গচিহাটা-ধূলদিয়া রেলসেতু বধ্যভূমি (কটিয়াদী, কিশোরগঞ্জ)
গচিহাটা-ধূলদিয়া রেলসেতু বধ্যভূমি (কটিয়াদী, কিশোরগঞ্জ) কিশোরগঞ্জ জেলার কটিয়াদী উপজেলায় অবস্থিত। গচিহাটা রেলস্টেশনে পাকবাহিনীর একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্যাম্প ছিল। এখানে রাজাকার- রিক্রুটমেন্ট ও তাদের প্রশিক্ষণ দেয়া হতো। এর লাগোয়া উত্তর পার্শ্বের রেলসেতুটি ছিল পাকহানাদারদের বাঙালি নিধনের অন্যতম স্থান। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে হানাদাররা কটিয়াদী থানাসহ কিশোরগঞ্জ মহকুমার বিভিন্ন এলাকা থেকে নিরীহ লোকদের ধরে এনে এ বধ্যভূমিতে হত্যা করত। এখানে বিভিন্ন সময়ে ধরে আনা আড়াই শতাধিক বাঙালিকে হত্যার কথা জানা যায়, যদিও নিহতদের সকলের পরিচয় উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। বিভিন্ন সূত্রের মাধ্যমে কয়েকজনের পরিচয় পাওয়া গেছে। তাঁদের মধ্যে একজন ছিলেন পাকুন্দিয়া থানা সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. অমূল্য চক্রবর্তী। তাঁর বাড়ি ছিল চট্টগ্রামের বোয়ালখালি থানায়। তিনি হাসপাতালের সরকারি বাসভবনে সপরিবারে বসবাস করতেন। জুন মাসের এক রাতে পাকবাহিনী তাঁকে এবং তাঁর তিন পুত্র শ্যামল চক্রবর্তী, মৃদুল চক্রবর্তী ও বকুল চক্রবর্তীকে বাসা থেকে ধরে নিয়ে যায়। বয়স স্বল্পতার কারণে কনিষ্ঠ পুত্র বকুলকে ছেড়ে দিলেও দুই পুত্রসহ অমূল্য চক্রবর্তীকে গচিহাটার ধূলদিয়া রেলসেতুতে নিয়ে হত্যা করে। অমূল্য চক্রবর্তীর অফিস পিয়ন আবদুল মমিনকেও তাঁদের সঙ্গে ধরে নিয়ে হত্যা করে। আবদুল মমিনের বাড়ি ছিল পাকুন্দিয়া থানার হাপানিয়া লক্ষ্মীয়া গ্রামে।
মুক্তিযুদ্ধকালে গচিহাটা রেলস্টেশনে পয়েন্টসম্যানের চাকরি করতেন হারান বাবু। তিনি স্টেশনের আবাসিক ভবনে বসবাস করতেন। রেলস্টেশন পাকহানাদারদের দখলে চলে গেলে তিনি কর্মস্থল ত্যাগ করে নিকটস্থ দেওজান গ্রামে বসবাস করতে থাকেন। জুলাই মাসে স্থানীয় রাজাকাররা তাকে দেওজান গ্রাম থেকে ধরে এনে ধূলদিয়া রেলসেতুতে হত্যা করে। গচিহাটা গ্রামের ৬০ বছরের বৃদ্ধ কাঠমিস্ত্রী বৈকুণ্ঠ সূত্রধরের ৪০ বছর বয়সী কনিষ্ঠপুত্র তরণী সূত্রধর মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলেন। সে-কারণে ১৩ই জুলাই কতিপয় রাজাকার ও হানাদার পাকসেনা তার পিতা বৈকুণ্ঠ সূত্রধর ও ভাই ধরণী সূত্রধরকে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে ধূলদিয়া রেলসেতুতে হত্যা করে। ধূলদিয়া কাচারিপাড়া গ্রামের যতীন্দ্র ঠাকুর ধূলদিয়া বাজারে পাটব্যবসা করতেন। অবসর সময়ে তিনি বিভিন্ন পূজা-পার্বণে পুরোহিতের কাজ করতেন। ২৯শে জুলাই পাকসেনাদের একটি দল তাকে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে কিশোরগঞ্জ শহরের পাকিস্তানি সেনাক্যাম্পে আটকে রাখে। এর চারদিন পর তাকে ধূলদিয়া রেলসেতুতে নিয়ে হত্যা করে।
গচিহাটা রেলস্টেশনের নিকটবর্তী পূর্ব সহশ্রামের আবদুর রশিদের ৩০ বছর বয়সী পুত্র আবদুল মালেক ট্রেনে ফেরি করে বনৌষধি বিক্রি করতেন। আগস্ট মাসে পাকহানাদার বাহিনী তাকে কিশোরগঞ্জ স্টেশন সংলগ্ন আর্মি ক্যাম্পে আটকে রাখে। পরে আরো কয়েকজন বাঙালির সঙ্গে ধূলদিয়া রেলসেতুতে নিয়ে তাকে হত্যা করে। পূর্ব সহশ্রামের ইমাদ আলী শাহের ৩০ বছর বয়সী পুত্র মীর হোসেন কৃষিকাজ করতেন। ২৪শে আগস্ট পাকিস্তানি হানাদাররা তাকে বাড়ি থেকে ধরে এনে ধূলদিয়া রেলসেতুতে হত্যা করে। সহশ্রাম পশ্চিমপাড়া গ্রামের রইছ আলী শাহের পুত্র আবদুল হেকিম ঠিকাদারী ব্যবসা করতেন। একই দিন ৬৫ বছরের বৃদ্ধ এই রইছ আলীকে পাকসেনারা বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে যায়। পরে তাকে ধূলদিয়া রেলসেতুতে হত্যা করে। একই দিন কিশোরগঞ্জ সদর থানার ভাস্করখিলা গ্রামের নবীনচন্দ্র ধরের পুত্র হরেন্দ্রচন্দ্র ধর, শরৎচন্দ্র ধরের পুত্র ধরণীকান্ত ধর, ইন্দ্রনারায়ণ ধরের পুত্র নগেন্দ্র ধর, গৌরমোহন নাহার পুত্র কৃষ্ণমোহন নাহা, রামনারায়ণ ভৌমিকের পুত্র দেবেন্দ্র ভৌমিক, দেবেন্দ্র ভৌমিকের পুত্র নগেন্দ্র ভৌমিক, নগেন্দ্ৰ ভৌমিকের পুত্র মধুসূদন ভৌমিক, বিপিনচন্দ্র বিশ্বাসের পুত্র বিজয় বিশ্বাস, জয়নাথ দে-র পুত্র সুবোধচন্দ্র দে এবং বিশ্বনাথ নাহার পুত্র হীরেন্দ্র নাহাকে রাজাকার ও -আলবদর-রা ধরে এনে ধূলদিয়া রেলসেতু বধ্যভূমিতে হত্যা করে।
কাঁঠালতলী গ্রামের বৃন্দাবন চন্দ্র বণিকের পুত্র যতীন্দ্র চন্দ্র বণিক ছিলেন ব্যবসায়ী। ২৬শে আগস্ট সকালে পাকহানাদার ও রাজাকার বাহিনী এ গ্রামে যৌথ অভিযান চালায় এবং হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের ১২জন নিরীহ লোককে ধরে নিয়ে যায়। পরে তাদের সকলকে ধূলদিয়া রেলসেতুতে নিয়ে হত্যা করে। নেত্রকোণা জেলার আমতলার বাসিন্দা রাধাবিনোদ অধিকারী বৈবাহিক সূত্রে ধূলদিয়া বেড়াটির শ্বশুরালয়ে স্ত্রী ও এক কন্যাসহ বসবাস করতেন। তিনি ধূলদিয়া বাজারে পান-সুপারির ব্যবসা করতেন। ১৫ই সেপ্টেম্বর পার্শ্ববর্তী ঝিকরজোড়া গ্রামের রাজাকার কমান্ডার শামছু ও তার সহযোগী মহিশবাড়ি গ্রামের রাজাকার জামির উদ্দিন তাদের বাহিনী নিয়ে ধূলদিয়া এলাকায় অভিযান চালায়। এ-সময় ঘাতক রাজাকারের দল রাধাবিনোদ অধিকারীকে ধরে নিয়ে ধূলদিয়া রেলসেতু সংলগ্ন রাজাকার ক্যাম্পে আটকে রাখে। তিনদিন পর রাজাকাররা তাকে ধূলদিয়া রেলসেতুতে হত্যা করে।
২৬শে সেপ্টেম্বর কিশোরগঞ্জ সদর থানার বাটাইল টুটিয়ারচরের মো. তজুর উদ্দিনের ৬০ বছর বয়সী পুত্র মো. ইমাম হোসেন, অপর পুত্র মো. ইসরাঈল এবং একই গ্রামের আবদুর রাজ্জাকের পুত্র মোহাম্মদ আলীসহ ৫জন গ্রামবাসীকে নিজ-নিজ বাড়ি থেকে ধরে এনে ধূলদিয়া রেলসেতুতে হত্যা করে। কিশোরগঞ্জ শহরের বত্রিশ এলাকার বাসিন্দা নীরদ চন্দ্র সরকার, তার দুই পুত্র রঞ্জিত সরকার ও অজিত চন্দ্র সরকার পরিবার-পরিজন নিয়ে নৌকাযোগে পালাবার সময় ধূলদিয়ায় রাজাকার বাহিনীর হাতে ধরা পড়েন। রাজাকাররা তাদের ধূলদিয়া রেলসেতুতে এনে একসঙ্গে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করে। [মো. রফিকুল হক আখন্দ]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৩য় খণ্ড