খুনিয়াদিঘি বধ্যভূমি (রাণীশংকৈল, ঠাকুরগাঁও)
খুনিয়াদিঘি বধ্যভূমি (রাণীশংকৈল, ঠাকুরগাঁও) ঠাকুরগাঁও জেলার রাণীশংকৈল উপজেলার হোসেনগাঁও ইউনিয়নের ভাণ্ডারা গ্রামে অবস্থিত। প্রায় ছয় একর বিস্তৃত এ দিঘিতে মে মাস থেকে আগস্ট মাস পর্যন্ত নৃশংস হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়। পাকসেনা ও তাদের দোসর, যাদের স্থানীয় ভাষায় ‘মালদাইয়া’ বা ‘সেকেন্ড বিহারি’ বলা হয়, তারা যৌথভাবে এ গণহত্যা ঘটায়। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর এই ‘মালদাইয়া’ মুসলমানরা ভারতের মালদহ থেকে এ অঞ্চলে আসে। ঐ সময় থেকেই স্থানীয় জনগণের সঙ্গে তাদের দা-কুমড়া সম্পর্ক। জলা-জমি-জঙ্গল, হাটবাজার, সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক প্রভৃতি ক্ষেত্রে নেতৃত্ব নিয়ে স্থানীয়দের সঙ্গে তাদের দ্বন্দ্ব ছিল। মূলত এ কারণেই উত্তর জনপদের এই জলাশয়টি এ ভয়ঙ্কর বধ্যভূমিতে পরিণত হয়। পাকসেনারা সাধারণত গ্রামাঞ্চল বা সীমান্তবর্তী অঞ্চলে যেত না। তাদের হয়ে লুটপাট, নির্যাতন, অগ্নিসংযোগ ও বর্বর হত্যাকাণ্ড চালাত মালদাইয়ারা। তারা সারাদিন বিভিন্ন এলাকা থেকে নারী-পুরুষ-বৃদ্ধ-বনিতাদের ধরে রাণীশংকৈল থানায় নিয়ে যেত। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ হিসেবে বলা হতো, তারা দেশদ্রোহী, মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় ও খাদ্যের যোগানদাতা। আরো বলা হতো, তাদের আত্মীয়-স্বজনদের কেউ-কেউ ভারতে আশ্রয় নিয়েছে। তাই থানায় ধরে এনে থানার ইনচার্জ ক্যাপ্টেন মো. নজিরের তথাকথিত আদালতে কোর্ট মার্শালে তাদের বিচার করা হতো। তারপর সন্ধ্যার অন্ধকারে তাদের হাত ও চোখ বেঁধে খুনিয়াদিঘির পাড়ে নিয়ে যাওয়া হতো। সেখানে পাকবাহিনী তাদের লাইনে দাঁড় করিয়ে গুলি চালাত। কখনো বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে- খুঁচিয়ে হত্যা করত। হত্যার পর লাশগুলোকে দিঘিতে ফেলে দেয়া হতো।
খুনিয়াদিঘি বধ্যভূমিতে শহীদদের সংখ্যা দু-হাজারের কম নয়। স্বাধীনতার পর চার-পাঁচ ট্রাক মাথার খুলি ও হাড়গোড় ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হয়।
খুনিয়াদিঘিতে যাদের হত্যা করা হয়, তারা দিনাজপুর, সেতাবগঞ্জ, পীরগঞ্জ, হরিপুর, বালিয়াডাঙ্গী, ঠাকুরগাঁও, বোদাসহ বিভিন্ন এলাকার অধিবাসী ছিলেন। ফলে, শহীদদের সকলের নাম জানা সম্ভব হয়নি। যে কয়েকজনের নাম জানা গেছে, তাঁরা হলেন— সিরাজুল ইসলাম প্রধান (পিতা আশরাফ আলী প্রধান), খায়রুল ইসলাম প্রধান (পিতা মফিজউদ্দিন প্রধান), গাজিমউদ্দিন ওরফে আলসিয়া (পিতা গোলামউদ্দিন), আনছার আলী (পিতা ইউসুফ আলী), আব্দুর রহমান (পিতা আফাজউদ্দীন), আমীর আলী (পিতা রমজাত আলী), চান্দুউল্লাহ (পিতা ফজল হক), আব্দুল বারেক (পিতা মো. শফিউল্লাহ), ওসমান গনি (পিতা আকতার আকন্দ), আবু তাহের (পিতা এবাদ আলী), হবিবর রহমান (পিতা আজিবউদ্দীন), আশরাফ আলী, আব্দুল হক এবং নফিজউদ্দিন মাস্টার (রাণীশংকৈল, ঠাকুরগাঁও)। শেষের জন বাদে অন্যরা সবাই ছিলেন বর্তমান পঞ্চগড় জেলা (সাবেক মহাকুমা)-র বোদা উপজেলার নয়াদিঘির অধিবাসী। [প্রবীর চন্দ]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৩য় খণ্ড