খোলাবাড়িয়ার যুদ্ধ (নলডাঙ্গা, নাটোর)
খোলাবাড়িয়ার যুদ্ধ (নলডাঙ্গা, নাটোর) সংঘটিত হয় ৮ই ডিসেম্বর। এতে একজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন এবং হানাদাররা পালিয়ে যায়।
নাটোর জেলার নলডাঙ্গা উপজেলার পিপরুল ইউনিয়নের ঐতিহ্যবাহী গ্রাম খোলাবাড়িয়া। চলনবিল লাগোয়া হালতির বিলের মাঝখানে খোলাবাড়িয়া গ্রামের অবস্থান। বর্ষাকালে চারিদিকে জলাবদ্ধ থাকায় বিলের মাঝখানে গ্রামটি অনেকটা দ্বীপের মতো মনে হয়। ৮ই ডিসেম্বর এ গ্রামে পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধ সংঘটিত হয়।
পিপরুল ইউনিয়নের শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান আব্দুল করিম শিকদার ও তার ছেলে জামান শিকদারের অত্যাচারে আশপাশের গ্রামবাসী ভীষণ আতঙ্কগ্রস্ত ছিল। ঘাতকদের শাস্তি দেয়ার জন্য ৪ঠা নভেম্বর গেরিলা কমান্ডার চিত্তরঞ্জন রায়ের নেতৃত্বে খোলাবাড়িয়ার আব্দুস সাত্তার, আফাজ উদ্দিন, আব্দুস সামাদ, বিলজোয়ানীর আব্দুস সামাদ দেওয়ান, আবুল হোসেন, সিংড়ার হাতিয়ানদহর দিলীপ কুমার সরকার, বেসারত আলী, আজমল হোসেন প্রমুখ মুক্তিযোদ্ধা খোলাবাড়িয়া গ্রামে আশ্রয় নেন। মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানের খবর ফাঁস হয়ে গেলে শান্তি কমিটির নেতা আব্দুল করিম শিকদার পাকবাহিনীর সহায়তায় মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণ করার জন্য একটি অপারেশন টিম গঠন করে। তারা গ্রামের চতুর্দিকে চৌকি বসায়, যাতে মুক্তিযোদ্ধারা বের হয়ে যেতে না পারেন। মুক্তিযোদ্ধারা এ খবর পেয়ে ৯টি বাঙ্কার তৈরি করে যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। তাঁরা গ্রামের উৎসাহী ও নির্ভীক যুবকদের যুদ্ধের প্রাথমিক প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করেন। গ্রামের সাধারণ মানুষজনদের শত্রুপক্ষের নিক্ষিপ্ত গুলি থেকে আত্মরক্ষার প্রশিক্ষণও প্রদান করেন। ৮ই ডিসেম্বর পাকবাহিনী এদেশীয় দালালদের সঙ্গে নিয়ে চন্দ্রাকারে ৩০টি নৌকায় খোলাবাড়িয়ার দিকে এগুতে থাকে। তারা ফায়ার করতে-করতে মুক্তিযোদ্ধাদের বাঙ্কারের কাছে চলে আসে। তাদের গুলিতে মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রাজ্জাক শহীদ হন। তাঁর মৃত্যুতে অন্য মুক্তিযোদ্ধারা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েন। এরূপ অবস্থায় দলের কমান্ডার চিত্তরঞ্জন রায় বাঙ্কারের মধ্যে অবস্থানরত সহযোদ্ধাদের ফায়ার ওপেন করার নির্দেশ দিয়ে নিজে এলএমজি দিয়ে ফায়ার ওপেন করেন। উভয় পক্ষের মধ্যে প্রায় তিন ঘণ্টা গোলাগুলিতে পাকবাহিনীর ৩০টি নৌকার মধ্যে ২২টি ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় বা ডুবে যায়। পাকহানাদাররা বাকি ৮টি নৌকায় করে কোনরকমে পালিয়ে আত্মরক্ষা করে। এ-যুদ্ধে ২৪ জন মুক্তিযোদ্ধা অংশগ্রহণ করেন। তাঁদের সহযোগী হিসেবে গ্রামের সমসংখ্যক যুবক অংশ নেয়। মুক্তিযোদ্ধাদের পরামর্শ অনুযায়ী যুদ্ধের পর গ্রামের প্রায় সবাই নিরাপদ স্থানে চলে যায়। পরের দিন পাকবাহিনী খোলাবাড়িয়া এসে সমস্ত গ্রাম আগুনে পুড়িয়ে দেয়। ছয়জন বৃদ্ধ গ্রাম ত্যাগ করতে পারেননি। হানাদাররা তাদের নির্মমভাবে হত্যা করে। [এস এম জি মহিউদ্দিন]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৩য় খণ্ড