You dont have javascript enabled! Please enable it!

মুক্তিযুদ্ধে গংগাচড়া উপজেলা (রংপুর)

গংগাচড়া উপজেলা (রংপুর) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান- ১৯৬৯ সালে আগরতলা মামলা থেকে মুক্তিলাভের পর উত্তরবঙ্গ সফরে এসে রংপুর, লালমনিরহাট, গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম ও নিলফামারীর জনসমাবেশে বক্তৃতা করেন। তাঁর এ সফরের ফলে রংপুর অঞ্চলসহ গংগাচড়ায় পাকিস্তান-বিরোধী গণআন্দোলন বেগবান হয়।
১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে বাঙালিদের নিরঙ্কুশ বিজয়ের পর প্রতিরোধ আন্দোলনে রংপুর অঞ্চলের জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করে। গংগাচড়া উপজেলা রংপুর জেলা সদর থেকে মাত্র ১২ কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত হওয়ায় রংপুর জেলা আওয়ামী লীগ-এর নেতৃত্বে সেখানকার আন্দোলন-সংগ্রাম পরিচালিত হতো। রংপুর জেলা আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব দেন আব্দুল আউয়াল এমএনএ, মো. সিদ্দিক হোসেন এমপিএ, শাহ আব্দুর রাজ্জাক এমপিএ, হামিদুজ্জামান সরকার এমপিএ, মো. গাজী রহমান এমপিএ, শেখ আমজাদ হোসেন, এডভোকেট আব্দুল গণি, তৈয়বুর রহমান, মীর আনিছুল হক পেয়ারা প্রমুখ। ৩রা মার্চ বঙ্গবন্ধুর ডাকে দেশব্যাপী হরতালের কর্মসূচি চলাকালে রংপুর শহরের ছাত্র-জনতার মিছিলে অবাঙালিদের গুলিতে তিনজন নিহত হয়। এতে ক্ষোভ ও উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে গংগাচড়াসহ জেলার সর্বত্র। ৩রা মার্চ থেকে ৫ই মার্চ পর্যন্ত রংপুর শহরে পাকিস্তান সরকার কারফিউ জারি করে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাতই মার্চের ভাষণ এর পর রংপুর জেলা আওয়ামী লীগের নির্দেশে গংগাচড়ার জনগণ আন্দোলন- সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে। পাড়ায়-পাড়ায়, গ্রামে-গ্রামে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি চলতে থাকে। ২৮শে মার্চ বাঁশের লাঠি আর তীর-ধনুক নিয়ে রংপুর সেনানিবাস আক্রমণ-এর যে ঘটনা ঘটে, তাতে গংগাচড়া উপজেলার বিভিন্ন গ্রাম থেকে আসা শতশত সংগ্রামী জনতা যোগ দেয়। তাদের অনেকেই সেদিন আহত ও শহীদ হন। জেলা আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দের সহযোগিতায় দেশপ্রেমিক যুবকদের শংকরদহের উত্তরে তিস্তার চরে মুক্তিযুদ্ধের প্রাথমিক প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। পরবর্তীতে তারা ভারতের বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে মুক্তিযুদ্ধের উচ্চতর প্রশিক্ষণ নিয়ে এসে গংগাচড়াসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে যুদ্ধ করেন। গংগাচড়া উপজেলায় যুদ্ধকালীন কমান্ডার ছিলেন মীর আব্দুস সালাম (পিতা ওসমান গণি, মহীপুর)।
পাকবাহিনী মে মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে গংগাচড়া সদরে টহল দিতে শুরু করে। মে মাসের মাঝামাঝি তারা গংগাচড়া ডাকবাংলো ও বুড়িরহাট হাইস্কুলে ক্যাম্প স্থাপন করে। তাছাড়া আলমবিদিতের মণ্ডলের হাট প্রাথমকি বিদ্যালয়ে একটি রাজাকার- ক্যাম্প স্থাপিত হয়।
রংপুর সেনানিবাস গংগাচড়ার কাছাকাছি হওয়ায় মুক্তিযোদ্ধারা তিস্তার চর ও কাকিনা এলাকায় অবস্থান নেন এবং সেখান থেকে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করেন।
মে মাসে স্বাধীনতাবিরোধীদের নিয়ে রাজাকার বাহিনী গঠিত হয়। গংগাচড়ার পাকবাহিনীর দালাল ও রাজাকারদের মধ্যে মৌলবী মো. হাবিবুর রহমান (গংগাচড়া থানা রাজাকার কমান্ডার, গজঘণ্টা উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক), মো. মোতালেব হোসেন মন্টু (ডেপুটি রাজাকার কমান্ডার, জয়দেব), জয়নাল আবেদীন (ভুটকা), মো. আবুল হোসেন (দক্ষিণ খলেয়া), মৌলবী আব্দুল কদ্দুস (মসজিদের ইমাম, কিসমত হাবু), মৌলবী আব্দুল মজিদ (কিসমত হাবু), মৌলবী জয়নাল আবেদীন (শিক্ষক), আসাদুল হক (গংগাচড়া), মন্টু মিয়া চৌকিদার (গংগাচড়া), মৌলবী মেছের আলী (গংগাচড়া), আলী মহুরী (বাগপুর), মাসুম (মাদ্রাসা শিক্ষক, বাগপুর), ইয়াসিন (বাগপুর), মোহাম্মদ আলী মেম্বার (আরাজী নিয়ামত), তসলিম মৌলবী (আরাজী নিয়ামত), হবিবর রহমান (গজঘণ্টা), বাচ্চু দালাল (মহীপুর), মওলানা রুহুল আমিন ওরফে সুজা পীর (পাকুড়িয়া) প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। এছাড়া মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য যাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছিল, তাদের মধ্যে নূর মোহাম্মদ (রাজবল্লভ), মোজাম্মেল হক (শংকরদহ), মোহাম্মদ আলী (আরাজী নিয়ামত), ফজলুল হক (পানাপুকুর), মজির উদ্দিন (জয়সা মামুদ, চেংমারী), আব্দুল নূর (বড়রূপাই), আব্দুস সাত্তার (বড়রূপাই) – এদের নাম উল্লেখযোগ্য।
মুক্তিযোদ্ধাদের ১২ই ডিসেম্বর গংগাচড়া থানা আক্রমণের খবর পেয়ে ১৩ই ডিসেম্বর রংপুর সেনানিবাস থেকে একদল পাকবাহিনী গংগাচড়ার শংকরদহ গ্রামে অপারেশনে আসে। তারা ব্রাশফায়ার করতে-করতে শংকরদহ গ্রামের পথে আব্দুল আজিজ, ফজর উদ্দিন, মফিজ উদ্দিন ও হাবিবুর রহমানকে হত্যা করে। এ নির্মম হত্যাকাণ্ড দেখে গ্রামবাসী আতঙ্কিত হয়ে প্রাণের ভয়ে বকুলতলা পুরাতন মসজিদে নফল নামাজ আদায় করতে যায়। পাকিস্তানি হানাদাররা মসজিদে ঢুকে নামাজরত অবস্থায় মসজিদের ইমাম মৌলবি তৈয়ব আলী, মহির উদ্দিন, সহির উদ্দিন, বছির উদ্দিন, নবির উদ্দিন ও তার সাত বছরের ছেলেসহ ১৮ জন মুসল্লীকে মসজিদের ভেতরে গুলি করে হত্যা করে। এরপর শংকদহের রজনীকান্তের বাড়িতে প্রবেশ করে নারীদের ওপর পাশবিক নির্যাতন চালাতে থাকে। রজনীকান্ত বাঁধা দিলে হানাদাররা তাকে বেয়নেট চার্জ করে হত্যা করে। পাকিস্তানি হানাদাররা সেখান থেকে ফেরার পথে ব্রাশফায়ার করে মুন্সী মঞ্জুর আলী, রহিম উদ্দিন, আকবর আলী, সহিদার রহমান, বদিউল ইসলাম, আলী মাস্টারসহ আরো কয়েকজনকে হত্যা করে। শংকরদহ গণহত্যায় মোট ২৪ জন শহীদ হন।
গংগাচড়া উপজেলার শংকরদহে একটি বধ্যভূমি রয়েছে। বুড়িরহাট হাইস্কুলে স্থাপিত হানাদার ক্যাম্পটি পাকবাহিনী নির্যাতনকেন্দ্র ও বন্দিশিবির হিসেবে ব্যবহার করত। সেখানে মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোকদের ধরে নিয়ে নির্যাতন চালাত।
অক্টোবর মাসে শংকরদহে পাকবাহিনীর গোলাগুলির শব্দ শুনে তিস্তার চরে অবস্থানরত ১২০ জন মুক্তিযোদ্ধার সমন্বয়ে গঠিত কোম্পানিটি তিন গ্রুপে ভাগ হয়ে যায়। কোম্পানি কমান্ডার হারেস উদ্দিন সরকারের নেতৃত্বে একটি গ্রুপ গংগাচড়ার গজঘণ্টায় এবং শামসুল ইসলামের নেতৃত্বে অন্য একটি গ্রুপ গংগাচড়ার মহীপুর রাস্তার শেষ মাথায় অবস্থান নেয়। কোম্পানি কমান্ডার মীর আব্দুস সালামের নেতৃত্বে অপর একটি গ্রুপ শংকরদহের দিকে অগ্রসর হয়। সেখানে পৌঁছে তারা পাকিস্তানি সেনাদের ওপর গুলিবর্ষণ শুরু করে। এতে দুজন পাকিস্তানি সেনা ও পাঁচজন রাজাকার নিহত হয়। ফলে পাকিস্তানি সেনারা পিছু হটে রংপুর সেনানিবাসের দিকে চলে যায়। শংকরদহ অপারেশন শেষে মুক্তিযোদ্ধারা তিস্তার ওপারে ছামাদ আলীর চরে অবস্থান নেয়।
১২ই ডিসেম্বর সকালে কোম্পানি কমান্ডার মীর আব্দুস সালামের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি গ্রুপ গংগাচড়া থানা আক্রমণ করে। সেখান থেকে তারা বেশ কিছু অস্ত্র, গোলাবারুদ ও একজন পাকিস্তানি বাবুর্চিকে তিস্তা নদীর চরে মুক্ত এলাকায় ধরে নিয়ে যায়। ১৬ই ডিসেম্বর গংগাচড়া উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়। উপজেলার খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা হলেন— মাহতাব আলী সরকার, বীর প্রতীক (পিতা বছিরউদ্দিন সরকার, গংগাচড়া, রংপুর)।
গংগাচড়া উপজেলায় পাঁচজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার নাম পাওয়া যায়। তাঁরা হলেন— মোহাম্মদ আলী (পিতা আব্দুল গণি, চরবিনবিনিয়া), আবুবকর সিদ্দিক (পিতা ইদ্রিস আলী, ধামুর), সাইফুল ইসলাম (পিতা মো. খবির উদ্দিন, রাজবল্লভ), রফিকুল ইসলাম (পিতা ফজলার রহমান, মৌভাষা) এবং শামসুজ্জামান (পিতা নবির উদ্দিন, মৌভাষা) গংগাচড়া ডিগ্রি কলেজের সামনে মুক্তিযুদ্ধের একটি স্মৃতিস্মারক নির্মিত হয়েছে। গংগাচড়া বাজারে এলএসডি গোডাউনের দক্ষিণে গংগাচড়া-রংপুর সড়কের পূর্ব দিকে ৩৩ শতক খাস জমি মুক্তিযোদ্ধাদের স্বতন্ত্র কবরস্থানের জন্য নির্ধারণ করা হয়েছে। [বিবেকানন্দ মহন্ত]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৩য় খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!