিন দেখা যায় পাকিস্তানি সৈন্যদের পোশাকপরা কতগুলো লাশ এবং ৯ জন বিহারি যুবকের লাশ এখানে পড়ে আছে। এ ঘটনায় ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে বিভিন্ন নির্যাতনকেন্দ্রে কর্মরত বিহারি যুবকদের অনেকেই পালিয়ে যায়। শহরের বিভিন্ন স্থানে বিহারিদের আবাসস্থলেও ভীতির সঞ্চার হয়। ফলে শহরে এরূপ নির্যাতনের পরিমাণ কমে আসে। [সাখাওয়াত হোসেন মজনু]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৩য় খণ্ড